তোমাকে - মুন্নী আক্তার প্রিয়া
সময় গড়িয়েছে। পার হয়েছে বহু সেকেন্ড, মিনিট। কয়েক, কয়েক কোটি! বসন্ত গিয়েছে আবার বসন্ত এসেছে। চারিপাশে শুধু বসন্তের শুভেচ্ছা। ঘ্রাণ! নানান রঙের কাপড় ও মাথায় ফুলের ক্রাউন দিয়ে মেয়েরা হেঁটে চলেছে তার সঙ্গীর হাত ধরে। কখনো বা হাসতে হাসতে খুনসুটি করছে। কী নিখুঁত সুন্দর সেই হাসি। ভুবন ভোলানো যাবে নিঃসন্দেহে। খুব জানতে ইচ্ছে করে, সময় কেন থেমে থাকে না? কেন রঙিন দিনগুলো এত তাড়াতাড়ি চলে যায়? ইশ! যদি একবার ফিরিয়ে আনা যেত সেই সময়গুলো! না, আসবে না সেদিন। আর কখনোই আসবে না। সবার যখন মনে বসন্তের ছোঁয়া তখন পরীর জীবন রঙহীন। যেমনটা সাদাকালো। সাদাকালো রঙহীন জীবন খুব বিচ্ছিরি খুব। এমন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা মরা লাশের মতোই। ব্যলকোনিতে দাঁড়িয়ে কপোত-কপোতীদের চলাফেরা দেখছিল। বসন্তের সাজ আজ সবার গায়ে। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা নোনাজল। রাতে ফেসবুকে ঢুকে দেখেছে মেহনুবার পোষ্ট। প্রেগন্যান্ট মেহনুবা। অথচ এই খবরটি মেহু পরীকে দেয়নি। কাল রাতেও ফোনে কথা হয়েছে দুজনের। তবুও জানায়নি। কষ্ট হয় পরীর। বুক ফেঁটে কান্না চলে আসে। কাঁদে না। নিজেকে মানানোর চেষ্টা করে পরী। কিন্তু হায়! না মন সেটা বোঝে আর না চোখ বাঁধা মানে।
“তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি
তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি;
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে,
বলো কীভাবে বোঝাই ভালোবাসি।”
ফোনের রিংটোন বাজছে। তুর্য গান গেয়ে সেটা পরীর ফোনে টোন সেট করে দিয়েছিল। ভালোবাসি যখন বলে তখন কী যে ভালো লাগে! মনে হয় এই মানুষটার জন্যই বেঁচে থাকা। পরী রুমে গিয়ে দেখে তিথি হোয়াটসএপে ফোন দিয়েছে। তিথির ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। গুলুমুলু একদম। দেখতে প্রান্তর মতো হয়েছে। ছোট ছোট হাত-পা দিয়ে যখন হামাগুরি দেয় তখন ইচ্ছে করে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে রাখি। প্রান্তর নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে পৌষি। তিথি পৌষিকে শিখিয়েছে পরীকে মা বলে ডাকতে। আধো আধো বুলিতে পৌষি পরীকে মা বলেই ডাকে। আনন্দে তখন চোখের কোণে তখন পানি চলে আসে। পরী ফোন রিসিভ করে। ভিডিও কলের ওপাশে রয়েছে তিথি আর পৌষি। তিথি পৌষির হাত নাড়িয়ে বলে,
“তোমার বড় মা কে হাই বলো।”
পৌষি এক গাল হেসে হাত নাড়ায় আর ‘মা’, ‘মা’ বলে। পরী না চাইতেও কেঁদে ফেলে। তিথি বলে,
“কী ভাবি? তোমাকে না বলেছি তুমি কাঁদবে না?”
“কী করব বোন? মন যে মানে না।” চোখের পানি মুছে বলে পরী।
“তুমি না কত স্ট্রং গার্ল? তাহলে ভেঙে কেন পড়ছ? আমরা আছি তো তোমার সঙ্গে।”
“অপূর্ণতা আর ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর ভয় একটা শক্ত মনের মানুষকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয় তিথি। এই কষ্ট যেন কখনো কাউকে পেতে না হয়!”
পরী আর কথা বলে না। লাইন কেটে দেয়। তিথি আবার কয়েকবার ফোন দেয় কিন্তু পরী কোনো রেসপন্স করে না। ফ্লোরে বসে দেয়ালের সাথে মাথা হেলান দেয়।
দুজনে আলাদা হওয়ার মাস দুয়েক পরেই তাহমিনা বেগম ওদের মেনে নিয়েছিল। কেঁদে কেঁদে তুর্যর কাছে মাফ চেয়েছিল। সব মিটমাট হলেও দুজনে আলাদা বাসাতেই থেকেছে তুর্যর অফিসের সুবিধার্থে। বৃহস্পতিবার রাতে পরীকে নিয়ে বাসায় চলে গেছে আবার শুক্রবার রাতে পরীকে নিয়ে চলে এসেছে। তখন সবাই খুব খুশি ছিল। তবুও পরীর মনে হতো এখনো পরীর ওপর তাহমিনা বেগম রাগ কিঞ্চিৎ হলেও আছে। হয়তো তুর্যকে হারানোর ভয়েই বলতো না। পাশের বাড়ির ঐ আন্টিদের সাথেও কথাবার্তা তেমন বলতো না। পরীর কোনো দোষও ধরত না। একদিন পরী তুর্যর বুকের ওপর মাথা দিয়ে শুয়েছিল। তুর্য এক হাতে পরীকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে পরীর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। পরী আদুরী কণ্ঠে বলেছিল,
“এক বছর গেলেই আমরা একটা বাবু নেব হ্যাঁ?”
তুর্য হেসে বলেছিল,
“মায়ের মন সম্পূর্ণ জয় করতে?”
“তুমি এত বোঝো কীভাবে বলো তো?”
“ভালোবাসি যে।”
“আমিও বাসি। খুব বেশি। এখন বলো না!”
“তোমার পড়াশোনা শেষ হলে।”
“পড়াশোনা শেষ হতে তো অনেক দেরি।”
“তাতে কী?”
“না, এত দেরিতে না। আমার আগেই বাবু চাই।”
“তোমার পড়াশোনায় ক্ষতি হবে।”
“হবে না। আমার বাবু চাই মানে বাবু চাই।”
“আচ্ছা আগে এক বছর যাক।”
“না। তুমি পরে ভুলে যাবে। আমায় কথা দাও।”
“কী পাগলামি শুরু করলে?”
“জানি না। আমি বাবু চাই।”
তুর্য সেদিন পরীকে কথা দিয়েছিল। বলেছিল পরী যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়বে তখনই বাবু নেবে। পরী রাজি হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ্ বোধ হয় ওদের সহায় হননি। এত এত ভালোবাসায় হয়তো কারো নজর পড়েছিল। কথায় আছে সুখের পর দুঃখ আসবেই। সুখ ও দুঃখ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পরীর কপালেও সুখ বেশিদিন টিকল না। কোনোমতেই বাচ্চা নিতে পারেনি। ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে টেস্ট করে দুজনেরই। পরে জানা যায়, পরী মা হতে পারবে না কোনোদিন। সেদিনটা ছিল পরী আর তুর্যর জীবনে বিষাদময়, ভয়ংকর একটা দিন। যদি সুযোগ থাকত তাহলে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে এই দিনটা মুছে দিত। সেদিন দুজনই কেঁদেছিল। পাগলের মতো কেঁদেছিল দুজনকে জড়িয়ে ধরে। এই একটা অপূর্ণতা পরীর মনে আরো একটি ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। তুর্যকে হারানোর ভয়! তুর্য বলেছিল পরীকে কোনোদিনই ছাড়বে না। তুর্য কথা রেখেছেও। এখনো ছেড়ে যায়নি পরীকে। আগের মতোই এখনো ভালোবাসে। কিন্তু তবুও একটা অপূর্ণতা দুজনকে কুড়ে কুড়ে খায়। পরীর অক্ষমতা তুর্যকেও বাবা হওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করছে। কিন্তু পরীরই বা কী করার আছে? পরী যে তুর্যর সাথে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারবে না। কখনো না।
.
তুর্য অফিস থেকে এসে শুয়ে পড়েছে। ক্লান্ত লাগছে খুব। মেহনুবাকে ফোন করে পরী। মেহনুবা ফোন রিসিভ করে বলে,
“কেমন আছিস? বিকেলে ফোন দিলাম ধরলি না কেন?”
“কাজ করছিলাম।”
“ওহ। এখন কী করছিস?”
“তোর সাথে কথা বলছি।”
“খেয়েছিস?”
“তোর ঠিকমতো খাওয়া উচিত।”
মেহনুবা চুপ করে থাকে। কিছুটা আন্দাজ করতে পারে পরীর কথা। পরী বলে,
“আমি পর হয়ে গেছি তাই না মেহু? নাকি তুইও আমায় ঘৃণা করিস?”
“এসব তুই কী বলিস পরী?”
পরী হাসে। বিষাদময় সেই হাসি!
“ভুল কী বললাম বল? তুই প্রেগন্যান্ট। অথচ একটাবারও আমায় বললি না। আমার নজর লাগবে বলে? যদি বাচ্চার ক্ষতি হয় এই ভয়ে? আমি তো অপয়া, অলক্ষী। আমার নজর লাগতেও পারে।”
“প্লিজ পরী! আমায় ভুল বুঝিস না তুই। আমি কীভাবে বলতাম বল? যেখানে একটা বাচ্চাই তোর এত কষ্টের কারণ। তুই আবার কষ্ট পাবি ভেবে আমি বলিনি।”
“কষ্ট পাইনি। ভীষণ খুশি হয়েছি। তোদের জীবনে নতুন অতিথি আসছে। অনেক শুভেচ্ছা রইল। ঠিকমতো খাবি। নিজের খেয়াল রাখবি। রাখছি।”
ফোন কেটে লম্বা দীর্ঘশ্বাস নেয় পরী। বারান্দা থেকে রুমে গিয়ে দেখে তুর্য গোসল করে বেরিয়েছে। পরীকে দেখে বলে,
“রেডি হয়ে নাও।”
“ঐ বাসায় যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“আমি যাব না।”
“কেন?”
“জানোই তো কেন। ঐ বাড়িতে গেলে আমার খুব কষ্ট হয়। কারো মুখোমুখি আমি হতে পারি না। আম্মু তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়। আমি এসব শুনতে পারি না তুর্য। আমি তোমায় কারো সাথে ভাগ করতে পারব না।”
“এতদিন কি ছেড়ে গিয়েছি আমি? বিয়ে করলে আগেই করতাম।”
পরী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের কষ্টটা তুর্যকে বোঝাতে পারে না। ঐ বাড়িতে যাওয়ার পর দরজা খুলে দেয় তাহমিনা বেগম। চোখেমুখে রাগ। কোনোকিছু না বলেই দরজা খুলে দিয়ে চলে যায়। দিশান দৌঁড়ে আসে। পরীকে বলে,
“কেমন আছো ভাবি?”
“ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আমি তো ভালো আছি।”
“বাবা কোথায়?”
“ঘরে।”
পরী আর তুর্য শ্বশুর-শ্বাশুরীর রুমে যায়। পরীর ওপর শ্বশুরও অসন্তুষ্ট সেটা বোঝে পরী। তুর্য জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো তোমরা?”
“যেমনটা রেখেছিস।” বলেন তাহমিনা বেগম।
“আমার ওপর রেগে আছো মা?”
“তুই বুঝিস আমার রাগ? কখনো তোর কাছে কিছু চেয়ে পেয়েছি আমি? আমার কোনো কথাই শুনিসনি তুই। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি এই অপয়া মেয়েটাকে মেনে নিয়েছি। কিন্তু কী দিল এই মেয়ে? সংসারটা ছাড়খার করে দিল। এত বছরেও একটা নাতি-নাতনি দিতে পারল না। তোর বাবা আর আমি কত বছরই বা বাঁচব। নাতি-নাতনির মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না আমাদের? খেলতে ইচ্ছে করে না নাত-নাতনি নিয়ে? আমার যদি আরো একটা ছেলে থাকত তাহলে তোরে বলতাম না আরেকটা বিয়ে কর। তুই তো বিয়েও করবি না। এই মেয়ে তো তোর মাথা চিবিয়ে খাইছে। তুই আমাদের একমাত্র ছেলে বাবা। তুই আরেকটা বিয়ে না করলে আমাদের বংশ কীভাবে এগোবে বল? আমাদের স্বপ্ন পূরণ করবি না তুই? আমি তো বলিনি পরীকে ডিভোর্স দিতে। ও থাকুক। ছেলেরা কি দুই বিয়ে করে না? তাছাড়া তুই তো আর এমনি এমনি করবি না। পরী যদি মা হতে পারত তাহলে তো অন্য বিয়ে করার দরকার পড়ত না।”
একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি আবার বলেন,
“বাবা আমার কথাটা শোন। তুই আবার বিয়ে কর বাবা। নাতি-নাতনির মুখ দেখে আমরা যেন মরতে পারি। তোর সুখ দেখে মরতে চাই আমরা।”
পরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তুর্য মাথা নিচু করে বসে আছে।
তবে কি পাল্টে যাবে তুর্য?

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.