রাতের আকাশে অজস্র তারার মেলা বসেছে।চারিদিকের ভ্যাপসা গরমের কারনে সবার জীবন ওষ্ঠাগত। ছাদের দোলনায় বসে গরমের তীব্রতা আন্দাজ করতে পারছে নূর। সারাদিন এসির ভেতর থেকে গরমের তীব্রতা উপভোগ করার সুযোগ হয় না।পূর্বপুরুষদের অর্জনের জন্য এই বিলাসবহুল জীবন তার।কি হতো যদি এতো বিলাসিতা না থাকতো?আর পাচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো তারাও না হয় সংগ্রাম করে বেচে থাকতো।দামী গাড়িতে না চড়ে লোকাল বাসে চড়ে সবার মতো সাধারণ জীবন যাপন করতো। দিন শেষে আপন মানুষগুলো কে পাশে তো পাওয়া যেতো। কি হবে এতো অর্থ পতিপত্তি দিয়ে।আভিজাত্য যদি দিন শেষে নিঃসঙ্গতা দেয় সেই আভিজাত্য তো অভিশাপ স্বরুপ। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নূরের।পেটে হাত রেখে অনুভব করলো নিজের অস্তিত্ব কে। মা হওয়ার সংবাদ তাকে আশমিন ই দিয়েছে। চোখে মুখে তার কি নিদারুণ জোত্যি ছিল।ভাবতেই নূরের ঠোঁটে বিষাদের হাসি ফুটে উঠলো। কি হতো তাকে একটু ভালবাসলে? মিথ্যা ভালবাসি না বলে সত্যি ঘৃণা করি বলে নাহয় গু*লি ই করে দিতো।মৃ*ত্যু যন্ত্রণা হয়তো এই মিথ্যার যন্ত্রণার থেকে কম ই হতো। এই যে ক্ষনে ক্ষনে বুক ভারি হয়ে আসে।কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে থেকে মরণ যন্ত্রণা দেয়।এর চেয়ে কি মৃত্যু ভালো ছিল না?
আহা কষ্ট! এই কষ্ট তার পিছু কেন ছারছে না?আর কতটা যন্ত্রণা ভোগ করলে কষ্ট তাকে রেহাই দিবে?
— এখানে কি করছো নূর?
আমজাদ চৌধুরীর কথায় চোখ তুলে তাকালো নূর।বিষাদমাখা হাসি দিয়ে আবার আকাশ দেখায় মন দিলো। আজকাল কাউকে তার সহ্য হয় না। আসেপাশের সবাইকে প্রতারক মনে হয়। এতো মানুষের ভিড়ে তার কেন একজন আপন মানুষ নেই এই ভেবেই দিনের অর্ধেক টা সময় কেটে যায়।
আমজাদ চৌধুরী এসে নূরের পাশে বসলো। নূরের মলিন চেহারা দেখে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো। কিছু না করেও এই মেয়েটাকেই সব কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেন?
— রাত হয়ে গেছে তো মা।এই সময়ে এভাবে এখানে বসে থাকতে নেই।
— ঘরেই যদি জান নেয়ার মানুষ থাকে তাহলে বাইরে আর কিসের ভয়?
আমজাদ চৌধুরী হচকচিয়ে গেলো। হতভম্ব গলায় বলল,
— কি বলছো মা?
— একটা গল্প শুনবে আংকেল? এক অভাগী রাজকুমারীর গল্প।
আমজাদ চৌধুরী শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। নূর হালকা হেসে বলতে শুরু করলো,
— এক দেশে এক রাজকুমারী ছিল।রাজা রানীর চোখের মনি। হেসে খেলে তাদের জীবন পার হচ্ছিল। একদিন হুট করেই তাদের জীবনে অতীত হানা দিল।রাজার বোন প্রেমে পড়েছিল এক ভীনদেশী যুবকের।রাজার অগোচরে রেজিষ্ট্রি করে বিয়েও করেছিল তারা।
একমাত্র বোনের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি রাজা।ক্ষুব্ধ হয়ে বোনের কাছে গেলো জবাব চাইতে। বোন নিজের ভালোবাসার কথা জানালে রাজা তাদের মানতে অস্বীকৃতি জানান। বোন ও জেদ ধরে রাজার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়।রানী দুজন কে থামাতে ব্যর্থ হলে রাজার বোন কে বোঝায় আপাতত রাজার কথা মেনে নিতে। বোন তাকে অপমান করতে পিছ পা হয় না। বড় বোনের মতো ভাবির গায়ে হাত তুলতে ও পিছ পা হয় না। প্রেয়সীর গায়ে আঘাত সহ্য করতে পারে না রাজা।সকল রাগ গিয়ে জমা হয় ভীনদেশী যুবকের উপর। আঘাত করে বসে বোনের স্বামী কে।দুর্ঘটনা বশত মৃত্যু হয় তার। স্বামীর মৃত্যুর শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যায় বোন।
মৃত্যুর কারণ ধামাচাপা দিলেও বোনের নজরে থেকে যায় আজীবন দোষী। দুই মাসের অন্তসত্তা বোন কে নিয়ে বারবার আফসোস করতে থাকে রাজা।বোনের নীরবতা তাকে বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে নিজের অপরাধ দেখিয়ে দিচ্ছিলো। হাতে পায়ে ধরেও ক্ষমা পায় নি সে। নয় মাস পরে এক ফুটফুটে ছেলের জন্ম দেয় সে। ছেলে জন্ম দেয়ার তিন মাস পর বিয়ে করে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে। যাকে ভালোবাসলেও আজ পর্যন্ত স্বামীর অধিকার দিতে পারে নি। নিজের প্রথম ভালবাসাকে ভুলে এগিয়ে যেতে পারে নি সে। ছেলে কে সব সময় নিজের থেকে দূরে রেখেছে সে।ছেলের মুখের আদল বারবার তাকে তার ভালবাসার মানুষ টির কথা মনে করিয়ে দিতো। যাকে তার ভাই খু*ন করেছে। প্রতিশোধের আগুনে বারবার নিজের স্বত্তা কে জ্বালিয়ে ভাইকে ধ্বংসের খেলার নেমেছে সে। ক্ষমা করার ভান করে তাকে বারবার আঘাত করেছে।ঠান্ডা মাথায় তার প্রিয়তমা স্ত্রী কে খু*ন করে এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দিয়েছে। দেখাশোনার নাম করে রাজার আদরের রাজকুমারী কে চাকরানীর মতো ট্রিট করেছে। প্রথম স্বামীর বোন কে দিয়ে রাজা কে সিডিউস করেছে। সেই সন্তানদের কেই তাকে ধ্বংস করার কাজে লাগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলেকে দিয়ে,,,,(তাচ্ছিল্যের হেসে)
আচ্ছা আংকেল, এক ভুলের কতো শাস্তি হয় বলো তো? অনুশোচনার চেয়ে বড় শাস্তি কি এই পৃথিবীতে আর কিছু আছে? এখন রাজকুমারী যদি প্রতিশোধ নিতে চায়! তার মাকে খু*ন করার প্রতিশোধ, তার শৈশব, কৈশোর নষ্ট করার প্রতিশোধ, মিথ্যা সম্পর্কে বেধে দেয়ার প্রতিশোধ, ভালবাসার নামে ঠকানোর প্রতিশোধ, তাকে এই পৃথিবীতে পুরোপুরি এতিম করে দেয়ার প্রতিশোধ, তাকে প্রতারণার মতো মরণ যন্ত্রণা দেয়ার প্রতিশোধ। তখন রাজকুমারী অপরাধী হবে না তো? কিছু না করেও সেই তো সবচেয়ে বেশি শাস্তি পেলো।তার প্রতিশোধ নেয়া অন্যায় হবে না তাই না?
আমজাদ চৌধুরীর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পরছে।নূরের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার।এই তিক্ত সত্যি গুলো নূর কিভাবে জানলো তা নিয়েও মাথা ব্যথা নেই। আশমিন তার ছেলে না হলেও সে তাকে জীবনের চেয়ে ও বেশি ভালোবাসে। নিজের বুকে রেখে মানুষ করেছে তাকে।কখনো বুঝতে দেয় নি সে তার নিজের ছেলে না। একটা সময় এসে আশমিন ও সত্যি টা জেনে যায়। সত্য হচ্ছে সূর্যের আলোর মতো। হাজার মেঘের আড়ালে ঢাকা পরলেও তা একসময় প্রকাশ পাবেই। আশমিন সত্যি টা জানলে ও সবসময় না জানার ভান করে থেকেছে। আগের চেয়ে বেশি তার সাথে শুরু করে। বন্ধুর মতো মিশেছে তার সাথে। এক সিগারেট দুই জন ভাগ করে খেয়েছে কতো। তার বাবা হয়ে সে এখনো ভার্জিন সেই আফসোসে কতো কতো হতাশার শ্বাস ফেলেছে। শুধু মাত্র কামিনীর প্রতিশোধের নেশা সব কিছু শেষ করে দিল। নূরের অসমাপ্ত কথার রেশ প্রমান করছে সে আরো অনেক কিছু জানে।আর চুপ থাকার মেয়েও সে না।ছেলের জন্য বুকের ভিতর আনচান করতে লাগলো আমজাদ চৌধুরীর। সে জানে তার ছেলে কতটা হিংস্র। ঠান্ডা মাথায় বাঘ শিকার করার মতো ছেলে তার।
আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে চুপসে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নূর। তাকে আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বললো,
— চিন্তা করো না আংকেল।আমি প্রতিশোধ নিবো না।প্রতিশোধ শুধু ধ্বংস করে। আমি চাইনা আমার সন্তান আমার মতো জীবন পাক। মন্ত্রী সাহেব কে কিছু জানিয়ো না। সম্পর্কে আর কোন দূরত্ব চাই না আমি। স্বামী সন্তান নিয়ে শান্তিতে সংসার করতে চাই।
আমজাদ চৌধুরী স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। নূরের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ভরাট গলায় বললো,,
— কষ্ট পেয়ো না মা। সব কিছু বাদ দিলেও এ কথা সত্যি, আশমিন তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসে।ওর ধ্যান ধারণা একমাত্র তুমি। তোমার শূন্যতা ওকে কতটা উন্মাদ করে দেয় তা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই। ওকে কষ্ট দিয়ো না।তারাতাড়ি নিচে চলে এসো।আশমিন এসে তোমাকে এখানে দেখলে রাগ করবে।
নূর মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।আমজাদ চৌধুরী ধীর পায়ে নেমে গেলো ছাদ থেকে। নূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,,
— যে ভালবাসা আমাকে বারবার আঘাত করছে সে ভালবাসা দিয়ে আমি কি করবো আংকেল?আমি তাকে কষ্ট দিবো না। সে নিজেই তার কষ্টের কারণ হবে।সব থেকেও সে থাকবে নিঃস্বঙ্গ।যে বিষাদের সাগরে সে আমাকে ফেলে দিয়েছে সেই বিষাদের স্বাদ সে পাবে না তা কি করে হতে পারে? আশমিন জায়িন চৌধুরী যদি তার মায়ের ছেলে হয় তাহলে তেহজিব নূর শিকদার ও তার বাবার মেয়ে।ধোকার পাল্টা জবাব দেয়া তার রক্তের বৈশিষ্ট্য।
— বউ,,,
আশমিনের ক্লান্ত গলা শুনে চোখ তুলে তাকালো নূর।সাদা পাঞ্জাবি তে রাজপুত্রের মতো লাগছে আশমিন কে। মুচকি হেসে হাত বারিয়ে দিল নূর।আশমিন নূরের হাত ধরে ধপ করে এসে বসে পরলো নূরের পাশে। নূরের হাতে চুমু খেয়ে এক হাতে জরিয়ে ধরলো তাকে।নূর ও বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি মেরে আশমিনের বুকে গা এলিয়ে দিলো।
— ছাদে আসতে নিষেধ করেছি না? এতো গুলো সিরি বেয়ে উঠতে কষ্ট হবে তো তোমার। আমি যখন বাসায় থাকবো তখন আমাকে বলবে।আমি কোলে করে নিয়ে আসবো তোমাকে।
আশমিনের কুচকানো মুখ দেখে হেসে ফেললো নূর।কাধে থুতনি ঠেকিয়ে নির্মিশেষে তাকিয়ে রইলো আশমিনের ক্লান্ত চেহারার দিকে।
— এভাবে তাকিয়ে থেকো না তো।আমার লজ্জা লাগে।
— আপনার লজ্জা ও লাগে(অবাক হয়ে)?
— আমি খুব লাজুক ছেলে বুঝলে? প্রথম যেদিন তোমাকে গভীর ভাবে ছুয়েছিলাম সেদিন আমি দুই সেকেন্ড লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। ভাবা যায়! ইসসস,,এতো লজ্জার জন্যই তো সুখবর পেতে বারো দিন দেড়ি হলো। এতো লজ্জা নিয়ে তো বছর বছর বাবা হতে পারবো না।কেমন বউ তুমি?বরের লজ্জা ভাঙ্গাতে পারো না।
নূর হতভম্ব হয়ে রাগ করতেও ভুলে গেলো। দুই মিনিট আশমিনের গলা চেপে ধরার অদম্য ইচ্ছা টাকে ঘুম পারিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো।
Leave a comment