বেঁচে থাকতে হলে সুখ দুঃখ দুটিরই স্বাদ সমানভাবে আস্বাদন করতে হবে। সব মিলিয়েই জীবন। সারাজীবন সুখ অথবা দুঃখ একাধারে পাওয়া সম্ভব না। প্রকৃতির এই বানানো নিয়মে জগৎ সংসার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তা-ই তো বলা হয় – ‘ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন ‘
পঞ্চম বারেও যখন প্রানেশা কল রিসিভ করলো না, তখন ঘাবরে গেলো সুফিয়ান। শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চিনচিনে ব্যথা। কিছুক্ষণ আগেই অপারেশন করে ফিরলো। এক কথায় প্রচুর প্রেশারে ছিলো। এমনিতেই প্রানেশার প্রেগ্ন্যাসির খবর শোনার পর থেকে সারাক্ষণ মন ছটফট করতে থাকে। হসপিটালের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার চেষ্টায় থাকে ৷ কীভাবে প্রানেশাকে একটু বেশি সময় দেয়া যায়, কী করে ওকে হাসিখুশি রাখা যায়, কোন খাবার বাচ্চার জন্য ভালো এসব কিছু নিয়ে সবসময়ই চিন্তায় থাকে সে। তা-ই তো কিছুক্ষণ পর পরই কল করে খবর নেয়। প্রানেশা কমসেকম দ্বিতীয় বারের মধ্যেই রিসিভ করে ফেলে। কিন্তু এত লেট কখনো হয়না। হাত পা ঘামতে শুরু করলো সুফিয়ানের। নিজের পরনে এখনো অপারেশনের স্যুট। অর্থাৎ, চেঞ্জ করার সময়টুকুও সে পায়নি। স্যুটটা খুলেই দ্রুত হাতে মিসেস অদিতিকে কল করলো। মিসেস অদিতি তখন প্রানেশার জন্য তেল গরম করছিলেন, অনেক দিন ধরে ঘাড়ে ব্যাথা মেয়েটার। নিজের রুমে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। ঘুম ভেঙে গেলো বিধায় তেল গরম করে প্রানেশার রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলেন। চুলোর পাশেই সেলফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করে কানে দিতেই ভেসে এলো সুফিয়ানের অস্থির কন্ঠ –
‘মা, প্রাণ ঠিক আছে তো?’
মিসেস অদিতি অবাক সুরে বললেন-
‘প্রানেশার কী হবে! ও তো সেই কখন থেকে রুমেই আছে। ‘
‘তুমি একটু গিয়ে দেখো তো, কল রিসিভ করছে না মেয়েটা ‘
‘ঠিক আছে, আমি দেখছি ‘
‘হ্যা, আর কল কেটো না৷ কমফার্ম হয়ে আমাকে জানাও ‘
‘ঠিক আছে বাবা’
মিসেস অদিতিও ভীত মনে উপরের দিকে অগ্রসর হলেন। দরজা চাপানো ছিলো৷ ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো৷ প্রানেশাকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন। অপর পাশে সুফিয়ানের বুক ধকধক করছে। মিসেস অদিতির হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো। তিনি গলা ফাটানো শব্দ করে বললেন –
‘আল্লাহ গো! সব শেষ হয়ে গেলো সুফি, সব শেষ হয়ে গেলো! ‘
সুফিয়ান মাথা ঘুরিয়ে চেয়ারের সাথে ধাক্কা খেলো। গায়ের শার্টটা ঘামে ভিজে চুব চুব করছে৷ নিজেকে সামলে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো। গাড়ি চালানোর ক্ষমতা নেই তার। তাই ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে পাশে বসলো সে৷ আধা ঘণ্টায় পৌঁছে গেলো বাড়ি। এক দৌড়ে নিজের রুমে পৌঁছালো৷ একজন ডাক্তার ভেতরে বসে আছে। মিসেস অদিতিই কল করে ডেকে এনেছেন। বিছানায় শুয়ে আছে নিথর প্রানেশা। সুফিয়ান দ্রুত পদে হেঁটে প্রানেশার পাশে বসলো৷ মুখ পাণ্ডুর, মাথায় আর ডান হাতের কবজিতে ব্যান্ডেজ করা। ডাক্তার চেকআপ শেষ করে সুফিয়ানের দিকে ফিরলেন। সুফিয়ান উদ্বিগ্ন হয়ে বললো-
‘ডক্টর, প্রাণ আর বেবি ঠিক আছে তো?কোনো ক্ষতি হয়নি তো? এভরিথিং ইজ ফাইন না? ‘
ডক্টর প্রিয়া, সুফিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-
‘দেখুন, আরেকটু দেরি হলে হয়তো ক্ষতি হয়ে যেতো পারতো৷ প্রথমত পেটে তেমন কোনো আঘাত পায়নি আর দ্বিতীয়ত মাথায় খুব বেশি ব্লিডিং হয়নি। তাই তেমন কিছু হয়নি বললেই চলে ‘
কিছুটা থেমে তারপর আবার বললেন –
‘কিন্তু, এরপরে একটু বেশি করে খেয়াল রাখবেন। এই যাত্রায় বেঁচে গেছেন৷ পরে আবার কিছু হলে কিন্তু বড় কোনো ক্ষতি হতে পারে ‘
সুফিয়ান প্রথমের কথায় স্বস্তি পেলেও শেষের কথা গুলোতে আবার চিন্তায় পড়ে গেলো। ডক্টর আরও কিছু এডভাইস দিয়ে ঔষধ প্রেসক্রাইব করে চলে গেলেন৷ সুফিয়ান দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রানেশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ মনে মনে নিজেকেই দোষ দিলো,বাসায় থাকলে হয়তো প্রানেশার এত কষ্ট করার প্রয়োজন হতো না। কিছুক্ষণ যেতেই প্রানেশার জ্ঞান ফিরে এলো। হাত পা হালকা নেড়ে উঠে বসলো আস্তে ধীরে। মাথা ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো –
‘খারাপ লাগছে প্রাণ? পানি খাবে? খুব বেশি লেগেছে মাথায়?’
প্রানেশা সুফিয়ানের হাতটা সরিয়ে দিলো। জোর করে নিজের শরীরে ভর দিয়ে উঠে পড়লো। হাতে চাপ লাগতেই আর্তনাদ মূলক গোঙানির শব্দ করে উঠলো৷
সুফিয়ান ধমকের গলায় বললো –
‘প্রাণ! বারবার বলার পরও কথা শুনছো না কেনো? ‘
প্রানেশা নিজের হাতের ব্যাথাকে বেশি একটা পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ কিছু মুহূর্তের জন্য সে নিজেও ঘাবড়ে গেছিলো। কিন্তু এখন শরীরের থেকে মনের ব্যাথাটাই বেশি কষ্ট দিচ্ছে। প্রানেশার প্রথমে মনে হয়েছিলো, ছবিগুলো হয়তো ইডিট না হয় রেয়ানের। কিন্তু শারীরিক গঠন আর গলার কন্ঠমনিতে বোঝাই যাচ্ছে ওটা সুফিয়ান। তারপরও সুফিয়ানের মুখে সত্যিটা শুনতে চায়। সুফিয়ান একবার যদি বলে যে ছবিগুলো তার নয় তাহলে বিনাবাক্যেই বিশ্বাস করে নেবে সে। এই সিদ্ধান্তে মনোনিবেশ করেই অস্থিরচিত্তে মোবাইল খুঁজে বের করলো৷ পাশেই ফ্লোরে পড়ে ছিলো। মোবাইল উঠিয়ে দ্রুত পদে সুফিয়ান পায়ের কাছে বসলো। সুফিয়ান প্রানেশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কী করতে চাইছে প্রানেশা সেটা এখনও বোধগম্য হয়ে ওঠেনি।
প্রানেশা মোবাইল ঘেঁটে ছবিগুলো বের করলো। আবারও চোখ টলমল করে উঠলো। কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না সে। সুফিয়ানের সঙ্গে অন্য কাউকে এই অবস্থায় দেখে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। সুফিয়ানের হাত মুঠোয় নিয়ে প্রানেশা শান্ত কন্ঠে বললো-
‘আজ আমি যা জিজ্ঞেস করবো তা সত্যি সত্যি উত্তর দেবেন ‘
সুফিয়ানের কপালে ভাজ পড়লো। ভ্রু কুচকে বললো-
‘কী জানতে চাও প্রাণ?’
প্রানেশা হাতের মোবাইলটা কাঁপা হাতে সুফিয়ানের মুখের সামনে ধরলো৷ সুফিয়ান অবহেলা দৃষ্টি দিয়ে মোবাইলে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলো কিন্তু চোখ আর ফেরানো হলো না৷ বিস্ফোরিত নয়নে নিবদ্ধ হয়ে গেলো স্ক্রিনে থাকা ছবিতে। হ্যা এটা তখনকার ছবি যখন সে অস্ট্রেলিয়ায় নেশায় বুদ ছিলো৷ ইভানান রোজ তার রুমে ক্লাবের মেয়ে পাঠাতো৷ শারীরিক সম্পর্ক না হলেও ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত তৈরি হয়েছিলো৷ তখনও সুফিয়ান বোঝেনি ইভানানের মেয়ে পাঠানোর পেছনের কারণ। ইভানান তাহলে এই কারণে ওইসব করেছিলো! সুফিয়ানের সঙ্গে সঙ্গে পিলে চমকে উঠলো। মনের মধ্যে অপরাধ বোধও জন্মালো। এখন সে প্রানেশাকে কী করে বোঝাবে যে, বহুবার বহু নারীর সংস্পর্শে যেয়েও ফিরে এসেছে প্রানেশার টানে। যতবার চেষ্টা করেছে প্রানেশাকে ভুলে নতুন কারো সাথে মগ্ন হতে কিন্তু ততবারই প্রানেশার মুখ ভেসে উঠতো। কিন্তু প্রানেশাকে এখন কী বোঝানো সম্ভব! কারণ, বিছানায় অনেকটাই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে।
প্রানেশা থমকানো স্বরে বললো –
‘ শুধু একবার বলুন, এটা আপনি নন। আমার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই। ‘
সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো৷ মিথ্যা বলতে চায় না। কিন্তু প্রানেশা কী সত্যিটা অসুস্থ শরীরে মেনে নিতে পারবে! এটা ভেবেই সুফিয়ান সাহস পাচ্ছে না। তারপরও একরাজ্য অস্বস্তি আর ভয়কে ঠেলে দিয়ে প্রানেশার মুখোমুখি হয়ে এক নিশ্বাসে বললো-
‘ওটা আমিই প্রাণ।’
প্রানেশার হাত থেকে ঠাস করে মোবাইলটা নিচে পড়ে গেলো। শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামা বেড়ে গেলো৷ সব কিছু এমন অন্ধকার লাগছে কেনো? কোথাও কী আলোর ঘাটতি পড়লো! ওহ না,সব ঠিকই আছে। বোধ হয় তার দুনিয়াটাতেই শুধু আলোরা নেতিয়ে পড়েছে। সুফিয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
‘প্রাণ, হ্যা ওটা আমি কিন্তু তুমি যা ভাবছো ব্যাপারটা তেমন নয় বিশ্বাস করো। আমার সঙ্গে তেমন.. ‘
পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রানেশা খাটের সঙ্গে হেলে বসলো৷ তাচ্ছিল্য হেসে বললো –
‘আর বলতে হবে না। শিশু নই আমি। সবটা পানির মতোন পরিষ্কার হয়ে গেছে। ‘
তীক্ষ্ণ আক্রোশের দৃষ্টি দিয়ে প্রানেশা জোরে চেচিয়ে বললো -‘আপনার মুখও দেখতে চাই না আমি৷ এই মুহুর্তে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো ‘
বলেই উঠে বাহিরে যেতে উদ্যত হলো সে। সুফিয়ান পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো৷ প্রানেশা ছুড়াছুড়ি করে একসময় ক্লান্ত হয়ে ভর ছেড়ে দিলো। সুফিয়ান প্রানেশার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে আহতস্বরে বললো-
‘ এইটুকু সহ্য করতে পারছো না প্রাণ! তাহলে আমি পাঁচ পাঁচটে বছর তোমাকে আমার আপন ভাইয়ের সঙ্গে কী করে সহ্য করেছি? তুমি কেঁদে চিৎকার করে সবটা বলতে পারছো৷ আমি যে রাতের পর রাত তরপেছি। তোমাদের কাছাকাছি ছবি, হাতে হাত ধরে চলার সাক্ষী হয়ে থেকেছি! এই পর্যন্ত সবটা চুপচাপ বুকের ভিতর চেপে পুড়েছি। পুড়তে পুড়তে আজ আমি অঙ্গার হয়েছি প্রাণ। কিন্তু তুমি অঙ্গারের নেশা হতে পেরেছো তো?’