নুরু মিয়া তো চলে গেলো, কিন্তু মন থেকে ভয় দূর হলো না শ্রাবণের। সে কি আবার আসবে? সাদাফ বাসায় না থাকলে যদি তুলেও নিয়ে যায় তবুও কি সে কিছু করতে পারবে? ইদানীং ভয় তার পিছুই ছাড়ে না। একটা না একটা ভয় লেগেই আছে তার পিছু। ডানে বামে সামনে পেছনে যেদিকে যায়, কেবল অপ্রত্যাশিত ভয়ানক কিছুই দেখতে পায়। তাই ইদানিং চলাফেরা করতেও তার ভয় হয়। সাদাফ আবার শুয়ে পড়েছে। শ্রাবণকে ভীতুর মতো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
“রান্না শেষ তোমার? দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“হুম, রান্না শেষ। হাতমুখ ধুয়ে নিন। খাবার দিচ্ছি।”
“একটু পরে খাবো।”
“গরম গরম খাবার ভালো লাগবে।”
সাদাফ জবাব না দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়েই রইলো। শ্রাবণ হাড়িপাতিল মেজে গোসল সেড়ে নিয়েছে। রুমে এসে দেখলো সাদাফ জানালার ধারে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। শ্রাবণকে ফিরতে দেখে সে উঠে কাপড়চোপড় নিতে লাগলো। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে দরজার বাইরে ছুড়ে ফেলে গোসলের জন্য চলে গেলো। এদিকে শ্রাবণ নাস্তা রেডি করে বসে আছে। সাদাফ ঘরে ফিরে বললো,
“তুমি খাওনি?”
“উহু।”
“অযথা বসে আছো কেন?”
তার কোনো জবাব দিলো না শ্রাবণ। চুপচাপ প্লেট নিতে লাগলো। সাদাফও বসে পড়লো খাওয়া জন্য। তারপর বেরিয়ে গেলো কোথায় যেন। ফিরলো দুপুরের পর। হাতে শপিং ব্যাগ সাথে একটা ছোট প্যাকেট। দুটোই এগিয়ে দিলো শ্রাবণের হাতে। শ্রাবণ শপিং ব্যাগ খুলে দেখলো তার জন্য সোয়েটার এনেছে। খুবই সুন্দর দেখতে। একটু দামীও হবে বটে। ছোট প্যাকেটে আছে গরম গরম জিলাপি! শ্রাবণ মনে মনে বেশ খুশি হলেও ততটা প্রকাশ করলো না। সাদাফ হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছে তাই চলে গেলো খাবার দিতে। সাথে সে-ও খেয়েছে তবে কম পরিমাণে। জিলাপি খাওয়ার জন্য জায়গা রেখেছে পেটে।
এরপর একটু পরপর দেখা যায় তাকে জিলাপি হাতে। সাদাফও খেয়েছে অল্প একটু। বাকিসবই শ্রাবণের পেটে। আজ বিকেলে শ্রাবণকে উপর তলায় যেতে দেখেনি, পরদিন বিকেলেও যাচ্ছে না তাই সাদাফ বললো,
“বাচ্চাদের দেখলাম যাচ্ছে। তুমি যাও না কেন? নামাজ শেখা হয়ে গেছে?”
শ্রাবণ দুদিকে মাথা নাড়লো। সাদাফ বললো,
“তাহলে যাও না কেন?”
“যাবো?”
“এ কেমন কথা! শিখতে হলে যাবে না?”
“আচ্ছা, যাই।”
শ্রাবণ তখনই বেরিয়ে গেলো। তাদের জিজ্ঞাসায় স্বামীর পরিচয় দিতে কথায় কথায় যদি তার কর্মের কথাও মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, সেই ভয়ে ভেবেছিলো আর কারো সাথেই মিশতে যাবে না। কিন্তু সাদাফ বলাতে আবার গেলো। সেদিন রাতেই সাদাফ মাতাল হয়ে বাড়ি এসেছে। মাতলামো করেছে শ্রাবণের সাথে। হাতে কিছু টাকা এলেই যেন মাদকতা টেনে নেয় তাকে। সিগারেটের গন্ধটা সয়ে গেলেও, এই বাজে গন্ধ একদমই সহ্য করতে পারে না শ্রাবণ। তাই নিরুপায় হয়ে কান্না করেছে সে। সেই শুরু থেকেই খুব কষ্ট লাগে যখন সাদাফকে মাতাল অবস্থায় দেখে। সেটাও অস্বীকার করে না যে, এই কষ্ট থেকেই তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। তবুও সকালে নাস্তা করার সময় সাহস করে অনুরোধ করে বসলো,
“আপনি মদ্যপান কেন করেন? এসব তো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দয়া করে ওসবে টাকা নষ্ট করবেন না আর।”
“তাতে তোমার ক্ষতি কি?”
“আমি সহ্য করতে পারি না আপনাকে মাতাল অবস্থায়। কোনো নারীই চাইবে না তার স্বামী মদ্যপান করুক। আমিও চাই না। আপনার কাছে অনুরোধ, দয়া করে অভ্যাসটা ত্যাগ করেন। এতে আপনারও ভালো হবে, আমিও সুখে থাকবো।”
সাদাফ কোনো কথাই বললো না। নিজের কাজে ব্যস্ত। দাবাঘর ঠিক হয়ে গেছে। তাই অবসর সময়ে আবার সেদিকে ধাবিত হয়। তবে রাতে এতো দেরি করে ফিরে না। সে যে আবার দাবার নেশায় মত্ত হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে শ্রাবণও দিনের বেলাও তাকে কাছে রাখতে চায়। তার জন্য যোগাড় করতে হয় নানান বাহানা। কখনো সাদাফ প্রশ্রয় দেয়, কখনো বা তাড়া দেখিয়ে প্রস্থান করে। যখন বেশি তাড়া দেখায় তখন শ্রাবণ বুঝতে পারে আসলেই তার কাজ আছে। তাই ছেড়ে দেয়।
মাস দুয়েক পেরিয়ে গেছে বিয়ে হয়েছে। শ্রাবণ নামাজ শিখে নিয়েছে। কুরআনও শিখছে একটু আধটু করে। প্রতি ওয়াক্তে নামাজ আদায় করার চেষ্টা করে। কিন্তু সাদাফকে নামাজে পাঠাতে পারে না। সপ্তাহে একদিন কেবল জুমার নামাজে পাঠাতে সক্ষম হয় শ্রাবণ। সেদিনের পর থেকে আর মাতাল হয়ে ফিরতে দেখা যায় না তাকে। তবে মাঝে মাঝে পোটলাপাটলি এনে আলমারিতে তুলে রাখতে দেখা যায়। আর সিগারেট তো প্রত্যেক প্রহরের নাস্তা। এখন সিগারেট থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে শ্রাবণ। নিষেধ করে কিন্তু সাদাফ শুনে না। মাঝে মাঝে প্যাকেট পেলে লুকিয়ে ফেলে সে। সাদাফ খুঁজলে বলে দেখেনি কোথাও। কিন্তু কদিন মিথ্যা বলে পাড় পাবে? সাদাফের সন্দেহের চোখে ঠিকই পড়ে গেছে। কারণ কয়েকবারই এমন ঘটেছে যে, মাত্র রেখে বাথরুম কিংবা বাইরে গেছে। কয়েকমিনিট পর এসেই দেখে উধাও! রাতে ঘুমানোর সময় বিছানার কোণে রেখে ঘুমায় সকালে উঠেই আর পায় না। তাহলে সে তো শ্রাবণের কাজ ছাড়া আর কারো কাজ নয়! তাই সে এখন যেখানে সেখানে রাখেও না। যখন খাওয়ার সময় হয় দোকান থেকেই কিনে খায়, আর নাহয় পকেটে সংরক্ষণে রেখে দেয়।
শীত চলে গেছে। পুরোপুরি গরমকাল আসেনি কিন্তু তেমন শরীর কাঁপানো শীতও বসে নেই। তাই শীতের চাদর আর সোয়েটার ধুয়ে দিয়েছে শ্রাবণ। বিকেলে সেগুলো তুলে রাখছিলো ব্যাগে। এখন প্রয়োজনেও আলমারি খুলতে যায় না সে। যা প্রয়োজন, সাদাফ ফিরলে তাকেই দিতে বলে। আর নিজের জিনিসপত্র ব্যাগেই তুলে রাখে। সে যখন সোয়েটার ভাজ করতে ব্যস্ত, সাদাফ তখন বাথরুমে থেকে ডেকে বললো,
“শ্রাবণ, ভাতের মার পড়ে।”
সে ভুলেই গিয়েছিলো ভাতের কথা। তাই সাথে সাথেই ব্যাগ-ট্যাগ ফেলে ছুটে গেলো সেদিকে। সাদাফ হাতমুখ ধুয়ে এসে গামছায় মুছতে মুছতে খাটে বসলো। মেঝেতে পাশেই রাখা ব্যাগের দিকে চোখ পড়তেই সিগারেটের প্যাকেট পড়লো নজরে। সাদাফ নিচু হয়ে কাপড়চোপড় ঘেটে এতোদিনের লুকানো সিগারেট গুলো পেয়ে গেলো। শ্রাবণ ফিরে এসে দেখলো একে একে বিছানায় রেখে এখনো কাপড়চোপড় ঘাটছে। সে ছুটে এসে খপ করে সেগুলো নিয়ে বললো,
“আপনি এসব বের করছেন কেন?”
“কার জন্য জমা করছো? লুকিয়ে লুকিয়ে খাও নাকি?”
“হ্যাঁ, খাই।”
“সবগুলো রাখো এখানে। আরও আছে?”
“সবগুলো এখন চুলোয় পুড়বো।”
সাদাফ উঠে তার হাত ধরতে গেলেই শ্রাবণ হাত পেছনে গুটিয়ে ফেললো। সাদাফ বললো,
“দাও!”
“না। আপনাকে নিষেধ করেছি না এসব খেতে! এসব খেয়ে খেয়ে শরীরের কি অবস্থা করছেন!”
“কথা কম বলো। দিতে বলেছি দাও।”
“দিবো না।”
“একেবারে শেষ করে ফেলবো!”
সাদাফ ভয়ংকরভাবে ধমকে হাত তুলে ফেললো উল্টো হাতে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য। তার আগেই শ্রাবণ ভয়ে মাথা হেলিয়ে ফেলায় আর থাপ্পড় দেয়নি সে। হাত থেকে নিয়ে নিয়েছে সিগারেটগুলো। বেরিয়ে গেছে হনহনিয়ে। শ্রাবণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ভেবেছিলো আজও বুঝি আবার দেখতে হবে সাদাফের ভয়ংকর রূপ! তা না দেখলেও মন ভীষণ খারাপ। হাত উপরে তুলতেই কষ্ট পেয়েছে বেশ। পরক্ষণে রান্নাবান্নার কথা মনে হতেই চোখ মুছতে মুছতে সেখানে চলে গেলো৷ দুপুরে এমনিতেই হায়দার সাহেবের সাথে কথা কাটাকাটিতে ছোটখাটো ঝগড়া হয়ে গেছে। তাই মেজাজটা খারাপ ছিলো। যদিও বাইরের ঝগড়ার প্রভাব কখনো ঘরে ফেলে না সে, কিন্তু মেজাজ খারাপের মাঝেই শ্রাবণ আবার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছিলো তাই দুইয়ে মিলে সে একটু বেশিই রেগে গিয়েছিলো। কিন্তু শ্রাবণের চেহারায় ভয় দেখতে পেয়েছে বিধায় তার উপর রাগটা দেখালো না। নিজেকে সামলে নিয়ে চলে এসেছে। বাইরে ঘুরাঘুরি করে একটু ঠান্ডা হওয়ার চেষ্টা করে সন্ধ্যার পর আবার ফিরেছে। শ্রাবণ মেঝেতে মাদুর পেতে তাকে ভাত খেতে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিজে রাগ করে বসে আছে সাদাফ তখন ধমকে যাওয়ায়। এখন ভাত খাবে না সে। সাদাফ ব্রু কুচকে বললো,
“বসে আছো কেন, খাও না!”
শ্রাবণ চুপচাপ বসেই আছে। সাদাফ খালি প্লেট আছাড় মেরে উঠে গেলো খাওয়া ছেড়ে। শুয়ে পড়লো বিছানায়। প্লেট ভেঙে টুকরো টুকরো! শ্রাবণ আবারও ফোপাঁতে লাগলো। কিছুক্ষণ একইভাবে বসে থেকে ঢেকে রাখতে লাগলো খাবার। সাদাফ শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকালো। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে উঠে এসে আবার মাদুরে বসলো। ভালো প্লেটটা নিয়ে নিজেই খাবার নিতে লাগলো। ভাত মাখতে মাখতে নরম গলায় বললো,
“আর কখনো সিগারেট ধরবে না। আমাকে নিষেধও করবে না। নাও।”
মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলো সাদাফ। শ্রাবণ অশ্রুভেজা চোখে তাকালো তার দিকে। সাদাফ অন্য হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুম্বন করে আবার বললো,
“নাও।”
শ্রাবণ ভেজা গাল হাতের তালুতে মুছে খাবার মুখে নিলো। কিছু কিছু সুখের কাছে দুঃখ গুলো সহজেই হেরে যায়। কিছু কিছু ভালোবাসা সবসময়ই অভিমান মুছে নেয়। ফিরিয়ে দেয় আনন্দ। ফিরিয়ে দেয় সুখের মুহুর্ত। তাইতো এখন সুখে ভাসছে শ্রাবণ।