গত কয়েকদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। দিন নেই রাত নেই প্রকৃতি মুখরিত হয়ে আছে শ্রাবণ ধারায়। সুহাস, আইয়াজ গতকাল ঢাকায় ফিরেছে। ছুটি শেষ ওদের। ফারাহ আপাতত নামীর সঙ্গে নামীর বাসাতে থাকছে। একমাসের মধ্যে আইয়াজ তার পরিবারকে মানিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ফারাহকে ঘরে তুলবে। আজ আইয়াজ আর সৌধর নাইট ডিউটি। তাই ওরা দু’জন হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। ফাঁকা বাসায় আয়েশ করতে করতে সুহাস কল করল নামীকে। নামী ব্যস্ত থাকায় ফোন রিসিভ করল ফারাহ। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
‘ ভাইয়া নামী শাওয়ার নিচ্ছে। ‘
সুহাসের কপালে ভাঁজ পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
‘ রাত বাজে ন’টা। এখন শাওয়ার নিচ্ছে মানে? জ্বর, ঠান্ডা লাগানোর মতলব করছে নাকি তোমার বান্ধবী? ‘
ফারাহ বিব্রত হলো। বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়ে গেল সুহাস। বলল,
‘ নামী এলে ব্যাক করতে বলো। ‘
ফোন কেটে দৃঢ়চিত্তে প্রচণ্ড ঝগড়ার সিদ্ধান্ত নিল সুহাস। কয়েকদিন ভালোবাসায় বুঁদ থেকে ঝগড়ার সময় হয়ে ওঠেনি। আজ বাসা ফাঁকা, বিশেষ করে সৌধ নেই। আরামসে, জবরদস্ত ভাবে ঝগড়া করা যাবে। মনটা শিহরিত হয়ে ওঠল সুহাসের। অনেকদিন পর তার সুহাসিনীকে আজ কঠিন রাগিনী রূপে দর্শন করবে। ঝগড়ার শুরুটা কী নিয়ে করবে? বিছানায় আয়েশ করে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে ভাবল, প্রথমে সন্দেহি হওয়ার ভাণ করে এত রাতে শাওয়ার নেয়ার রহস্য জানতে চাইবে। ব্যস দপ করে জ্বলে ওঠবে নামীদামি!
.
.
হসপিটালে ঢুকতে না ঢুকতেই নিধির সম্মুখীন হলো সৌধ। কয়েক হাত দূরে একজন সিনিয়র ডক্টরের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে নিধি৷ সৌধ আর আইয়াজকে দেখে একটুখানি হাসল। সৌধ এক পলক দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে শ্বাসরোধ করে ত্বরিত স্থান ত্যাগ করল। তার পিছু পিছু ছুটল আইয়াজও৷ নিধি হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরল সম্মুখে থাকা ডক্টরের ডাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিধি। কথা শেষে চলে গেল নিজের কাজে। একজন মহিলার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। তার ডি এন সি করানো হচ্ছে। পাশের কেবিন থেকে গগনবিদারী চিৎকার ভেসে আসছে। যে চিৎকার গুলো শুনে নিধির শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ল। সে একজন প্যাশেন্টকে ইনজেকশন পুশ করতে গিয়ে হাতে কাঁপন ধরিয়ে ফেলল। পাশ থেকে সিনিয়র ডক্টর ধমকে ওঠল তাকে। ধমক খেয়ে নিজের কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সিনিয়র ডক্টর বুঝতে পারলেন তার অস্বাভাবিকতা৷ তাই বললেন,
‘ তোমাকে কিছুটা ডিপ্রেশড লাগছে। এভাবে রুগি দেখবে কী করে? যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। ‘
‘ জি স্যার। ‘
ক্ষীণ কণ্ঠে এটুকু বলেই ত্বরিত বেরিয়ে এলো নিধি। আশপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজল যেন। না পেয়ে কল করল আইয়াজের ফোনে। এত বছরের বন্ধুত্ব তাদের। এই প্রথম এতখানি অবহেলা, এড়িয়ে চলা। মেনে নিতে তীব্র কষ্ট হচ্ছে। সৌধর ব্যাপারটা না হয় আলাদা। আইয়াজও কথা বলল না? মনের ভিতর এসবই চলছিল তার৷ ফলে অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিল৷ এরওপর কারো হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। যা তার হৃদয়ও ব্যথিত করল। সব মিলিয়ে অবস্থা করুণ। আইয়াজ ফোন না ধরাতে সেই করুণতা বৃদ্ধি পেল। হাসফাস চিত্তে এদিকওদিক ঘুরতে লাগল সে। তক্ষুনি ফোন এলো অর্পণ স্যারের। ফোন রিসিভ করতেই ভালো, মন্দ জিজ্ঞেস না করে সরাসরি অর্পণ স্যার প্রশ্ন করল,
‘ মা’কে ফোন দিয়েছিলে? ‘
আঁতকে ওঠল নিধি। বলল,
‘ সরি আমার খেয়াল ছিল না। ডিউটিতে আছি কাল সকালে দিব। ‘
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল অর্পণের। চটে যাওয়া মেজাজি কণ্ঠেই বলল,
‘ ইট’স নট রাইট নিধি। আমার মায়ের একমাত্র ছেলের বউ তুমি৷ তোমার থেকে উনি অনেকবেশি আশা করে৷ তিনদিন হয়ে গেল মাকে একটা ফোনকল করার সময় তুমি পাওনি। এখন ডিউটির অজুহাত দিচ্ছ? সারাদিন কী করলে বাসায়? নাকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছ সারাদিন! এক মিনিট, সৌধদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার? ‘
একনাগাড়ে এতগুলো কথা শুনে মাথা ধরে গেল নিধির। বিষণ্ন মনটা বিষিয়ে ওঠল খুব৷ তবু স্বামী হিসেবে সম্মান পূর্বক শেষ কথাটির জবাব দিল,
‘ হ্যা হয়েছিল। ‘
সেদিন বিয়ে বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভুলতে পারেনি অর্পণ স্যার। বন্ধুত্বের পাশাপাশি সৌধ নিধিকে ভালোবাসে আর নিধি স্রেফ বন্ধুই ভাবে। এ কথা নিধিই জানিয়েছে তাকে৷ সৌধর হয়ে ক্ষমা চেয়েছে অনেকবার৷ কান্নাকাটি করেছে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে। নিধির কোনো দোষ পায়নি অর্পণ স্যার৷ আর না সৌধকে দোষারোপ করতে পেরেছিল। সেদিন তিন বন্ধু খোলা চোখে যা দেখেছে তারই প্রতিবাদ করেছে। তারা তো আর জানত না তার আর নিধির ভেতরকার সম্পর্কটির কথা। তাই ওইদিনের ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ দূর্ঘটনা হিসেবেই নিয়েছে। তবু কিঞ্চিৎ অপমানের রেশ থেকে গেছে সুপ্তভাবে। খুবই ভদ্র শ্রেণীর মানুষ হওয়ার সুবাদে এ নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি৷ সবচেয়ে বড়ো কথা বউয়ের বন্ধু ওরা৷ বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় খুঁজে পায়নি৷ কিন্তু নিজের বউকে অন্য কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখছে বা দেখবে এটা তার অহমিকায় আঘাত করে৷ তাই নিধিকে বোঝায়, সৌধর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে৷ যদিও নিধি কিছু বলেনি৷ তবু অর্পণ বুঝে নিয়েছিল তার কথা মেনে চলবে নিধি৷ কতটুকু মেনে চলল সেই সত্যতা যাচাই করতে প্রশ্ন করল,
‘ কথা হয়েছে? ‘
হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিধি উত্তর দিল,
‘ না। ‘
স্বস্তি পেল অর্পণ। বলল,
‘ সাবধানে থেকো। সমস্যা হলে জানিও আমাকে। ‘
‘ কী সমস্যা হবে? ‘
‘ প্রশ্ন করছ, বুঝতে পারছ না? সৌধ মোটেই সুবিধার ছেলে নয়। ‘
কপাল কুঁচকে গেল নিধির৷ শত হোক প্রিয় বন্ধু বলে কথা। তাই মন প্রতিবাদ করে ওঠল। শক্ত কণ্ঠে শুধাল,
‘ সুবিধার নয় বলতে কী বোঝাতে চাইলেন স্যার? সেদিন যা ঘটেছে তা ধরে আপনি সৌধকে বিচার করবেন না। সৌধ আর যাই হোক ক্যারেক্টারলেস নয়। সেদিন ও জানত না আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ। আমি ম্যারেড৷ কিন্তু আজ জানে…। ‘
‘ বন্ধুর জন্য স্বামীর সঙ্গে এমন শক্ত আচরণ! আমি একবারো বলিনি সৌধ চরিত্রহীন৷ ওকে আমিও জানি কিছুটা তবু ও তোমাকে ভালোবাসত। তোমার জন্য প্রচণ্ড ডেস্পারেট সৌধ। স্বামী হিসেবে এটুকু সচেতন করতেই পারি আমি। ‘
বিরক্ত হলো নিধি। থমথমে গলায় বলল,
‘ আপনার কথার টোন তেমনই ছিল। ‘
‘ ওকে ফাইন, হার মানলাম বউ। ঘুমাব আমি বুঝেছ?’
ছোটো করে উত্তর দিল নিধি,
‘ হু। ‘
অর্পণ স্যার বলল,
‘ শোনো, কষ্ট করে হলেও মাকে ফোন দিও একটা। জাস্ট তিন মিনিট সময় দিও। মা খুশি হবে, আমারো ভালো লাগবে৷ বিয়ে মানে শুধু বিয়েই নয় নিধি, বিয়ে মানে অনেকটা দায়বদ্ধতা। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? ‘
‘ হু, রাখছি৷ গুড নাইট। ‘
চট করে কল কেটে দিল নিধি। হঠাৎই অর্পণ স্যারকে অসহ্য লাগছে তার। অথচ দু’দিন আগে অবধি তার কথায় মুগ্ধ হতো। তাকে দেখে বিমোহিত হতো চোখজোড়া। হৃদয় কোণে শিহরণ জাগত৷ কী প্রগাঢ় অনুভূতিতে সিক্ত ছিল মন। হঠাৎ করে এমন বিরক্তি ঠেকছে কেন? চারপাশ জুড়ে এত অসহ্য অসহ্য অনুভূতি কেন হঠাৎ? দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিধি৷ ভাবল মন ভালো নেই, বন্ধুরা এড়িয়ে চলছে৷ ওদিকে একই বাসায়, একই রুমে থেকেও প্রাচীকে আগের ন্যায় অনুভব করতে পারছে না৷ মেয়েটা কথা বলছে, মিশছে, হাসছে তবু যেন এক আকাশসম দূরত্ব। চোখে যেন এক সমুদ্র রাগ, অভিমান, ক্ষোভ। বাসায় প্রাচী হসপিটালে সৌধর পাশাপাশি আইয়াজের এড়িয়ে চলা সব মিলিয়ে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যা তার সমস্ত ভালোলাগা শুষে নিয়েছে। ফলে অর্পণ স্যারকেও এখন ভালো লাগছে না৷ কী অদ্ভুত মন তার। বিয়ে, স্বামী এসব কী আর ছেলেখেলা? গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা অবস্থায় সহসা
মনে পড়ল আইয়াজকে কল করার কথা৷ ছেলেটা কল ধরল না। ব্যাকও করল না। তবে কী ওরা চাইছে না ওর সঙ্গে বন্ধুত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে! বুকের ভেতর গভীর এক চাপ অনুভব করল নিধি৷ অশান্ত হৃদয়ে পা বাড়াল আইয়াজের কেবিনের উদ্দেশ্যে। কেবিনে গিয়ে জানতে পারল আইয়াজ ইমারজেন্সিতে গেছে৷ ওর কোন আত্মীয় যেন এক্সিডেন্ট করেছে। কী আর করার হতাশ চিত্তে ফিরতে উদ্যত হলো নিধি। এমন সময় পাশের রেবিন থেকে সাদা অ্যাপ্রোন পরনে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো সৌধ বেরিয়ে এলো। আকস্মিক তাকে দেখে একটুখানি চমকালেও মুহুর্তেই সামলে নিল নিজেকে। এরপর সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই ত্বরিত ডাকল নিধি,
‘ সৌধ প্লিজ দাঁড়া। ‘
হাঁটা পা থেমে গেল সৌধর সম্মুখে দৃষ্টি অটল রেখে দু’পা পিছিয়ে এলো। কিন্তু ডানপাশ ঘুরে দাঁড়াল না। কান দু’টো সজাগ রাখল শুধু৷ নিধি ওর ভাবগতিক বুঝে ঢোক গিলল৷ ভয় ভয় কণ্ঠে বলল,
‘ তোরা এভাবে এড়িয়ে চলিস না আমাকে। মানছি আমার ভুল হয়েছে তোদের না জানিয়ে…।’
বাকিটুকু শোনার আর ধৈর্য্য রইল না সৌধর। শক্ত মুখে দৃঢ় চিত্তে প্রস্থান করল ত্বরিত। নিধি থমকে গেল। অসহায় চোখে নিষ্পলক দেখল রুদ্ধশ্বাসে সৌধর চলে যাওয়া৷ নিধির চোখের আড়ালে যাওয়া মাত্রই নিয়ন্ত্রণ হারাল সৌধ। সবার দৃষ্টির অগোচরে শক্ত মুঠো করে দেয়ালে ঘুষি দিল গোটা দশেক। এরপর বাথরুমে ঢুকে একবার নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরল। আরেকবার বুকের যে পাশটায় অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে সে পাশে খামচে ধরল। মনে মনে হাজারবার আর্তনাদ করে ওঠল,
‘ তুই আমাকে ডাকিস না রে, তুই আমার সামনে আসিস না রে বেইমান। ‘
.
.
ওদের ইন্টার্নির শেষ সময়গুলো ছিল খুবই দুর্বিষহ। সৌধ চাইত না নিধির সঙ্গে দেখা হোক৷ কিন্তু হয়ে যেত বারংবার। নিধি চাইত সুহাস, আইয়াজ, সৌধ, প্রাচী সবার সঙ্গে আগের মতো মন খুলে কথা বলতে। সময় কাটাতে চাইত বন্ধুদের সঙ্গে। কষ্ট পেত ওদের এড়িয়ে যাওয়া দেখে। দম বন্ধ লাগত, তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠত আগের সময় গুলো স্মরণ করে৷ স্মৃতির পাতায় সৌধর যত্নশীল আচরণ, সুহাসের দুষ্টুমি, আইয়াজের শীতল দুষ্ট স্বভাব, প্রাচীর বোনবোধ মিস করত খুব৷ কখনো কখনো তার শক্ত হৃদয় নরম হতো, কান্নাও করত। ইন্টার্নির শেষ দিন ফেরার পথে তো মেয়েটা সর্বসম্মুখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না সবাই সহ্য করলেও সহ্য করল না সৌধ। সে প্রচণ্ড রাগান্বিত হলো প্রাচীর ওপর, সুহাস আর আইয়াজের ওপরও। নিধি তাকে ঠকিয়েছে, তার সঙ্গে বেইমানি করেছে শাস্তি কেন সবাই মিলে দেবে? প্রাচীকে ধমকাল খুব। সুহাস, আইয়াজকেও ধমকে বলল,
‘ আমি একাই তোদের বন্ধু? ও বন্ধু নয়? কথা বলছিস না কেন ওর সঙ্গে? শেষদিন অন্তত তোরা একসঙ্গে কিছু সময় কাটাতে পারিস। আমার কোনো প্রবলেম হবে না। ‘
সৌধর কথায় সকলে স্তম্ভিত। কাঁদল নিধি একাই৷ ওর কান্নায় সৌধর ক্রোধ বাড়ল মারাত্মকভাবে। পকেট থেকে টিস্যু ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
‘ তোকে কাঁদলে মানায় না। যারা মানুষকে কাঁদায় তারা কাঁদলে হাস্যকর লাগে, অসহ্য ঠেকে। কান্না থামা, চোখের পানি মোছ। নয়তো থা প ড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব৷ তখন তোর অর্পণ তার মনের দর্পণে আর ঠাঁই দিবে না৷ ‘
সৌধর এহেন কথায় সকল মূঢ় হয়ে গেল। আর নিধি আবেগান্বিত হয়ে আকস্মিক সৌধকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। এটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল ওর জীবনে। সৌধ তো অপমান করে গা ঝাড়া দিয়ে ছুঁড়ে ফেললই৷ এদিকে অর্পণ স্যারের পরিচিত এক নার্স দৃশ্যটি দেখে দূর থেকে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল মুহুর্তেই। বউয়ের প্রতি গোপন সন্দেহ ছিল অর্পণের। সে সন্দেহের জের ধরেই পরিচিত নার্সটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত৷ নিধির খেয়াল রাখতে বলত। সে খেয়ালটা কূটনীতিতে পরিণত হয়ে গেল হঠাৎ। আগে পড়ে না ভেবে নার্স মহিলাটির পাঠানো ছবির রেশ ধরেই অর্পণ, নিধির দাম্পত্য জীবনে অশান্তির সূচনা ঘটল…! এটা কী প্রকৃতির অভিশাপ নাকি করুণ নিয়তি?
তিনমাস পর,
বন্ধুমহল এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আইয়াজ, ফারাহ সুখে সংসার করছে। সোহান খন্দকারও উদয়িনীর সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে। নামীকে ঘরে তুলতে আপত্তি নেই উদয়িনীর। বেশ বড়ো করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেও প্রস্তুত সে। কিন্তু শশুর ঘরে ফিরে যেতে ঘোর আপত্তি নামীর৷ সে জানালো, সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নড়চড় নেই। এই নিয়ে সুহাসের সঙ্গে তুমুল বাকবিতন্ডা হলো। সুহাসও জানিয়ে দিল, তার সঙ্গে না দেখা করবে আর না কথা বলবে। তার মা এতবড়ো মুখ করে সব আয়োজন করতে চাইল। আর সে দম্ভ দেখিয়ে না করে দিল? বেশ ভালো কথা। নামী যেমন ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে শশুর ঘরে পা মাড়াবে না। সেও তেমন নামীর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎ, ফোনকল, টেক্সট সমস্ত কিছু থেকে বিরত থাকবে। জেদ শুধু নামীর একারই নয় তারও আছে৷ সিদ্ধান্ত শুধু নামী না সেও নিতে পারে। সুতরাং সুহাস, নামী এখন পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন!
.
.
বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। বিয়ে নিয়ে সৌধর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে এক কথায় অনড়,
‘ আমি বিয়ে করব না৷ বিয়ে বিহীন বেঁচে থাকা অন্যায় হলে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দাও। ‘
ছেলের এহেন কথা শুনে মা তানজিম চৌধুরীর প্রেশার বাড়ে। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী রয় তিনদিন। একদিকে বিরহ বেদনা অন্যদিকে বিয়ের চাপ, মায়ের অসুস্থতা। সবমিলিয়ে সৌধ যেন আরো ছন্নছাড়া হয়ে ওঠে৷ সিগারেটের পাশাপাশি অ্যালকোহলের প্রতিও ঝুঁকে পড়ে সে। সুজা চৌধুরীর কানে সমস্ত কথাই যায়। যেখানে সুহাস, আইয়াজ সহ সৌধর বাকি বন্ধুরা ক্যারিয়ার গোছাতে ব্যস্ত। সেখানে সৌধর বেহাল দশা ভাবিয়ে তুলল তাকে। বন্ধু সোহান তাকে পরামর্শ দিল সৌধ যতই আপত্তি করুক, পাগলামি করুন বিয়ের বন্দোবস্ত করতে। তার বেপরোয়া, উদ্ধতস্বভাবের ছেলেটা যদি বিয়ের পর নামীর সংস্পর্শে এসে এতটা বদলাতে পারে৷ সৌধও নিশ্চয়ই পারবে। পুরুষ যতই কঠিন, শক্তিশালী হোক না কেন, যতই তাদের রক্ত উষ্ণ থাকুক নির্দিষ্ট একজন নারী যে কিনা তার অর্ধাঙ্গিনী তার সংস্পর্শে এলে ঠিক নরম, দুর্বল এবং শীতল হতে বাধ্য। বন্ধুর ইতিবাচক পরামর্শে সুজা চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেয় এবার ছেলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে।
এদিকে অর্পণ স্যারের সঙ্গে নিধি এখন হসপিটাল কোয়ার্টারেই থাকে। তারা এখনো ডাক্তারি লাইসেন্স পায়নি। লাইসেন্স পাওয়ার আগ পর্যন্ত চর্চার ওপরে থাকবে৷ সপ্তাহে দু’দিন একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে বসে নিধি৷ একই শহরে থাকা সত্ত্বেও সৌধর সঙ্গে দেখা হয় না। এখন আর দেখা করার ইচ্ছেও হয় না। সৌধ তাকে সহ্য করতে পারে না। বন্ধুরা তার সঙ্গ পছন্দ করে না। তাই দূরত্ব বুকে পুষেই সংসার করে যাচ্ছে অর্পণ স্যারের সঙ্গে। সেদিনের সেই ঘটনার জন্য কম ভুগতে হয়নি৷ স্বামীর থেকে অপমান, অবহেলা, লাঞ্ছনা পেয়েও মাথা নত করে থেকেছে। একজন কঠিন ব্যক্তিত্বের নারীর ব্যক্তিত্ব কত সহজে একজন পুরুষ হরণ করে নিতে পারে নিজ জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে। সে একজন প্রতিবাদী, প্রতিষ্ঠিত নারী হয়েও স্বামীর কাছে অতি নগন্য রূপে ধরা দিয়েছে। কেন দিয়েছে? এর সঠিক উত্তর নিজেকেও ঠিকঠাক দিতে পারবে না নিধি৷ আবার হয়তো দিতে পারবে কিন্তু দেবে না। কারণ তাকে ভালো থাকতে হবে। অর্পণ স্যারকে নিয়েই সুখে থাকতে হবে তাকে। যদি না পারে তবে অভিনয় করতে হবে সুখে থাকার৷ জগতে নারীর জন্য এ যে চির ধারিত অভিনয়। প্রতিষ্ঠিত সুন্দরী নারী হোক বা অসুন্দরী অশিক্ষিত, অবহেলিত গৃহিণী নারী৷ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবনে নায়িকা না হলেও সুনিপুণ অভিনেত্রী। নিধির অভিনয় করে যেতে হবে৷ ক্লান্ত হলেও থামা যাবে না৷ কারণ যে সর্গীয় প্রেম অবহেলা, অনাদরে ফেলে ক্ষণিকের মোহে ডুবে অর্পণ স্যারকে বেছে নিয়েছে। সে প্রেমের সামনে নিজের অসুখ প্রকাশ করা যাবে না। নিজের অসুখী জীবন চিত্র সমাজ, বন্ধু, বান্ধবের সম্মুখে প্রকাশ হওয়ার ভয়েই অভিনয় করে যেতে হবে তাকে। দিনশেষে আফসোস রয়ে যাবে একটাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়েও পাওয়া হলো না। নিজের ভুল অনুভূতির জন্য। নিধি আজ খুব করে অনুভব করে নিজের অনুভূতি দ্বারাই ভীষণ ভাবে প্রতারিত সে৷ সৌধর সঙ্গে সে প্রতারণা করেছে কিনা জানে না৷ তবে নিজের সঙ্গে অনেক বড়ো একটি প্রতারণা করেছে। বিয়ের প্রথম দিকে নিধির মনে হতো অর্পণ স্যার তাকে ভীষণ ভালোবাসে। যে ভালোবাসার গভীরতা সৌধর ভালোবাসার চেয়ে হাজার গুণ বেশি৷ কিন্তু একসঙ্গে থাকতে থাকতে সে অনুভব করল, এরচেয়েও গভীরভাবে সৌধ তাকে ভালোবেসেছিল। যা তখন বুঝতে না পারলেও এখন হারে হারে টের পাচ্ছে। এরপর যখন সৌধকে জড়িয়ে ধরা ছবি নিয়ে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শুরু হলো। তখন নিখুঁতভাবে অনুভব করল সে অর্পণ স্যারকে ভালোবাসে না৷ অর্পণ স্যারের প্রতি তার অনুভূতিটা আসলে মোহ মাত্র। বুকের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটল তখনি৷ যখন অর্পণ স্যারের কথায় তার মাথায় আসতে শুরু হলো এখানে সৌধ থাকলে কী বলত? নিশ্চয়ই এভাবে বলত, ওভাবে রিয়াক্ট করত। অর্পণ স্যার গভীর রাতে তার শরীর ছুঁয়ে কষ্ট দিলে আকস্মিক তার হৃদয় নড়ে ওঠত। মন বলত, এখানে সৌধ থাকলে নিশ্চয়ই এতটা হার্ডলি স্পর্শ করত না। মনে পড়ে যেত সৌধর করা সেই প্রথম চুম্বন মুহুর্তটুকু। কী আবেগপ্রবণ, কত ভালোবাসাময় ছিল সৌধর প্রতিটা কথায়, প্রতিটা স্পর্শে। এসব মনে পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠত নিধি৷ গভীর রাতে দু’টো শরীর আদিম খেলা মত্ত। যার একটি মন ভালোবাসার অভাবে ডুকরে ওঠত। আকস্মিক নিধির কান্না শুনে অর্পণ স্যার বিরক্তি সুরে বলত,
‘ কী আশ্চর্য ফার্স্ট নাইটেও তো এভাবে কাঁদোনি! ‘
বলেই দূরে সরে যেত৷ এরপর সারারাত নির্ঘুম, ক্রন্দনরত নিধি ছটফট করতে করতে দীর্ঘ রাত পারি দিত৷ তাদের সম্পর্কের অবনতি হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে অসহ্য হয়ে নিধি ভেবেছিল ডিভোর্স দেবে৷ বিয়ের এক বছর না যেতেই ডিভোর্স! এ নিয়েও গুমড়ে মরছিল মেয়েটা। তক্ষুনি মা বুদ্ধি দিল বাচ্চা নিতে৷ এতে তাদের সম্পর্ক মজবুত হবে। হুঁশে নয় বেহুঁশেই বাচ্চা নিয়ে নিল নিধি৷ সত্যি বলতে যে ভালোবাসা ভুলবশত দূরে ঠেলে এসেছে ঐ ভালোবাসা অর্পণ স্যারের কাছে পাওয়ার লোভ জন্মাল। কারণ এই মানুষটা তার স্বামী। সবশেষে তাদের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি পবিত্র সম্পর্ক আছে৷ যেটাতে প্রতিটি মেয়েই ভীষণ রকমের দুর্বল। দুর্বল নিধিও। সত্যি সত্যি অশান্তি কাটল ওদের৷ নতুন প্রাণের আগমনী বার্তায় প্রথম দিকের অর্পণকেই ফিরে পেল নিধি৷ বুকের ভেতর কিছুটা ক্ষ ত থেকে গেল অবশ্য। নিধি এখন তিনমাসের গর্ভবতী। তার গর্ভে একটু একটু করে বেড়ে ওঠছে অর্পণ স্যারের অংশ। সেই অংশকে নিয়ে আজ বেরিয়েছে একটু ফুচকা খেতে৷ অর্পণ ব্যস্ত থাকায় একা একাই বেরিয়েছে। টুকটাক জিনিস কিনে ফুচকা খায়। খাওয়া শেষে অনুভব করে তার গা গুলাচ্ছে৷ তাই ত্বরিত সামনে থেকে পাঁচ মিশালি আচার কিনে রিকশা ডাকতে উদ্যত হয়৷ কিয়ৎক্ষণ অতিক্রান্ত হতেই মাথা চক্কর দেয় তার অমনি ভয়ে
জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে৷ যখন জ্ঞান ফেরে সম্মুখে স্তব্ধ মুখে, রক্তিম দৃষ্টিতে পলকহীন বসে থাকা সৌধকে দেখতে পায়! ভয়ে শিউরে ওঠে নিধি। ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসতেই দেখতে পায় তার দু’পাশে নামী আর ফারাহ বসে। নামী নিধিকে ধরে কিছু বলতে উদ্যত হতেই থমকানো কণ্ঠে সৌধ আদেশ করল,
‘ নামী, ফারাহ তোমরা দু’জন একটু বাইরে যাও।‘
Leave a comment