বাইজি কন্যা

ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমে পুরুষালি বলিষ্ঠ দেহের ওম পেয়ে প্রচণ্ড তপ্ত হয়ে ওঠল ছোট্ট নরম দেহশ্রী। মাঝরাত থেকেই বিদ্যুৎ নেই। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান’টা ঘুরছে না। ঘুমন্ত প্রণয়ের শরীর থেকে স্বেদজল চুইয়ে চুইয়ে শাহিনুরের সারা গায়ে মিশে যাচ্ছে। তপ্ত অনুভূতি’তে সহসা হিম অনুভব করায় ঘুম ছুটে গেল। চোখ খুলতেই রাশভারী পুরুষটিকে দেখে অধর কোণে হাসি ফুটে ওঠল। সে হাসির রেখা দীর্ঘস্থায়ী হলো না, নিমিষেই দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে গেল৷ ছলছল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ উঁচিয়ে কপালে চুমু খেল। মনে মনে বলল,
-‘আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন ডাক্তারসাহেব। আমি আপনার কথা রাখতে পারব না৷ যে পথ আমি বেছে নিয়েছি, সে পথ থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়,উচিৎও নয়৷ শেষবেলায় যদি সৃষ্টিকর্তা চান তবে সংসার হবে আমাদের।’
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পুনরায় গাঢ় একটি চুমু খেল কপালে। নতুন দিনের সূচনায় নিজেকে নতুন রূপে প্রস্তুত করার উদ্যমে নিমগ্ন হলো সে। ঘড়িতে সময় তখন সাতটা বেজে বাইশ মিনিট। সময় দেখে নিয়ে আবারও প্রণয়ের ঘুমন্ত মুখের পানে তাকাল। মানুষ’টা তাকে দু’হাতে আবদ্ধ করে গায়ের সঙ্গে গা লেপটে ঘুমাচ্ছে। স্বামীর ঘর্মাক্ত দেহে নাক ডুবিয়ে, চোখ বুজে ঘ্রাণ নিল একবার। অন্তঃকোণে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। ব্যথাটুকু যত্নসহকারে লুকিয়ে অতি সাবধানে স্বামীর বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করল। পালঙ্ক থেকে নেমে দাঁড়াতেই মাথা’টা ঝিমঝিম করে ওঠল। চারপাশ’টা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। শূন্য বুক’টায় একটি হাত চেপে রুদ্ধ শ্বাস ছাড়ল। পিছন ফিরে আবারও তাকাল প্রণয়ের দিকে। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘অন্যায় আমার সঙ্গে হয়েছে, জবাব’টা আমিই দেব। আমি জানি এর জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আপনার থেকে ক্ষমা পেলেও পৃথিবীর কারো থেকে পাব না। আপনার মনের আইনে ছাড় পেলেও বিবেকের আইনে ছাড় পাব না। দূরত্ব যখন আসবেই সূচনা এখান থেকেই হোক।’
চোখ বন্ধ করে লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলল শাহিনুর। বিরবির করে বলল,
-‘মাঝের এ’কটা মাস সুখস্বপ্ন ছিল আর কিছু নয়!’

রোজকার মতো ঘুম ভাঙতেই শাহিনুর’কে পেল না প্রণয়। খুব স্বাভাবিক মনে করেই গোসল সেরে হসপিটালের জন্য রেডি হলো সে। ভোজনালয়ে যাওয়ার সময় জেবার সঙ্গে দেখা হলো। শাহিনুর শবনমের সঙ্গে রান্নাঘরে আছে শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে সকালের নাস্তা করল। বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে শাহিনুর’কে ডাকল। কিন্তু এলো না। অধৈর্য হয়ে সে নিজেই রান্নাঘরে গেল। অরুণা, শবনমের সামনেই শাহিনুর’কে কক্ষে আসার জন্য আদেশ দিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহিনুর’কে যেতে হলো। কক্ষে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচলিত হয়ে শাহিনুরের কাঁধ চেপে ধরল প্রণয়। বলল,
-‘কী ব্যাপার? ডাকছি আসছো না কেন? তাড়া থাকে আমার জানো না?’
প্রণয়ের দৃষ্টি স্থির থাকলেও শাহিনুরের দৃষ্টিতে চঞ্চলতা স্পষ্ট। কোনভাবেই প্রণয়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো না সে। প্রণয় চট করে ওর কপালে চুমু খেল। একহাতে গালে আলতো ছুঁয়ে বলল,
-‘আমার তাড়া আছে। তুমি সাবধানে থেকো। সময় না কাটলে যে বইগুলো এনেছি ওগুলো নিয়ে বড়ো ভাবির কাছে বসো। আসছি।’
বেরিয়ে গেল প্রণয়। রোজকার মতো আজ কোন কিছুই গুছিয়ে দেওয়া হলো না। এ নিয়ে প্রণয় কতটা চিন্তিত বোঝা না গেলেও শাহিনুরের মনটা বড্ড অস্থির লাগতে শুরু করল। কিন্তু সে অস্থিরতা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করল। তার ডাক্তারসাহেব’কে পূর্বের মতোই একা একা বাঁচতে হবে। পাশে পাবে না তাকে, এ’কমাসের অভ্যাসটা দ্রুতই পরিবর্তন করতে হবে। মাথায় ঘোমটা টেনে আবারও বের হলো শাহিনুর। ভাবিদের সঙ্গে সকালের নাস্তা সেরে কক্ষে আসার পথে বৈঠকখানায় ময়না’কে দেখতে পেল। মনে পড়ে গেল প্রণয়ের বলা কিছু কথা। সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। নাকের ডগা লাল বর্ণে পরিণত হলো। ধপাধপ্ পা ফেলে বৈঠকখানায় উপস্থিত হলো সে। পল্লব আর পলাশ’কে চা দিয়ে সবেই পিছন ঘুরেছে ময়না। অমনি সজোরে তিনটা চড় মারল শাহিনুর৷ শেষ চড়’টার ধকল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়তে নিলো সে। তৎক্ষনাৎ পলাশ এসে ধরল ও’কে, ক্রুদ্ধ হয়ে তাকাল শাহিনুরের দিকে। ময়না হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। পলাশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘তোর এতবড়ো সাহস।’
অকপটে জবাব দিল শাহিনুর,
-‘বাড়ির চাকরানি’কে অন্যায়ের শাস্তি দিতে খুব কম সাহসই লাগে মেজো ভাইজান।’
যদিও গা গুলিয়ে বমি পেল তবুও তাচ্ছিল্য সহকারে পলাশ’কে কিঞ্চিৎ সম্মান দিল সে। এদিকে ময়নার কান্নার শব্দে সকলেই বৈঠকখানায় উপস্থিত হয়েছে। তাদের সকলের সম্মুখে গলা উঁচিয়ে রুক্ষ কন্ঠে শাহিনুর বলল,
-‘আমার দাসী হয়ে আমার জিনিস চুরি করেছো। মাফ করে দিয়েছি, কিন্তু আমার স্বামীর জিনিসে হাত বাড়ানোর সাহস হয় কি করে?’
সহসা শাহিনুরের এমন হুংকারে উপস্থিত সকলের হৃদযন্ত্র কেঁপে ওঠল। ময়না থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-‘আল্লাহ রে আমি বলে চুরি করছি গো, ও আল্লাহরে এমন কথা হুনার আগে মরণ দিলা না ক্যা গো।’
চিৎকার করে কথাগুলো বলেই পলাশের বুকে ঢলে পড়ল ময়না৷ মুনতাহা রাগে গজগজ করতে করতে এসে একটানে পলাশের থেকে ময়না’কে টেনে এনে বলল,
-‘এই তুই উনার ওপর ঢলে পড়ছিস কেন?’
কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে ধপাস করে নিচে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল ময়না। শাহিনুর আবারও গর্জে ওঠল,
-‘সত্যি করে বলো কার কথায় এসব করছো তুমি?’
মুনতাহা চোখ কটমট করে ময়নার চুলের মুঠিতে ধরে বলল,
-‘বল কোন সাহসে উনার বুকে মাথা রেখেছিস তুই ?’
মুনতাহার কাণ্ডে অরুণা বিরক্ত হলো। বলল,
-‘এসব কি হচ্ছে বউ মা তোমার শরীর ভালো নেই এদিকে আসো, এদিকে আসো।’
মুনতাহা’কে টেনে নিয়ে গেল অরুণা। যাওয়ার আগে শাহিনুর’কে বলে গেল,
-‘ঠান্ডা মাথায় বড়ো বউ’কে নিয়ে সমস্যা সমাধান করো। প্রয়োজনে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেও। তবুও অশান্তি কইরো না।’
অরুণা চলে যেতেই পল্লব গম্ভীর স্বরে শবনম’কে বলল,
-‘মহিলাদের সমস্যা মহিলারাই সামলাও।’
বলেই পলাশ’কে ইশারা করে চলে গেল সে৷ কিন্তু পলাশ এক পা’ও নড়লো না। সে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল শাহিনুরের তেজস্বী মুখশ্রীর দিকে। সহসা চট করে প্রেমে পড়েও গেল। এতদিন সে শাহিনুর’কে শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তু সরূপ চাইতো। কচি দেহের প্রতি কামাতুর ছিল। কিন্তু আজ শাহিনুরের মাঝে অন্যরকম এক সৌন্দর্য খুঁজে পেল। যা তার অনুভূতি’কে চট করেই চঞ্চল করে তুলল। আগাগোড়া দৃষ্টিপাত করল শাহিনুর’কে। শাহিনুরের শারীরিক গঠনের পরিবর্তন হয়েছে। কিশোরী ভাব সরে গিয়ে যুবতিতে পরিণত হয়েছে। তার আঁটসাঁট দেহে দুস্তর যৌবনের আভাস স্পষ্ট। পলাশের মাথা চনমনিয়ে ওঠল। চোখের সামনে এত কাছে শাহিনুরের যৌবনশ্রী দেখে পুরুষত্ব জেগে ওঠল। অদ্ভুত এক শব্দ করে অধর কামড়ে ধরল। তার অশ্লীল দৃষ্টি দেখে শাহিনুর চোখ,মুখ শক্ত করে শবনম’কে বলল,
-‘ বড়ো ভাবি ময়না’কে নিয়ে অন্দরে আসুন।’
চোখের পলক বৈঠকখানা ত্যাগ করল শাহিনুর। শরীরের শিরায় শিরায় জ্বলতে শুরু করল পলাশের। মস্তিষ্ক থেকে যেন রক্তের ফোয়ারা ছুটতে শুরু করল। কোনক্রমেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না সে। বাঁধ্য হয়ে পল্লব’কে নিজের অনুভূতির কথা জানাল।
পল্লব বলল,
-‘তুই ভুল করছিস। এখনো ঐ মেয়ের আশা কেন করছিস? মেয়েটা আমাদের ছোটো ভাইয়ের বউ। সবচেয়ে বড়ো কথা যে আশায় ছিলি সেটা আর সম্ভব না।’
বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসল পলাশ। বলল,
-‘একদিনের জন্য হলেও ও’কে আমার চাই।’
-‘বাসি জিনিসের প্রতি এত আকর্ষণ? টাটকা এনে দেব তবুও ওর কথা ভুলে যা।’
-‘যতকাল নারীর দেহে যৌবন আছে ততকাল সে দেহ বাসি হয় না। ঐ নারী’তে যে সুধা আছে, তা আমি পান করেই ছাড়ব!’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.