সকাল সকাল রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছে নূর।আজ নাফিসা শিকদার আসবে এই বাড়িতে। মায়ের জন্য নিজের হাতে রান্না করছে নূর।আশমিন শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মায়ের জন্য মনে এতো ভালবাসা থাকে বুঝি?তবে তার নেই কেন? মা নামক অনুভূতি গুলো তার কাছেই কেন ভোতা মনে হয়? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নূরের কাছে গিয়ে দাড়ালো আশমিন। কিচেনের সবাই আশমিন কে দেখে সরে গেলো।
— অসুস্থ শরীরে এভাবে লাফালাফি করছো কেন নূর? এসব করার জন্য মানুষ আছে।রুমে গিয়ে রেস্ট করো।
নূর আশমিনের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসলো। উৎফুল্ল গলায় বলল,
— এই দেখুন, আমি বাঙালি খাবার রান্না করছি।আসলে আম্মু কি খেতে পছন্দ করে বুঝতে পারছি না। আম্মু কে নিয়ে কোন কিছু আমার খুব একটা মনে নেই।(উদাস গলায়)।তাই এগুলো ই করলাম।এতো দিন দেশের বাইরে থেকে আম্মু নিশ্চয়ই এই খাবার গুলো মিস করেছে।আপনি একটু টেস্ট করে বলুন তো কেমন হয়েছে।
আশমিন যেন হিংসায় জ্বলে গেলো। তার জন্য তো কোনদিন রান্না করে নি।এখন শ্বাশুড়ির জন্য রান্না করে তাকে দিয়ে টেস্ট করাচ্ছে! কি হৃদয়হীন মহিলা!
আশমিন গমগমে গলায় বলল,
— ভালো হয়নি।দেখতেই বিদঘুটে লাগছে।তুমি রুমে যাও। শেফ রান্না করে দিবে।
নূর ভ্রু কুচকে ফেললো। খাবার গুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে চিন্তিত গলায় বলল,
— কি বলছেন!আসলেই খারাপ দেখাচ্ছে? আমি কতো কষ্ট করে রান্না করলাম! আমার রান্না তো খারাপ হয় না। আমি বরং আবার রান্না করি।
আশমিন চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। নূর আবার নতুন উদ্যমে রান্না শুরু করেছে। আশমিনের মন চাইলো এই মেয়ে কে নিয়ে হাত পা বেধে সুইমিংপুলে ফেলে দিতে। সে তার শ্বাশুড়ি কে হিংসে করছে!লোকে শুনলে কি বলবে? তাকে তো নিম্নমানের হিংসুটে বলে আখ্যায়িত করবে। ছেহঃ
নূর একবার আড়চোখে আশমিনের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিলো। মনে মনে বিস্তর পরিকল্পনা করে ফেললো আশমিন কে জ্বালানোর।
নাফিসা শিকদার নূর মঞ্জিলে পৌছালো বেলা সারে এগারোটায়। আশমিন গেট থেকে এগিয়ে আনলো তাকে। ছলছল চোখে চারিদিকে চোখ বুলাচ্ছে সে।আজ কতগুলো বছর পরে এ বাড়িতে তার আগমন হয়েছে। কিন্তু তার সবচেয়ে কাছের মানুষ টা ই আর নেই।চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো নাফিসা শিকদারের।
ড্রয়িং রুমে বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছে নূর। তার অস্থির দৃষ্টি দরজাতেই নিবদ্ধ।নাফিসা শিকদার কে হুইল চেয়ারে দেখেই ছুটে গেলো তার কাছে।মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে শব্দ করে কেদে ফেললো নূর। নাফিসা শিকদার আগলে ধরলো মেয়েকে।মাথায় হাত বুলিয়ে সে ও অশ্রু ঝরাচ্ছে। আশমিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মা মেয়ের মিলন দেখে বুকে প্রশান্তির সাথে সাথে আবার ও হিংসা উকি দিলো।তার সাথেও তো কতদিনের বিচ্ছেদ ছিল।কই,তাকে তো এভাবে গলা জরিয়ে ধরে নাকের পানি চোখের পানি ঝরায় নি! উল্টো আরেকজনের ঘাড়ে তাকে তুলে দিতে উঠে পরে লেগেছিলো।
সে হিসেবে তার ও একটা ঝাপ্পি পাওনা আছে।আজ তা আদায় করে নিতে হবে। আশমিন ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে তার রাজকন্যা দের কাছে চলে গেলো। সুখ হাত পা নাড়িয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করছে।পাখি এক হাত মুখে ঢুকিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। আশমিন সুখ কে কোলে তুলে নিলো। পাখি সেদিকে তাকিয়ে আবার নিজের হাত খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। সুখ কে কিছুক্ষণ আদর করে পাখিকে কোলে নিয়ে ও কিছুক্ষণ আদর করলো আশমিন। ঘড়িতে আবার চোখ বুলিয়ে মা মেয়ের গলা জড়াজড়ি দেখলো।আমজাদ চৌধুরী কান্নার শব্দে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। মায়া বেগম রান্নাঘরের এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সানভি মায়া বেগমের লাগেজ নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। আশমিন রাফসান শিকদারের রুমে লাগেজ রাখতে বলে নূরের কাছে গেলো। শান্ত গলায় বললো,
— মামি মা অনেক দূর থেকে এসেছে নূর। তাকে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করতে দাও।তারপর যতখুশি কেদো।চাইলে প্রতিদিন এক ঘন্টা করে কাদতে পারো।এখন আমাদের খেতে দাও।
নূর নাফিসা শিকদার কে ছেড়ে খাবার বারতে চলে গেলো। আশমিনের বাকা কথার শোধ পরেও নেয়া যাবে।
আশমিন সুখ পাখি কে নাফিসা শিকাদের কোলে দিলো।নাতনিদের দেখে আবার ও চোখ ভরে এলো তার। আমজাদ চৌধুরী আর নাফিসা শিকদারের সামনে গেলো না লজ্জায়।নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে গেলো সে। মায়া বেগম খাবার গরম করার দায়িত্ব নিজে নিয়ে নূর কে পাঠিয়ে দিলো নাফিসা শিকদার কে ফ্রেশ হতে সাহায্য করতে।
নূর বিনাবাক্যে চলে গেলো নাফিসা শিকদার কে ফ্রেশ হতে সাহায্য করতে।
সারাদিন মায়ের কাছে ই ছিল নূর।আশমিন বাসায় এসেছে রাত আট টায়। এখন রাত এগারো টা বাজে নূরের আসার খবর নেই।মেজাজ চরম খারাপ হলো আশমিনের। নাফিসা শিকদারের রুমে গিয়ে দেখলো মেয়েদের নিয়ে নাফিসা শিকদারের পাশেই শুয়ে ঘুমিয়ে পরেছে নূর। মেয়েরা ও মায়ের পাশে আরামসে ঘুমাচ্ছে। নাফিসা শিকদার বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আশমিন মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো। মেয়েদের কোলে নিয়ে বললো,,
— আমি বউ মেয়ে ছাড়া ঘুমাতে পারি না। মেয়েদের রেখে বউ কে নিতে আসছি।
নাফিসা শিকদার শব্দ করে হেসে ফেললো। আশমিন মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে গেছে। মেয়েদের রেখে নূর কে ও নিয়ে এলো রুমে। নাফিসা শিকদার হাসলেন। মেয়ে তার আশমিনের সাথে সুখেই আছে।
নির্বাচন নিয়ে ভিষণ ব্যস্ত আশমিন। দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে আশমিন। গত বার রাফসান শিকদার তার মাথার উপর ছায়ার মতো ছিল।কোন ঝড় ঝাপটা তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। কিন্তু এবার সেই বৃক্ষের ছায়া তার মাথার উপর নেই। সব কিছু সামলে হিমসিম খাওয়ার অবস্থা। কিছু দিন যাবত পদ ছেড়ে দেয়ার জন্য হুমকি আসছে। দলের উচ্চপদস্থ নেতারা আস্বস্ত করলেও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়।রাজনীতি তে হাত নোংরা হবে এটা স্বাভাবিক। আশমিন এর শেষ দেখে ছাড়বে।
মিটিং মিছিল নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নূর আর মেয়েদের সময় দিতে পারছে না ঠিক মতো। সকালে বাসার থেকে বের হলে একেবারে মধ্যরাতে ফিরতে হয়। নূর কে নিয়ে কিছুটা চিন্তিত সে।লুবানার চোখের অপারেশনের জন্য তাকে কানাডা পাঠানো হয়েছে। অমি অফিস সামলে আবার নূরের দিকে ঠিক করে সময় দিতে পারছে না। আশিয়ান কে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না আশমিন। তাই তাকে এসবে জরানো ঠিক মনে করছে না।কয়েক দিন হলো নূর অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। ম*রার উপর খারার ঘা হয়ে আবিস্কার হয়েছে তানভীর। নূরের চারিদিকে মৌমাছির মতো ঘুরঘুর করতে থাকে। নির্বাচনের ঝামেলা টা মিটে গেলেই মৌমাছির পাখনা ভেঙে দিবে সে।
আশমিনের বাসায় এলো রাত আড়াই টায়।নূর তখনো জেগে। মেয়েদের নিয়ে এদিক সেদিক হাটাহাটি করছে।একজন কে ঘুম পারালে আরেকজন জেগে যায়। আকিকা দিয়ে মেয়েদের নাম রেখেছে আশমিন।একজনের নাম নুরাইসা জায়িন চৌধুরী সখ।আরেকজনের নাম নুবাইতা জায়িন চৌধুরী পাখি। অবশেষে নূরের পছন্দ করা নাম ই তাকে রাখতে হয়েছে।সে ও মনে মনে ষড়যন্ত্র করে রেখেছে।যতদিন নিজের পছন্দ মতো নাম সে রাখতে পারবে না ততদিন সে বাবা হওয়ার প্রসেস বন্ধ করবে না। এতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়ে চায়নার সমান হয়ে যাক। তাতে কিছু যায় আসে না। দেশের একজন গণ্যমান্য মন্ত্রী হয়ে তার এমন ভাবনা যথেষ্ট লজ্জাজনক। কিন্তু তার ই বা কি করার আছে! বউ কে বাগে আনার এই একটা ই রাস্তা।
আশমিন ক্লান্ত পায়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। আজ সারাদিন পেটে বিশেষ কিছু পরেনি।ব্যস্ততার দরুন খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না ঠিক মতো।মেয়েকে দোলনায় শুয়িয়ে আশমিনের দিকে তাকিয়ে নিজেই নূর গেলো খাবার গরম করতে।