ওপর থেকে তাড়াহুড়ো পায়ে নেমে এলেন রাশিদ। সঙ্গে আমজাদ ও আছেন। দুজন বিশ্রাম করছিলেন এক ঘরেই। ওনাদের নামতে দেখেই ছোটদের খেলাধুলায় ভাঁটা পরল। অবাক চোখমুখ গুলো ধূসরের থেকে সরে নিক্ষেপ হলো সেদিকে। রাশিদ ধৈর্য হীন কণ্ঠে ময়মুনাকে ডাকলেন। পাশাপাশি উচ্চারন করলেন,
‘আপা, আপা! ‘
কাজ ফেলে ছুটে এলেন তারা। জিজ্ঞাসা নিয়ে সাথে এলেন বাকীরাও। মিনা বেগম শুধালেন,
‘ কী হয়েছে?’
‘ ওনারা এসে গেছেন। ‘
এক বাক্যে তটস্থ হলো সবাই। বসে থাকা সকলে তৎপর উঠে দাঁড়াল। ময়মুনা খাতুন চোখ গোল করে বললেন,
‘ কারা? বর্ষার শ্বশুরবাড়ির লোকজন?’
‘ হ্যাঁ, যাও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো। আমরা এদিকটা দেখছি। ‘
ময়মুনা বেগম ছুটলেন। মিনা বেগম গেলেন পেছনে। সুমনা বেগম মেঝেতে বিছানো পাটি ভাঁজ করতে নিলেই বর্ষা আটকায়। কে*ড়ে নেয় । অতিথি মানুষ কাজ করবে কেন? বরং নিজেই গুছিয়ে শান্তার হাতে দেয়। পরপর দৌড়ে চলে যায় কামড়ায়। শ্বশুর বাড়ির লোকদের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়?
পুরুষরা দরজার দিক এগোলেন। সোফার ওপর ফেলে রাখা এলোমেলো কুশান গুলো ত্রস্ত ভঙিতে ঠিকঠাক করল পুষ্প। বাড়ির সামনে গাড়ি ভিড়ানোর শব্দ এলো। মৈত্রী, শান্তা, সুপ্তি বাপ চাচার পেছনে ছুটল। পিউ একইরকম দাঁড়িয়ে। নড়ছেওনা, কথাও নেই। ধূসর দু কদম এগিয়ে সদর দরজার কাছে যায়। গলা উঁচিয়ে বাইরেটা দেখে নেয়। বাড়ির সামনে গাড়ি ভিড়েছে মাত্র। পরপর নামলেন ছয়জন পুরুষ। অল্পবয়সী ছেলেই বেশি। ধূসর দেখা মাত্র পিউয়ের দিক এগোলো। কাছে এসে ওর দিকে তাকাতেই ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে ফেলল। মেয়েটা কেমন অবাক চোখে,হা করে তাকিয়ে। ধূসর আমোলে নিলোনা। উলটে ব্যস্ত ভঙিতে বলল,
‘ ওপরে যা। ওনারা গেলে নামবি।’
খরখরে কণ্ঠে পিউয়ের হেলদোল নেই। তার নির্নিমেষ অক্ষিপট এক চুল সরল অবধি না। ধূসর আশেপাশে সবার দিকে তাকাল একবার। পরপর আস্তে, পুরু কণ্ঠে বলল,
‘ সমস্যা কী?’
তাও রা নেই। ধূসরের শৈলপ্রান্ত এক জায়গায় গুছিয়ে এলো। মৃদূ ধম*কে বলল,
‘ কিছু বলেছি না?’
পিউ নড়ে ওঠে, সম্বিৎ ফেরে। ধূসরের তপ্ত চাউনি খেয়াল পরতেই এক ছুটে ত্যাগ করে বসার ঘর। পুষ্পকেও চোখ দিয়ে একইরকম ইশারা করল ধূসর। ভাইয়ের জো হুকুম মানতে কুটিকুটি পায়ে সেও উঠে গেল।
মেয়েদের মধ্যে,সুপ্তি,শান্তা,মারিয়া,মৈত্রী উপস্থিত সেথায়। মিনিটের মধ্যে বসার ঘর ভরে আসে। রাশিদ,মুত্তালিব সাদরে সোফায় নিয়ে বসালেন অতিথিদের। সিকদার বাড়ির সবার সাথে পরিচিত করালেন। ধূসরের সঙ্গেও সাড়া হলো করমোর্দন। সাদিফ নেই এখানে। মাত্রই কোথাও একটা গিয়েছে।
ছেলের দুলাভাই,নিজের ভাই বন্ধু আর কাজিন সহ মোট ছয়জন এসেছে। বড় বড় তিনটে লাগেজ বয়ে এনেছে সাথে । বর্ষার পা থেকে মাথা অবধি যা প্রয়োজন সব রয়েছে এখানে। পাঁচ মিনিটের মাথায় ময়মুনা বেগম, শিউলি খাতুন, মিনা বেগম হাজির হলেন ট্রে সমেত। একেক জনের হাতে একেক ট্রে,তাতে কয়েক আইটেমের খাবার। ওনাদের দেখে সালাম দিলেন বরপক্ষ।
বর্ষার দেবর ময়মুনাকে শুধাল ‘ ভাবি কোথায় আন্টি?’
‘ ঘরেই আছে বাবা।’
ছেলের দুলাভাই বললেন ‘ ওকে ডাকবেন একটু? দেখা করে যাই।’
ময়মুনা স্বামীর দিক তাকালেন। তিনি আবার দেখলেন আমজাদের দিকে। আমজাদ ইশারা করলেন,বোঝালেন ডাকতে। ময়মুনা খাতুন সুপ্তিকে বললেন,
‘ ডেকে আন তো মা।’
ছুটল মেয়েটা। বর্ষাকে ডাকতে গেল। এই ডাকাডাকির জন্যে দিনে অন্তত পঁচিশ বার তাকে দৌড়াতে হয়। অত বড় সিড়ি ওঠা-নামা করতে হয়। এতবার ছোটাছুটিতে আজ অবধি মোটা হওয়া হলোনা তার। হবেওনা। জন্ম থেকেই হ্যাংলা-পাতলা রয়ে গেল।
সুপ্তি একেবারে বর্ষাকে সাথে নিয়েই নেমেছে। মাথায় তার বিশাল ঘোমটা। নরম পায়ে এসে হাত উঁচিয়ে সালাম দিলো সবাইকে। অর্ধেক কথাই অস্পষ্ট। চোখ মেঝেতে, কণ্ঠ কাঁ*পছে কুণ্ঠায়।
ছেলের দুলাভাই হেসে বসতে বললেন। বসল সে। জিজ্ঞেস করলেন ‘ কেমন আছেন?’
বর্ষা কম্পিত স্বরেই জবাব দিল ‘ ভালো। আপনারা? ‘
শুরু হলো গল্প। মারিয়া দাঁড়িয়ে এক কোনায়। তার সুন্দর চেহারার দিক একটু পরপর তাকাচ্ছে বরের বন্ধু আরিফ। মারিয়ার খেয়াল পরল অনেকক্ষন পর। প্রথম দফায় গায়ে না মাখলেও আস্তেধীরে চাউনী জোড়াল হলো। মারিয়ার অস্বস্তির সাথে মেজাজ বিগড়াল। এভাবে ক্যাবলার মত চেয়ে আছে কেন? আশ্চর্য!
সে গায়ের ওড়না ঠিকঠাক করল। কপালে পরেছে গাঢ় ভাঁজ।
আচমকা সেখানে হাজির হলো সাদিফ। আলগোছে একটা প্ল্যাস্টিকের চেয়ার পাতাল ঠিক তার পেছনে। ওপরে রাখল একটা বড় সাইজের পঁচা টমেটো। এটা সে ভুজুংভাজুং দিয়ে বেলালের থেকে জোগাড় করেছে। ছেলেটা অবশ্য কারন না জেনেই এনে দিয়েছিল।
সাদিফ সচেতন দৃষ্টি চারপাশে বোলাল। না,এদিকে কারোরই মনোযোগ নেই। সে কাজ শেষ করে এসে পাশে দাঁড়াল মারিয়ার। সে ওকে দেখে ভ্রুঁ কোঁচকায়। বিপরীতে সাদিফ দাঁত বার করে হাসল। ওমনি মুখ বেঁকাল মারিয়া। ভড়কাল সাদিফ। সামনে ফিরে বিদ্বিষ্ট হয়ে শ্বাস ফেলে ভাবল ‘ কী মেয়েরে বাবাহ!’
সোফায় তখন গল্পে মশগুল সবাই। রাশিদ,আমজাদ জমিয়ে নিয়েছেন। ছেলের বড় দুলাভাই মোটামুটি বয়সের বলে আড্ডা বেশ মেতেছে।
এর মধ্যেই সাদিফ মারিয়ার পায়ের দিক চেয়ে উঁচু কণ্ঠে বলল,
‘ আরশোলা!’
মারিয়ার হৃদপিণ্ড ছলকে ওঠে। সত্যি-মিথ্যে দেখারও প্রয়োজন পরল না। ওইটুকু শুনেই চিৎকার ছুড়ল
‘ আআয়ায়ায়ায়া…’
পরপর ভ*য় পেয়ে পিছিয়ে যেতে নিলেই চেয়ারটা বাধল৷ মারিয়া টাল হারিয়ে ধপ করে বসে পরল। ওমনি পঁচা টমেটো ফেটে মেখে গেল গায়ে। কিছু ছিটকে লাগল লম্বা চুলে। জামার ব্যাকসাইড পুরো একাকার হয়ে গেছে। মারিয়া হকচকাল। থমকে তাকাল। যত্রতত্র হুহা করে হেসে উঠল সাদিফ। হাসতে হাসতে নুইয়ে গেল। পেট চে*পে ধরল। মারিয়া হতবুদ্ধি হয়ে হাত রাখল চেয়ারে। আঁঠালো কিছু উঠে এলো আঙুলে। নাকের কাছে ধরতেই পঁচা গন্ধে গা গুলিয়ে এলো। মুখভঙ্গি দেখে আরো বেশি করে হেসে ফেলল সাদিফ। মারিয়ার বুঝতে বাকী নেই,এসব কার কাজ! কট*মট করে তাকাল সে। ইতোমধ্যে সকলের মনোযোগ পরেছে এদিকটায়। সাদিফের আরশোলা কথাটা না শুনলেও মারিয়ার চেঁচানো স্পষ্ট শুনেছে। রাশিদ উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
‘ কী হলো মারিয়া? চেঁচালে কেন?’
মারিয়ার রা*গে, দুঃ*খে কা*ন্না পেল। সে না পারছে উঠতে,না পারছে বসে থাকতে। অথচ দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল ‘ কিছু না।’
সাদিফ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তখন। ঠোঁট চে*পে হাসছে। মাঝে মাঝে শরীর দুলছে। মারিয়া গাঁট হয়ে বসে থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভেবে,অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত হয় সকলে। সাদিফ সুযোগ বুঝে এগিয়ে এলো একটু। ক্ষানিক ঝুঁকে আস্তে করে বলল,
‘ মিথ্যে মিথ্যে সিনিয়র সাজলে,এরকম সন্মানই তার প্রাপ্য হয় মিস ম্যালেরিয়া ।কী ভেবেছিলেন? বয়সে আমার ছোট হয়েও বড় আপু হবেন? ভার্সিটির সিনিয়রদের মত র্যাগিং করবেন তারপর? সত্যিই, জবাব নেই আপনার বুদ্ধির! বোঁকা মেয়ে,
আজকের পর সাদিফের সাথে ঝগ*ড়া করতে এলেও কিন্তু দুবার ভাববেন, কেমন?’
তারপর বিজয়ী হেসে সোজা হয়ে দাঁড়াল। হেঁটে গিয়ে সামিল হলো সভায়। পেছনে মারিয়া অসহায় বনে বসে থাকল। যতক্ষন না, বসার ঘর খালি হবে,এভাবেই থাকতে হবে। উঠে, ঘুরলেই তো দেখে নেবে সবাই। মান ইজ্জ্বত থাকবে কিছু?
সেরাতে বর্ষা একা নয়,গোসল তাকেও সাড়তে হয়েছে। চুলে মেখে যাওয়া পঁচা টমেটোর রসে শ্যাম্পুও করতে হলো। মারিয়া কাঁ*পতে কাঁ*পতে কম্বল মুড়ি দেয়। এক ঘর মানুষের সামনে এত বড় অপমান! সাদিফের অট্টহাসি মনে করেই সে পণ করল,
‘ এর শোধ আমি তুলবই। ‘
*****
পিউ বিছানায় বসে । ঠোঁট জুড়ে মুচকি হাসির ছোটাছুটি। চোখের সামনে মেলে রাখা ফোনের স্ক্রিন। জ্বল্পজ্বল করছে ধূসরের শার্ট-প্যান্ট পরা ছবি। এইত দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। কিছুদিন আগেই আপলোড করেছিল টাইমলাইনে। পিউ যে কতবার দেখছে এটা! উফ! কী মারাত্মক স্টাইল দাঁড়ানোর!
মাঝেমধ্যে ধূসরের বুকপকেটে গোঁজা সানগ্লাস টাকেও ভীষণ হিং*সে হয়। ওটাও তার বুকের কাছে জায়গা পায়,আর সে?
ভেবেই পিউ লজ্জ্বায় দুহাত ভে*ঙে এলো। কানের কাছে বেজে উঠলো একটু আগের কথাগুলো। ধূসরের মন মাতানো,হৃদয় জুড়ানো সেই সব অবিশ্বাস্য ধ্বনি। সেই ক্ষনে পিউ তলিয়ে গেল দোটানায়। ধূসর কি ওসব ওকে উদ্দেশ্য করে বলেছে,না কি বলেনি? একবার মনে হলো ওকে বলেনি। যদি বলতেন,তবে যার হৃদয়ে এত প্রেম,সে কী করে এত নিরুদ্বেগ থাকতে পারে?
আবার মনে হচ্ছে ওকেই বলেছে। নাহলে আর কেই বা আছে ধূসর ভাইয়ের? ওনার পাশে কাউকে ভাবলেই তো…
পিউয়ের বুক কাঁ*পে। বক্ষস্পন্দন বাড়তে বাড়তে পাহাড় ছুঁলো। দুদিকে ঘনঘন মাথা নেড়ে জোর দিয়ে বলল,
‘ না না উনি আমাকেই বলেছেন, আমাকেই।’
তারপর ঠোঁটের কাছে ফোন এনে,ধূসরের ছবিতে দীর্ঘ গভীর চুঁমু আঁকল পিউ। এই লোকটার প্রেমে পাগল হবে সে। ও না,হবে কী?হয়েইত আছে।
হঠাৎ পাশ থেকে ফোনের রিংটোন বাজল। টেবিলের ওপর রেখে যাওয়া পুষ্পর ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে সমানে। পিউ তাকিয়ে দেখল একবার। বিছানায় বসে স্ক্রিনের ছোট ছোট নম্বর ঠাওড় করা গেল না। পুষ্প ওয়াশরুমে তখন। পিউ বসে থেকেই হাঁক ছুড়ল,
‘ তোর ফোন বাজছে।’
ওপাশ থেকে উত্তর আসেনা। অথচ রিং হচ্ছে এখনও। অজ্ঞাত ব্যক্তি অধৈর্য খুব। পিউ শেষমেষ গা থেকে লেপ সরিয়ে উঠে এলো। ফোন তুলল হাতে।
আনসেভ নম্বর দেখে বিভ্রমে পরল। ধরা কী ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতে কে*টে গেল লাইন। সেকেন্ডের মাথায় আবার বাজল। পিউ রিসিভ করল এবার। কানে গুঁজে ‘হ্যালো ‘বলার আগেই উৎকন্ঠিত স্বর ভেসে এলো,
‘ কী করছো? বিজি? ফোন ধরছিলেনা যে? ‘
পিউ মুহুর্তমধ্যে স্বর চিনে ফেলল। বিভ্রান্ত হয়ে আরেকবার ফোন সামনে আনলো। পরিষ্কার চোখ বুলিয়ে ফের কানে ঠেকাল। ওপাশের মানুষটা বলল,
‘ হ্যালো,শুনতে পাচ্ছো না? হ্যালো!’
পিউ অনিশ্চিত কণ্ঠে ডাকল ‘ ইকবাল ভাইয়া?’
লোকটির কথা বন্ধ। পিনপতন নীরবতা নেমে এলো তৎক্ষনাৎ। হ্যাঁ-না বলছে না। টু শব্দ নেই। পিউ আবার বলল,
‘ ইকবাল ভাইয়া না? হ্যালো,শুনতে পা…’
এর মধ্যেই ফোন টেনে নিলো পুষ্প। পিউ চমকালো না,তবে অবাক হলো। পুষ্প স্ক্রিনে তাকাতেই চোখ বড় বড় করল। কেমন ভ্যাবাচেকা খেল। পরপর খট করে লাইন কে*টে দিলো। তাকালো তার দিকে। রা*গ দেখিয়ে বলল,
‘ পারমিশন না নিয়ে কারো ফোন রিসিভ করতে নেই,জানিস না তুই? ‘
‘ ওটা কি ইকবাল ভাইয়া ছিলেন?’
পিউ সঠিক জায়গায় তীর ছু*ড়েছে। পুষ্প তবুও নিভে গেলনা। উলটে প্রতাপ নিয়ে বলল,
‘ ইকবাল ভাই হবেন কেন? উনি কেন ফোন করবেন? আন্দাজে কথা না বললে চলেনা তোর,
তাইনা?’
পিউ ভ্রুঁ কুটি করে বলল ‘ চেঁ*তে যাচ্ছিস কেন? আমিতো শুধু… ‘
পথিমধ্যে কথা কে*ড়ে নিল পুষ্প,
‘ কী শুধু? তুই আমার ফোন রিসিভ করে কী গোয়েন্দা হতে চেয়েছিলি? আর যেন না দেখি আমার ফোন ধরতে। এক চ*ড়ে সব দাঁত ফেলে দেব তাহলে। বেয়াদ*ব কোথাকারে!’
পুষ্পর রুক্ষ ব্যবহারে পিউয়ের বুক ভারী হয়। ক*ষ্ট পেল সে। চোখ ফেটে উঁকি দিলো স্বচ্ছ জল। নেত্রপল্লব ভিজে উঠল। ঠোঁট চে*পে কান্না আটকে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
‘ তুই আমার সাথে আর কক্ষনও কথা বলবিনা।’
এরপর বিছানার কোনায় গিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। পুষ্পর এতক্ষনে হুশ ফিরেছে। কপাল চাঁ*পড়ে, জ্বিভ কা*টল সে। ভ*য় পেয়ে, নার্ভাস হয়ে কী না কী বলে ফেলল, ইশ! সে চটজলদি গিয়ে বোনের পাশে শোয়। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই পিউ মুচ*ড়ে উঠল। দা-পাদাপি করে বলল,
‘ ছাড় আমাকে।’
পুষ্প ছাড়লোনা। উলটে বোনের তুলতুলে গালে চুঁমু খেয়ে বলল
‘আমাল লক্ষী বাবু,এমন কলেনা। ‘
পিউ চুপ করে থাকল। ছোটাছুটি করলেও লাভ হবেনা। পুষ্প মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
‘ সামনে তোর পরীক্ষা তো,অনেক চিন্তায় ছিলাম। ওইজন্যে না বুঝে কী না কী বলে ফেলেছি।স্যরি!’
পিউ নাকমুখ কুঁচকে তাকায়। এটা কেমন লজিক? পরীক্ষা ওর,চিন্তা তার বোনের? কিছু বলতে গেল,তখনি ঘরে ঢুকল বর্ষা। লাজুক লাজুক চেহারাটা দেখতেই পিউ কথা গি*লে নেয়। বর্ষার বুকের সাথে চে*পে রাখা প্যাকেটটায় চোখ পরে। সে দোর চাপিয়ে এগিয়ে এলো। দুবোন তৎক্ষনাৎ শোয়া থেকে উঠে বসে। পুষ্প শুধাল,
‘ প্যাকেটে কী?’
বর্ষা মাথা নামিয়ে হাসল।
মৃদূ কণ্ঠে বলল ‘ তোর ভাইয়া পাঠিয়েছেন।’
পিউয়ের এতক্ষনের রা*গ -ঢাক উবে গেল৷ চোখ বড় করে বলল, ‘ তাই? কী দিয়েছেন,দেখি?’
বর্ষা প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো। হাতে নিয়েই উদগ্রীব হয়ে খুলল সে। বেরিয়ে এলো টকটকে গোলাপ, রজনীগন্ধা আর সাথে একটা লাল পাড়ের কালো শাড়ি। ভেতরে ছোটখাটো চিঠিও আছে। পিউ হাতে তুলল। অনুমতি চাইল ‘ পড়ব?’
বর্ষা মাথা দোলায়। পিউ ভাঁজ খুলে
জোরে জোরে পড়ল,
‘ বিয়ের আগে আমার তরফ থেকে পাঠানো প্রথম উপহার। আশা করছি আর আক্ষেপ নেই! আমার মেয়েদের জিনিস কেনার অভিজ্ঞতা নেই। জানিনা কেমন লাগবে তোমার! তবুও কিনেছি,এখন
আমার মিষ্টি বউটার পছন্দ হলেই শান্তি।’
পিউ থামল। পুষ্প বুকে হাত দিয়ে বলল ‘ হায়! কী রোমান্টিক! ‘
বর্ষা শাড়ির আঁচলটা আঙুলে প্যাচাতে প্যাচাতে বলল,
‘ সকালে কথায় কথায় বলেছিলাম,আমার একটা প্রেম করা হলোনা। এখন তো বিয়েই হয়ে যাচ্ছে। আপনার থেকেও একটা উপহার পেলাম না। যেটা দেখে মনে হবে,না বয়ফ্রেন্ড দিয়েছে।
তাই উনি এখন ওনার ভাইয়ের থেকে লুকিয়ে পাঠালেন। তিনি দিয়েছেন ও লুকিয়ে।’
পিউ-পুষ্প মুখ চাওয়া- চাওয়ি করল। আচমকা দুজনেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পরল বিছানায়। ভ্যাবাচেকা খেল বর্ষা। দুজন সমস্বরে চিৎকারর করে বলল,
‘ উ মাগো টুরু লাভ!’
****
বর্ষার বিয়ে আজ। জাক-জমক অনুষ্ঠানেরও আজকেই সমাপ্তি। এরপর মেয়েটা চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি। আত্মীয় -স্বজন ফিরে যাবে নিজেদের ভিঁটায়। পূর্ন,গমগমে ঘরবাড়ি খালি হবে। যে যার মত ব্যস্ত হবে কাজে। শুধু ফাঁকা পরে থাকবে বাবা মায়ের বুক।
ভোর থেকে ময়মুনা ভার মুখে ঘুরছেন। ঠিকঠাক কাজ করলেও হাসির দেখা নেই। যতবার মনে পড়ছে মেয়েটা চলে যাবে আজ,চোখ জ্ব*লে উঠছে কা*ন্নায়। ক্ষনে ক্ষনে অশ্রু আঁচলে মুছছেন। লাভই হচ্ছেনা! বেহায়া চোখ আবার ভিজে ওঠে।
বর্ষা সকাল বেলা উঠেছে। ঠান্ডা লেগেছে তার। গতকাল বেলালের ডেয়ার পূরন করতে গিয়ে সর্দি বেঁধেছে। টিস্যু দিয়ে নাক মুছতে মুছতে রান্নাঘরে এলো সে। ময়মুনা খাতুন এঁটো চায়ের কাপ ধুচ্ছেন তখন। বর্ষা বলল,
‘ মা,এক কাপ চা দেবে আমায়?’
তিনি বোজা কণ্ঠে বললেন ‘ দিচ্ছি।’
মায়ের গলা শুনে বর্ষার ভ্রুঁ বাঁকা হয়। আপাতত রান্নাঘরে নেই কেউ। বর্ষা একটু এগিয়ে এলো। মায়ের বাহু ধরে নিজের দিকে ঘোরাল। চোখ ভরা জল দেখে আঁত*কে বলল,
‘ ওমা কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?’
ময়মুনা তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছে বললেন,
‘ কিছুনা। পেয়াজ কে*টেছিলাম তাই….’
‘ আমি চলে যাব বলে কাঁ*দছিলে, তাইনা?’
বলতে না বলতেই বর্ষার চোখ বেয়ে জল গালে পরল। মেয়ের কা*ন্না দেখে ময়মুনার আর শক্ত থাকা হলোনা। গা ভে*ঙে কেঁ*দে ফেললেন। সাথে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন ওকে। হাউমাউ করে বললেন,
‘ আমি তোকে ছাড়া কী করে থাকব রে মা? আমার ঘরটা যে খালি হয়ে যাবে।’
বর্ষা জোরে কেঁ*দে ওঠে। শব্দ পেয়ে নাস্তার টেবিল থেকে উঠে পরলেন মিনা বেগম। পিছন পিছন এলেন অনেকেই। মা মেয়ের কা*ন্না দেখে রাশিদের চোখ ছলছলে। বর্ষা কাঁ*দতে কাঁ*দতে ছেলেমানুষী কন্ঠে বলল,
‘ আমি যাব না,কোত্থাও যাব না। বিয়ে করব না আমি।’
মিনা বেগম নরম মনের মানুষ। তার ও চোখ ভরল জলে। এগিয়ে গিয়ে বর্ষার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ বোঁকা মেয়ে! তুই কি একবারে যাচ্ছিস না কী? মন চাইলেই আসবি।’
বর্ষা মায়ের বুকে থেকেই জোরে জোরে দুদিকে মাথা ঝাঁকায়। এই যুক্তি মানেনা সে।
মিনা বেগম ময়মুনা কে কপট ধম*কে বললেন,
‘ কী শুরু করলি তুই মুনা? মেয়েটা যদি বিয়ের দিন কেঁ*দে চোখ ডাবায়,ভালো লাগবে সাজলে?’
রাশিদ ও এগিয়ে এলেন। মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। স্ত্রীকে বললেন,
‘ নিজেকে সামলাও,মেয়েটা যে কাঁ*দছে খুব!’
ময়মুনা বহু ক*ষ্টে কা*ন্না থামালেন,চোখ মুছলেন। মেয়ের মাথা বুক থেকে তুলে গাল দুটো আজোলে নিলেন। আদুরে স্বরে বলেন,
‘ খুব সুখী হবি তুই, দেখিস।’
বর্ষা কাঁ*দছে তখনও।
মিনা বেগিম রান্নাঘর আর জটলা থেকে বেরিয়ে এলেন। কোমল,আদুরে নেত্রে ওপরের ঘরের দিক তাকালেন। তার নিজেরও তো দুই মেয়ে। একদিন প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়মানুসারে ওদেরকেও পাঠাতে হবে পরের ঘরে। তার বুকটাও এভাবে পুড়*বে না তখন? ভাবতেই কা*ন্না উগলে আসে যেন। তিনি যত্র এগোলেন সেদিকে। মেয়ে দুটো এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। এই ফাঁকে একটু আদর করে আসবেন গিয়ে। ও রাতো ভাবে মা সারাদিন ব*কে,ধম*কায়। কিন্তু পৃথিবীতে মায়ের মত ভালো যে কেউ বাসেনা। সে কী কোনও সন্তান বোঝে?’
*******
সাদিফ সিড়ি বেয়ে উঠছে। হাতে সবুজ আপেল।
শূন্যে ছুড়ে আবার ধরে ফেলছে সেটাকে। এর মধ্যে পথে বাঁ*ধল মারিয়া। মেয়েটা সবে ঘুম থেকে উঠেছে। এলোমেলো কেশে, হাই তুলতে তুলতে সাদিফের সামনে পরল। ওকে দেখা মাত্রই সাদিফ ঠোঁট টিপে হাসল। গত রাতে মেয়েটাকে যেই পরিমান নাকানি-চুবানি খাইয়েছে, সেই কথা মনে করেই। মারিয়ার গা জ্ব*লে গেল তাতে। সাদিফ হেসে পাশ কা*টাতে গেলেই সে হা-হুতা*শ করে বলল,
‘ ইশ!ইয়া আল্লাহ! সকাল সকাল কার মুখ দেখলাম? পুরো দিনটাই খা*রাপ যাবে এখন।’
সাদিফ দাঁড়িয়ে গেল ওমনি। পেছনে না তাকিয়ে নিজেও হুতাশন করল,
‘ আসলেই! কাকে দেখালে মা’বুদ৷ এসব ম্যালেরিয়া, ট্যালেরিয়া কে আমার থেকে দূরে রাখো, প্লিজ গড প্লিজ।
মারিয়া সতর্ক কণ্ঠে বলল ‘ ম্যালেরিয়া কাকে বললেন?’
নির্লিপ্ত জবাব,
‘ আপনাকে।’
মারিয়া হা করে বলল,
‘ আপনি আমাকে ম্যালেরিয়া বললেন? ‘
সাদিফ অবুঝের ভাণ করল,
‘ বেশি সন্মান দিয়ে ফেললাম?’
মারিয়া ভীষণ রে*গে বলল,
‘ আপনি আমার সুন্দর নাম বিকৃত করছেন?’
‘ করছি।’
মারিয়া দাঁত চে*পে চোখ বুজল। গা ঝেড়ে শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ সেতো করবেনই। আপনার এসব আজেবাজে কথা ছাড়া ভাণ্ডারে আছেই বা কী? এই যে আপনি একজন তালকানা,রাতকানা,দিনতানা,আমি কী একটাও বলেছি? বলিনি৷ কারন আমি ভদ্র ও সভ্য মেয়ে। আপনার মতো অসভ্য আর ঠোঁট কা*টা নই।’
সাদিফ ফুঁ*সে উঠল। আঙুল উঁচিয়ে বলল
‘ দেখুন! আপনি একজন ইয়ে বলে,কিছু বলছিনা। নাহলে….’
মারিয়া চোখ ঝাপটে হেসে বলল,
‘ আমাকে ঠিক যতটা ইয়ে ভাবছেন,আমি ঠিক ততটা ইয়ে নই। একটা সুযোগ পাই,বুঝিয়ে দেব কেমন?’
সাদিফ জবাব দিতে চাইল,এর মধ্যেই জবা বেগম কে আসতে দেখে থেমে গেল। তবে চাপা কণ্ঠে হুশিয়ারি দিলো,
‘ মা আসছে বলে বেঁচে গেলেন। ‘
মারিয়া হাত নাড়ল। যেন মশা তাড়াল। সাদিফ আর দাঁড়ায় না। মেয়েদের সাথে কথা বলতে দেখলে মা উল্টোপাল্টা ভাবে যদি? তাড়াহুড়ো করে প্রস্থান নিলো। জবা বেগম,মারিয়া মুখোমুখি হতেই দুজনেই মৃদু হাসল। তিনি চলে গেলেন ঘরে। মারিয়া বুকের সাথে হাত ভাঁজ করে ঠোঁট কাম*ড়াল। মনোযোগ দিয়ে ভাবল,
‘ এই সাদা মূলা টাকে যে কীভাবে শায়েস্তা করি!’
_____
পিউ ব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে, এসে কলপাড়ে দাঁড়াল। ট্যাংকির পানি বরফের মতো ঠান্ডা। শীতকালে টিউবওয়েল থেকে যে গরম পানি পরে,সেটা দারুণ লাগে তার। সে শান বাঁধানো ফ্লোরে দাঁড়াতে যাবে,
তক্ষুনি,পানি নিতে এলেন একজন মধ্যবয়সী নারী। কোমড়ের হাড়ে বড় সাইজের কলসি গোঁজা। পড়নে সুতির কাপড়, পেঁচিয়ে মাথাও ঢেকেছেন। পাশেই বাড়ি তাদের।
ওনাকে দেখে পিউ সরে জায়গা দিলো। ভদ্রমহিলা ওর দিক তাকাতে তাকাতে কলস পাতালেন টিউবওয়েলের নীচে। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে পিউয়ের আপাদমস্তক দেখলেন। ভীষণ কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘ এই বাড়িত বেড়াইবার আইছো?’
পিউ মাথা দুলিয়ে বলল ‘ জি।’
‘ রাশিদ বাই কী অয় তুমগো?’
‘ আমার মামা।’
মহিলাটি ভ্রুঁ তুলে বললেন ‘ তুমি কার মাইয়া?’ মার নাম কী?’
‘ জী, মিনা পারভীন।’
মুহুর্তে গদগদ হয়ে উঠলেন তিনি। পান খাওয়া, লাল দাঁত বের করে হেসে বললেন’
‘ ও, তুমি মিনা আপার মাইয়া? আগে কইবানা। তুমারে দেখছি হেই কবে! ডাঙ্গর অইছো অনেক। কোন কেলাসে পড়ো?
‘ এইচ এস সি দেব। ‘
বুঝলেন না তিনি,
‘ এ্যা? কী দেবা?’
‘ মানে,ইন্টার দেব।’
‘ ওও.. ভালা। তোমার বড় বোইনের বিয়া অইছে?’
‘ না হয়নি।’
মহিলাটি ভ্রুঁ গুছিয়ে বললেন ‘ ক্যান? বিয়া দ্যায়না ক্যান? কুনো সমেস্যা?’
পিউ উদ্বেগ নিয়ে বলল ‘ না না, সমস্যা কেন হবে? আপুতো পড়ছে এখনও।’
মহিলাটি মাথার কাপড় কানের দুপাশে গুজে বললেন,
‘ হুনো, মাইয়া মাইনষ্যের এত লেহন পড়ন ভালানা। তাত্তাড়ি বিয়া-শাদি করোনই অইলো তাগো আসল কাম। ছুডো একটা জীবন, বাঁচবা কয়দিন? আইচ্ছা বাদ দাও,তুমার তো চেহারা, সুরত মাশাল্লাহ। গা’র রংডাও টকটকা। আমার ধারে ভালো পোলা আছে। তুমার আম্মার লগে কতা কইয়া দেহি কী কও!
পিউ হতভম্ব হয়ে বলল ‘ এসব কী বলছেন? আমিত এখনও ছোট। ‘
মহিলাটি বললেন ‘ আরে কীর ছুডো? তুমাগো নাখান বওসে আমার পোলাপান আছিল দুইডা। এহনি তো শইল মোইড় দেওনের সময়। এইডাই বওস বিয়া করনের। বুজছো? পরে বওস বাড়লে কুনো পোলারতে দাম পাইবানা।’
বলার সাথে বুড়ো আঙুল চিৎকাত করে দেখালেন তিনি। পিউ চেহারা গোঁটাল। এর মধ্যেই পেছন থেকে কেউ জবাব ছোড়ে,
‘ ওর বিয়ে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা। তার জন্যে আমরা আছি।’
পিউ ফটাফট ঘুরে তাকায়। তাকালেন নারীটিও। ধূসর এগিয়ে এসে পিউয়ের পাশে দাঁড়ায়। ভদ্রমহিলা একবার ওকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে পিউকে শুধালেন,
‘ ক্যাডা ?’
পিউ বিপাকে পরল। এই প্রশ্নটা সবথেকে বিব্রতকর তার কাছে। ধূসরের পাশে ‘ভাই’ শব্দ লাগাতে বুকটা ফেটে যায় যে। মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ কাজিন।’
‘ কী জিন?’
‘ আমার চাচাতো ভাই।’
মহিলাটি মাথা দুলিয়ে বললেন ‘ ও, তুমার বাই? বড় বাই?
পিউ নাক ফোলায়। মুখ খোলার
আগেই ধূসর ভুল শুধরানোর ভঙিতে বলল
‘ চাচাতো ভাই। আপনার পানি নেয়া হয়নি?’
তিনি বুঝতে না পেরে বললেন ‘ ক্যান?’
‘ হলে যে পথ দিয়ে এসছেন সে পথ দিয়েই বের হবেন। রাস্তঘাটে ঘটকালী করেন ভালো,কিন্তু আমাদের বাড়ির মেয়েদের বিয়ে নিয়ে আপনাকে নাক গলাতে কেউ বলেছে?’
সোজাসাপটা,ভণিতাহীন উত্তরে নারীটি চুপসে গেলেন। মুখ ছোট করে মাথা নাড়লেন দুদিকে। পরপর কল চাপার গতি বাড়িয়ে দিলেন। নিমিষে কলস ভরে উঠল। পানি উপচে পরল। ধূসরকে একবার দেখে কলসটাকে ফের কোমড়ে তুললেন। দ্রুত পায়ে ছাড়লেন বাড়ির আঙিনা।
ধূসর বিরক্ত হয়ে দেখছিল। চোখ এনে পিউয়ের দিক ফেলতেই, দেখল মেয়েটা আবার হা করে তাকিয়ে। ধূসর ভ্রুঁ শিথিল করল। দু আঙুল দিয়ে পিউয়ের ঠোঁট চে*পে ধরে হা ‘টুকুন আটকে দিয়ে বলল,
‘ গ্রামে অনেক মাছি! মুখ বন্ধ রাখ, ঢুকে যাবে নাহলে।’
পিউ নড়েচড়ে ওঠে। ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যেই গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে হাজির হয় সাদিফ। সাথে বেলাল,রাদিফ,রোহান এরাও আছে। সাদিফের পড়নে লুঙ্গি,খালি গা। ধূসর ওকে দেখে কপাল কুঁচকে বলল ‘ কোথায় যাচ্ছিস?
সে হৈহৈ করে জানাল,
‘ নদীতে। গোসল করব,যাবে?’
পিউ অবাক হয়ে বলল ‘ নদীতে? আপনি তো সাঁতার জানেন না ভাইয়া,ডু*বে গেলে?’
সাদিফ চিন্তিত কণ্ঠে বলল ‘ সেত জানিনা। কিন্তু বেলাল বলেছে ও সামলাবে।’
ধূসর বলল ‘ তোর মত গাট্টাগোট্টা লোক ডুবতে নিলে ও পারবে তুলতে?’
আর রাদিফ ,তুই কোথায় যাচ্ছিস?’
ভাইয়ের চোখ দেখে ছেলেটা গুটিয়ে গেল। ভীত কণ্ঠে বলল ‘ আমিও একটু….’
‘ বাহ! তোরা যে দলবেঁধে পানিতে ডু*বে ম*রতে চাস,আগে জানাবিনা? তাহলে বাড়ির পেছনের পুকুরটা কী দোষ করল? ওখানে গিয়ে মর। নদীর থেকে বেটার আই থিংক। অন্তত লা*শ খুঁজে পাওয়া যাবে।’
ধূসরের নিরুৎসাহিত কথাবার্তা।
সাদিফ অসহায় নেত্রে বেলালের দিক তাকাল। সেও মহাচিন্তায় পরেছে। সত্যিইত,রোহান আর সেই সাঁতার জানে। ওদের দুজনের কিছু হলে তুলতে পারবে? সে মাথা চুল্কে বলল,
‘ সাদিফ ভাই,তাহলে কী থাকবে আজ?’
রাদিফ কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল,
‘ আমার যে খুব শখ, নদীতে গোসল করব। ও বড় ভাইয়া,তুমিও চলোনা আমাদের সাথে। আমরা ডুবতে নিলে তুমিত তুলতে পারবে। তোমারত অনেক শক্তি। কত ভারী ভারী ডাম্বেল তোলো। ‘
উজ্জ্বল হয়ে আসে সাদিফ। সেও সুর মেলায়,
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইয়া তুমিও চলো। তাহলে আর চিন্তা নেই।’
ধূসর নাঁকচ করল,
‘ না।’
‘ আরে চলোনা,মজা হবে। এসো এসো… এই বেলাল,ভাইয়ার জন্যে একটা লুঙ্গির ব্যবস্থা করোতো।’ ‘
‘ যাবনা বললাম না,ছাড়, সাদিফ,আরে…’
কে শোনে কার কথা! সাদিফ,রাদিফ সব ক’টা মিলে ধূসরের দুবাহু ধরে টেনেটুনে নিয়ে চলল। বেলাল আবার বাড়িতে ঢুকল তার জন্যে লুঙ্গি আনতে।
পিউ সব দেখে হাসল। বুক ফুলিয়ে দীর্ঘ এক শ্বাস নিলো। কবে যে মানুষটাকে মনের কথা বলবে!
****
মারিয়া চোরের মত পা ফেলে ফেলে ঘরে ঢুকল। আপাতত সাদিফ আর ধূসরের দখলে যেটা। দরজা চাপিয়ে ভেতরে এলো। আশেপাশে তাকাল, খুঁজল কিছু। কাক্ষিত বস্তু পেতেই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাল। চেয়ারের ওপর ভাঁজ করে রাখা সাদিফের মেরুন পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা সেট। একটু আগেই সুনিপুণ হাতে আয়রন করে রেখে গেছে সে।
গোসল সেড়ে এসে এগুলোই পরবে। মারিয়া ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছিল। বুঝতে বাকী নেই মহারাজ বিয়েতে এটাই পরিধান করবেন।
সেই থেকেই তক্কে তক্কে ছিল সে। যেই মাত্র ঘর খালি হয়েছে,লুফে নিলো সুযোগ।
মারিয়া ওড়নার নিচ থেকে ডান হাত বের করল। ছোট একটা পলিথিন নিয়ে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে বেশ কবার দেখে নিল পেছনে। পাছে এসে পরে কেউ!
কাপড়গুলোর কাছে এসে পলিথিনের মুখ খুলল। বেরিয়ে এলো সবুজ সবুজ কিছু অমসৃন পাতা। ক্রুর হাসল সে। পাঞ্জাবিটার দিক চেয়ে বিড়বিড় করল,
‘ মারিয়ার সাথে পাঙ্গা? রাতকানা মশাই,এবার বোঝাব মজা।’
সবকটা পাতা পাঞ্জাবিতে ডলে ডলে দিল তারপর। কিছু রেখে দিল পকেটেও। কাজ শেষে হাত ঝেড়ে সাবধান করল,
‘ পরেরবার আমার সাথে লাগতে এলে,আজকের কথা দুবার নয়,দশবার ভাববেন। ওকে?’
যেন সত্যিই সাদিফকে শা*সাল সে। ঠিক কাল যেভাবে হেসেছিল সাদিফ,সেভাবেই হাসল মারিয়া। বেনীটাকে সামনে থেকে ছুড়ে পেছনে ফেলল। হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করে গান ধরল,
‘ সে যে কেন এলোনা,কিছু ভালো লাগেনা। এবার আসুক, তারে আমি মজা দেখাব।’
****
বিশাল বাড়ি হৈচৈ-এ পরিপূর্ণ । বরযাত্রী রওনা করেছেন, মাত্রই খবর পেলেন রাশিদ। বাড়িতে ঢুকে মুত্তালিব মেয়েকে সাজানোর পায়তারা দিলেন। পুষ্প,মারিয়া হুকুম মাত্রই অবঢৌকন,আর বর্ষাকে নিয়ে বসে গেল। মারিয়া শাড়ি পরাবে,আর মেক-আপ করাবে পুষ্প। ওর আবার সাজগোজের হাত ভালো।
গ্রামের যত মানুষ দাওয়াতে এসছে,তাদের ভীড়ে নিমিষে ভরে গেল ঘর। সবাই উৎসুক হয়ে দেখছে। বর্ষাকে বিছানায় বসিয়ে সাজাচ্ছে ওরা। ঘরটাও বেশ বড়সড়। অথচ আজ যেন শ্বাস ফেলার ও জায়গা হচ্ছেনা। শীতের মধ্যেও ছুটে আসছে প্রচন্ড গরম।
পিউ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। সাথে পরেছে ভারী লেহেঙ্গা। সেজেছে কখন,অথচ ঘর ছাড়েনি।
আসলে মন ভালো ছিল না। ধূসরের সাথে ম্যাচিং করার মত আর একটাও জামা নেই বলে। বাধ্য হয়ে এটাই পরেছে। তাও পুষ্পর কথায়। কালার ভিন্ন হলেও জামার ডিজাইন একইরকম দুজনের।
পিউ ভীড় ঠেলেঠুলে প্রান বাঁচিয়ে বেরিয়ে এলো। লেহেঙ্গার দু মাথা ধরে ধরে সিড়ি বেয়ে নামল। অল্প উঁচু দেখে হিল পরেছে পায়ে। আস্তে-ধীরে দেখে-শুনে পা ফেলে বাড়ির বাইরে এলো।
প্যান্ডেলের ভেতর এসে সামনে তাকাতেই বড়সড় হোচ*ট খেল পিউ। একেবারে চারশ আশি ভোল্টেজের ঝটকা। প্যান্ডেলের এক কোনায় চেয়ার পাতানো। তার একটাতে বসে ধূসর। পাশে তুহিন রাও আছে। মুত্তালিব ও এসে বসেছেন কেবল। গোল হয়ে আড্ডা দিচ্ছে তারা।
অথচ সবাইকে ছাপিয়ে পিউয়ের চোখ পরে রইল ধূসরের ওপর। ওর গায়ের মেরুন পাঞ্জাবিটা দেখে মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। একটুও চিনতে ভুল হয়নি, এটা সেই পাঞ্জাবি, যেটার জন্যে গোটা এক বেলা তার মুখে হাসি ছিল না। ধূসরের জন্যে বাছাই করেও,মুখের সামনে থেকে সাদিফ ভাইয়া নিয়ে গেলেন। হ্যাঁ সেটাইত। একই রঙ,একই নকশা, সবই এক।
এই পাঞ্জাবি কোথায় পেলেন ধূসর ভাই?