‘লোভ’ মানুষ কে ধ্বংস করে দেয়। সাম্রাজ্য থেকে অতি ক্ষুদ্র বিষয়ের লোভ তৈরি করে ধ্বংসলীলা।
লোভ কারী ব্যক্তিদের শাস্তিও ভয়ানক। আল্লাহ লোভীদের পছন্দ করেন না। তাইতো খোদা হওয়ার লোভ ফেরাউনকে বিশাল সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিল। তবে অতি আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে ফেরাউন তার নিজের শাস্তি নিজেই লিখে দিয়েছিল জিব্রাঈল (আঃ) এর কাছে। নীলনদে পানি আনার জন্য ফেরাউন যখন দোয়া করেন তখন আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নীলনদে পানি ফিরিয়ে দেন এবং জিব্রাঈল (আঃ) পাঠিয়ে দেন। তিনি ফেরাউন কে প্রশ্ন করেন,’যদি কোন মনিব তার ভৃত্য কে দুনিয়ার সমস্ত সুখ দেয়। তবুও সেই ভৃত্য তা উপেক্ষা করে নিজেই মনিব সাজতে চায় তাহলে তার কিরূপ শাস্তি হওয়া উচিত?’
উত্তরে ফেরাউন বলেছেন,’ওই অকৃতজ্ঞ কে এই নীল নদের পানিতে ডুবিয়ে মারা উচিত।’
ফেরাউনের উক্তিটি কাগজে লিখিয়ে নিয়ে চলে যান জিব্রাঈল (আঃ)। সেরকম মৃত্যু দেওয়া হয় ফেরাউন কে। সমুদ্রের গভীরে ডুবিয়ে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন।
লোভ কখনোই মানুষ কে শান্তিতে বাঁচতে দেয় না। হেরোনা যার কারণে সবসময়ই আতঙ্কে থাকে। শায়েরের ভাগে যেটুকু সম্পদ রয়েছে তা হাতিয়ে আনতে পারলে বেশ হবে। হেরোনার সাথে তার স্বামী আকবর ও আছেন। সাথে বাকি দুই ভাই আর তার বউয়েরাও। তাদের পরিকল্পনার প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছে হেরোনার মেয়ে চম্পাকে। শায়ের বলতে পাগল সে এখনও। এখনও সে শায়েরের চরণ তলে একটু ঠাঁই চায়। যার দরুন মায়ের অন্যায় আবদার সে মেনে নিয়েছে। পরীর সাথে ভাব জমিয়েছে। কথা বলার ছলে এটা ওটা খাওয়ায়। যার সাথে এক বিশেষ ধরনের ওষুধ মেশানো থাকে যা দূর গ্রামের একজন কবিরাজের কাছ থেকে আনিয়েছেন হেরোনা। পরী যাতে সন্তান জন্ম দিতে না পারে এবং সেই সুযোগে চম্পাকে শায়েরের সাথে বিয়ে দিবেন হেরোনা। এই সামান্য সম্পদের জন্য এখন মেয়েকেও উৎসর্গ করেছেন তিনি। চম্পাকে বুঝিয়েছে শায়ের তো পুরুষের জাত। বাচ্চা না হলে মেয়ে মানুষের দাম থাকে না। সে যতোই রূপবতী হোক না কেন!! তেমন করে পরীকেও সে ছুড়ে ফেলে দিবে। তার পর চম্পার সাথে শায়েরের বিয়ে দেবেন। চম্পাও খুশি মনে তা মেনে নিয়েছে। মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে সে।
কিন্ত শায়েরের পরীজান সম্পর্কে অবগত নন বলেই এসব কাজ করছে হেরোনা। যদি জানতো তাহলে এরকম জঘন্য চিন্তা মাথায় আনতো না।
শায়ের দুপুরের খাবার খেতে এসেছে। উঠোনে পরীর পরনের শাড়ি দেখে দেখে অবাক হলো সে। কেননা শায়ের ফেরা না পর্যন্ত পরী গোসল করে না। শায়ের যেদিন তাকে বলেছিল তার সবচেয়ে মোহনীয় রূপ হচ্ছে যখন সে গোসল করে কাপড় মেলতে যায়। সেই দৃশ্যটা শায়ের কে উপভোগ করানোর জন্য দুপুরে শায়ের ফেরার পর পরী গোসলে যায়। তাহলে আজকে হলো কি পরীর?? ঘরে আসতেই দেখলো পরী নামাজ পড়ছে। শুক্রবার বিধায় আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছে শায়ের। সে ভাবছে এখনও তো নামাজের সময় হয়নি। পরক্ষণে ভাবলো হয়তো নফল নামাজ পড়ছে। তাই শায়ের ও চলে গেল গোসলে। তারপর সেও চলে গেল মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে। শুক্রবারে দুপুরের পর বাড়িতেই থাকে শায়ের। নামাজ শেষে ফিরে এসে দেখে পরী অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। শায়ের পরীর পাশে বসে বলে,’আপনার কি মন খারাপ পরীজান?’
হঠাৎ শায়েরের কথায় চমকে ওঠে পরী। কোন এক ধ্যানে মগ্ন ছিলো সে। শায়েরের কথাতে ধ্যান ভঙ্গ হলো তার।
-‘আপনি কি বাড়ির জন্য চিন্তিত?’
-‘নাহ তেমন কিছু না।’
-‘আপনার চোখ দেখে মনের ভাবনা কিছুটা বুঝতে পারছি। আপনি কি বাড়িতে যেতে চান? তাহলে নিয়ে যাবো।’
-‘নাহ!!বাড়িতে আমি যাবো না। ক’দিন হলো তো এসেছি। আমার কিছু হয়নি।’
-‘তাহলে আপনার মুখে হাসি নেই কেন পরীজান? আমি যেই হাসিটা দেখার জন্য ছুটে আসি সেই হাসিটা আজ কেন দেখতে পেলাম না? আপনি কি আমার কাছে সুখি নন পরীজান?’
পরী তৎক্ষণাৎ শায়েরের হাত মুঠোয় নিয়ে বলে, ‘আপনি ছাড়া আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির কাছেও সুখি থাকতে পারবো না। তাই এই প্রশ্ন আপনি কখনোই করবেন না।’
পরম যত্নে স্ত্রীর গালে হাত রাখলো শায়ের। তারপর বলল,’তাহলে আমার থেকে কিছু লুকাবেন না। সব বলুন ভালো লাগবে।’
পরী শায়েরের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। বলে,’আপার বাচ্চাকে দেখেছেন??কি সুন্দর তাই না?’
পরীর মনোভাব সব বুঝে গেল শায়ের। সেও হাত ধরে পরীর তারপর বলল,’আপনার চাই তাই তো?’
-‘ফুপু বলেছিলেন একটা বাচ্চার কথা,কিন্ত??’
একটু চুপ থেকে পরী বলে,’আচ্ছা আমি কি মা হতে পারবো না?’
-‘আল্লাহ চাইলে সব পারেন পরীজান। আপনি ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ আপনার সাথে আছেন। কখনো আর এই চিন্তা করবেন না।’
-‘অনেক দিন তো পার হয়ে গেল। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আর ফুপু,,’
-‘বুঝেছি ফুপু আপনাকে চাপ দিচ্ছে তাই তো।’
-‘নাহ,ফুপুর ও তো মন চায় তাই না?তাছাড়া আমিও চাই।’
-‘এতো চিন্তা করবেন না। আপনাকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে ভালো লাগেনা আমার। আমার পরীজান কে সবসময়ই হাসিখুসি দেখতে চাই।’
পরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শায়ের। নাজানি এখন একটা বাচ্চার জন্য পরীকে কথা শুনতে হয়। ভাবনাটা সেটা নিয়ে নয়। ভাবনা হলো পরী তখন কীভাবে নেবে বিষয়টা? নিশ্চয়ই কঠিন ভাবে প্রতিবাদ করবে। তখন না অশান্তির সৃষ্টি হয়।
মন ভাল করার জন্য পরীকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো শায়ের। গ্রামের পথে প্রায়শই যায় ওরা। তবে আজকে রাতে বের হয়েছে ওরা। সুধাকরের আলোতে তখন ঝলমল করছে ধরণী। রাস্তাঘাট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে হাতে হাত রেখে হেঁটে চলছে শায়ের পরী। আলতো করে পরীর বাহু ধরে জড়িয়ে ধরেছে পরীকে। রাতে তো কেউ রাস্তাঘাটে খুব একটা আসেনা। ফাঁকা রাস্তাটা দুজনে বেশ উপভোগ করছে। সাথে পরীর মনটাও ভালো হয়ে গেছে। শায়ের বলে,’কিছু ভালোবাসা আর কিছু অনুভূতি গোপনে সুন্দর জানেন কি?’
-‘না তো!!আপনার কাছে প্রথম শুনলাম।’
-‘আপনার প্রতি আমার সকল অনুভূতি ভালোবাসা সবই ছিলো গোপন। কখনোই ভাবিনি আপনি আমার ভাগ্যে আছেন। আমি চাঁদের আশা করিনি,চাঁদের আলোতেই খুশি ছিলাম। কিন্ত বিধাতা যে আকাশসহ চাঁদটাকেই আমাকে দিয়ে দিলেন।’
চাঁদের থেকে চোখ সরিয়ে পরীর দিকে তাকিয়ে শায়ের বলে,’যে রাতে আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম খুব দীর্ঘ একটা রাত ছিলো। আপনাকে দেখার পর কাকভেজা চোখ নিয়ে শুধু অস্থিরতায় ছটফট করেছিলাম বাকি রাতটুকু। আপনাকে আরেকটিবার দেখার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলাম কিন্ত সেই দেখা দিলেন বিয়ের রাতে। কত অপেক্ষা করিয়েছেন আমাকে ভাবতে পারছেন?’
-‘কিন্ত আপনার চোখে কখনোই সেই অনুভূতি দেখিনি মালি সাহেব। কীভাবে এতোসব গোপন রাখেন আপনি?’
-‘আমার সবচেয়ে গোপন জিনিস টা কি জানেন?’
মাথা নেড়ে না বুঝায় পরী। শায়ের তখন পকেট থেকে কিছু একটা বের করে। চাঁদের রুপালি আলোতে চিকচিক করে উঠলো নূপুর টা। পরী এবার ভিশন অবাক হলো!!এই সেই হারিয়ে যাওয়া নূপুর। যেটা পাগলের মতো খুজেছে পরী। আর সেটা কি না শায়েরের কাছে ছিলো!!সে বুঝতেই পারেনি। পরী জিজ্ঞেস করে,’এটা আপনার কাছে ছিলো? তবে আপনি তখন বলেননি কেন?’
-‘তখন তো জানতাম না যে এই নূপুরের মালিক আমার হবে। তাই যত্নে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এখন বুঝতে পারছেন তো আমার ভালোবাসা কতটা গোপন ছিলো!!’
বিনিময়ে হাসলো পরী। শায়ের হাটুমুড়ে বসে নূপুরটা পরিয়ে দিলো পরীকে। শায়ের উঠে দাঁড়ানোর আগেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে পরীর। ধাক্কাটা খুব জোরে লাগতে সরে আসে সে। পেছন ফিরে কাউকে দ্রুত পদে চলে যেতে দেখলো পরী। শায়ের উঠে দাঁড়াল পরীকে ধরে বলল,’আপনার লাগেনি তো?’
পরী আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো তখনো। শায়ের বলল,’এই যে দাঁড়ান? চোখে দেখেন না? এভাবে ধাক্কা দিলেন!!’
-‘মেজো কাকি।’
শায়ের অবাক হলো বলল,’মেজো কাকি!! আপনি চিনলেন কীভাবে?’
পরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিনার দিকে তাকিয়ে বলে,’তার চাল চলন আমি খুব ভাল করে চিনি। সে যেই সুগন্ধি তেল মাখে তার গন্ধটাও পেয়েছি। কিন্ত মেজো কাকি এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলেন?’
শায়ের নিজেও তা খেয়াল করে। সত্যিই তো কোথায় যেতে পারে সে? এসব চিন্তা করতে করতে বাড়িতে চলে আসে ওরা। শায়ের কিছু না ভাবলেও পরী ভাবছে। কেননা ইদানীং পরী শায়েরের মেজ কাকি রিনা আর হেরোনাকে কথা বলতে দেখে। কিন্ত বিষয়টা এখন বেশ বুঝেছে সে। সাথে খুসিনাকে ঘরে ডেকে নিয়ে কিছু বলে। পরী এতদিন এসবে পাত্তা দিতো না। ওরা যা বলে বলুক ওর কি তাতে। কিন্ত যখন বিষয়টা খুসিনা পর্যন্ত গিয়েছে তখন পরী ভেবেছে কিছু তো ঘাপলা আছে। পরীর ধারণা সঠিক হলো যখন খুসিনা পরেরদিন এসে শায়ের কে ডাকলো।
কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে শায়ের। খুসিনা তখন শায়ের কে ডাকতে ডাকতে ঘরে ডুকলো,’কামে যাস তুই?’
-‘হুমম কিছু বলবে তুমি??’
-‘হ কইতাম। কি কমু? তুই আমার পোলা, তোর ভালার লাইগা কইতে হইবো। তোর বউয়ের তো পোলাপান হইবো না। বংশধর তো আনোন লাগবো। নাইলে তোর হইবো কি? তাই কইছিলাম তোর বউও থাক। তুই চম্পারে বিয়া কর।’
পরী যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ফুপু যে এতো সহজে কথাটা বলে ফেলবেন তা জানা ছিলো না পরীর। এতোদিন কতই না ভালোভাবে দিন কাটছিল এই ফুপুর সাথে। আর আজকে এই মানুষ টা এতো সহজ ভাবে কথাগুলো বলে দিলো? পরী কিছু বলল না। শুধু শায়েরের জবাবের আশাতে চেয়ে রইল। শায়ের শান্ত স্বরেই বলে,’আজ বলেছো,তবে দ্বিতীয়বার যেন তোমার মুখে একথা না শুনি ফুপু।’
-‘ক্যান কমু না সেহরান। তোর কি বাপ হবার ইচ্ছা করে না? দেখ সব ভাইবা দেখছি আমি। তাই তোর বউর সামনেই কইলাম। তুই বিয়া কর। দেখবি সব ঠিক হইয়া যাইবো।’
শায়ের এবার খুব রেগে গেলো। রাগন্বিত কন্ঠে বলল, ‘পরীজান থাকলেই চলবে আমার। চাই না আমার বাচ্চা। আর তোমাকে কে বলল আমার বউয়ের বাচ্চা হবে না?’
খুসিনা জবাব দিলেন না। জবাব দিলো পরী,’বড় কাকি বলেছে তাই না ফুপু?’
এবার ও জবাব দিলেন না তিনি। কথাটা তো হেরোনা বলেছে খুসিনাকে। খুসিনা আগেও চেয়েছিল চম্পা শায়েরের বউ হোক। এখন যখন পরী মা হতে পারবে না জেনেছে তখন চম্পার সাথে শায়েরের বিয়ে হলেই ভাল হবে। এই ভেবে খুসিনা রাজি হয়েছেন।
-‘বড় কাকি কিভাবে জানলো আমি মা হতে অক্ষম? তিনি এতোটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে?’
খুসিনা এবার মুখ খুললেন,’চম্পা তোমাগো কইতে হুনছে।’
শায়ের পরী একে অপরের দিকে তাকালো। ওরা কবে এসব নিয়ে আলোচনা করলো?আর চম্পা শুনলোই বা কীভাবে? পরীর মাথাটা ঘুরে গেল। ভালো ব্যবহার করাটা কি তাহলে চম্পার নাটক ছিলো? রাগে পরীর চেহারাটা লাল বর্ণ ধারণ করলো। ওর জীবনে বিশ্বাসঘাতকের জায়গা এক চুল ও নেই।