ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ১৯

16 Min Read

সৌধর গাড়ি এসে থামল সদর হাসপাতালের সামনে। সুহাস ত্বরিত গাড়ি থেকে নেমে দৌড় লাগাল৷ সৌধ মুখে মাস্ক পরে অপেক্ষা করতে লাগল ওদের ফিরে আসার৷ সে নিজে আর নামল না৷ দেখা গেল কেউ চিনে ফেললে বাবা, ভাইকে জানিয়ে দেবে। আর তারা রাগারাগি করবে একা একা বের হওয়ায়।
সুজা এমপির অত্যাধিক সুদর্শন, ছোটো পুত্রকে এ শহরের কে না চেনে? বাবা, চাচা, ভাইরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সে এসবে জড়ায়নি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। এমপির ছেলে সৌধ চৌধুরী। বর্তমানে মেডিকেল দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। যেমন মেধাবী তেমন সুদর্শন। মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্ব জিমে এক্সারসাইজ করা ভিডিয়ো আপলোড দেয়। যেগুলোতে হিউজ পরিমাণ ভিউ পড়ে৷ কমেন্ট বক্সে জড়ো হয় অগণিত মেয়েদের ঘায়েল হওয়ার বার্তা। এত অল্প বয়সে সকলের নজড়ে এভাবে চলে আসবে সৌধ তার পরিবারের কেউ ধারণাও করতে পারেনি৷ মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞায় বড়ো ভাই, বাবা তাকে রাজনীতির পথেও আসতে দেয়নি৷ অথচ বড়ো ভাইয়ের চেয়েও তুমুল জনপ্রিয় সে। সৌধর ফ্যান ফলোয়ারদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক জানে সে সুজা চৌধুরীর ছেলে৷ এরপরও সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। তার বন্ধুর ঝুলি পূর্ণ হলেও শত্রুর ঝুলি শূন্য। কিন্তু পারিবারিক শত্রুর অভাব নেই। বাবার আদেশ আছে একা একা ঘুরাফেরা না করার। সেই আদেশ অমান্য করেই বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে৷ নিজ বুদ্ধিমত্তায় যতটুকু সম্ভব নিরাপদে থাকারও চেষ্টা করে।
নামীকে দেখে যারপরনাই অবাক হচ্ছে নিধি, প্রাচী। এই মেয়েটা কি পাথর দিয়ে গড়া? বাড়িতে কী ঘটেছে জানে না তারা৷ তবে বুঝে নিল, সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে বলেই ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। উপরে উপরে শক্ত থাকলেও ভিতরে ভিতরে তীব্র কষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷ অথচ এ মুহুর্তে চোখ দু’টো নির্বিকার। মুখে মলিন হাসি। হাত, পায়ে ছিলে যাওয়া ত্বকে মেডিসিন দিয়ে ওষুধ লিখে দেয়া হয়েছে৷ নামী সে সব বুঝে নিয়ে নিধি, প্রাচীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘ আমার বিপদের কথা শুনে তোমরা এভাবে ছুটে আসবে ভাবতে পারিনি। ধন্যবাদ। ‘
এইটুকু বলেই ব্যাগপত্র নিয়ে বাসটার্মিনাল যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াল। যে মেয়েটা কিছুক্ষণ পূর্বে অজ্ঞান হয়ে পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। সে মেয়েটা এত দ্রুতই নিজেকে কীভাবে শক্ত করে নিল? ভাবতেই গা শিউরে ওঠল নিধির৷ সে ত্বরিত নামীর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে প্রাচীকে বলল,
‘ ওর জন্য ডাব কিনে নিয়ে আয়। আমরা ওপাশে বসার জায়গায় গিয়ে বসি৷ ‘
এরপর নামীকে বলল,
‘ এদিকে এসো বসো এখানে। ‘
নামী বসতে রাজি হলো না। সে মুহূর্তেই তীব্র দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ নিয়ে উপস্থিত হলো সুহাস। একটু চমকালেও নিজেকে সামলে নিল নামী। সুহাস কোনোদিকে না তাকিয়ে আচমকা ওর হাত চেপে ধরে বলল,
‘ কী হয়েছে তোমার? ‘
নামী চাপা আর্তনাদ করে ওঠল। নিধি চ্যাঁচিয়ে বলল,
‘ ওই ছাড়, রিকশা থেকে পড়ে ব্যথা পাইছে। ওখানেও জখম হইছে। ‘
সহসা হাত ছেড়ে দিল সুহাস। নামী শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের পাশ দিয়ে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ লোক হাঁটা পা থামিয়ে তাকিয়ে রইল ভ্রু কুঁচকে। নিধি খেয়াল করে মুখ ফিরিয়ে নিল। নামী ইতস্ততভাবে দাঁড়িয়ে। ওদের ভাবমূর্তি দেখে সুহাস পাশে থাকা ভদ্রলোককে দেখে মৃদু হাসল। ভদ্রলোকের মুখ কঠিন হলো এতে। সুহাস বুঝল লোকটা তাকে সন্দেহ করছে। তার চটপটে চেহেরা নিয়ে হয়েছে জ্বালা। সবাই দুষ্ট প্রকৃতিরই ভাবে। তাই বলল,
‘ কিছু বলবেন আংকেল? ‘
উত্তর দিল না ভদ্রলোক। তাকাল নামীর দিকে। তার চাহনি খেয়াল করে সুহাস চোখমুখ কুঁচকে বলল,
‘ ও আমার বউ। ‘
লোকটা চমকে ওঠল। চমকে ওঠল নামী আর নিধিও৷ সে চমকানো দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল সুহাস৷ নামীর বিস্মিত দৃষ্টি দেখে কানের নিচে চুলকাতে শুরু করল৷ ভদ্রলোক নামীর দিকে তাকাল জহরি চোখে। নামী খেয়াল করল লোকটা তার দিকে প্রশ্নসূচকে তাকিয়ে। তাই জোরপূর্বক হেসে বোঝাল সুহাসের কথাই ঠিক৷ সে তার বউ। এবারে লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্থান ত্যাগ করল। সুহাস তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ এদের জন্য শান্তি নেই। ব্যাটা হসপিটালে আসছিস নিজের রোগি থাকলে তাকে সামলা। অন্যের রোগির দিকে খেয়াল দিতে কে বলেছে? ‘
নিধি বিস্মিত দৃষ্টিতে সুহাসকে আপাদমস্তক দেখতে লাগল৷ নামী তার সকল বিস্ময় ঝেড়ে প্রচণ্ড বিরক্ত মুখে নিধির থেকে লাগেজ নিয়ে বলল,
‘ আসছি আপু। ‘
সুহাস চমকে ওঠে খপ করে লাগেজ নিয়ে নিল হাত থেকে। অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ আসছি মানে! ‘
নামী জবাব দিল না। প্রাচী ডাব কিনে এনে নামীকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এটা খেয়ে নাও শরীর ভালো লাগবে। ‘
নামী নিতে চাইল না। সে দম আটকে দাঁড়িয়ে রইল। সুহাসের সামনে থেকে যেতে পারলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। আজ সুহাসের কর্মকাণ্ড দেখে বান্ধবীরা ভাবল, নিশ্চিত নেশা করেছে এই ছেলে। প্রাচীর হাত থেকে ডাব নিয়ে নামীর সামনে ধরল সুহাস। বলল,
‘ আমি ধরে রেখেছি৷ তুমি খাও। ‘
আকস্মিক দরদে মেজাজ খারাপ করল নামীর৷ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ এসব আলগা দরদ দেখাতে আসবেন না। ‘
‘ এই নামীদামি একদম দাম দেখাবে না। যা বলছি তাই করো। ‘
ধমকে ওঠল সুহাস। নিধি বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে দাঁড়াল। বিস্ময়ে কেশে ওঠল প্রাচীও। নামী থমথমে মুখে চারপাশে তাকিয়ে দেখল কয়েকজন তাদের দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নিধি ভীত স্বরে বলল,
‘ এই সুহাস আস্তে কথা বল। ছিঃ ছিঃ মানুষ তাকাই আছে। ‘
সুহাস আশপাশে একবার তাকিয়ে নামীকে বলল,
‘ খাও। ‘
নামী কথা বাড়াল না। তীব্র অনীহা নিয়ে ডাবের পানি শেষ করতে লাগল। পাশাপাশি ভদ্র কিছু গালিগালাজ করতে লাগল সুহাসকে। আর সুহাস থম মেরে তাকিয়ে দেখতে লাগল, তার হৃদয়ের কলহপ্রিয় নারীটির কোমল ঠোঁটজোড়ার মাঝ বরাবর থাকা হলদে রঙা পাইপটাকে। যা দৃষ্টিপাত করে মনে মনে আওড়াল,
‘ আজ এই পাইপটাকেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হচ্ছে!’
সৌধর গাড়ির সামনে এসে ছোটোখাটো সুনামি ঘটিয়ে ফেলল সুহাস, নামী দম্পতি৷ সুহাস কিছুতেই নামীকে গ্রামে যেতে দেবে না। আর নামী কিছুতেই সুহাসের মতো দুর্বল মনের পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করবে না। এই নিয়ে তাণ্ডব শুরু হলো। সুহাস বুঝতে পারল মুখ চললেও নামীর শরীর ভালো নেই। ওর চোখ দু’টোই বলে দিচ্ছে প্রচণ্ড দুর্বল সে৷ তাই শেষে চিৎকার করে বলল,
‘ তোমার জন্য ঐ ব্যাংকার আর ব্যাংকারের মায়ের কাছে ছোটো হয়েছি আমি। আর তুমি আমাকে ফেলে চলে যাবে! তা তো হবে না নামীদামি। ‘
মুখ বন্ধ হয়ে গেল নামীর। তার সঙ্গে নিধি, প্রাচীও ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নামী চাপা স্বরে বলল,
‘ এ কথার মানে কী?’
সৌধ এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করল। বলল,
‘ নামী লোকজন দেখছে। গাড়িতে বসে কথা বলো। এরপর সিদ্ধান্ত নাও। প্রয়োজনে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব তোমাকে। ‘
সৌধর ব্যবহার এতটাই অমায়িক যে নামী কখনোই তার কথা ফেলতে পারে না। আজো পারল না। ওঠে বসল গাড়িতে। নিধি বসল সামনে। বাকিরা পেছনে। নামী, সুহাসকে বসানো হলো পাশাপাশি। এরপর নামী বলল,
‘ আপনি কী চান সুহাস? ‘
‘ তুমি কোথাও যেতে পারবে না নামী। ‘
একগুঁয়ে স্বর সুহাসের। নামীও জিদি কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘ আমি কোথায় যাব না যাব এটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। ‘
‘ শাটআপ! ‘
ধমকে ওঠল সুহাস। নিধি কিছু বলতে নিলে সৌধ ওর হাত চেপে ধরে চোখের ইশারায় বলল,
‘ ওদের টা ওদের বুঝে নিতে দে। ‘
এদিকে প্রাচীও পার্স থেকে ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকে নিউজফিড স্ক্রোল করতে শুরু করল। নামী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সুহাসও রক্তিম চোখে তাকিয়ে বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলছে। যা দেখে চাপাস্বরে নামী বলল,
‘ অধিকার ফলাচ্ছেন? ‘
চোখে চোখ রেখে সুহাস বলল,
‘ ধরে নাও তাই। ‘
‘কিন্তু কেন অধিকার দেখাচ্ছেন? কী অর্থে? ‘
‘ অর্থ আবার কীসের? আমার অধিকার আমি ফলাই তোমার কী সমস্যা? ‘
ওপাশ থেকে সৌধ বলল,
‘ বলে দে ভালোবাসিস তাই অধিকার ফলাস। ‘
‘ অসম্ভব ওর মতো মেয়েকে আমি ভালোবাসি না। ‘
এ কথায় উত্তেজিত মনটা নিভে গেল নামীর। সৌধ তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘ তাহলে ঐ ব্যাংকারের মাকে কেন বললি নামী ম্যারেড আর তুই ওর হাজব্যন্ড। তোরা পড়াশোনা করছিস বলে এসব গোপন আছে। তাই উনারা যেন নামীকে নিয়ে তোর বাবা মায়ের কাছে প্রস্তাব না দেয়। ‘
বিস্ময়ে নামীর চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এসব কী শুনছে সে? সুহাস এসব বলেছে পাশের বাসার আন্টিকে! সৌধর প্রশ্নে সুহাস উত্তর দিল,
‘ যা সত্যি তাই বলেছি। ‘
‘ তাহলে সাহস করে ভালোবাসার কথাটাও বলে দে। ‘
নামীর হাত, পা কাঁপতে শুরু করেছে। সুহাসের দিকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে সে। সুহাস চোরা দৃষ্টিতে নামীর অবস্থা দেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘ আমি কোনো নামীদামিকে ভালোবাসি না। ‘
এ কথা শুনে সৌধর মারতে ইচ্ছে করল ও’কে। আর নামীর ইচ্ছে হলো কষিয়ে দু’টো থাপ্পড় দিতে। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল নিজের গাল ইশারা করে বলল,
‘ দেখেছেন? ‘
সুহাস চুপ হয়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এরজন্য আমি দায়ী নই। এর শাস্তি আমি পেতে পারি না। ‘
বাঁকা হেসে নামী বলল,
‘ একজনের জন্য অপরজন শাস্তি পায় এটা আপনিই শিখিয়েছেন আমায়। ‘
‘ তার মানে বলছ তোমার মায়ের ভুলে তুমি শাস্তি পাচ্ছ? ‘
‘ নেভার, আমার মা কোনো ভুল করেনি। ভুল করেছে… ‘
‘ ব্যস, ‘
তাচ্ছিল্য হেসে নামী বলল,
‘ আমার মেরুদণ্ড আপনার মতো নিচু নয় সুহাস৷ আমাকে যেতে দিন। যদি স্বামীর অধিকার দেখাতে চান তাহলে নিজের মায়ের মুখোমুখি হয়ে আমাকে স্বীকার করুন। পারবেন? আপনি যদি এটা পারেন আমি ফিরে যাব আপনার সঙ্গে। ‘
নামীর এ কথায় সকলেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। নামী দুচোখ ভরে দেখতে লাগল এক অসহায়, ভঙ্গুর পুরুষকে। যেন ক্লাস ফোরের একটি বাচ্চা ছেলে ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করার দরুন মাথা নত করে বসে আছে। মায়া হলো খুব, তিন কবুল বলে গ্রহণ করা স্বামী নামক পুরুষটির অসহায়ত্ব যন্ত্রণা দিল তাকেও। ঠিক সে সময়ই সুহাসের মনের অবস্থা টের পেয়ে নিধি প্রস্তাব দিল,
‘ গ্রামে যাওয়ার কী দরকার নামী? তুমি আমাদের বাসায় ভাড়া ওঠতে পারো। চিন্তা নেই এমনি এমনি ওঠতে বলছি না। রুমমেট খুঁজছিলাম আমরা। তুমি ওঠলে বেশ ভালোই হবে৷ ‘
নিধির উপস্থিত বুদ্ধি বাহবা দেয়ার মতো। সৌধ অভিভূত হয়ে চেয়ে রইল। সুহাস তাকাল কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে। প্রাচী দুহাত জোড় করে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল নামী যেন রাজি হয়। আর নামী তাকিয়ে রইল সুহাসের ধূসর বর্ণের রক্তিম চোখজোড়ায়। ও চোখের ভাষা আজ বড্ড অপরিচিত তার। অপরিচিত এই ভাষা তার হৃদয় অস্থির করে তুলছে। মনে হচ্ছে এই দৃষ্টির মালিক তার আপন খুব খুব আপন। এই দৃষ্টির আকুলতা তার জন্য শুধুই তার জন্য। এই দৃষ্টির মালিক তার একান্তই তার। সকলে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে তার সিদ্ধান্ত জানার জন্য। সে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করল অনেকক্ষণ। মা নেই। বাবা দেশের বাইরে। গ্রামে যারা আছে তারা তাকে কিছু পরামর্শ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না৷ মাঝখান থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে, তাকে শশুর ঘরের লোক মেনে নেয়নি, স্বামী গ্রহণ করেনি। কী দরকার এসব জলঘোলা করার। তার সমস্যা একান্ত তার সমস্যা হয়েই থাকুক না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। বলল,
‘ আমি রাজি। ‘
***
সুহাস বাড়ি ফিরছে বেশ রাত করে। মায়ের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিধিকে ম্যাসেজ করে বলল,
‘ নামীকে বলে দিস, মায়ের হয়ে আমি সরি খুব সরি।’
নিধি রিপ্লাই করল,
‘ বলতে পারব না৷ তোর দেয়া ম্যাসেজটা দেখিয়ে দিব। ‘
নিধির ম্যাসেজ দেখা শেষে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল সে। দেখতে পেল সিমরানের একটি বড়োসড় ম্যাসেজ,
‘ আব্বু, আম্মুর মধ্যে খুব ঝগড়া হয়েছে ব্রো। আব্বুর গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিল আম্মু আমি বাঁধা দেয়ায় থাপ্পড়টা আমার গালে পড়েছে। আমার আর এসব ভালো লাগে না। বাবা, মায়ের ঝগড়া দেখতে দেখতে আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমাকে তুমি হোস্টেলে রাখার ব্যবস্থা করো প্লিজ ব্রো প্লিজ। আমি এ বাড়িতে আর থাকব না। আমি আমার বাবা, মায়ের থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই। আমি ভুলতে পারছি না ব্রো আমার গালে আম্মুর পাঁচ আঙুলের দাগ। আমি সহ্য করতে পারছি না, একটুও সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ ব্রো তুমি আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচাও। এরা আমাদের বিষাক্ত বাবা, মা বিলিভ মি ব্রো এরা দুজনই আমাদের জন্য অভিশাপ! আমি খুব ডিপ্রেশড ব্রো খুব। আমি কিছু একটা করে ফেলব দেখো। কিছু একটা করে এই দু’জনকে কঠিন একটা শিক্ষা দিয়ে যাব। ‘
বোনের ম্যাসজটা পড়েই ক্রোধে মাথা দপদপিয়ে ওঠল৷ আচমকা মোবাইল ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে চিৎকার করে ওঠল। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এরপর ত্বরিত চলে গেল বোনের ঘরে। রুম অন্ধকার করে এক কোণে বসে ছিল সিমরান। ভাই গিয়ে লাইট অন করতেই ছুটে এসে ভাইকে জাপ্টে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আম্মু আমাকে মেরেছে ব্রো! আমি মেনে নিতে পারছি না। একদমই পারছি না। আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইট ব্রো, আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইট! ‘
বোনকে শক্ত করে বুকে চেপে রইল সুহাস। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ সিনু শান্ত হ প্লিজ। চুপ, চুপ কাঁদবি না, একদম না সিনু। ‘
কথাটা বলেই বোনের মুখ উঁচু করল। দুধে আলতা মসৃণ ত্বকে পাঁচ আঙুলের দাগ দেখে বুক কেঁপে ওঠল সুহাসের। মনে পড়ল নামীর গালেও একই দাগের কথা। শ্বাসরোধ হয়ে এলো তার। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘ মা পাগল হয়ে গেছে সিনু। আমি আমার এই মাকে চিনতে পারছি না, একদম চিনতে পারছি না। ‘
সিমরানের কান্নার বেগ বাড়ল। সুহাস ওকে সামলানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ বাবা কোথায়? ‘
‘ জানি না। সেই যে রেগে বেড়িয়েছে… ‘
সুহাস সিদ্ধান্ত নিল আগে বোনের মন ভালো করবে। শান্ত করবে বোনকে এরপর বাবার সাথে দেখা করবে। কিন্তু মায়ের মুখোমুখি সে কিছুতেই হবে না। যে রূপে মাকে সে ভাবতে পারে না, মায়ের যে রূপ সে বিশ্বাস করে না। সেই রূপ স্বচক্ষে দেখতে সামনে যাবে না। তবে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে মাকে ঠিক বোঝাবে সে যা করেছে ভুল করেছে। যে কারণে নামীর ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছে আসলে তেমন কিছুই ঘটেনি। ভুল বোঝাবুঝি থেকে এত বড়ো ঘটনা ঘটানো, নামীর গায়ে হাত তোলা, সিমরানের গায়ে অবধি হাত তোলা! একদম উচিত হয়নি, একদম না।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।