সিমরান বেড়ে ওঠেছে একক পরিবারে। যেদিন থেকে সৌধদের যৌথ পরিবারের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে সেদিন থেকে এই পরিবারের প্রতি আলাদা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। এ পরিবারের মানুষ গুলোও তাকে খুব আপন করে নিয়েছে। নিজের পরিবার বলতে বাবা, মা, ভাইকেই দেখেছে সে। বাবা, মাকে পেয়েছে খুব কম সময়। পরিবার কী? পরিবার কেমন হয় জানত না। তেমন কোনো অনুভূতি ছিলই না পরিবার নিয়ে। চৌধুরী বাড়ির সঙ্গে তার বাবা, মায়ের বন্ধুত্ব সম্পর্কের সুবাদে এ বাড়ি আসা, যাওয়া শুরু হয়৷ তারপর থেকেই বুঝতে শুরু করে যৌথ পরিবারের মর্ম। একটি যৌথ পরিবারে শুধু হাসি, খুশি, আনন্দ, উল্লাস বা শুধু ভালোবাসাই থাকে না। থাকে দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ এবং নিয়মানুবর্তিতা। সিমরান খোলা চোখে এ পরিবারে শুধু অঢেল ভালোবাসা আর আনন্দ টুকুই দেখেছে। বাদবাকি বিষয়ে খুব একটা খেয়াল করা হয়নি। তার মাধ্যে প্রচণ্ড পরিমাণে ম্যাচিওরিটির অভাব। বাবা, মায়ের সান্নিধ্য পায়নি বলেই শিশুকাল থেকে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। চাইতে দেরি কিন্তু পেতে দেরি হয়নি কখনো৷ বাবা, মায়ের অভাব বোধ অনুভব করলেও তারা দুই ভাই, বোন কখনো অভিযোগ করতে পারেনি। কেন করবে? ছোট্ট থেকেই তো শেখানো হয়েছে, বোঝানো হয়েছে , ‘ তোমরা যখন যা চাচ্ছ তাই পাচ্ছ। অন্যান্য পরিবারের বাচ্চারা তোমাদের মতো এত সুবিধা পাচ্ছে না। সবাই সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে না। একদিকে সেক্রিফাইস করলে অন্যদিকে পরিপূর্ণ ভাবে পাওয়া যায়। ‘ সেই শেখানো বুলি মস্তিষ্কে চেপেই বেড়ে ওঠা ওদের। অভিযোগ করার কারণ দাঁড় করাতে পারেনি কখনোই। সেই একক পরিবারের সন্তান হয়ে যৌথ পরিবারে মানিয়ে নেয়াও ভীষণ কঠিন৷ যতই ভালোলাগা থাকুক তবু কিছু জটিলতার সম্মুখীন তো হতেই হয়৷ হতেও হলো সিমরানের৷ গতকাল স্মৃতি আপুর মেহেদি অনুষ্ঠান ছিল। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সৌধর বাবা-মা দু’দিকের আত্মীয় আর বন্ধু, বান্ধব। নিধি বাদে সব বন্ধুরাই উপস্থিত ছিল। নিধি গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউভাত এই তিনদিন থাকবে কথা দিয়েছে। তাই মেহেদি অনুষ্ঠানে না থাকায় রাগ করেনি সৌধ। চুপচাপই ছিল সে। বড়ো বোনের মেহদি অনুষ্ঠানে আনন্দ করেছে খুব। নাচ, গান, গল্পআড্ডা সবশেষে কাজিন আর বন্ধুদের জোরাজোরিতে একটু মেহেদি লাগানো হাতে৷ সব মিলিয়ে সময়টা তার দারুণ কেটেছে। তাকে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে সিমরান। কাজিনদের মধ্যে সবাই সৌধকে ভীষণ ভয় পায়৷ প্রচণ্ড সম্মান আর ভালোওবাসে। কিন্তু পাশাপাশি বসে তার হাত ধরে মেহেদি দিয়ে দেয়াতে সাহস সিমরান ছাড়া কারোরি বেশি ছিল না। প্রিয় মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে হাত রাঙিয়ে দেয়ার সুযোগটুকুও হাত ছাড়া করতে চায়নি সিমরান, লুফে নিয়েছে তৎক্ষনাৎ। সৌধর দাদি আশায়রা বেগম। খুবই চতুরা নারী। সেকালের মেট্রিক পাশ । শিক্ষিতা নারী। এ-র ওপর বড়ো ঘরের বউ। ভীষণ দাপুটে। বর্তমানে বয়স পয়ষট্টি ছুঁয়েছে। মাথায় কাঁচা চুলের দেখা মেলে না। দেহের চামড়া ঝুলে বার্ধক্যের চিহ্ন ফুটে ওঠেছে। চোখের পাওয়ারও কম। চশমা ছাড়া চোখে দেখে না৷ তবু তেজ কমেনি এক চুল পরিমাণও। এই পরিবারে তার চোখে চোখ রেখে, তার কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে পারো দু’জন ব্যক্তি। একজন তার বড়ো ছেলে সুজা চৌধুরী। আরেকজন ছোটো নাতি সৌধ চৌধুরী। আশায়রা বেগম ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করে না সিমরানকে। তার কাছে সিমরান আর সুহাস দু’জনকেই অতিরিক্ত চঞ্চল, আর ঔদ্ধত্য মনে হয়৷ যাদের মধ্যে সাধারণ জ্ঞান নেই। ভদ্রতা, সভ্যতার লেশমাত্র নেই। বড়োদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হয় এদেরকে পরিবার থেকে শিখানো হয়নি। সবচেয়ে বড়ো কথা আশায়রা বেগম উদয়িনীকে অপছন্দ করেন। তার পরিবারের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না উদয়িনী এবং তার ছেলেমেয়েদের চলনবলন। সুজা কীভাবে এমন একটি পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল সৌধই বা কোন রুচিতে এদের সঙ্গে বন্ধু পাতালো বুঝে ওঠতে পারেন না তিনি। সিমরানের অতিরিক্ত হৈহৈ রৈরৈয়েও বিরক্ত তিনি। এই বিরক্তি ক্রোধে পরিণত হলো তার দুই মেয়ে অর্থাৎ সৌধর দুই ফুপু আর ফুপাত ভাই, বোনরা আসার পর৷ কারণ সৌধর ফুপাত ভাইদের মধ্যে দু’জনই তাগড়া যুবক। বাড়ি, ভর্তি আত্মীয়স্বজন, এদের মাঝে সিমরান বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে। কানামাছি, লুকোচুরি খেলে। পরনের ওড়না ঠিকভাবে রাখে না। রাতদুপুরে শুধু টিশার্ট আর প্লাজু পরে ঘুরে বেড়ায়। সব মিলিয়ে সিমরানকে তার নির্লজ্জ মনে হয়েছে। আর নির্লজ্জ নারীরা তার দুচোখের বিষ। গতকাল মেহেদি অনুষ্ঠানেও তার নাতনিদের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে দেখেছে। শেষ পর্যন্ত সৌধকেও ছাড় দেয়নি। সর্ব সম্মুখে হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে। তার চোখ জহুরি। সিমরানের চোখ দু’টোর ভাষাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই অনুষ্ঠান শেষে সিমরানকে একা ডেকে পাঠায় সে। দাদুনিকে আর সবার মতো সিমরানও ভয় পায় ভীষণ। হঠাৎ ডেকে পাঠানোতে বুকের ভেতর ধুকপুকানি নিয়েই উপস্থিত হয়। ঘরে ঢুকেই চোখে, মুখে হাসি ফুটিয়ে শুধায়,
‘ দাদুনি আমাকে ডেকেছ? ‘
তিনটে শব্দে ভুল আরো একটা করে বসে সিমরান। দাদুনিকে এ বাড়ির বড়ো থেকে ছোটো সবাই আপনি সম্বোধন করে। বিষয়টা একদমই মনে থাকে না সিমরানের। মনে তখনো ছিল না৷ তাই তুমি করেই বলে ফেলে৷ এতে দাদুনির রাগ তীব্র হয়। সদ্যই চশমা খুলে পাশের টেবিলে রেখেছিল। তা পুনরায় চোখে তুলে৷ এরপর সুক্ষ্ম চোখে তাকায় সিমরানের পানে। সিমরানের পরনে কালো রঙের টিশার্ট আর ধূসর রঙের ঢোলা পাজামা৷ কাঁধের দু’পাশে চুল ছাড়া একদম বুক অবধি। তাই আলাদা করে আর ওড়না পরেনি৷ মধ্যরাত৷ অনুষ্ঠানে রাত জেগে সবাই যে যার ঘরে ঘুমুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই যেভাবে ছিল ওভাবেই ত্বরিত এসে পড়েছে। আপাদমস্তক সিমরানের দিকে নজর বুলিয়ে দাদুনি বলল,
‘ এ বাড়ির সবাই আমাকে আপনি সম্বোধন করে। বড়োদের সম্মান পূর্বক আপনি সম্বোধন করাই উচিত। যদি গদগদ সম্পর্ক হয় আর কেউ তুমিতে সায় দেয় তবেই তুমি করে বলা যায় নচেৎ তুমি বলা চরম বেয়াদবি। ‘
মুহুর্তেই মুখটা থমথমে হয়ে যায়। থমকানো কণ্ঠে সিমরান বলে,
‘ সরি দাদুনি, মনে ছিল না। ‘
দাদুনি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
‘ এরপর থেকে মনে রাখবা। ‘
মাথা কাত করে সিমরান। দাদুনি কিয়ৎক্ষণ চুপ রয়৷ সিমরান দু-হাত সামনে বেঁধে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। দাদুনি এবার শোনাতে শুরু করে কয়েকটা কড়া কথা। কথাগুলো শিক্ষনীয় হলেও প্রকাশভঙ্গী খুবই কঠিন আর অপমান দায়ক ছিল। যেসবে একেবারেই অভ্যস্ত নয় সিমরান৷ প্রচণ্ড মিশুক প্রকৃতির মেয়ে সে। কারো সঙ্গে নিজেও কঠিন আচরণ করতে পারে না। আর না কারো কঠিন আচরণ সহ্য করতে পারে।
দাদুনি বলে,
‘ শুনো তোমার পারিবারিক শিক্ষার অভাব আছে আমরা সবাই জানি। যাদের বাবা, মায়ের মাঝে বনিবনা কম, যাদের বাবা মা সন্তানকে একা ছেড়ে দূরে থাকে তারা এমনই ঔদ্ধত্য হয়৷ কিন্তু সব পরিবার তো আর তোমার এই ঔদ্ধত্য মেনে নিবে না৷ তাছাড়া মেহমান হয়ে কোনো বাড়িতে এসে মেয়ে মানুষের ছেলেদের সঙ্গে ঢলাঢলিও সব পরিবার সহ্য করবে না৷ বয়স তোমার কম হয় নাই। পুরুষ মানুষের থেকে দূরত্ব রেখে চলা উচিত। বাড়ি জুড়ে মেহমান ভর্তি। দামড়ি মেয়ে সকলের সামনে ছুটাছুটি করো লজ্জা করে না? তাহানী, আর ইনানের সাথে তোমার তাল মিলানি তো মানায় না। তোমাকে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়ার মানুষ নাই। তাই আমিই দিলাম, অতো ছটফটানি বাদ দিয়া দাওয়াত খাবার আসছ। খেয়েদেয়ে বিদায় হও। ‘
তাহানী এ বাড়ির ছোটো ছেলের মেয়ে। আর ইনান সৌধর বড়ো ভাইের ছেলে বয়স সাড়ে তিন বছর৷ এই বাচ্চা দু’টোর সঙ্গে সিমরানের সখ্যতা অনেক বেশিই।
চুপচাপ দাদুনির কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যেন চোখ গলে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মেয়েটার। দাদুনি সেটা খেয়াল করল না৷ সিমরান ত্বরিত বেগে দু’হাতে অশ্রু কণা মুছে নিল। দাদুনি আরো বলল,
‘ আর বিশেষ করে আমি নাতিদের থেকে দূরত্ব মেপে চলবা। পরনের কাপড় ঠিকঠাক রাখবা৷ তোমাদের বাড়ির মতো এই বাড়ি না৷ এখানে অনেক সদস্য আছে। তার ওপর অনুষ্ঠান বাড়ি৷ পুরুষ মানুষের আনাগোনাও কম নাই৷ তোমার লজ্জা, শরম কম এইটা পরের বাড়ি এসে বোঝানোর দরকার নাই৷ তোমার কারণে আমার বাড়ির সম্মান নষ্ট হউক এটা আমি চাই না। মনে রাখবা কথাগুলো। যাও এখন। ‘
মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করত পারল না সিমরান। গলা কাঁপতে লাগল। বহু কষ্টে মাথা কাত করে সম্মতি দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরুতে উদ্যত হলো। তৎক্ষনাৎ দাদুনি ফের পিছু ডেকে বলল,
‘ আর একটা কথা। কারো ঘরে ঢুকবার আগে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয়। কেউ মনে হয় শিখায় নাই। আমি আজ শিখিয়ে দিলাম৷ এটাও মাথায় রাখবা। ‘
বুকের ভেতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে যেন গলায় আঁটকে রইল। দরজার ওপারে যেতেই একছুটে উপরে চলে আসে সিমরান। স্মৃতি আপু ঘুমিয়ে কাঁদা। সে গিয়ে চুপচাপ স্মৃতি আপুর পাশে শুয়ে পড়ে৷ কিন্তু সারারাত কাটে নির্ঘুমে। সকাল হলেই সিদ্ধান্ত নেয় এ বাড়িতে আর এক মুহুর্ত নয়। দাদুনি তাকে পছন্দ করত না টের পেয়েছিল আগেই৷ কিন্তু গতরাতে যেভাবে ঘরে ডেকে অপমান করল এরপর আর এ বাড়িতে থাকা সম্ভব হলেও তার সামনে যাওয়া সম্ভব না। এ বাড়িতে থাকতে হলে তার সামনে যেতেই হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিল, বাড়ি চলে যাবে সে। ত্বরিত ব্যাগপত্র গুছিয়ে ভাইয়ের ফোনে কল দিল।
.
.
বেশ রাত করে ঘুমিয়েছে সুহাস, নামী। সৌধদের গেস্ট রুমে ঘুমিয়েছে তারা। তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে রাতে৷ যুদ্ধ আবার কবে হয় না তাদের? সেই শুরুর দিন থেকে চলছে যুদ্ধ। এরপর থেকে একটা না একটা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে লেগেই থাকে। স্বামী-স্ত্রী থেকে শত্রু হলো। শত্রু থেকে আবার বন্ধু। এরপর তাদের সম্পর্ক মোড় নিল গাঢ় প্রণয়ে। তবু যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল না। সৌধর দু’জন যুবক ফুপাত ভাইদের মধ্যে একজনের মাঝে ছ্যাবলামি দোষ রয়েছে। নাম, রোশান আহমেদ। ছোটো করে শান ডাকে সবাই। অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মামাত বোনের বিয়েতে এসেছে আর মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করবে না? তাই কখনো হয় নাকি? তাই কেন জানি এত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে নামীকেই খুঁজে পায় সে৷ গল্প জমানোর ফাঁকে অবশ্য জানতে পারে নামী সুহাসের বউ। তাতে তার কী? কে কার বউ এসবে তার কাজ নেই। বিয়ে বাড়িতে এসেছে, তার দরকার ফ্লার্ট করার তাই সেটা করাতেই মন দিয়েছে। নামী তখন মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিল ছোট্ট তাহানীর হাতে৷ তখনি শান এসে পাশে বসে। অনেকক্ষণ ইয়ার্কি, ঠাট্টা করার পর হাত পেতে বলে,
‘ ভাবিজান, দেবরের হাতে মেহেদি পরিয়ে দেন না? ‘
স্মার্ট মেয়ে নামী। সবকিছুরই প্রতিত্তোর দিতে পারে সে৷ তাই ঠাট্টার উত্তর ঠাট্টা দিয়েই দিচ্ছিল৷ কিন্তু তাহানীর মেহেদি পরা শেষ হতেই নামীকে সে বায়নার স্বরে বলল,
‘ শানুভাইয়ের হাতে মেহেদি দিয়ে দাও ভাবি। ‘
বাচ্চা মেয়েটার বায়না আর শানের ঠাট্টা,
‘ তোমার ভাবি শুধু তোমাকেই মেহেদি পরাতে পারে তাহানী সিস্টার৷ দেবরদের মেহেদি পরানোর কলিজা তার নেই। ‘
ব্যস কথাটা অহমিকায় লাগল খুব। মনে জেদ চেপে শানকে মেহেদি দিয়ে দিতেও শুরু করল। সুহাস, আইয়াজ আর আজিজকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে গিয়েছিল৷ হাঁটাহাঁটি শেষে অনুষ্ঠানে আসতেই দেখতে পেল, তার বউটি সৌধর ফুপাত ভাইয়ের হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। এমনিতেই এই ছেলেটাকে পছন্দ না তার। কেমন যেন মেয়েদের গা ঘেঁষে থাকা স্বভাব। সে নিজেও অসংখ্য গার্লফ্রেন্ড লালন, পালন করা ছেলে৷ কিন্তু এই রোশান ছেলেটার সঙ্গে তার যেন বহুগুণ তফাৎ। একটি ছেলে আরেকটি ছেলের চোখের ভাষা, মনের ভাষা যেভাবে পড়তে পারে একটি মেয়ের পক্ষে তা কখনো সম্ভব হয় না৷ রোশানকে অপছন্দ করার পেছনে আরো একটি কারণ হলো, সৌধ। সৌধ নিজেও রোশানকে পছন্দ করে না। তাহলে নিশ্চয়ই এই ছেলেটার মধ্যে সমস্যা আছে? তাই কঠিন ক্রোধে ফেটে পড়ে সুহাস৷ বার বার ডেকে পাঠায় নামীকে। কিন্তু মেহেদি পরানো শেষ না হওয়া অবধি নামী তার কাছে আসে না৷ এরপর রাতের খাবার খেয়ে শোবার সময় হয়ে এলে নামী যখন গেস্ট রুমে আসে। পাগলা ঘোড়ার মতো আক্রমণ করে সে। দরজা লক করে আচমকা নামীর গাল দু’টো একহাতে চেপে ধরে বলে,
‘ এখন এলি কেন? থেকে যেতি ঐ শানের কাছে। ‘
গাল ব্যথায় অসহ্য হয়ে ওঠে নামী। এরওপর এমন বাঁকা কথা শুনে রাগও হয়। এক ঝটকানি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠে,
‘ পাগল হয়ে গেছ সুহাস? এটা কী ধরনের আচরণ!’
চ্যাঁচিয়ে ওঠে সুহাস নিজেও,
‘ একদম উপযুক্ত আচরণ। এখানে এসেছিস কেন? যা ঐ শানের ঘরে যা। যাকে এতক্ষণ আদর করে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিলি। ‘
চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলে নামী৷ বলে,
‘ মুখ সামলে কথা বলো। ‘
‘ তুই সামলে চলবি না আর আমি সামলে বলব? ‘
‘ আশ্চর্য! কী করেছি আমি? তোমার মতো বউ থাকা সত্ত্বেও দশ, পাঁচটা জিএফ পুষেছি? ‘
‘ জিএফ পুষবি কেন তুই ওটা পুষব আমি৷ তুই পুষবি বিএফ। ‘
দুজনের মধ্যেই ভয়াবহ ঝগড়া লেগে যায়। সুহাসের চিৎকার, চ্যাঁচামেচি, অপমান, গায়ে হাত তুলতে আসা সবটায় তিক্ত হয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় নামী৷ সুহাস তখন পেছন থেকে জাপ্টে ধরে তাকে। বলে,
‘ কোথায় যাচ্ছিস শানের ঘরে? ‘
তীব্র ক্রোধে নামীও স্বীকার করে,
‘ হ্যাঁ শানের ঘরেই যাচ্ছি। তোমার মতো পুরুষের কাছে থাকার চেয়ে অন্য পুরুষের কাছে যাওয়া ঢের ভালো! ‘
এমন একটি কথা কি আর সহ্য হয়? এক হাতে নামীর মুখ চেপে ধরে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে সুহাস বলে,
‘ এটা কী বললি তুই? ‘
আর কিছু বলে না নামী। বলতে পারে না। সুহাসের মতো রাগের বশে যাতা বলার স্বভাব নেই তার। তবু বলে ফেলেছে। তাই আর জোর খাটায় না সুহাসের থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য৷ কিন্তু সুহাসের কি আর রাগ কমে? সমস্ত রাগ, সমস্ত ঝড় উগ্রে দেয় নামীর শরীরের ওপর। অন্ধকার, বদ্ধ ঘরে ক্ষেপাটে সুহাসকে সামলানো খুব সহজ ছিল না। তবু সহজ করে নিয়েছে নামী। ভোর হলেই শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে শাওয়ার নিয়ে নেয় দ্রুত। এরপর ঘরে এসে ভেজা চুল শুকাতে নিলে সুহাস সাহায্য করতে চায়। নামী তার সাহায্য নিতে নারাজ। শরীর জর্জরিত তীব্র ব্যথায় আর মন তীব্র অভিমানে। তাই ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসে। পিছু পিছু এসে সুহাস পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে। নরম স্বরে বলে,
‘ সরি বউ। ‘
নামী চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ সুহাস ওর কানের নিচে কামড়ের দাগটায় আলতো চুমু খায়। রাতে রাগের বশে এমন অসংখ্য দাগ বসিয়েছে বউয়ের শরীরে। যা এখন স্পষ্ট দেখতে পেয়ে নিজেরি খারাপ লাগছে। নামী তার থেকে ছুটার জন্য ছটফট করে৷ সুহাস জোরপূর্বক গালে একটি চুমু দিয়ে বলে,
‘ শান ভালো ছেলে নয় নামী। আমি আগেই বলতে চেয়েছিলাম ওর থেকে সাবধানে থাকতে৷ তার আগেই ও তোমার সঙ্গে এসে ভাব জমিয়েছে আর তুমিও সায় দিয়েছ দেখে রাগটা সামলাতে পারিনি। ‘
‘ এখন আর কী চাই? রাগ কমেনি, ঝাঁঝ মেটেনি? আরো মেটাতে চাও। বিছানায় আসো তবে। এটুকুই তো জোর। ‘
নামীর গলা কাঁপছিল কথাগুলো বলার সময়৷ সুহাস জোরপূর্বক ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। দু’হাতে গাল দুটো আলতো করে ধরে কপালে চুমু খেল। বলল,
‘ সরি জান। জানোই তো আমি কেমন। তুমি তর্ক না দিয়ে শান্ত থাকলেই এতটা রিয়াক্ট হতো না। ‘
নামী চোখ ঘুরিয়ে নিল। তাচ্ছিল্য মুখে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে। সুহাস আদুরে স্বরে বলল,
‘ সরি বউ, তোমার বরটা কেমন পাগলাটে, তার রাগটাও কেমন পাগলাটে জানোই তো। ‘
‘ না জানি না৷ এখন জানছি তুমি কেমন রাক্ষস! ‘
মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে ওঠল সুহাস৷ জোরপূর্বক নামীর চুল শুকাতে সাহায্য করল। এরপর বিছানায় বসিয়ে নিজের রাগ মিশ্রিত ভালোবাসার চিহ্ন গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে আদুরে চুমু বসাল প্রতিটি স্থানে। নামীর মন তখনো গলল না। তাই বাঁধ্য হয়ে বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দু’কান ধরল সে। বলল,
‘ ক’বার ওঠবোস করলে রাগ কমবে? ‘
নামী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সুহাস মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল,
‘ বউয়ের রাগ ভাঙাতে এই সুহাস সব করতে পারে। ‘
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল নামী। বলল,
‘ ওকে পঁয়ত্রিশবার ওঠবোস করো। ‘
ঠিক পঁয়ত্রিশ বারই ওঠবোস করল সুহাস। সেই সঙ্গে শানের থেকে কেন দূরত্ব বজায় রাখবে এবং সে ঠিক কী কী অপছন্দ করে সবটাই খুলে বলল। সবশেষে বলল,
‘ ভালোবাসি খুউব জান৷ তোমায় নিয়ে আমি ভয়ংকর পজেসিভ বউ। সবকিছুতে ছাড় পাবে শুধু আমি ব্যতীত অন্য পুরুষের সান্নিধ্যে থাকবে এ বিষয়টায় ছাড় পাবে না৷ এতে সুহাস তোমার কাছে খারাপ হোক, রাক্ষস হোক বা নরকের কীট হোক আই ডোন্ট কেয়ার। ‘
তাদের সে যুদ্ধের সমাপ্তি শেষেই সিমরানের কল আসে। কল রিসিভ করতেই শুনতে পায় সিমরানের হুহু করে কান্নার শব্দ। নিমেষেই বুক ধক করে ওঠে সুহাসের। নামী কাছেই ছিল কান্নার শব্দ শুনে সেও চিন্তিত হয় খুব৷ অন্তঃকোণে প্রশ্ন জাগে সাতসকালে মেয়েটার কী হলো হঠাৎ?
Leave a comment