কাউকে ভীষণ ভালবেসে ফেলার পরে নিজের মন বোধ হয় আর নিজের কন্ট্রোলে থাকে না।নিজের অনিচ্ছায় মন অন্য কারো দখলে চলে যায়।মন একবার কারো দিকে ঘুরে গেলে তাকে আর ফেরানো যায় না।এই কিশোরী মন টা যে বিহান ভাই কেটে নিয়েছে শুধুই কি যাতনা দেওয়ার জন্য।কত স্বপ্ন নিয়ে ছিলাম আজ আমার বানানো কেক টা দিয়ে দিয়ে উনার জন্মদিন পালন করবো কিন্তু চাইলেই কি আর মানুষ তা পায়।মানুষ ভাবে এক হয় আরেক।প্রেয়সীর আনা কেকেই পালিত হয়ে গেলো বিহান ভাই এর জন্মদিন।
জীবনে সব কিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু কারো করা ভীষণ অপমান সহ্য করতে পারি না।প্রেয়সী আমার থেকে বেটার ভালো কথা আমি তো কমপেয়ার করতে যায় নি তার সাথে নিজেকে।আর কোনদিন ওই নিষ্টুর বেঈমান বিহান নামক মানুষ টার কথা ভাববো না।কেনো ভাববো আমি?কি হই আমি উনার কিছুই তো না।অহেতুক কষ্ট ছাড়া কি পেলাম আমি।
রাত আটটার দিকে বাড়িতে প্রবেশ করলাম আমি।মুখে কোনো কথা নেই।আম্মু আমাকে দেখে বললো,’কিরে দিয়া এত সকালে চলে এলি যে।তোদের না আজ থেকে আসার কথা।’
‘আম্মুর কথার কোনো উত্তর দিলাম না আমি।কারণ আম্মুর কোনো কথা আমার কানে বাজছিলো না।আমার মন ধ্যান চিন্তা সব টায় ছিলো ও বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর।আম্মু এবার সন্দিহান ভাবে বললো,কিরে রিয়া কোথায়?আর কাউকে দেখছি না যে।তুই কি একা এসছিস দিয়া।’
‘হ্যাঁ আম্মু আমি একাই এসছি।।’
‘কিহ বললি?তুই একাই এসছিস।এত রাতে তুই অতদূর থেকে একা চলে আসলি।শহরে মদখোর গাজাখোর এর অভাব নেই যদি কেউ কিছু বলতো?..’
‘আমি এখন ছোট নেই আম্মু।এত টুক রাস্তা আমি একাই আসতে পারি।’
‘খুব সাহস বেড়েছে তাইনা তোর।নিজের খামখেয়ালি মতো চলাফেরা শিখে গিয়েছিস।দিন দিন এত অসভ্য হচ্ছিস তুই। তোর বাবা আসুক তুই কোন সাহসে একা একা এসেছিস সেটার কইফত দিতে হবে।কেনো শুভ কে বললে কি হতো।বেয়াদব মেয়ে কোথাকার ভাবতেই আমার কেমন লাগছে একা চলে এসছিস।।।’
‘প্লিজ আম্মু এবার একটু থামো।সব সময় এত শাষন আমার ভাল লাগে না।তাছাড়া তোমার মেয়ে এতটা রূপসী নয় যে কোনো ছেলে নজর দিবে।তোমার মেয়ের হাইট এত টা মারাত্মক ভাল না যে ছেলেরা দেখে পাগল হয়ে যাবে।কতটা কুৎসিত মেয়ের জন্ম দিয়েছো তুমি জানোনা।জানোই তো কেমন বাজে চেহারার তোমার মেয়ে।জেনে বুঝে এগুলা আজগুবি কথা কেনো বলো?’
‘আম্মু আমার রিয়্যাক্ট দেখে অবাক হয়ে গেলো।কারণ আগে কখনো আম্মুর সাথে এমন ব্যাবহার আমি করি নি।খুব গতির সাথে নিজের রুমে গিয়ে দরজা খুব জোরে লাগিয়ে দিলাম আমি।’
ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা দিয়ে সুয়ে রইলাম আমি।চোখ দিয়ে অনবরত ঝরে যাচ্ছে চোখের পানি।
‘কিছুক্ষণ পরে মামি ফোন দিলেন আম্মুর কাছে।মামি আম্মুকে প্রশ্ন করলেন, দিয়া কি বাড়িতে গিয়েছে।’
‘বাড়িতে এসেছে ভাবি।কিন্তু তোমরা তো জানোই দিয়া ছেলে মানুষ। একটু দেখে শুনে রাখবে না।এত গুলা মানুষ থাকতে এত রাতে একা বাড়িতে চলে এসছে। ভাবি এই মেয়ে কবে একটা অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে।’
মামি ফোন টা কেটে দিয়ে বিহান ভাইকে ডাকলেন,অলরেডি আমাকে অনেক খোজাখুজি চলছিলো। বাড়ির কোথাও না পেয়েই আম্মুর কাছেই ফোন টা দেওয়া মামির।
________________________________
আমার ফোনে অসংখ্য বার বিহান ভাই এর ফোন। অনবরত মেসেজ করেই যাচ্ছেন কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিলাম না।নাম্বার সহ ব্লক করে দিলাম।
রাত এগারো টা বাজে কি মনে করে ফোনের দিকে তাকালাম দেখি বিভোর ভাই এর ফোন।অনেক বার মেসেজ করছে বিভোর ভাই খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে নাকি।ছাদে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো।বিভোর ভাই এর অনুরোধ আমি ফেলতে পারলাম না।বিভোর ভাই রিকুয়েষ্ট করলেন কেউ যেনো না জানে যে,আমি ছাদে এসছি।বিভোর ভাই ঠিক কেনো আমাকে এইভাবে অনুরোধ করছেন জানিনা।আস্তে করে ছাদের দিকে গেলাম।ছাদে গিয়ে দেখি কেউ নেই। কিছুক্ষণ পরে দেখি মই বেয়ে কেউ একজন উঠে আসছে।বিহান ভাই কে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।উনি এখানে এখন।উনার বাড়িতে না উনার প্রিয়জন এসছে।তাছাড়া এখানে তো বিভোর ভাই এর আসার কথা উনি কেনো?উনাকে দেখে আমি পেছন দিক ঘুরে রওনা হতেই হাত ধরে টান দিলেন।প্রচন্ড রাগে আমার শরীর জ্বলছে।তার মানে বিভোর ভাই এর ফোন থেকেই উনি মেসেজ দিচ্ছিলেন।হাত খুব জোরে ঝাড়ি দিয়ে বললাম ছাড়ুন বলছি।
‘উনি হাত টা ধরে রেখে বললেন, এত রাগ।’
‘রাগের কি আছে ছাড়ুন আমার হাত।আমার একটুও পছন্দ হচ্ছে না ব্যাপার টা যে আপনি আমার হাত ধরে রেখেছেন।’
‘ক্যানো পিচ্চি।কি করেছি আমি।’
‘কিছুই করেন নি।আমার ঘেন্না লাগছে জাস্ট আপনার স্পর্শ। মিথ্যাবাদী মিথ্যুক মানুষ। ‘
‘এত ঘৃনা করিস আমায়।আমার পিচ্চি কখন এমন হয়ে গেলো।।।”
‘আমি একটুও পিচ্চি না বিহান ভাই।আর আপনার আপনার করছেন কেনো আমি কি আপনার সম্পত্তি নাকি।’
‘দিয়া মানেই বিহানের আকাশের রংধনু পিচ্চি।এত রাগ কি নিয়ে হয়েছে বল প্লিজ।’
‘আমার কেনো রাগ হবে? কোন অধিকারে রাগ হবে।আপনি আমার মামাতো ভাই আমি আপনার ফুফাতো বোন এর বেশী তো কিছুই না।এতে রাগের কি আছে।’
‘আমি কখনোই তোকে বোন বলে ভাবি না দিয়া।তুই মানেই আমার আকাশের রংধনু।তুই ছাড়া বিহানের আকাশে চাঁদ ওঠে না। এটা বুঝিস না।’
‘আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি বিহান ভাই।কেনো বার বার আমাকে ভাঙতে আসেন আর গড়তে আসেন।দয়া করে আমাকে মুক্তি দিন প্লিজ।’
‘ক্ষতি তো তুই আমার করেছিস পিচ্চি।আম্মুর এই জেদী ছেলেটাকে উইক করে ফেলেছিস।এই যে তোর রাগ কে আমি ভয় পাচ্ছি,তোর রাগ হলে আমার ভেতরে কষ্ট বাড়ছে এটা কি কম বড় ক্ষতি।’
‘আপনি এখান থেকে আপনার সুন্দরী বান্ধবীর কাছে যান।যে দেখতে সুন্দর, হাইট ভালো,ডাক্তার। সেখানে গিয়ে এগুলা বলেন বিহান ভাই।সে কোটিপতির মেয়ে।আপনার জন্য দামী গিফট আনতে পারে।আমার মতো অযোগ্য কালো,শর্ট,গরীব না।’
‘বুঝেছি রাগে মাথা ঠিক নেই।এত টুকু মাথায় এত রাগ থাকে বাবাহ।আচ্ছা রাগ টা পরে দেখাস প্লিজ।এত কষ্ট করে বানানো কেক টা কাটবি না। ‘
আমি রাগি দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম উনার দিকে।
“বিহান ভাই বললেন,ফ্রিজ খুলেছিলাম পানি বের করতে হঠাত কেক টা চোখে পড়লো।দেখেই বুঝেছিলাম এটা পিচ্চিই বানিয়েছে তার রাক্ষস ভাইয়ের জন্য।তাকে কোথাও খুজে না পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।আম্মু আচ্ছা বকুনি দিলো।ভাবলো তার ছেলে ই তার বউমা কে কিছু বলেছে।আচ্ছা পুচকি এই যে রাগ দেখিয়ে চলে এলেন আপনি কি জানেন আপনার একটা ফোন কলে পাগলের মতো ছুটে এসছিলাম আমি।সেই আপনি আমাকে ইগনোর করলে এই জন্মদিনের মানেই হয় না।এগুলা নিয়ে মাতামাতি ভাল লাগে না।কিন্তু তার ফোন কলেই তো ছুটে আসা আমার।”
“কেক টা বিহান ভাই এর হাত থেকে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিলাম আমি।কোনো কেক কাটবো না আমি।”
বিহান ভাই এর মুখটা মলিন হয়ে গেলো।উনাকে বললাম, এক মিনিট দাঁড়ান বলেই উনার দেওয়া গিফট গুলো এক মিনিটের মাঝে রুম থেকে সব নিয়ে উনার মুখের উপর ছুড়ে ফেলে দিলাম।
“আজ আমি অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলাম আপনাকে নিয়ে।আমি জানি আপনি বকুনি দিতেন।তাও আমি রেডি ছিলাম।আপনাকে নিয়ে মনের মাঝে তৈরি হওয়া ফিলিংস গুলো একটু একটু করে দানা বাঁধছিলো আমার মনে।আপনাকে আমি ভালবেসেছিলাম বিহান ভাই।ভীষণ ভালবেসেছিলাম।কিন্তু আপনি আমার কিশোরী মন নিয়ে খেলা করেছেন।নিজের প্রেমিকা থাকতেও আমার সাথে প্রেমিকা সুলভ আচরণ করেছেন আপনার বন্ধুরা আমাকে যে অপমান করেছে আমি কোনদিন সেটা ভুলবো না।আজ থেকে আপনাকে আমি চিনি না।চলে যান এখান থেকে।”
সেদিন রাগে অভিমানে আমার মাথা ঠিক ছিলো না।বিহান ভাই এর মুখ টা ছিলো ভীষণ মলিন।ছাদ থেকে চলে এসে উনাকে ব্লক করে দিলাম সব জায়গা থেকে।
প্রায় পনেরো দিন কেটে গিয়েছে,আর কোনো যোগাযোগ নেই কারো সাথে কারোর।বিহান ভাই আর একবারের জন্য ও আমার খোজ নেন নি।বা কারো সাথে যোগাযোগ করেন নি।আমিও নিজের মতো করেই রইলাম।বিহান ভাই কে বোধহয় প্রথমবার কেউ এত অপমান করেছে।যা ইচ্ছা করুক যা ইচ্ছা ভাবুক আমার কিছুই যায় আসে না।।
—————————————————
হঠাত দেখি ফোনে দশ টার মতো মিস কল।নাম্বার টা সম্পূর্ণ অচেনা। আগে কখনো দেখি নি।কারো দরকারী কল ভেবে কল ব্যাক করলাম।ফোন টা কেয়াতে দিয়ে কল ব্যাক করলো।ফোনের ওপাশ থেকে অচেনা একটা ছেলের কন্ঠ আমার নাম ধরে ডাক দিলো,”দিয়া”কিছটা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম তুমি ই দিয়া রাইট।
“জ্বী আমি দিয়া।”
“তোমার সাথে আমার একটু ইমারজেন্সি কথা ছিলো।”
“আপনাকে তো চিনলাম না ভাইয়া।”
“আমি বিহানের ফ্রেন্ড।সেদিন আমাকে দেখেছিলে বিহানের জন্মদিনে।আই এম সরি দিয়া।তোমার সাথে যেটা হয়েছে অনেক বড় অন্যায় হয়েছে।আমি আসলে জানতাম না অবনি আর নেহাল তোমার সাথে এতটা বাজে ব্যাবহার করেছে।আমি পরে জানতে পেরেছি ওরা তোমাকে কি কি বলেছে।!
“প্লিজ ভাইয়া এগুলা শুনতে ভাল লাগছে না।ফোনটা রাখছি।”
“বিহান আর ডাক্তারি পড়বে না দিয়া।”
কথাটা শুনেই বুকটা কেঁপে উঠলো আমার।বিহান ভাই আর পড়বেন না মানে।
কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম কেনো ভাইয়া কি হয়েছে।
“জানোই তো বিহান যা বলে তাই করে এক রোখা জেদি ছেলে।ওর সিদ্ধান্ত কেউ পাল্টাতে পারে না।একমাত্র তুমি পারবে আমি জানি।আজ থেকে প্রায় দশ দিন আগে ভার্সিটির মধ্য অবনি আর নেহাল তোমাকে কি বলেছিলো ওটা নিয়ে ফ্রেন্ড রা হাসাহাসি করছিলো।বিহান মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো অবনি প্রেয়সী নেহাল এর কথা।বিহান গম্ভীর হয়ে গেছিলো।আমি মেডিকেল কলেজে বিহানের বেষ্ট ফ্রেন্ড তাই আমি পুরাটা জানি।অনেক মানুষের মাঝে প্রেয়সী বিহান কে প্রপোজ করেছিলো। বিহান প্রেয়সীর দুই গালে দুইটা থাপ্পড় মেরেছে প্রচন্ড রাগ নিয়ে। এবং বলেছে এতদিন আমাকে বিরক্ত করিস আমি কিছুই বলি নি।কিন্তু দিয়াকে হার্ট করার অধিকার আর সাহস কিভাবে পেয়েছিস।নেক্সট টাইম দিয়ার আশে পাশে গেলে অনেক খারাপ হবে সিসুয়েশন।”
এ ছাড়া বিহান আরো অনেক রিয়্যাক্ট করেছিলো।আমাদের মেডিকেল কলেজের সবার ক্রাশ ছিলো বিহান।এখন সবার মুখে একটা কথা কে এই দিয়া যার জন্য বিহান এতটা সিরিয়াস।তুমি বিহানের সাথে কথা বলো না এ কারনেই বিহান আর লেখাপড়া করবে না।প্রচন্ড জ্বর নিয়ে সকালে বাড়িতে গিয়েছে।প্লিজ দিয়া বিহান কে বোঝাও।রিকুয়েষ্ট ইউ দিয়া।
ফোনটা কেটে দিয়ে দীর্ঘঃনিশ্বাস নিলাম।মানুষ টা কঠিন কিন্তু ভেতরে ভেতরে কত যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে।
হঠাত দেখি মামির ফোন।ফোন টা রিসিভ করতেই বললো দিয়া একটু আসবি মা।বিহান অনেক অসুস্থ তাছাড়া ও নাকি আর লেখাপড়া করবে না।
এক ছুটে যা পরা ছিলো তাই পরেই চলে গেলাম মামাদের বাড়ি।
মামির কোলে মাথা দিয়ে প্রচন্ড জ্বরে জ্ঞানে নাকি অজ্ঞানে বলছেন জানিনা।
“আই নিড দিয়া আম্মু।আমি আর পারছি না আম্মু।দিয়াকে এনে দাও আম্মু।প্লিজ আম্মু দিয়া ছাড়া পৃথিবীর কিছুই ভাল লাগে না আমার’
দরজায় দাঁড়িয়ে দু’ফোটা চোখের পানি ছেড়ে দিলাম আমি।