প্রায় এক ঘন্টা হতে চলল। মা, মেয়ে আর ছেলে দ্বার রুদ্ধ করেছে। সোহান খন্দকার একবার উপরে ওঠছেন। আরেকবার নিচে নামছেন৷ বসার ঘরে সোফার এক কোণে মাথা নিচু করে বসে নামী। তার পাশেই নিধি বসে৷ ক্ষণে ক্ষণে নামী যে ঘেমে ওঠছে টের পেল নিধি৷ তাই দূরে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা সৌধকে বলল,
‘ সৌধ ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে দে। ‘
গম্ভীর মুখে এক পলক তাকাল সৌধ। দেখতে পেল নামী প্রচণ্ড হাসফাস করছে। ত্বরিত সে ফ্যানের পাওয়ার বাড়াল৷ ঠিক সে সময়ই সোহান এসে উপস্থিত হলো নামীর সামনে। নামীর বুক ধক করে ওঠল৷ নিধি খেয়াল করল মেয়েটার শরীর কাঁপছে। ঢোক গিলছে ঘনঘন। সে ত্বরান্বিত হয়ে ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। কিয়ৎক্ষণ পরই আবার চলে এলো। নিয়ে এলো, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি। যা নামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ পানিটা খেয়ে নাও নামী। ‘
অসহায় চোখে তাকাল নামী। নিধি ইশারায় গ্লাস নিতে বললে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল৷ সোহান খন্দকার ততক্ষণে নামীর পাশেই বসেছে। একরাশ দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে তার চোখেমুখেও। নামী পানি খেয়ে বুকের ভেতর চলা তীব্র ভয়, উত্তেজনাকে দমানোর চেষ্টা করল৷ নিধি সোহানকে বলল,
‘ আংকেল আপনার জন্য পানি আনব? ‘
পেছন থেকে কপট রাগ দেখিয়ে সৌধ বলল,
‘ প্রশ্ন না করে নিয়ে আয়। ‘
নিধি চটজলদি গিয়ে গ্লাসে পানি ভরে ফিরে এলো। কিন্তু সোহান খন্দকার পানি খেলেন না৷ বুক ভর্তি তৃষ্ণাকে গুরুত্ব দিলেন না তিনি। পাশে বসা বাচ্চা মেয়েটির মনের অবস্থা টের পেয়ে দুঃখে জর্জরিত হয়ে গেলেন। তবুও যা করেছেন তা নিয়ে আফসোস করলেন না৷ বরং তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন,
‘ ঘাতপ্রতিঘাত জীবনেরই অংশ মা। সুসময়ের পর যেমন দুঃসময় আসে৷ তেমন দুঃসময়ের পরও সুসময় আসে। ‘
আচমকা অশ্রুতে দু’চোখ ভরে ওঠল নামীর। সোহান খন্দকার এতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন,
‘ একি মা ও চোখে পানি কেন? তুমি কী ভয় পাচ্ছ? ভয় কেন? বাবা আছে তো পাশে কোনো ভয় নেই। ‘
নিচের দিক মাথা করে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল নামী। সোহান খন্দকার তার মাথায় আস্থাশীল হাত রেখে বললেন,
‘ যে ঝড় এসেছে, সে ঝড় থেমে যাবে নামী। যদি থামতে খুব বেশি সময় নেয়, তুমি ভেঙে পড়ো না। মনে রেখো, তোমার উদ্দেশ্য আমার ছেলের বউ হয়ে সংসার করা নয়৷ তোমার উদ্দেশ্য তোমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা। তোমার বাবা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তার পর এ পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান আমার কাছে। পরপারে নিলুর আত্মাও নিশ্চিন্ত আছে। কারণ তোমার পাশে আজ তার অতি প্রিয় মানুষটা আছে। যে তোমাকে বটগাছের ছায়ার মতো দুনিয়ার সমস্ত ঝড় থেকে রক্ষা করবে। ‘
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল নামী৷ সোহান খন্দকার আচমকা ওর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ আমাকে কথা দাও মা যত যাই হয়ে যাক। এই বাবাকে ছেড়ে কখনো যাবে না। ‘
সহসা এমন কথায় হতভম্ব হয়ে গেল নামী। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল সে। সোহান খন্দকার পুনরায় তাগাদা দিয়ে বললেন,
‘ কথা দাও মা। ‘
নামী এক মুহুর্ত ভাবল, বাবা চলে গেলে এ শহরে তার আপন বলতে কেউ থাকবে না। সে এ শহরেই থাকতে চায়৷ পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়৷ পূরণ করতে চায় মা এবং তার স্বপ্ন। সুহাসের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। যত যাই হয়ে যাক এখন আর ফিরে তাকানো সম্ভব না। এখন শুধু তাকে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। পেছনে তাকালেই সব শেষ!
‘ নামী মা? ‘
চমকে ওঠল নামী। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল সোহানের দিকে। এরপর মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ কথা দিলাম আংকেল। আপনাকে ছেড়ে যাব না। আমার জীবনে আপনিই এখন বড়ো শুভাকাঙ্ক্ষী। এই সত্যিটাও
ভুলব না। ‘
.
.
মানুষ হিসেবে ডক্টর উদয়িনী প্রচণ্ড স্বার্থপর। নিজের চৌকশ বুদ্ধি দ্বারা আজ সে সফল নারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই মহিলা নিজের স্বার্থ হাসিলে নিজেকেও আঘাত করতে দ্বিধান্বিত হয় না। সন্তানদের চোখে বরাবরই সে একজন আদর্শ নারী। এ সুযোগটাই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজে লাগাল। অতীত জীবনের সত্যিটা সুহাসের সামনে আসার আগেই মিথ্যা দিয়ে ঢেকে ফেলল তা। জীবনের শুরুতে যার কাছে হার মানেনি শেষে তার কাছে হার মানার প্রশ্নই ওঠে না৷ তাই নিলু আর সোহানের মাঝখানে সে কীভাবে ঢুকেছিল। সেই ঘটনা চেপে গিয়ে তার বিয়ের পর নিলু কীভাবে তার সংসারে ঢুকতে চেয়েছিল। সেই মিথ্যা রচনা বিবৃতি করে শুনাল ছেলেমেয়েকে। সেসব শুনে ছেলেমেয়েরা ঘৃণায় চোখমুখ শক্ত করে বসে রইল। উদয়িনী চোখের পানি ছেড়ে সুহাসকে মনে করিয়ে দিল, তার মা কখনো স্বামীর ভালোবাসা পায়নি। অনেক বড়ো একটি শূন্যতা নিয়ে সংসার করছে সে। এ সংসারে নিলু ঢুকতে পারেনি বলে শেষ পর্যন্ত নিলুর মেয়ে ঢুকে পড়ল! কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না উদয়িনী। মায়ের কষ্টে সুহাস তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে থাকল। উদয়িনী ছেলের অপরাধবোধ দ্বিগুণ করতে বলল,
‘ তুই আমার একমাত্র ছেলে সুহাস। কত স্বপ্ন আমার তোকে নিয়ে। পড়াশোনা শেষ করবি। নিজের পায়ে দাঁড়াবি। আমি নিজের পছন্দ অনুযায়ী এ বাড়িতে পুত্রবধূ আনব। আমার সে সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল সুহাস। না স্বামীকে মনের মতো করে পেলাম। আর না সন্তানকে। ‘
উদয়িনী কান্নার বেগ বাড়ল। মায়ের কথা শুনে সিমরান তীব্র মন খারাপ করে ভাইকে বলল,
‘ তোমার বিয়ে নিয়ে আমারো কত প্ল্যান ছিল ভাইয়া। সেসব প্ল্যান তো দূরে থাক। কী মেয়েকে বিয়ে করলে তুমি? ও কি আমাদের সাথে যায় বলো। আমাদের কথা বাদ। তোমার সাথে যায়? আমার এত সুন্দর ভাইয়ের বউ কিনা অমন কালো! ‘
নাক ছিটকাল সিমরান৷ সুহাসের মাথাটাও বিগড়ে গেল। শতহোক অল্পবয়সী ছেলে। ভার বুদ্ধি তখনো হয়নি তার৷ সে নিজেও এখন বিশ্বাস করতে পারল না। ঐ মেয়েটাকে সে বিয়ে করেছে। ঐ মেয়েটা তার বউ! দু’হাতে মাথা চেপে ধরল সুহাস। তীব্র ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করে বলল,
‘ মানি না এই বিয়ে আমি। মানি না। যার কারণে আমার মায়ের কষ্ট হবে তাকে আমি মানি না। আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স নাও। ‘
এক নিমিষে কান্না থেমে গেল উদয়িনীর। ছেলেকে কাছে টেনে সারা মুখে চুমু খেল সে। বলল,
‘ আমি জানতাম আমার সুহাস তার বাবার মতো হয়নি। ‘
মায়ের খুশি৷ বোনের সমর্থন দেখে সুহাস হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। দরজা খুলল শব্দ করে।
তৎক্ষণাৎ বুলেটের গতিতে তার মস্তিষ্কে আঘাত হানল বাবার বলা সেই কথাটি৷ সে যদি নামীকে বিয়ে না করে তাহলে বাবা মাকে ডিভোর্স দেবে! সহসা পা দু’টো থমকে দাঁড়াল তার। বিছানায় আঁধশোয়া হয়ে বসে থাকা মায়ের দিকে তাকাল বিস্ময় ভরে। হাত, পা কাঁপতে থাকল অবিরত। সিমরান পাশে এসে বলল,
‘ কী হলো ভাইয়া? ‘
সুহাস থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ বাবা বলেছিল, আমি নামীকে বিয়ে না করলে মাকে ডিভোর্স দেবে। এখন আমি যদি নামীকে ডিভোর্স দিই বাবা মায়ের সম্পর্কে বিচ্ছেদ আসবে না তো? ‘
‘ অবশ্যই আসবে। ‘
প্রায় হুংকার দিয়ে কথাটা বললেন সোহান খন্দকার। বড়ো বড়ো পা ফেলে ছেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সুহাস, সিমরান দু’জনই হতবাক কণ্ঠে ডাকল,
‘ বাবাহ! ‘
সোহান খন্দকার ছেলেমেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ঘৃণা ভরে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,
‘ উদয়িনী আজ যদি সুহাস নামীকে ডিভোর্স দেয়। তাহলে তোমাকেও তো আমার ডিভোর্স দেয়া উচিত। তাই না? ‘
ভয়ে শিউরে ওঠল উদয়িনী। মায়ের সে ভয় দেখে তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ল সুহাস। তড়াক করে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
‘ খবরদার, আমার মায়ের সঙ্গে এমন আচরণ করবে না। ‘
ছেলের স্পর্ধা দেখে সোহান খন্দকার মনে মনে আহত হলেন। কিন্তু সে অনুভূতি কাউকে বুঝতে না দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
‘ বাহ উদয়িনী বাহ। কী শিক্ষা দিয়েছ ছেলেকে। যে ছেলের হাত বাবাকে মারার জন্য কষকষ করে! ‘
কাঁপতে থাকা হাত দুটো সামলে নিল সুহাস৷ কিন্তু ক্রোধে ভেসে ওঠা কপালের নীল রগ আড়াল করতে পারল না। স্বামীর ওপর এতক্ষণ ক্রোধ হলেও এবারে ভয় জমল বুকে। সত্যি সত্যিই সোহান তাকে ডিভোর্স দেবে! না না এভাবে সে হারতে পারে না। উদয়িনী ফুঁপিয়ে উঠলো। বলল,
‘ এ বয়সে এসেও নিজের সংসার বাঁচাতে যুদ্ধ করতে হবে আমাকে? ‘
ত্বরিত মাকে গিয়ে ধরল সুহাস। ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,
‘ না মা আর তুমি যুদ্ধ করবে না। দরকার নেই আর এ সংসার আঁকড়ে থাকার৷ বাবা যদি চায় তোমাকে ডিভোর্স দিতে তুমি দেবে। আমি, সিমরান তোমার পাশে আছি। ‘
সিমরান চমকে ওঠল। বিস্ময় কণ্ঠে বলল,
‘ কী বলছ ভাইয়া! পাগল হয়ে গেছ তুমি। ঐ মেয়ের জন্য কেন আমরা আলাদা হবো। এতই সহজ। বাইরের একটা মেয়ের জন্য আমাদের সংসার ভাঙা, এতই সহজ? ‘
সোহান খন্দকার ধমকে ওঠল সিমরানকে,
‘ সিমরান নিজের রুমে যাও। অসুস্থ তুমি। বড়োদের মাঝখানে থাকতে হবে না। বিশ্রাম নাও। ‘
‘ আমার অসুস্থতার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না আব্বু৷ তুমি যদি আমাদের কথা এতই ভাবতে আজ এই পরিস্থিতি দাঁড়াত না। ‘
ছেলেমেয়েদের স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সোহান। এ কোন শিক্ষায় মানুষ হয়েছে সুহাস, সিমরান৷ এ তো তার শিক্ষা নয়। এদিকে, সুহাস মাকে বোঝাতে লাগল, ডিভোর্স হলে হোক আর যেন সে ভয় না পায়। তার মতো স্বাবলম্বী নারীকে একটা সংসারের জন্য এভাবে ভয় মানায় না। ছেলের কথা বুঝলেও উদয়িনীর পক্ষে এ সংসার ছাড়া সম্ভব না৷ কারণ এ সংসার যতটা না তার ভালোবাসার তার চেয়েও বেশি জেদ আর প্রতিশোধের। এ কথা তো আর ছেলেকে বলা যায় না। তাই সে শান্ত হয়ে স্বামীকে বলল,
‘ সুহাস কোনোদিন ঐ মেয়েকে মন থেকে মানতে পারবে না। ‘
‘ আমি আজো তোমাকে মন থেকে মেনে নেইনি উদয়িনী।’
অকপটে জবাবে অপমানে মুখ থমথম করতে লাগল উদয়িনীর। সুহাস মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল বাবার দিকে। উদয়িনী বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,
‘ নিলুর মেয়েকে আত্মসম্মানহীন মনে হচ্ছে না। ‘
তাচ্ছিল্য হেসে সোহান বলল,
‘ তাহলে মানছ, তোমার আত্মসম্মান নেই? ‘
চোয়াল শক্ত করে হুংকার দিল সুহাস,
‘ বাবা! ‘
সোহান খন্দকার তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করল,
‘ এক থাপ্পড়ে বেয়াদবি শুধরে দেব। স্টুপিড। ‘
হকচকিয়ে গেল উদয়িনী। বাবা, ছেলের সম্পর্কের বিপর্যয়তা দেখে ছেলেকে চোখের ইশারায় থামতে বলল৷ এরপর স্বামীকে বলল,
‘ সুহাস কোনোদিন ওকে বউ হিসেবে মেনে নেবে না। তোমার কি মনে হয় ঐ মেয়ে এসব সহ্য করে এখানে পড়ে থাকবে? ‘
‘ ওকে এসব সহ্য করার জন্য আনিনি আমি। ‘,
‘ তাহলে কেন এনেছ? ‘
‘নিলুর স্বপ্ন পূরণ করতে। অনেক বড়ো ডাক্তার তৈরি করতে। ‘
‘ তাহলে এই বিয়ে কেন? প্রতিশোধ নিলে?’
‘ ওটা তোমার স্বভাব, আমার না। ‘
এক মুহুর্ত শক্ত হয়ে বসে রইল উদয়িনী। পরোক্ষণেই বলল,
‘ সুহাসকে ওর বউ হিসেবে কোনোদিন মানব না আমি। ‘
সুহাস বলল,
‘ আমি এই বিয়েটাই মানছি না। ওকে মানা তো দূরে থাক। আমার কাছে আমার মায়ের আগে কেউ না৷’
ছেলের দিকে তাকালেন না সোহান। স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন,
‘ কাউকে মানতে হবে না। কিন্তু নামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে সুহাস ওকে ডিভোর্সও দিতে পারবে না। আর হ্যাঁ এ বাড়িতে নামী আমার মেয়ে হয়েই থাকবে। এটাই আমার শেষ কথা। ‘
.
.
উপরে হয়ে যাওয়া সমস্ত কথাই শুনতে পেল নামী। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। সে রাতে আর সুহাসের মুখোমুখি হয়নি সে৷ সারারাত ঘরের এক কোণে নিথর শরীরে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে শুধু। মেনে নিয়েছে আকস্মিক ঝড় আর কঠিন বাস্তবতাকে। ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝড়ে যাওয়া কলি হিসেবে জীবন শুরু হলো তার। আসার সময় কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কাপড়চোপড় আর ব্যক্তিগত ডায়ারি এনেছিল। শেষ রাতে ডায়ারি বের করে মধ্য পাতায় লিখল,
‘ ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া কলি আমি। ‘
এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধির পাশে শুয়ে পড়ল। এ বাড়িতে আজ তার প্রথম রাত। নিয়ম অনুযায়ী আজ তার আর সুহাসের বাসর রাত। যে রাত নিয়ে সুহাস অনেক বেশি উত্তেজিত ছিল। তার পাশে এখন নিধি নয় সুহাস থাকার কথা ছিল। জগত এত নিষ্ঠুর কেন? যার যেখানে থাকার কথা সে কেন সেখানে থাকে না? সহসা সামাজিক রীতিতে হওয়া বিয়ের রাতের কথা স্মরণ হলো নামীর। বেপরোয়া সুহাসের বেসামাল অনুভূতির সংস্পর্শে যাওয়ার মুহুর্তটুকু মনে পড়তেই ডুকরে ওঠল৷ দু’হাতে মুখ চেপে ধরল মুহুর্তেই। নিধি আপু জেগে ওঠার ভয়ে। নিরব কান্নায় ভেঙে পড়ল। নিভৃতে ঝড়াল অশ্রুজল।
_________________
পাঁচ মাস পর,
এমবিবিএস প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট’সদের আজ প্রথম ক্লাস। ছাত্র-ছাত্রীরা রঙ বেরঙের পোশাক সাদা অ্যাপ্রোনে আড়াল করে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হচ্ছে। দশটা পনেরোর দিকে চুইংগাম চিবুতে চিবুতে বাইক নিয়ে কলেজ প্রাঙ্গনে উপস্থিত হলো সুহাস। নির্দিষ্ট স্থানে বাইক রেখে আসার পথে দেখল সিনিয়র কয়েকজন ভাই জুনিয়রদের রেগ দিচ্ছে। বাঁকা হেসে তর্জনীতে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে সে গিয়ে মাঠের একপাশে বসার স্থানে বসল। কল করল সৌধকে। কখন আসবে শুনে নিয়ে একা একাই সময় কাটাতে লাগল। এমন সময় তার সহপাঠীরা এসে ঘিরে ধরল তাকে। বলল,
‘ দোস্ত প্রথম বর্ষের মেয়েরা আজ আসছে। চল কয়েকটাকে ধরে রেগ দেই। ‘
সুহাস আগ্রহ দেখাল না। তখন হুট করেই সেখানে আজিজ এলো। সুহাসের কানে কানে কী যেন একটা বলল। এরপরই তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সুহাস৷ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
‘রেগ দিবি বললি না? ‘
সকলে হইহই করে ওঠল। সুহাস দুর্বোধ্য হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ তবে দেরি কেন চল। ‘
এরপর আজিজকে ইশারায় কিছু বলতেই আজিজ বলল,
‘ ডান। ‘
কলেজ প্রাঙ্গনে প্রথম দিন নামীর৷ বন্ধু-বান্ধব এখনো হয়নি৷ ফেসবুকে কলেজের যে গ্রুপটা আছে সেখানে ফারাহ নামের এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সে বলেছে সাড়ে দশটায় গেটে থাকতে। তার জন্যই অপেক্ষা করছে নামী৷ এমন সময় তিনজন ছেলে এসে তার সামনে দাঁড়াল। বলল,
‘ প্রথম বর্ষ? ‘
নামী উত্তর দিল,
‘ জি। ‘
‘ আমরা সেকেন্ড ইয়ার তোমার সিনিয়র। ‘
নামী থতমত খেয়ে গেল। বুক ধুকপুক করে ওঠল তার। ঢোক চিপে মৃদু হাসার চেষ্টা করল সে। কিন্তু বড়ো ভাইদের কথা শুনে ধুকপুকানি বেড়ে বুক শুকিয়ে মরুভূমিতে রূপান্তরিত হলো।
‘ আমরা আজ জুনিয়রদের রেগ দিচ্ছি। তোমাকেও দিব। ‘
সিনিয়ররা বলল। সে মুহুর্তেই উপস্থিত হলো আজিজ। বলল,
‘ ভয় নেই। বিষয়টা আর সবার মতো ইজিলি নাও। আর সম্মানের সাথে বড়ো ভাইদের কথা মতো কাজ করো। ‘
আজিজকে দেখে কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল নামী। কারণ আজিজ তার চেনা৷ সৌধ ভাই, নিধি আপুর সঙ্গে আজিজও সেদিন তাদের বাড়ি গিয়েছিল। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। এদিকে সবাই বলল,
‘ আমাদের কলেজের মোস্ট হ্যান্ডসাম একজন ছেলেকে তোমায় প্রপোজ করতে হবে। ‘
তাদের ব্যাচের মোস্ট হ্যান্ডসাম ছেলে বলতে সৌধর নামটাই আগে আসে। যেহেতু সৌধ ক্যাম্পাসে উপস্থিত নেই সেহেতু সবার মাথায় এখন সুহাসের নাম এলো। আজিজ তির্যক হাসল। বুদ্ধিটা আসলে তারই। কারণ সে বন্ধু সুহাসের একনিষ্ঠ ভক্ত। সুহাস নামীর সম্পর্ক এখন ঠিক সাপে নেওলের মতো। জানে সে। তাই একটি থ্রিল দৃশ্য তৈরি করার পরিকল্পনা মাত্র। নামী প্রথমে এটাকে সাধারণ রেগ হিসেবেই নিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল সুহাসকে প্রপোজ করতে হবে৷ তখন রাগে মাথা দপদপিয়ে ওঠল। বুঝে ফেলল, তাকে হেনস্তা করার জন্য এটা সুহাসেরই প্ল্যান। যেখানে সুহাসকে এখন সে সহ্যই করতে পারে না৷ সেখানে কিনা প্রপোজ করতে হবে!
জিন্স প্যান্টের সাথে কালো কামিজ পরনে নামীর৷ তার ওপর সাদা অ্যাপ্রোন। মাথার চুলগুলো পেছনে বেশ উঁচুতে ঝুটি করে রাখা। কপাল ছেয়ে আছে ছোটো ছোটো চুল দ্বারা। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। কাঁধে মাঝারি আকৃতির কালো ব্যাগ। আর হাতে সাদা রঙের আইফোন। শ্যামলাটে মুখটায় বিরক্তি ফুটিয়ে ধীরেধীরে এগিয়ে আসছে৷ যা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকল সুহাস। সে একটু দূরেই দু-হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে সটান৷ নামী এসে সামনে দাঁড়াতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। অন্য সময় হলে তার দাম্ভিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখাত নামী৷ কিন্তু এ মুহুর্তে তা সম্ভব হলো না। ওদিকে বড়ো ভাইরা চ্যাঁচাচ্ছে। উপায় না পেয়ে নামী হাঁটু গেড়ে বসল। আজিজের দেয়া কলমটা এগিয়ে ধরল সুহাসের দিকে। এরপর চোখমুখ খিঁচে বলে দিল,
‘ মিস্টার সুহাস খন্দকার, আই লাভ ইউ। ‘
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। দাপটের সঙ্গে পরিহিত কালো শার্টের বোতাম গুলো খুলতে শুরু করল। একে একে সবকটা বোতাম খোলার পর ভেতরের সাদা টিশার্ট বেরিয়ে এলো। শার্টের দু’দিকে ধরে দুহাতে টান দিল সুহাস। টিশার্টে ঢাকা লম্বা দেহের বুকের পাটা দৃশ্যমান করে মাথা নিচু করল। নামীর মুখোমুখি হয়ে দৃষ্টিজোড়া কঠিন করে আচমকা তীব্র চিৎকারে বলল,
‘ আই হেইট ইউ! আই জাস্ট হেইট ইউ নামী রহমান!’
তীব্র ক্ষোভ মিশ্রিত সে চিৎকারে সুহাসের বন্ধুরা স্তব্ধ হয়ে গেল! স্তব্ধ হয়ে গেল আশপাশে থাকা জুনিয়র এবং সিনিয়র ভাই, বোনরাও!
Leave a comment