ইট পাটকেল

হাসপাতালে গম্ভীর মুখে বসে আছে আশমিন। নূর কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে দুই ঘন্টা হতে চললো। আশমিন তখন থেকেই থম ধরে বসে আছে। আট মাসেই সিজার করে ফেলতে হচ্ছে। নূরের কন্ডিশন ভালো ছিল না। একজন হলে সমস্যা হতো না। টুইনস বেবি হওয়ায় সিজার করে ফেলতে হচ্ছে। বাচ্চা উল্টে গেছে।নূর কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা।তখন পেটে আঘাত লাগায় রক্তপাত শুরু হয়।নূর কিডন্যাপ হওয়ার দুই ঘন্টা পরে আশমিন নূরের কাছে পৌঁছেছে।বেবিদের কোন ক্ষতি হয়নি।ব্লিডিং বন্ধ না হওয়ায় এখনি সিজার করতে হচ্ছে। নূরের শরীরের কন্ডিশন খুব একটা ভালো না।আশমিন অমি দের সাথেই একজন ডক্টর পাঠিয়ে ছিল।সে চেকআপ করে নূরের কন্ডিশন বলতেই আশমিন সাথে সাথে নূর কে হসপিটাল নিয়ে এসেছে।
অমি অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আশমিন কে এতো শান্ত দেখে অবাকের সাথে সাথে মেজাজ ও খারাপ হচ্ছে। নূর কে নিয়ে আশমিনের কোন মাথা ব্যথা ই নেই!সানভি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।নূরের জন্য তার খুব খারাপ লাগছে। লুবানা পাশে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে কেদে যাচ্ছে। সানভি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেললো। এই মেয়েকে দেখে তার মাথা ব্যথা হচ্ছে।
আশমিনের ফোন বাজতেই কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে স্থির হয়ে গেলো। আশমিন ফোন রিসিভ করে একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো।
— বলো বাহাদুর।
— নাফিজা ম্যামের খবর পেয়েছি ম্যাম।
— আচ্ছা। এড্রেস পাঠিয়ে দাও।
— এদের কি করবো স্যার?(আমতা আমতা করে)
— মে*রে দাও।এতো গুলো পি*স করো যে বোঝা না যায় এরা মানুষ ছিল।
আশমিনের শান্ত গলায় এমন ভয়ংকর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো বাহাদুর। সে জানে আশমিন কতটা ভয়ংকর। মনে মনে একটু আফসোস হলো এদের জন্য।
— মা*রার আগে মেয়ে গুলোর খোজ নিয়ে নিবে। এদের হদিশ যেন কাক পক্ষি ও টের না পায়।
বাহাদুর সম্মতি দিয়ে ফোন কেটে দিল। আশমিন গিয়ে আবার আগের যায়গায় বসে পরলো। অপারেশন থিয়েটারের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলো। সানভি আশমিনের বসার জন্য ভিআইপি ক্যাবিন নিলেও আশমিন সেখানে যায় নি।তার ভিতরের অস্থিরতা সে কাউকে দেখাতে পারছে না।দম বন্ধ হয়ে আসছে।হুট করেই বসা থেকে দুম করে দাঁড়িয়ে গেলো আশমিন। অপারেশ থিয়েটারের দরজায় নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো। অমি এসে আগলে ধরলো আশমিন কে। আশমিনের সারা শরীর কাপছে।এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলে ও এখন আর তার সহ্য হচ্ছে না। নূর কি অবস্থায় আছে না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই তার।বুকের ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। বুকের যন্ত্রণায় তার শ্বাস আটকে আসছে। আশমিন কে অমি ধরে রাখতে পারছে না।আশমিনের শক্তির সাথে তার মতো দুইটা অমিও কিছু না। সানভি ভয়ে সামনে যাচ্ছে না। লুবানা শব্দ করে কাদছে।
— দরজা খোল,,আমি ভিতরে যাবো।
আশমিনের হুংকার শুনে একজন নার্স দরজা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। সব সময় শান্ত থাকা মানুষ টা কে এভাবে ভয়ংকর রুপে দেখে গলা শুকিয়ে গেলো তার।আশমিন নার্স কে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। নূর কে অপারেশন টেবিলে দেখে তার অশান্ত চোখ গুলো আপনা আপনি শান্ত হয়ে গেলো। ডাক্তার অপারেশন বাদ দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন ইশারায় তার কাজ করতে বলে নূরের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের ফ্যাকাসে মুখের দিকে। অক্সিজেন মাক্স লাগানো নূর কে দেখে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো। কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশমিন। বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। বুকে কয়েক বার হাত বুলিয়ে অসহায় চোখে চারিদিকে চোখ বুলালো। সে অসুস্থ হতে চায় না এখন। নূরের পাসে থাকতে চায়।কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না। বউয়ের সিজার দেখে সে বুক ব্যথায় মরে যাচ্ছে। এমন দুর্বল মন্ত্রী দিয়ে দেশ চলবে!কি লজ্জাজনক ব্যপার।
বাচ্চার হালকা কান্নার আওয়াজে ধ্যান ফিরলো আশমিনের।বুকের ব্যথা ভুলে সেদিকে তাকিয়ে চোখ স্থির হয়ে গেলো। দুজন নার্সের কোলে দুটো রাজকন্যা। রক্তে মাখামাখি তাদের ছোট্ট শরীর পরিস্কার করে তার কাছে নিয়ে এলো বাচ্চাদের।আশমিন শুধু এক পলক দেখার সুযোগ পাবে।তার পর তাদের এনআইসিউ তে নিয়ে যাবে।ওখানেই পনের দিন রাখার পরে তাদের মায়ের কাছে দেয়া হবে। আশমিন একপলক দেখে বাচ্চাদের নিজের কোলে নিলো।নার্স কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আশমিন কে কিছু বলার ক্ষমতা নেই তাদের।একজন হ্যান্ড স্যানিটাইজার করতে বললো মিনমিন করে। আশমিন বাচ্চাদের দিয়ে নিজের হাত স্যানিটেশন করে আবার তাদের কোলে নিলো।দুজনের কানের কাছে আজান দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে তাদের আবার নার্সদের কোলে দিয়ে দিলো।
— অপারেশন হয়ে গেছে স্যার।ম্যাম কে কিছুক্ষণ পরে কেবিনে সিফট করা হবে। আপনি যদি একটু,,
শেষের কথা টা আমতা আমতা করে বলতে গিয়েও থেমে গেলো ডাক্তার।আশমিন আর কিছু বললো না। নূরের কপালে চুমু খেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। বুকের ব্যথা টা এখন কমেছে।প্রিন্সেসদের কোলে নিয়ে অর্ধেক কমে গেছে। বউকে বুকে নিলে পুরোটা চলে যাবে নিশ্চিত। অমি সানভি আর লুবানা বাচ্চাদের দেখে এসেছে একপলক। উত্তেজনায় কখন সানভির হাত জরিয়ে ধরেছে নিজেও টের পায়নি। সানভি লুবানার বাচ্চামো দেখে হালকা হাসলো। রাগ করার ভান করে বললো,
— এই হাত ছাড়ো সাবানা।তোমাকে বিশ্বাস নেই।এখন হাত ধরছো একটু পরে গলা ধরতে আসবে। আমি কোন দুই ইঞ্চি লিলিপুট কে আমার গলা জরিয়ে ধরতে দিবো না। নারী কেলেংকারী হলেও মেনে নেয়া যাবে। কিন্তু বাচ্চা কেলেংকারি হলে আমি মুখ দেখাতে পারবো না।আল্লাহর দোহায় লাগে আমাকে ছেড়ে দাও।
লুবানা ঝামটা দিয়ে সানভির হাত ছেড়ে দিলো। কটমট করতে করতে বললো,
— এমন একটা ভাব করছেন জেন আমি আপনার ইজ্জত লুটে নিচ্ছি। ফালতু যত্তসব। আর আমার নাম লুবানা। আরেকদিন সাবানা বললে আপনাকে সাবান দিয়ে মুচড়ে মুচড়ে ধুয়ে দিবো আমি। ল্যাব পিপলস।
লুবানা গটগট করে চলে গেলো। সানভি বিরস মুখে তাকিয়ে দেখলো তার চলে যাওয়া। অমি কপাল চাপড়ে বললো,
— সমস্যা কি তোমাদের।সতিনের মতো সারাদিন একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকো কেন?আর এই ল্যাব পিপলস মানে কি?(অবাক হয়ে)
— আমার কংকাল ল্যাবে দান করা হয়েছে।তাই আমি ল্যাব পিপলস। (শ্বাস ছেড়ে)
— মানে??
— লম্বা কাহিনি। বাদ দাও।
— হুম।
আমজাদ চৌধুরী হসপিটালে এসেছে পাচ মিনিট হলো। আশমিন হাসপাতালের বিলাসবহুল কেবিনে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। সারাদিনের চিন্তা ক্লান্তি চিন্তায় শরীর ভার ছেড়ে দিয়েছে।আমজাদ চৌধুরীর খারাপ লাগলো ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে।বাড়ি তে নাচতে থাকা বিপদের কথা কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না।কামিনী চৌধুরীর উপর বিতিষ্ণা চলে এসেছে। তবুও সে ঘৃণা করতে পারে না তাকে।একেই বুঝি ভালবাসা বলে।
— বউ ছেড়ে আসতে মন চাইলো?তুমি তো দিন দিন বউ পাগল হয়ে যাচ্ছো।পুরুষ মানুষের এমন বউ পাগল হলে চলে!
আশমিনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো আমজাদ চৌধুরী।কে এই কথা বলছে! যে নিজেই সারাদিন বউয়ের আগে পিছে ঘুরঘুর করে।
— ক্লান্ত লাগছে আব্বু।
আমজাদ চৌধুরীর মায়া হলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— নূরের কি অবস্থা?
— ভালো।
— আমার নাতনি রা কেমন আছে?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আব্বু।এই এটুকু হয়েছে(হাত দিয়ে ইশারা করে) আশমিন জায়িন চৌধুরীর মেয়েরা কিনা ইদুরের বাচ্চার সাইজ নিয়ে দুনিয়ায় এলো! ওদের কান্না ও ঠিক ভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম না।চোখ খুলে আমাকে দেখেনি ওরা।আমার নূরের কতো কষ্ট হয়েছে! সব কয়টা কে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো আমি।কার কলিজায় হাত দিয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।(দাতে দাত চেপে)
— ওদের তুমি এখনো বাচিয়ে রেখেছো এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছো?(ভ্রু কুচকে)
— ওরা তো চুনোপুঁটি আব্বু।রাঘববোয়ালদের ধরা এখনো বাকি।সব কয়টা কে ইঞ্চি দিয়ে মেপে মেপে সাইজ করবো।
— আচ্ছা বাদ দাও। ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।একটু রেস্ট নাও।
— দুই দুইটা মেয়ে পৃথিবীতে আনা চারটি খানি কথা! তুমি কি বুঝবা।নিজে দুই বাচ্চার বাপ হয়েও ভার্জিন বাপ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। তুমি আমার মান সম্মান ধূলিসাৎ করে দিলে। এ জীবন দিয়ে কি হবে আমার।শুধু বউ টার জন্য বেচে আছি।না হলে মসজিদের দান বক্সে দান করে দিতাম।
আমজাদ চৌধুরী হনহন করে বেরিয়ে গেল। এই ছেলের জন্য মায়া দেখানো তার জীবনের চরম ভুল।

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.