বাইজি কন্যা

পাঁচফোড়ন গৃহে টিভির জন্য আলাদা একটি কক্ষ রয়েছে। অবসর সময়ে শাশুড়ি, বউ’রা মিলে নাটক,সিনেমা দেখে। পুরুষ’রা সে কক্ষে তেমন আসে না। ভাইদের মাঝে রঙ্গনই বেশি আসে। আষাঢ় মাস। তাই প্রকৃতি’তে আষাঢ়ে বৃষ্টির ঢল নেমেছে। বিকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সকলে মিলে আজ টিভি দেখতে বসেছে। জেবা গিয়ে শাহিনুর’কে ডেকে আনল। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও শাহিনুর এলো। এসেই সে একটি দৃশ্যের সম্মুখীন হলো। যা দেখে মনে মনে জেবা’কে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল। মেঝেতে শীতল পাটি পেড়ে বসে আছে প্রেরণা। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে রঙ্গন৷ সোফায় বসে আছে শবনম, মুনতাহা। সকলের দৃষ্টি টিভির দিকে থাকলেও রঙ্গনের দৃষ্টি টিভিতে নেই। সে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুনতাহার পানে! যা দেখে বুক চিড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। জেবা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ভাবি খুব জরুরি একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। আপনি যান আমি আসছি।’
আর অপেক্ষা করল না শাহিনুর। ছুটে চলে এলো প্রণয়ের কক্ষে। এসেই টেলিফোনের কাছে ছুটে গেল। ডায়েরির পাতা উল্টে নাম্বার বের করে ফোন করল প্রণয়’কে। সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে উদগ্রীব কন্ঠস্বর ভেসে ওঠল,
-‘আমি আসছি।’
ছাতা ফুটিয়ে কেবলই গাড়ি থেকে নেমেছে প্রণয়। এমন সময় ফোন পেয়েছে। তাও শাহিনুরের! উত্তেজনাটুকু প্রকাশ করার মতো নয়। টেলিফোন হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল শাহিনুর। বুক’টা হুহু করে ওঠল তার৷ চারিদিকে অদ্ভুত শূন্যতা! আম্মা আর মান্নাত বুবু’কে আজ অনেক বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে তাদের বলা প্রতিটি কথা’কে। সে কথাগুলো আজ যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। মিলবে না কেন? তারা যে তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছে। সেদিন সেসব ধোঁআশার মতো থাকলেও আজ সবই পরিষ্কার।

কক্ষে এসে প্রণয় দেখল টেলিফোন হাতে বসে আছে শাহিনুর। মুখের ভাব থমথমে। সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে। ফিরেই বউ’য়ের এমন বিষণ্ন মুখ দেখে ফোঁস করে একটি নিঃশ্বাস ছাড়ল। কতশত ক্লান্তি মিশে ছিল সে নিঃশ্বাসে জানা নেই।
-‘বাড়ির সামনে ছিলাম তখনি ফোন দিয়েছো।’
চিন্তিত সুরে কথাটি বলল প্রণয়। কিন্তু শাহিনুরের কোন ভাবান্তর হলো না। ড্রেসআপ পরিবর্তন করে এসেও যখন শাহিনুর’কে একই রূপে পেল চিন্তায় ভাঁজ পড়ল কপালে। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে শাহিনুরের পাশে বসল। চিন্তান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘কি হয়েছে?’
-‘মানুষ কেন বেইমানি করে ডাক্তারসাহেব?’
চমকে ওঠল প্রণয়। সহসা হাত বাড়িয়ে এক গাল ছুঁয়ে আবারও প্রশ্ন করল,
-‘কি হয়েছে নুর?’
চেতনাশূন্য শাহিনুর সহসা চেতনা ফিরে পেল। বলল,
-‘আপনি এসেছেন?’
স্মিত হেসে প্রণয় বলল,
-‘তুমি অপেক্ষায় ছিলে?’
-‘হ্যাঁ।’
সরল কন্ঠে উত্তরটুকু দিয়ে ওঠে দাঁড়াল শাহিনুর। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল কক্ষ থেকে। প্রণয় হতভম্ব হয়ে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। দু’মিনিটের মাথায় আবার এলো শাহিনুর। দু’হাতে দু’টো গ্লাস নিয়ে ফিরল সে। প্রণয় অবাক হয়ে বলল,
-‘এসব কী?’
শাহিনুর মৃদু হেসে তার পাশে বসল। দু’টো গ্লাস সামনের টেবিলে রেখে বলল,
-‘একটায় শুধু ঠান্ডা পানি। আরেকটায় লেবু, চিনি মেশানো ঠান্ডা পানি। যেটা ইচ্ছে নিন।’
শরীরজুড়ে ভয়াবহ শিহরণ বয়ে গেল প্রণয়ের। স্বপ্ন না সত্যি বুঝে ওঠতে বেশ সময় লেগে গেল। উদাস মুখী শাহিনুরের কয়েকঘন্টার ব্যবধানে এতো পরিবর্তন! প্রচণ্ড সন্দেহ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল তাকে। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়েও রইল। শাহিনুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
-‘কি হলো নিবেন না?’
-‘আমার প্রতি হঠাৎ এতো সদয় যে!’
-‘আপনিই তো বলেছেন, আপনি আমার অর্ধাঙ্গ। সে হিসেবে এটুকু যত্ন করতেই পারি।’
ছলহীন বাক্যে অভিভূত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে লেবু, চিনি মেশানো পানির গ্লাসটি তুলে নিমিষেই শেষ করল প্রণয়। সারাদিনের ক্লান্তিটা এক নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে গেল যেন৷ বক্ষঃস্থলে ভর করল তৃপ্ততা। অধর কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠল। বলল,
-‘এবার সত্যি বিয়ে করেছি ফিল’টা পাচ্ছি।’
শাহিনুর তাকিয়ে রইল। সে বলল,
-‘ফিল মানে হলো অনুভূতি।’
একটু থেমে আবার বলল,
-‘তোমাকে পড়াশোনা করতে হবে নুর৷ ভাবছি কোয়ার্টারে যাওয়ার পর একজন শিক্ষক রাখব, তোমার জন্য। প্রাথমিক শিক্ষা হয়ে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেব।’
-‘আমার আম্মা অনেক বড়ো শিক্ষা দিয়ে গেছে ডাক্তারসাহেব। এক জীবনে আর কত শিক্ষা পাব বলুন তো?’
-‘পরিস্থিতি মানুষ’কে অনেক বেশি বড়ো করে তুলে, অনেক বেশি শক্ত করে তুলে জানতাম। তোমায় দেখে প্রমাণও পাচ্ছি। অনেক বড়ো হয়ে গেছ তুমি।’
মৃদু হাসলো শাহিনুর। প্রণয় খেয়াল করল,সে হাসিতে প্রাণ নেই। দু’জনের দৃষ্টিই দু’জনাতে স্থির। কেবল একে অপরের চোখের ভাষা বুঝতে মশগুল।
-‘আমার আম্মা কি বলেছিল জানেন?’
নির্নিমেষ তাকিয়েই উত্তর দিল,
-‘ কী?’
-‘বাঘ কখনো বাঘ মারে না, কুকুর কখনো কুকুর মারে না, কিন্তু মানুষ মানুষ’কে মারে!’
দৃষ্টি চঞ্চল হলো। বক্ষঃস্থল শঙ্কিত হলো। শাহিনুর পুনরায় বলল,
-‘সে কথাটির মর্ম সেদিন না বুঝলেও আজ ঠিক বুঝতে পেরেছি।’
উদবিগ্ন কন্ঠে প্রণয় বলল,
-‘কেউ কিছু বলেছে তোমায়?’
দৃষ্টি নত করে ফেলল শাহিনুর। বারকয়েক ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘জানেন? আমার বাবাও অনেক সম্মানিত একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার সম্মান’কে ধ্বংস করে দিয়েছে তার আপনজন’রাই।’
সুক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে রইল প্রণয়৷ শাহিনুর একটু থামল,এক ঢোক গিলে বলল,
-‘আম্মা মারা যাওয়ার পর প্রথম কোন কথাটি মনে পড়েছিল জানেন?’
-‘জানি না তুমি বলো।’
-‘আম্মা বলেছিল, যে ভালোবাসা, যে সুখ সে ত্যাগ করেছে। এই ত্যাগের পেছনের কারণ গুলো যদি কোন ষড়যন্ত্র হয়। আর এ ষড়যন্ত্রের পেছনে যদি জমিদারের হাত থাকে তাহলে সেদিন জমিদার আর রেহাই পাবে না! আম্মা সত্যি রেহাই দেয়নি৷’
-‘ভুল করেছেন তিনি৷ আর তার মাশুল দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে।’
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল শাহিনুরের। বলল,
-‘আপনি আমার আম্মা’কে ভুল বলতে পারেন না।’
-‘আইন কখনো নিজের হাতে তুলে নিতে হয় না নুর। তোমার আম্মা পারতেন আইনের সহায়তা নিতে। তাহলে অন্তত প্রাণ হারাতে হতো না, তুমিও মা হারা হতে না।’
-‘আপনাদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই লড়া যায় ডাক্তারসাহেব?’
এই কথাটি প্রণয়ের বুকে তিরের মতো বিঁধল। সহসা নরম হাতে শাহিনুরের কপোলদ্বয় চেপে ধরল। আহত সুরে বলল,
-‘একটু স্বাভাবিক হও নুর একটু স্বাভাবিক হও। আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। একটা বার বিশ্বাস করে দেখ, তুমি ঠকবে না।’
রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে শাহিনুর বলল,
-‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই।’
নিঃশ্বাস থমকে গেল প্রণয়ের অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে। শাহিনুর বলল,
-‘সম্মান জিনিসটার অনেক মূল্য তাইনা ডাক্তারসাহেব?’
শাহিনুরের কপালে কপাল ছুঁইয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করল প্রণয়। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-‘কি হয়েছে? সত্যিটা বলো আমায়।’
-‘ষড়যন্ত্র চলছে ডাক্তারসাহেব। কখনো ভাবিনি আপনিও শিকার!’
দৃঢ় চোখে তাকাল প্রণয়। সন্তর্পণে শাহিনুরের কপালে গাঢ় করে একটি চুমু খেল। ফিসফিসে কন্ঠে বলল,
-‘আমি ভীষণ রকম বিশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছি। কুল কিনারা হীন এক অবিশ্বাস্য ভালোবাসার গন্ধ পাচ্ছি। তুমি কি পাচ্ছো শাহিনুর শায়লা! ‘
সন্তর্পণে চোখদুটো বুজল শাহিনুর। গভীর কিছু নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
-‘আর আমি বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ পাচ্ছি।’
মৃদু কেঁপে ওঠল প্রণয়। শাহিনুরের কপোলদ্বয় থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল। সন্দিহান দৃষ্টি ছুঁড়ে ক্ষণকাল চুপ করে রইল। তাকে অবাক করে দিয়ে হাত বাড়াল শাহিনুর। কোমল হাতে স্পর্শ করল শক্ত হয়ে ওঠা পুরুষালী চোয়ালদ্বয়। শান্ত চোখে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
-‘আমি বিশ্বাস করি ঘাতক আপনি নন। না বিশ্বাসের আর না মানুষের! ‘

বিনা অনুমতি’তে হুট করেই কক্ষে প্রবেশ করল ময়না। দু’জন’কে একসাথে এতো কাছে দেখে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে একটা চিৎকার দিল,
-‘ও’মাগো শরমে মরে গেলাম গো!’
আতঙ্কিত হয়ে হাত দু’টো সরিয়ে নিল শাহিনুর।ক্রোধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রণয়। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে ধমক দিল ময়না’কে,
-‘এই মেয়ে আমার কক্ষে আসার সাহস কোথা থেকে পান আপনি।’
ধমক খেয়ে আঁতকে ওঠল ময়না। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-‘নতুন ভাবি’র দাসী আমি। ভাবি’র জন্যই এসেছি আমি।’
প্রণয়ের কঠিন মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শাহিনুর। গলা শুঁকিয়ে গেল তার। মনে পড়ে গেল প্রথম দিন দেখা সেই প্রণয়’কে। মনে পড়ল কিছু সময় পূর্বের প্রণয়’কেও। আকাশপাতাল পার্থক্য খুঁজে পেল। একই মানুষের দু’টো রূপ! আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইল। মৃদু স্বরে ময়নার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘আমার দাসী হয়েছ বলে অনুমতি ছাড়া ঘরে আসতে পারবে। এ’কথা কে বলল তোমায়।’
অপমানিত হয়ে মাথা নিচু করে ফেলল ময়না। প্রণয় ক্রোধে হাত দু’টো মুঠ করে ফেলল। ময়নার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-‘এ বাড়িতে কাজ করতে এসেছেন অথচ নিয়ম কানুন জানেন না! বেরিয়ে যান। আর কোনদিন আমার কক্ষের আশপাশে আপনাকে দেখতে চাইনা।’
পা থেকে মাথা অবধি কেঁপে ওঠল ময়নার। ধক করে ওঠল শাহিনুরের বক্ষঃস্থল। কম্পিত চরণে কক্ষ ত্যাগ করল ময়না। শাহিনুর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি প্রণয়ের পানেই স্থির। রেগে গেলে কী ভয়ংকর হয়ে যায় মানুষ’টা। কুচকুচে কালো জোড় ভ্রুদ্বয়ে ছোটো ছোটো গভীর চোখ দু’টো ভীষণ ভয়ানক লাগে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি’তে শক্ত হয়ে ওঠা গাল দু’টোতেই যেন তার গুরুগম্ভীর, ভার ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। শাহিনুর এক ঢোক গিলল। প্রণয় লম্বা একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তার দিকে তাকাল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-‘যেখানে আমার কক্ষে কেউ আসে না। সেখানে ঐ মেয়েটা বিনা অনুমতি’তে কি করে আসে?’
শাহিনুর জবাব দিল না। প্রণয় সহসা শান্ত হয়ে গেল। রাগটুকু দমন করে শান্ত কন্ঠে বলল,
-‘তোমার দাসী বলে এ ঘরে আসার অধিকার নেই তার। মনে থাকবে?’
মাথা নাড়াল শাহিনুর৷ তা দেখে মৃদু হাসল প্রণয়। শাহিনুর কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল। নিঃশব্দে কক্ষ ত্যাগ করতে উদ্যত হল৷ তাকে চলে যেতে দেখে প্রণয় ডাকল,
-‘ নুর…’
থামল সে। কিন্তু ঘুরল না। কান পেতে পিছন মুখী হয়েই দাঁড়িয়ে রইল৷ তা দেখে মুচকি হাসল প্রণয়। বলল,
-‘তোমার মুখে ডাক্তারসাহেব ডাকটি সারাজীবন অটুট থাকুক।’
[৬০]
স্বয়ং উপরওয়ালা যাকে সম্মান দান করেছেন, তার সম্মান নষ্ট করার সাধ্য কারো নেই। প্রণয় নিজ কর্মের দ্বারাই অর্জন করেছে সে সম্মান। নিজের মতো করে সততার সঙ্গে তৈরি করেছে নিজ চরিত্র’কে। যেখানে কোন মিথ্যা নেই, অন্যায় নেই, ভ্রান্তি নেই। নিজ সহোদর যখন তার চরিত্রে দাগ লাগাতে চেয়েছে। কলঙ্ক দিতে চেয়েছে। মহাল আল্লাহর কৃপায় দারুণ বুদ্ধিমত্তা’কে কাজে লাগিয়েছে শাহিনুর। স্মরণ করেছে ইতিহাস’কে। উপলব্ধি করেছে ও’রা ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটাতে কুকুরের মতো ওত পেতে আছে! কিন্তু ও’রা টের পায়নি সময় বদলে গেছে৷ প্রণয় শাহিন নয়। শাহিনুরও শারমিন বাইজি নয়। সে শারমিন বাইজির কন্যা। যে কিনা মা’য়ের মুখেই শুনেছিল তার হেরে যাওয়ার গল্প। বিশ্বাস,অবিশ্বাসের খেলায় হেরে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে শারমিন বাইজি৷ একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয় কি করে! যে সম্মান’কে টেনে হিঁচড়ে ধূলিসাৎ করতে চেয়েছে রঙ্গন, সে সম্মান হিমালয় পর্বতসম হয়ে ধরা দিয়েছে। যে সম্মান সকলের ধরা ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে।

প্রণয় খেয়াল করল ইদানীং তার প্রতি বেশ যত্নশীল আচরণ করছে শাহিনুর৷ রোজ সকালে হসপিটাল আসার পূর্বে কত যত্ন মিশিয়ে মেয়েটা সব কিছু গুছিয়ে দেয়। সুযোগ বুঝেই তাকিয়ে থাকে। যতক্ষণ না বাড়ি ফেরে অপেক্ষা করে। একটু দেরি হলেই টেলিফোন করে খোঁজ নেয়৷ রাতে নিয়ম করেও ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকে। এজন্য অবশ্য তার ঘুমিয়ে যাওয়া’কেই বেছে নেয়। কিন্তু মেয়েটা টের পায় না। তার স্বামী নামক পুরুষ’টি ঘুমের ভাণ করে থাকে। সে যেমন ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকে সেও ঘন্টার পর ঘন্টা অনুভব করে তার তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো। হসপিটাল এসে নিজের কেবিনে বসে বসে সেসবই ভাবছিল প্রণয়। ভাবনার মাঝে হঠাৎ সকালের একটি ঘটনা স্মরণ হলো তার, গোসল করে বের হতেই দেখতে পেল শাহিনুর তার পোশাক রেডি করে পালঙ্কে রেখে দিয়েছে। আশ্চর্য হয়ে প্রণয় বলল,
-‘তুমি রেখেছ!’
শাহিনুর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দিল,
-‘আর কে রাখবে? এ বাড়ির আর কেউ আপনার ঘরে আসে না।’
প্রণয় মৃদু হেসে ফেলল বলল,
-‘আশা করিনি।’
শাহিনুর কিছু বলল না। ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার পূর্বে বলে গেল,
-‘স্ত্রী হিসেবে এটুকু করার অধিকার আমার রয়েছে।’
বড়ো করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করল প্রণয়৷ বেশ চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগল,
-‘উত্তর টা ভালোবাসার হতে হবে।’

সকালবেলা অরুণা অঙ্গন’কে নাস্তা করাতে গেল। ওষুধপত্র ঠিকঠাক চলায় অঙ্গন বেশ চুপচাপই থাকে। কথাবার্তা তেমন বলে না৷ যাও বলে সব অগোছালো। অরুণা তাকে খাওয়াচ্ছিল। এমন সময় সে বলল,
-‘বড়োম্মা, নতুন ভাবি’কে তো দেখলাম না!’
হঠাৎ এমন একটি কথা বলবে অঙ্গন কল্পনার বাইরে ছিল৷ একদম সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় কথাটি বলল সে। অরুণা খুশিতে কেঁদে ফেলল। অঙ্গনের কপালে চুমু খেল। চিৎকার করে প্রেরণা’কে ডাকল। প্রেরণা ছুটে এল। অরুণা বলল,
-‘আমার অঙ্গন কি এতই ফেলনা হয়ে গেছে ছোটো। প্রণয়ের বউ’কে দেখার অধিকার কি ওর নেই?’
প্রেরণা সব শুনে অঙ্গনের কাছে এসে গালে হাত দিয়ে আদুরে স্বরে বলল,
-‘আব্বা তুমি নতুন ভাবি’কে দেখবা?’
অঙ্গন মাথা নাড়াল। প্রেরণা সকালের ওষুধগুলো সামনে ধরে বলল,
-‘ এটা খাও আব্বা তারপর তোমার ভাবি’কে ডেকে আনব৷’
পালঙ্কের শেষ সীমান্তে চলে গেল অঙ্গন। অস্বাভাবিক ভণিতায় বলল,
-‘তোমার হাতে খাব না, তোমার হাতে খাব না। নতুন ভাবির হাতে খাব। যাও যাও তুমি চলে যাও।’
হাত নাড়িয়ে তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করল অঙ্গন। প্রেরণা গেল না সে আবারও এগিয়ে যেতে নিল। অঙ্গন বিরক্ত হলো, মাথা চুলকে আশপাশে তাকাল। তার বিছানায় বিভিন্ন জিনিসে ছড়াছড়ি। সেই ছড়িয়েছে এভাবে৷ সেখানে একটি গ্লাস দেখতে পেল।
কাঁসার সে গ্লাসটি তুলেই ছুঁড়ে মারল প্রেরণার দিকে! ‘ওমাগো’ বলেই মেঝেতে বসে পড়ল প্রেরণা। কপাল ফেটে গড়গড় করে রক্ত পড়তে লাগল। আতঙ্কিত হয়ে অরুণা গিয়ে ধরল তাকে। হাঁক ছেড়ে ভৃত্যদের ডাকতেই তারা এসে প্রেরণা’কে নিয়ে গেল। অরুণাও অঙ্গন’কে রেখে কক্ষে দরজা আঁটকে চলে গেল।

বিশ মিনিটের মাথায় ময়না’কে সঙ্গে করে শাহিনুর এলো অঙ্গনের কাছে। আর কেউ আসার সাহস পেল না। দরজা খুলে দেখল দেয়ালে কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি দাগ করছে অঙ্গন। বাংলা পড়তে জানে সে। তাই রোমানা লেখাটিও দেখতে পেল। দেয়ালের প্রায় একাংশ জুড়েই রোমানা, রোমানা লিখা। সে লেখার ওপর আবার অসংখ্য কাটাকুটি। যেখানে অঙ্গন’কে দেখে সকলে ভয় পায় সেখানে সাবলীল ভাবেই কক্ষে প্রবেশ করল সে। পেছন থেকে ময়না বলল,
-‘নতুন ভাবি আপনি যান আমি বাইরেই থাকি।’
তাচ্ছিল্য হেসে শাহিনুর বলল,
-‘থাকো।’
নারী কন্ঠ শুনে ঘুরে বসল অঙ্গন৷ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল শাহিনুরের দিকে। শাহিনুর মৃদু হেসে এগিয়ে এলো। পালঙ্কে ওঠে বসল। অঙ্গন কিছুটা পিছিয়ে গেল৷ পিঠ ঠেকল দেয়ালে। এক গালে হাত রেখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল শাহিনুর’কে। শাহিনুর বলল,
-‘কী দেখছেন? আমি আপনার নতুন ভাবি।’
খুশিতে গদগদ হয়ে অঙ্গন বলল,
-‘আপনি কতো সুন্দর নতুন ভাবি।’
লজ্জা পেল শাহিনুর। হাত বাড়িয়ে কয়েকটা ট্যাবলেট দেখিয়ে বলল,
-‘এগুলো খাবেন না?’
গাল থেকে হাত সরিয়ে পিঠ ঘুরিয়ে বসল অঙ্গন৷ দেয়ালে একহাত রেখে তার ওপর মাথা ঠেকালো। আরচোখে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলল,
-‘আমি খাব না। ওগুলো পাগলের ওষুধ, আমিতো পাগল না নতুন ভাবি, আমিতো পাগল না।’
চোখ দুটো ছলছলিয়ে ওঠল শাহিনুরের। বলল,
-‘এগুলো পাগলের ওষুধ না। এগুলো রোগের ওষুধ। আপনার রোগ হয়েছে, এগুলো খেলে সেরে যাবে।’
শান্ত হলো অঙ্গন বলল,
-‘খাব কিন্তু একটা শর্ত আছে।’
বাচ্চাসুলভ কথাটি শুনতেই হেসে ফেলল শাহিনুর। সে হাসি দেখে লাজুক ভণিতায় তাকাল অঙ্গন। শাহিনুর বলল,
-‘সব শর্ত মানব আপনি এগুলো খেয়ে নিন।’
অঙ্গন এবার সম্পূর্ণ তার দিকে ঘুরে হাঁটু মুড়িয়ে বসল। ডান হাত উঁচিয়ে বলল,
-‘আমার দু’টো শর্ত আছে, দু’টো।’
মায়ার দৃষ্টিতে চেয়ে শাহিনুর বলল,
-‘বলুন।’
বেশ উল্লসিত হয়ে আঙুল দেখিয়ে অঙ্গন বলল,
-‘এক, আপনাকে আমার চেনা চেনা লাগছে। কেন লাগছে সেটা বলবেন।’
ঢোক চিপে আরেক আঙুল উঁচিয়ে বলল,
-‘দুই,আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। দেবর মানে তো ভাইয়ের সমান তাইনা।’
শাহিনুরের চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। বলল,
-‘ভাই, তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তুমি অসুস্থ তাই মনে করতে পারছ না। এবার ওষুধ গুলো খেয়ে নাও।’
অঙ্গন আবার বেঁকে বসল। শাহিনুর বলল,
-‘আবার কি হলো?’
-‘আরেকটা শর্ত আছে?’
অবাকান্বিত হয়ে বলল,
-‘কী?’
-‘এ ঘরে রোজ আসবেন আপনি। আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এ বাড়ির আর কাউকে পছন্দ করি না আমি।’
চোখ ছোট ছোট করে শাহিনুর বলল,
-‘ডাক্তারসাহেব’কেও না?’
-‘সে তো এ বাড়ির লোক না।’
আবারও হাসল সে,ওষুধ গুলো এগিয়ে দিয়ে বলল,
-‘আচ্ছা আসব এবার খেয়ে নাও।’
এবারেও খেল না অঙ্গন। শাহিনুর বলল,
-‘আরো শর্ত আছে?’
অঙ্গন মাথা নাড়িয়ে না করল। ফিসফিস কন্ঠে বলল,
-‘একটা কথা আছে।’
-‘কী?’
-‘আপনি বড়ো সুন্দরী।আপনার চোখ দু’টো খুব সুন্দর!’
লজ্জা পেল শাহিনুর। কিঞ্চিৎ দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-‘এবার ওষুধ গুলো খেতেই হবে।’
বাধ্য ছেলের মতো ওষুধ গুলো খেয়ে নিল অঙ্গন। তারপর গল্প শুরু করল। গল্পের শুরুতে নুতন ভাবি দিয়ে শুরু করলেও শেষ করল আমার রোমানা দিয়ে। গল্পের এক পর্যায়ে দুর্বলচিত্তে শুয়ে পড়ল সে । ধীরে ধীরে চোখ বুজে এলো তার। হয়তো ঘুমাবে। সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল। তবে ঘুমানোর পূর্বে আধোঘুম কন্ঠে যে কথাটি বলল তা হলো,
-‘নতুন ভাবি।’
-‘হ্যাঁ ভাই।’
-‘আপনি বড়ো সুন্দরী। কিন্তু আমার রোমানার চেয়ে একটু কম।’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.