শুভ্র পাঞ্জাবি ছেড়ে সাদা টি-শার্ট পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে আশমিন।চুল থেকে টপটপ করে পানি পরছে। শরীরের থেকে তার মনের ক্লান্তি বেশি।নূর গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।আধঘন্টা আগে স্যালাইন শেষ হয়েছে।এতক্ষণ সে নূরের হাত ধরেই বসে ছিল। নূরের দিকে তাকালে তার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মাথা ভালো করে মুছে টাওয়াল বেলকনিতে দিয়ে এলো আশমিন। নূরের দিকে নির্মিশেষে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। যতই দেখুক না কেন,চোখের তৃষ্ণা মেটে না।নূরের ফোলা পেটের দিকে তাকিয়ে হালকা ঢোক গিললো আশমিন।তাকে পুড়িয়ে ছাই করার অস্ত্র এই ছোট্ট পেটে লুকিয়ে আছে। এখনি সে নিজের করুণ পরিস্থিতি অনুভব করতে পারছে।মনে মনে চিৎকার করে উঠলো আশমিন।তার এতো পরিশ্রমের ফল নিয়ে নূর বাহাদুরি করবে ভাবতেই মুখটা শুকিয়ে গেলো। এক পুকুর কষ্ট নিয়ে নিজেকেই গালাগালি করতে লাগলো, কি দরকার ছিল এতো মেহনত করার? হলো তো এবার! বউ তোমার মেহনত দিয়েই তোমার থোতা মুখ ভোতা করে দিবে।খুশি?
আহ! কি দিন আসলো। এই দিন দেখার জন্য ই সে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আশমিন ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নূরের দিকে। হালকা ঝুকে পেটে কয়েকটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,
— মায়ের কথায় কান দেয়ার কোন দরকার নেই। তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ। ফুলের মতো পবিত্র। বাবার পক্ষে থাকবে সবসময়। তাহলে চকলেট আইসক্রিম পাবে। এটা আমাদের গোপন ডিল।কাউকে বলবে না। ইটস ভেরি কনফিডেনসিয়াল।
আরেকটা চুমু খেয়ে বিজয়ী হাসি হাসলো আশমিন। ডিল করা শেষ। বউ টা ঝামেলা না পাকালেই হয়। এবার ঝামেলা মিটে গেলেই সে তওবা করে ফেলবে।এই জীবনে ডায়েরি নামক কোন বস্তু সে হাতে নিবে না।এতো বছরের গভীর সম্পর্ক থাকার পরেও বউয়ের কাছে ধরা খাইয়ে দিল। মীরজাফর।
নূরের পাশেই শুয়ে পরলো আশমিন।শরীর মন দুটো ই খুব ক্লান্ত। নূর কে বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া জরুরি হয়ে গেছে।
রাত দশটায় পিটপিট করে চোখ খুললো নূর।মাথা টা ভার হয়ে আছে। কারো শক্ত বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। কয়েক বার চোখের পাতা ঝাপটে ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করলো নূর। হালকা ডিম লাইটের আলোতে আশমিনের মুখ দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। চারিদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। নূরের নড়াচড়ায় আশমিনের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। নূর কে আরেকটু শক্ত করে জরিয়ে ধরে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
— মোচড়ামুচড়ি করছো কেন? আমি কি তোমাকে চিমটি দিয়েছি?
— আমি এখানে এলাম কিভাবে(ভ্রু কুচকে)
— তোমার একমাত্র বরের কোলে চেপে। তোমার বর টা যে কি রোমান্টিক না। আহা! ভাবতেই তো হিংসা হয়।
নূর আশমিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আশমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসলো।ইন্টারকম থেকে কল করে তাদের খাবার উপরে পাঠিয়ে দিতে বললো। এক কাপ কফি হলে ভালো হতো। মাথা টা ভার ভার লাগছে। বেড থেকে নেমে নিজের স্টাডি টেবিলের কাছে থাকা কফি মেকার থেকে কফি নিয়ে সোফায় বসতেই ওয়াশরুম থেকে নূর বেরিয়ে এলো। টাওয়ালে মুখ মুছতে মুছতে আশমিনের দিকে আড় চোখে তাকালো। আশমিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নূর টাওয়াল নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। আশমিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে।
আকাশে মেঘের ছড়াছড়ি। কালো মেঘের ফাকে ফাকে বিদ্যুতের ঝলক মাঝে মাঝে পরিবেশ কে আলোকিত করে তুলছে। আশমিনের বারান্দা টা নূরের বারান্দার মতো। বারান্দার পাশেই সুইমিংপুল। ছোট বেলায় বাবার সাথে এখানে কতো সাতার কেটেছে নূর।রাফসান শিকদার নিজে তাকে সাতার শিখিয়েছে। বাবার কথা মনে হতেই চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।
— ভিতরে এসো নূর।খেতে হবে তোমার।মেডিসিন আছে।
রুম থেকে আশমিন ডাকছে। নূর নিজেকে সামলে ভিতরে গেলো। আশমিন টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে।
নূর মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে পরলো। ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,
— এতো আদর করে খাবার খাওয়াচ্ছেন যে বড়।বিষ টিস মিশিয়ে দিন নি তো আবার?
আশমিনের হাত থেমে গেলো। শান্ত চোখে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। নূর খাওয়া শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। আশমিনের বুক ভাড় হয়ে এলো। এতো অবিশ্বাস! হওয়ারই কথা। বিশ্বাস করার মতো কিছু করেনি সে।
— আমার বাবা কে কেন মারলেন মন্ত্রী সাহেব?
আশমিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। আশমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— দরকার ছিল।সে আমার বাবার খু*নি।আমি সহ্য করতে পারিনি নূর। তাকে মারতেই আমি বাংলাদেশ এসেছিলাম। রাজনীতি তে জরিয়ে যাওয়া আমার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। ঠিক ভুল বিচার করার অবস্থায় ছিলাম না নূর।বিশ্বাস করো আমাকে।
আশমিনের কাতর গলা শুনে হাসলো নূর। ঘাড় নেড়ে কয়েক বিশ্বাস শব্দটা কে আওরালো।
— আপনি কি বিশ্বাসের যোগ্য মন্ত্রী সাহেব? আপনার পুরো পরিবার বিষাক্ত সাপের মতো। যত্ন করে বুকে আগলে রাখলেও বুকে কামড়ে দিতে এক বার ও ভাবে না। তা আমাকে কবে মারবেন? আমি ই তো এই পরিবারের শেষ সদস্য। একজনের মৃত্যুর বদলা কতোবার নিলেন মন্ত্রী সাহেব। আমার মা কে মারলেন।আমাকে অত্যাচার করলেন। ভালবাসার অভিনন্দন করলেন।আমার বাবা কে মারলেন। আচ্ছা আমি যদি প্রতিশোধ নিতে যাই তখন কি হবে মন্ত্রী সাহেব?
আশমিন অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর নিজের খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো। আশমিন থম মেরে বসে আছে। সে তো এটা ও বলতে পারবে না যে রাগের বসে সে রাফসান শিকদার কে খু*ন করেছে।সে যা করেছে সব ঠান্ডা মাথায় করেছে। তবে নূর কে সে ভালবেসেই বিয়ে করেছে।সেখানে বিন্দুমাত্র অভিনয় ছিল না। আশমিন জানতো না কামিনী চৌধুরী নূরের মা কে খু*ন করেছে।নূরের উপর হওয়া অত্যাচার সম্পর্কে ও তার কোন ধারণা ছিল না।এসব কিছু সে নূর চলে যাওয়ার পরে জেনেছে। কিন্তু তখন আর তার হাতে কিছুই করার ছিল না।
নূর নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।আশমিন আগের মতোই খাবার সামনে বসে আছে। একবার ও খাবার মুখে দেয়নি সে। আশমিন ধীর পায়ে উঠে স্টাডি টেবিলের প্রয়াত থেকে নিজের গান বের করলো। এলোমেলো পায়ে এসে নূরের দিকে গান এগিয়ে ফিয়ে ধীর গলায় বলল,
— তুমি ও তোমার বাবার খু*নি কে মেরে ফেলো নূর। নিজের প্রতিশোধ নিয়ে নাও।
নূর শব্দ করে হেসে ফেললো। আশমিনের হাত থেকে গান নিয়ে তার মুখোমুখি দাড়ালো।
— মারবো কেন মন্ত্রী সাহেব? আমি তো আপনাকে বাচিয়ে রাখবো। বলেছিলাম না,আমাকে ধোকা দিলে আমি আপনাকে পৃথিবীতেই জাহান্নাম ঘুরিয়ে আনবো। আমি তো আপনাকে ভালবাসি বলেন। ভালবাসার মানুষ কে মে*রে ফেলা যায় বুঝি?
আশমিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। যাক, এ যাত্রায় বেচে গেছে।তবে বাঘিনী যে মনে মনে কোন ভয়ংকর ছক কষছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দোষ না করেও সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিতে হচ্ছে । ম আর মাত্র কয়েকটা মাস।একবার নূরের মায়ের সঠিক ঠিকানা জানতে পারলে কামিনী চৌধুরী কে কবরে বসে বরের সাথে লুডু খেলার ব্যবস্থা করে দিবে। জ্বালিয়ে খেলো।
আশমিন নিজের জান হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই সব ঠিক করতে হবে। নূর কে এসবে জরানো যাবে না কোনভাবেই। কামিনী চৌধুরী কে বোঝাতে হবে সব কিছু তার প্ল্যান মতো ই হচ্ছে।
দরজার সামনে আশমিন কে চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমজাদ চৌধুরী কপাল কুচকে ফেললো।
— রুম থেকে বের করে দিয়েছে?(ভ্রু কুচকে)
— আমি তোমার একটা বউ কে খু*ন করতে চাইছি।তাই আগে ভাগেই আরেকটার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বউয়ের মতো আমার হাড় না জ্বালিয়ে বলে দাও মামুনি কে তোমার বউ কোথায় আটকে রেখেছে?
আমজাদ চৌধুরী আকাশ থেকে পরলো।অবাক গলায় বলল,
— নূরের মা বেচে আছে?
— একদম ঢঙ করবে না। সব জানো তুমি। ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে নূর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়েছে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বউয়ের কাছে অপরাধীর মতো দাড়াতে হচ্ছে। মেন্টাল স্ট্রেস নিতে নিতে যদি আমার বউয়ের কিছু হয় তাহলে তোমার বউ কে আমি ভয়ংকর মৃ*ত্যু দিবো। সে মা কেন মানুষ হওয়ার ও যোগ্য নয়।মেন্টালি সিক সে। মামা কে সে নিজের হাতে মেরেছে আব্বু। তার পরেও কেন এতো ষড়যন্ত্র? আমাদের কে একটু শান্তি তে বাচতে কেন দিচ্ছে না? তার পার্টনার কে সহ তাকে জ্যান্ত যদি না জ্বালিয়েছি আমার নাম ও আশমিন জায়িন চৌধুরী না।
আমজাদ চৌধুরীর মন টা কামিনী চৌধুরীর প্রতি বিষাক্ত অনুভূতি তে ভরে গেলো। কামিনী কি পারতো না সব ভুলে তাকে নিয়ে সুখের একটা সংসার সাজাতে। রাফসান শিকদার কে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে দিলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। সব কিছু বিষিয়ে দিয়েছে সে।
গার্ড ছাড়া গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরেছে আশমিন।সেবার কানাডা গিয়ে তন্নতন্ন করে খুজেছে নূরের মা নাফিজা শিকদার কে। ফলাফল শূন্য। কামিনী চৌধুরীর উপর বাজ পাখির মতো নজর রেখেছে সে।আশিয়ান ডুবাই গিয়ে বসে আছে। এই বজ্জাত কে হাতে পেলে আস্তো রাখবেনা সে।সানভি বিরস মুখে বসে আছে আশমিনের পাশে।আশমিন কে বের হতে দেখে সে ও পিছু নিয়েছে।
— শোন সান,বিয়ে করলেই হুট করে বাবা হওয়ার চিন্তা মাথায় আনবে না।এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত।সব সময় পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হয় না। কখনো কখনো বাশ ও হয়ে যায়। ইউ শুড ইউজড প্রোটেকশন। আমি বিয়ের আগেই তোমাকে দিয়ে দিবো। আচ্ছা বাদ দাও।তোমার বিয়ে ই করার দরকার নেই। বুঝেছো?
সানভি দুঃখী দুঃখী চেহারা করে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। এমনি চলতে থাকলে তার বিয়ে করার স্বাদ এমনিতেই মিটে যাবে।