ক্যামেরা বা আলোকচিত্রগ্রাহী যন্ত্র ইংরেজিতে- Camera বা Photographic camera.আলোকচিত্র গ্রহণ ও ধারণের যন্ত্র। দৃশ্যমান স্থির বা গতিশীল ঘটনা ধরে রাখার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানবজাতি প্রযুক্তিমুখী হয়ে ওঠছে৷ হিডেন ক্যামেরা তেমনি একটি প্রযুক্তি। এটি গোপন আলোকচিত্রগ্রাহী যন্ত্র। এর সহায়তায় গোপনীয় ভাবে যেমন বিভিন্ন অন্যায়,অনৈতিক কাজ ধরে ফেলা যায়, তেমনি বিভিন্ন অন্যায় কাজ হাসিল করাও যায়। যে কোন কক্ষে গোপন ক্যামেরা খুঁজে পেতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি রয়েছে। যে পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্বেই অবগত ছিল প্রণয়। তাই বিকৃতমস্তিষ্কের কিছু ষড়যন্ত্র’কে অতিসহজেই ধরে ফেলেছে সে।অনেক ক্যামেরাতে মোশন ডিটেক্টর থাকে অর্থাৎ যে কক্ষে ক্যামেরাটি সেট করা থাকবে সে কক্ষে কোন মানুষ থাকলে সে যেদিকে যাবে ক্যামেরাও সেদিকে ঘুরে যাবে। এ ধরনের ক্যামেরা খুঁজে পেতে প্রথমে রুমের সব জানালা দরজা বন্ধ করে পুরো রুম অন্ধকার করে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। এবার, কোন শব্দ না করে রুমে এদিক ওদিক গেলেই দেখা যাবে গোপন ক্যামেরাটি তাকে ফলো করছে। রাত থাকায় প্রণয় ঠিক এই কৌশলটাই কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছে। হীন এই মানসিকতাটি কার হতে পারে খুব ভালো করেই টের পেল৷ কিন্তু ফুটেজ’টি চেক করে যা দেখল এতে তার মাথায় যেন পুরো আকাশ’টাই ভেঙে পড়ল। পায়ের রক্ত মাথায় ওঠে গেল তার। শরীরের শিরায় শিরায় অগ্নি জ্বলতে শুরু করল। নিজ হাতে খু/ন করতে ইচ্ছে হলো,নিজ সহোদর’কে। ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে ওঠল। নিজের সবটুকু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ক্ষিপ্ত বাঘের মতো হন্যে হয়ে ডিউটি ছেড়ে ভরদুপুরে ছুটে গেল পাঁচফোড়ন গৃহে।
অঙ্গন’কে দুপুরের ওষুধগুলো খাওয়িয়ে কেবলই বের হয়েছে শাহিনুর৷ তখনি দেখতে পেল প্রণয় হনহনিয়ে দোতালায় যাচ্ছে। শাহিনুরও ছুটে গেল। কক্ষে ঢুকেই প্রশ্ন করল,
-‘আজ আপনি এ সময়?’
পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে পালঙ্কে বসে আছে প্রণয়।শাহিনুর বুঝল প্রণয়ের মেজাজ ঠিক নেই। তাই নিঃশব্দে তার পাশে বসল। নরম কন্ঠে বলল,
-‘আপনি কি জেনে গেছেন ক্যামেরাটি কে রেখেছে?’
সহসা অগ্নিচক্ষু নিক্ষেপ করল প্রণয়। বক্ষঃস্থল মৃদু কেঁপে ওঠল শাহিনুরের। এক ঢোক গিলে কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘কী হয়েছে আপনার?’
ক্রমশ চোয়াল দ্বয় কঠিন হতে লাগল প্রণয়ের। ক্ষীণ স্বরে শাহিনুর বলল,
-‘এভাবে তাকাবেন না। আমি যদি কোন অন্যায় করে থাকি সোজাসুজি বলুন।’
দাঁতে দাঁত চেপে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। বড়ো বড়ো করে কয়েকদফা নিঃশ্বাস ফেলে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-‘যতক্ষণ না আমি চাইছি ততক্ষণ আমার সঙ্গে একটা কথাও তুমি বলবে না।’
ভ্রু কুঁচকে গেল শাহিনুরের। কিন্তু একটুও অবাক হল না। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিঃশব্দে পাশ থেকে ওঠে দাঁড়াল। বিন্দুমাত্র সময় অপেক্ষা না করেই ত্বরান্বিত হয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। একজন পুরুষ ভৃত্য’কে দিয়ে তার জন্য লেবু পানি পাঠিয়ে দিল। তা দেখে প্রণয়ের ক্রোধ আরো চওড়া হলো। লেবু পানির গ্লাসটা ছুঁড়ে মেরে ভৃত্য’কে ভয়ানক কিছু হুংকার ছাড়ল। স্বামী-স্ত্রীর মান অভিমানের মাঝে বেচারা নিরপরাধ ভৃত্য হয়ে গেল ঘোর অপরাধী!
[৬৪]
সারাদিন আর প্রণয়ের সামনে এলো না শাহিনুর৷ খুব কষ্টে নিজের ক্রোধটুকু নিয়ন্ত্রণ করল প্রণয়। দিন পেরিয়ে রাত এলো। পালঙ্কের এক কোণায় স্থবির হয়ে শুয়ে পড়ল প্রণয়। শাহিনুরও দুনিয়ার সকল নিরবতা’কে বরণ করে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। দু’জনের মাঝে দু’হাত দূরত্ব। কিন্তু প্রণয়ের মনে হলো আজ তাদের মাঝে বিস্তর এক ফারাক রয়েছে। রাত যখন গভীর হলো নিজের রক্তিম অক্ষিযুগল হঠাৎ মেলে তাকাল প্রণয়। বা’পাশে তাকিয়ে শাহিনুরের পৃষ্ঠদেশ দেখতে পেল। ধীরে ধীরে ঘাড় এগিয়ে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, সে ঘুমিয়েছে কিনা। যখন বুঝল ঘুমিয়ে গেছে তখন ত্বরিত বেগে পালঙ্ক ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। প্রণয় কক্ষ ছাড়তেই সটান হয়ে বসল শাহিনুর৷ রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সে। বক্ষঃস্থলে চিনচিনে এক ব্যথা অনুভব করল। আকস্মিক একটি প্রশ্ন জাগল মনে,
-‘কী লুকাচ্ছে ডাক্তারসাহেব? আমি কি ঠকে গেলাম!’
নিশুতি রাতে স্বামী’র পিছু নিল শাহিনুর। পাঁচফোড়ন গৃহ ছেড়ে বেরিয়ে জঙ্গলের পথ ধরেছে প্রণয়। তাকে অনুসরণ করে এগুতে লাগল সে। আকাশে এক ফালি চাঁদের দেখা মিলছে ঠিকই অথচ কিরণ নেই। আজ বুঝি চাঁদের মন খারাপ? শাহিনুর শায়লার অন্তঃকোণের সকল বিষাদ গিয়ে ঐ চাঁদেই ঠাঁই নিয়েছে বোধহয়। চারপাশে অন্ধকার একা একা নিবিড়ভাবে হেঁটে চলেছে শাহিনুর৷ আবছায়ায় দেখছে প্রণয়’কে। বাতাসে ভেসে আসছে বিক্ষিপ্ত প্রণয়ের ঘর্মাক্ত দেহের মাতোয়ারা সৌরভ। শাহিনুর লম্বা, লম্বা শ্বাস নিচ্ছে আর হাঁটছে। ঘন জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করে সোজা রঙ্গনের কুটিরের ভিতর ঢুকে পড়ল প্রণয়। শাহিনুরের বুক’টা ধক করে ওঠল। কুটিরের ভেতর সে প্রবেশ করতে পারবে না৷ তাই কুটিরের এক কোণায় কান সজাগ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ভিতরের তাণ্ডবগুলো সচক্ষে দেখতে না পেলেও অনুভব করল। শুনতে পেল নিকৃষ্টতম বেইমান পুরুষটির সঙ্গে তার প্রিয়তমের কথপোকথন।
মদ্যপান করে কাউচের ওপর একদম বুঁদ হয়ে শুয়ে ছিল রঙ্গন। সহসা হিংস্র বাঘের সরূপ আক্রমণ করল প্রণয়। দু’হাতে গলা টিপে ধরে গর্জে ওঠল,
-‘আমি মান্নাত বাইজি’কে খু/ন করছি? আমি আমার স্ত্রী’র কাছে মহান সেজে এক বাইজির কাছে নিজের পুরুষত্ব বিকিয়ে দিছি!’
এটুকু বলেই জীবনের প্রথম ভয়ানক এক গালি দিল প্রণয়৷ বাঁচার তাগিদে দুর্বল শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে খুব কষ্টে প্রণয়ের হাত ছাড়াল রঙ্গন৷ বেসামাল কন্ঠে বলল,
-‘আমাকে মাফ করো ভাই, আমাকে তুমি মাফ করো।’
এটুকু বাক্য উচ্চারণ করতেই কষিয়ে পরপর দু’টো থাপ্পড় লাগালো গালে। শুভ্র চোয়াল দ্বয়ে মুহূর্তেই দশ আঙুলের রক্তিম ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠল। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে রঙ্গন। তার সে ভয়’কে পরোয়া না করে বলিষ্ঠ হস্তে আবারও চেপে ধরল গণ্ডস্থলে।হ্যাংলা,পাতলা দেহটি নিমিষেই এক হাতে উঁচু করে ফেলল। সে হাত নিজের দু’হাতে চেপে ধরে ছাড়াতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল রঙ্গন। সে বুঝে গেল আজ প্রণয়ের মাঝে দশ পুরুষের শক্তি এসে ভর করেছে। আজ আর তার রেহাই নেই। রাগে, দুঃখে দু-চোখ উপচে অশ্রু ঝড়তে শুরু করল তার। সব শেষে বার বার সেই অপরাধী। এক ভাই অপরাধ করতে বাধ্য করবে, আরেক ভাই সে অপরাধের শাস্তি দেবে! হাহ জীবনের প্রতি সত্যি ঘৃণা জন্মাল তার। রুদ্ধ হয়ে আসা শ্বাসে কোনক্রমে উচ্চারণ করল,
-‘আমার মুন’কে বাঁচাতে ওর বাচ্চা’টাকে বাঁচাতে এসব করতে বাধ্য হয়েছি ভাই!’
সহসা ছেড়ে দিল প্রণয়। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল রঙ্গন৷ গর্জে ওঠল,
-‘তুই আমার ভাই হতে পারিস না। তুই পলাশের ভাই তুই আমার রঙ্গন হতে পারিস না!’
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মুখ উঠিয়ে মাটিতেই বসে রইল রঙ্গন। দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলল,
-‘আমি যদি এসব না করতাম তাহলে মেজো ভাই মুন’কে বাঁচতে দিত না। ওর অনাগত সন্তান পৃথিবীতে আসতে দিত না। আমি যদি নুর’কে এক রাতের জন্যও ওর শয্যাসঙ্গিনী করতে না পারি, তাহলে আমার মুন’কে মে/রে ফেলবে। আমার মুনের বাচ্চা’টা’কে দুনিয়ার আলো, বাতাসে আসতে দেবে না।’
ক্রোধে কাঁপতে শুরু করল প্রণয়। পলাশের করা প্রতিটি পরিকল্পনা রঙ্গনের থেকে শুনল। সবটা বলে রঙ্গন ওঠে দাঁড়াল। প্রণয়ের মুখোমুখি হয়ে বলল,
-‘আমি আমার ভালোবাসার জন্য এসব করতে বাধ্য হয়েছি।’
-‘তুই তোর ভালোবাসার জন্য যেমন ওর জীবন’টা নরক করে দিতে প্রস্তুত, আমিও আমার ভালোবাসার জন্য তোর জীবন নরক করতে প্রস্তুত মেরা ভাই!’
এটুকু বলতেই রঙ্গন প্রণয়ের পা’য়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলল,
-‘তুমি নুর’কে নিয়ে এখান থেকে চলে যাও ভাই। মেজো ভাই ভয়ংকর পরিকল্পনা করে রাখছে। আমার সহায়তা না পেলে মুনতাহা’কে শেষ করে দেবে। যে কোন মূল্যে নিজের চাহিদা সে পূরণ করবেই। মুনের জন্য সব পারি আমি, প্রয়োজনে নিজের জীবন’টাও বাজি রাখতে পারব।’
এক লা/ত্থি’তে ছিঁটকে পড়ল রঙ্গন। চোখ,মুখ খিঁচিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়া কন্ঠে প্রণয় বলল,
-‘রঙ্গন, যে ভালোবাসা’কে তুই হারাম, হালাল কোনরূপেই পাসনি। সেই ভালোবাসার জন্য নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে এমন ভয়ানক ষড়যন্ত্র করলি। তাহলে ভেবে দেখ যে ভালোবাসা’কে সম্পূর্ণ হালাল রূপে পেয়েছি আমি,শুদ্ধ ভালোবাসায় যাকে এই বাহুডোরে বেঁধেছি, যে মেয়েটা আমার নিঃশ্বাসে, প্রশ্বাসে মিশে আছে। যার শরীরের ঘ্রাণে ডুবে আমার প্রতিটি রাত কাটছে। আমার অর্ধেক অঙ্গ যেই মেয়েটা। সেই মেয়েটার জন্য আমি কি করতে পারি?’
ভয়ে কেঁপে ওঠল রঙ্গন। প্রণয় তার ভয়াতুর দৃষ্টি দেখে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-‘আম্মা আমাকে কসম দিয়েছে সেটা আমি ভুলিনি। তোর মস্তিষ্ক সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান আছে আমার৷ তোকে সোজা করার জন্য বেশি পরিশ্রম লাগবে না। সারাজীবনের মতো আমার কাছে বন্দি থাকবি তুই৷ এতে আম্মার কসম খুব ভালো ভাবে মানা হবে। তার ছোট পুত্র’কে যেমন জানে রক্ষা করা হবে তেমনি সকল অন্যায়,পাপাচার থেকেও মুক্ত রাখা হবে।’
-‘আমার মুনের কী হবে?’
কাতর স্বরে প্রশ্নটি শুনতেই বাঁকা হেসে প্রণয় বলল,
-‘প্রেরণা চৌধুরীর প্রিয় জিনিসগুলোর প্রতি আঘাত করা এত সহজ নয় রঙ্গন৷ এ মুহূর্তে তোকে আমার খু/ন করে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু প্রেরণা চৌধুরীর প্রিয় জিনিস বলে পারলাম না!’
রঙ্গন আর কিছু বলল না৷ নিশ্চুপ হয়ে রইল। প্রণয় এবার কঠোর স্বরে আরেকটি প্রশ্ন করল,
-‘মান্নাত বাইজির আসল খু/নি’কে কেন বাঁচাতে চাইছিস তুই? কে সেই লোক যার জন্য আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিতেও তোর বিবেকে বাঁধল না?’
রঙ্গন কম্পিত স্বরে বলল,
-‘মেজো ভাই!’
রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে প্রণয় বলল,
-‘কি দরকার ছিল এসবের? পাপের বোঝা আর কত ভারী করবে পলাশ চৌধুরী।’
রঙ্গন এবার সবুর উদ্দিন’কে উদ্দ্যেশ্য করে বিশ্রী ভাষায় একটি গালি দিল। বলল,
-‘তোমার আর নুরের বিয়ের পেছনে মান্নাতের অনেক বড়ো একটি অবদান রয়েছে। সবুর উদ্দিন মেজো ভাই’কে এসব কানপড়া দিয়ে রাগিয়ে দিছে। আর মেজো ভাই…’
আবারও চোয়াল শক্ত হয়ে গেল প্রণয়ের। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল,
-‘সবুর উদ্দিন!’
-‘অবাক হচ্ছো তুমি আমিও হয়েছিলাম। মাটির মতো নরম,দয়ালু মানুষ’টার আসল রূপ সম্পর্কে জানতে পেরে।’
-‘সবটা খুলে বল।’
কিঞ্চিৎ ইতস্ততভাবে রঙ্গন বলল,
-‘বাইজি রূপসীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে হঠাৎ পাশের কক্ষ থেকে মৃদু গোঙানি শুনতে পাই। রূপসী’র দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সে বলল, চুমকির কন্ঠ। আমার জানামতে বড়ো ভাই বা মেজো ভাই সেদিন বাইজি গৃহে আসেনি। আমাদের কোন অতিথিও আসেনি। তাছাড়া বাইজিদের ছুটির রাত ছিল সেদিন৷ আমি ছাড়া কারো আসার কথা না৷ তাই অবাক হয়ে বললাম, কে? রূপসী মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বলল,সবুর উদ্দিন। আমি বিস্মিত হয়ে ওর থেকে সরে গেলাম। বললাম, ছিঃ চুমকির রুচি এত খারাপ।জমিদারের টগবগে যুবকদের ছেড়ে শেষমেষ কুচকুচে কালো, বয়স্ক সবুর উদ্দিনের সঙ্গে। রূপসী মুখ ফসকে বলল,
‘তা নয় তো কি করবো মান্নাত বুবুর মতো জান দিব নাকি? মান্নাত বুবু জানের ভয় না করলেও আমাগো চুমকির জানের ভয় আছে। আমার তো ডর লাগে না জানি কবে ঐ বুইড়া নিচে আমারো পড়ন লাগে। ‘
এসব কথা শুনে মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার৷ বললাম,’মানে? কি বলছো তুমি?’
ভয়ে কুঁকড়ে গেল রূপসী। সত্যিটা কোনভাবেই বলতে চাইল না। সত্যিটা বের করার জন্য ওর ওপর টর্চার করতে হয়েছে। ঐ যে জানের ভয় আছে তাই সত্যিটা আমাকে বলেই দিছে সেদিন। যে সবুর উদ্দিন বাবার মতো স্নেহ করতো। যে সবুর উদ্দিন’কে বাবার মতো সম্মান করতো শারমিন বাইজি,মান্নাত বাইজি। শারমিন বাইজির মৃত্যুর পর সেই সবুর উদ্দিনের আসল রূপ বেরিয়ে আসে৷ নিঃসন্দেহে শারমিন বাইজি’কে ভয় করতো বলেই সে বেঁচে থাকা অবস্থায় তার আসল রূপটা মুখোশের আড়ালে ঢাকা পড়ে ছিল। যেই বাইজি গৃহ থেকে শারমিন বাইজির অস্তিত্ব হারিয়ে গেল। সবুর উদ্দিনও নিজের হীন মানসিকতা ফুটিয়ে তুলল৷ এক রাতে মান্নাত বাইজির কক্ষে যায় সবুর উদ্দিন। সময়টা তোমাদের বিয়ের গুটিকয়েক আগের। মাঝরাতে মান্নাত সবুর উদ্দিন’কে দেখে বেশ অবাক হয়। কোন সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চায়। সবুর উদ্দিন বুকে ব্যথার বাহানা দিয়ে মান্নাতের কক্ষে ঢুকে। মান্নাত সত্যি তাকে বিশ্বাস করে সেবা করতে চায় কিন্তু ধীরে ধীরে সবুর উদ্দিনের ভাবসাব স্পষ্ট হয়ে ওঠলে প্রতিবাদ করে। অনেক জোর জুলুম করেও মান্নাত’কে বাগে আনতে পারে না। শেষে মান্নাত তাকে আঘাত করে। চিৎকার করে সকল বাইজিদের ডেকে আনে। বেশ হেনস্তা হয়েই সবুর উদ্দিন চলে যায়। এরপর ছলে বলে কৌশলে অনেকবার মান্নাত’কে কাছে টানার চেষ্টা করে। নিজের কামনা বাসনা জানায়। লাভ হয় না৷ শেষে হুমকি দেয় সে যদি তার কাছে ধরা না দেয়। ভয়ংকর শাস্তি ভোগ করতে হবে৷ এখন বাইজি গৃহের সবাই সবুর উদ্দিন’কে যমের মতো ভয় করে। মান্নাত বাইজির সঙ্গে কি ঘটেছে সকলে না জানলেও হঠাৎ তার এভাবে উধাও হয়ে যাওয়াতে ভীষণ ভয় পেয়েছে তারা। সবুর উদ্দিন মান্নাত’কে ব্যবহার করেই এখন রাতের পর রাত বাইজিদের সঙ্গে কাটায়। ‘
কথপোকথনের এ পর্যায়ে শ্বাসরুদ্ধ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শাহিনুর বাইজি গৃহের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। তার শ্বাস নিশ্চল,দৃষ্টি স্থির। এতগুলো নির্মম সত্যি জেনেও তার হৃদয়ে স্পন্দন বাড়েনি। দৃষ্টি ঝাপসা হয়নি। দুঃখ পায়নি, কষ্ট হয়নি। তার শরীর এবং মনের গুমোট ভাবে প্রকৃতির হিমশীতল বাতাস এসে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। আকাশে মেঘ গর্জে ওঠল তবুও একটু কেঁপে ওঠল না সে৷ জগতের কোন দুঃখ, কষ্টই তাকে ছুঁয়ে দিতে পারল না। মানুষ’দের কর্মকাণ্ড গুলো এখন তাকে অবাক করে না৷ আকস্মিক ভাবে কোন ঘটনা ঘটে গেলেও বিস্ময় জাগে না মনে। যার জীবনে সুখ আসার আগেই দুঃখ জায়গা করে নিয়েছে। তার জীবনে নতুন দুঃখের আগমণ হলে তেমন প্রতিক্রিয়া সত্যি আসে না। আম্মার মৃত্যুর পর প্রিয় বুবুর খণ্ডিত দেহের টুকরো যেদিন সচক্ষে দেখেছিল,সহস্তে স্পর্শ করেছিল,সেদিন থেকেই জগতের কোন দুঃখ, কষ্ট ছুঁতে পারে না তাকে। তার কাছে জগৎ মানেই বিশ্বাসঘাতক’দের আস্তানা। যে আস্তানায় আবেগ, অনুভূতি, চোখের পানি, হাহাকার গুলো বড়োই হাস্যকর।
[৬৫]
ভোর পাঁচ’টা।ঘুমন্ত শাহিনুরের ললাটে গাঢ় একটি চুমু খেল প্রণয়৷ কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে ডাকল,
-‘বউ।’
নড়েচড়ে ওঠল শাহিনুর। পিটপিট করে এক পলক তাকিয়ে পিঠ ঘুরিয়ে শুয়ে রইল। ঈষৎ হেসে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরল প্রণয়। ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে মৃদ্যুস্বরে ডাকল,
-‘বউ।’
সহসা শাহিনুর তার দিকে ঘুরে তাকাল। অগ্নিচক্ষুতে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-‘কথা বলার সময় হয়েছে আপনার? আমার তো হয়নি।’
প্রণয় মুচকি হেসে কিছু বলতে উদ্যত হতেই। বাইরে হট্টগোল শুনতে পেল। বাইজি গৃহের প্রবেশদ্বারের সম্মুখে সবুর উদ্দিনের রক্তে রঞ্জিত গলা কাটা লাশ পড়ে আছে। একটি দেহ দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় পড়ে আছে ভূমিতে!