এক সমুদ্র প্রেম

রিক্সার গতি মন্থর,সুধীর। তিন চাকার বাহন খানা চলছে তার স্বকীয়তায়।
কোমল প্রবঞ্জন চতুর্দিক ঘিরে। বসন্তের হিমেল হাওয়া কাঁ*পন ধরায় গায়ে। রাস্তা ফাঁকা নেই। সংখ্যাতীত যানবাহনে ভর্তি আজ। তার ওপর মানুষের ভীড়। দিগবিদিক ঘুরছে অনেকে। পড়নের চাকচিক্যময়, সুন্দর সুন্দর পোশাক গুলো রঙচটা শহরে বেশ ফুটেছে আজ। যেদিকে তাকায় শুধু রঙীন আর রঙীন। অথচ এত কিছুতে মন,চোখ কোনটাই নেই পিউয়ের। সে লাজুক ভঙিতে ছটফট করছে। গাল দুটো লালিত। পল্লব কাঁ*পছে। বুকের ওঠানামা অস্বাভাবিক।
কেউ বাম পাশে হাত দিলে স্পষ্ট টের পাবে, হৃদযন্ত্রের লাফা*লাফি, দাপা*দাপি। ধূসরের গা ঘেঁষে বসা,তার মদ্যপ পারফিউমের সুগন্ধ,উষ্ণ স্পর্শ সব কিছুতে ওষ্ঠাগতপ্রাণ। মানুষটা হঠাৎ করে কীভাবে এলেন? রিক্সায় বসলেনই বা কেন? পিউয়ের মাথা ভর্তি প্রশ্ন অগোছালো,অবিন্যস্ত ছোটে। অন্তরে ফোটে বসন্তের ফুল। সত্যিই এমন দিনে মানুষটা তার এত কাছে? সত্যিই?

পিউ হাঁস*ফাঁস, হাঁস*ফাঁস করে। অস্থির চিত্তেও শান্ত হয়ে বসে থাকে। লাজুকলতার ন্যায় গুটিয়ে রয় দেহ। বক্ষে তখন উথাল-পাতাল। ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে হৃদপদ্মের ছোট্ট অবাধ্য খাঁচা। ঠান্ডা বাতাসেও কপাল জুড়ে ঘামের রেশ। রিক্ত মস্তক। অথচ পাশের মানুষটি নির্বিকার। যেন স্টিলের মত শক্ত হয়ে বসে।
রিক্সা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে পিউ জানেনা। সুদীর্ঘ পথের এক ফোটাও ঠাওড় করেনি। বুঝতে চায়নি গন্তব্য। তার অন্তঃকরনে বাজছে প্রেমের গীত। সেই বিখ্যাত উত্তাম কুমারের গান,
‘ এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হতো তুমি বলোতো!
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,তবে কেমন হতো তুমি বলোতো!’

সে মনে মনে হাসল। মিশ্র অনুভূতির, মৃদূ হাসি। প্রিয় মানুষের সঙ্গে হুড খোলা রিক্সায় বসার এক অমোঘ স্বপ্ন আজ পূরন হচ্ছে। এই প্রথম বার ধূসর ভাইয়ের সাথে রিক্সায় চড়ছে সে। ইশ! এইভাবে ওনাকে নিয়ে বাকী স্বপ্ন গুলোও সত্যি হতো যদি! তাহলে তার থেকে সুখী মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পেত না কেউ। পিউ আড়চোখে একবার ধূসরের দিক তাকায়। তার লম্বা চুলের ডগা গুলো উড়ে উড়ে লাগছে মানুষটার কানে,চোখের পাশে। অথচ নির্লিপ্ত তার দৃষ্টি ওই সম্মুখ সরণিতেই।
পিউ কুণ্ঠিত ভঙিতে চাউনী ফিরিয়ে নীচের দিকে তাকায়। আলগোছে অবাধ্য কেশ গুঁজে দেয় কানের পিঠে। আচমকা পুষ্পর কথা মাথায় এলো। তার লজ্জা -টজ্জা ওমনি শেষ।
চোখ বড় বড় করে ফেলল। তটস্থ ভঙিতে তাকাল ধূসরের দিকে। ভীত কণ্ঠে বলল,
‘ ধূসর ভাই,আপু ডেকেছিল।’
সে তাকালোনা। ওমন সামনে চেয়েই বলল ‘ কেন?’
‘ ওর বন্ধুরা আসবে,আমাকে দেখার জন্যে যেতে বলেছে।’
‘ তোকে দেখার কী আছে? তুই কি চিড়িয়াখানায় আটকে রাখা বানর?’
পিউ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল ‘ আলাপ করবে বলেছে।’
‘ আলাপ করবে কেন? তুই সেলিব্রেটি? ‘

একটা বাক্যও তার দিক চেয়ে বলেনি। পিউ হাল ছেড়ে বসে থাকল। অল্প স্বল্প চিন্তা শুরু হলো মাথায়। আপু যদি ওর দেরী দেখে বাসায় ফোন করে? কাল পরীক্ষা আর সে রাস্তায় ঘুরবে, দিতে হবে একশ একটা জবাবদিহি। আর আম্মুতো ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবেন।

ধূসর নিজে থেকেই বলল,
‘ চিন্তা নেই, আমি আছি।’

‘ আমি আছি’ এই একটা কথা পিউয়ের অস্থির মস্তিষ্ক, শান্ত করল নিমিষে। তার শঙ্কিত চোখমুখ সবেগে মসৃন হয়। ধূসরের প্রতি এক বুক ভরসায় অমত্ত থাকে মেয়েটা।
আরো কিছু পথ রিক্সা চলল। ধূসর বলাতে থামল রাস্তার এক পাড়ে এসে। পিউ এতক্ষণ পর আশেপাশে তাকাল। চোখ বোলাল যতটা দেখা যায়। দোকান-পাটের ওপর টাঙানো সাইনবোর্ড গুলোর লেখা দেখে নিশ্চিত হলো গন্তব্য স্থল। এটাত রবীন্দ্র সরোবর! দারূন জায়গা! পিউয়ের ক্ষুদ্র হৃদয় চটপটে হয়। ধূসর নেমে দাঁড়াল। ভাড়া মেটাল চালকের। পিউ চারপাশ থেকে দৃষ্টি এনে তাকাতেই ছোটখাটো হো*চট খেল। ধূসরের পাতা হাতের দিকে নি*ক্ষেপ হলো তার বিকট,অবিশ্বাস্য চক্ষুদ্বয়। আস্তেধীরে কম্পিত বীণা রাখল সেই হাতের ওপর। ধূসর অচিরেই আকড়ে ধরল। বৃহৎ হস্ত তালুতে মিশে গেল পিউয়ের কনিষ্ঠ কব্জি। রিক্সা থেকে নামল সে। উত্তেজনায় হাত পা কাঁ*পছে। ধূসর ভাই কী তাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন? এতটা সুপ্রসন্ন ভাগ্য কবে হলো?
ধূসর ওকে সমেত সামনে এগোয়। তার লম্বা কদম আজ ভীষণ সুস্থির। পিউ এতেও তাল মেলাতে ব্যর্থ,হিমশিম খায়। তার মনে হচ্ছে সে দৌড়ালে ঠিকঠাক হতো।

ধূসর গিয়ে বসল একটা বেঞ্চে। পিউকে বলতে হয়নি,সে চঞ্চল ভঙিতে বসল আগেই। ধূসর এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে চারপাশে তাকায়। গলা উঁচিয়ে দ্যাখে। নীরবে কাউকে খোঁজে। পিউয়ের আপাতত কোনও দিকে মন নেই। তার দুটো তৃপ্ত চোখ ধূসরের সুশ্রী চেহারায়। ওইটুকু সময় ধূসরের মুখের গড়ন হৃদয়পটে বন্ধ করে ফেলল। এই মুখটা যত দেখে আঁশ মেটেনা,মন ভরেনা। প্রতিবার তুষাতুর লাগে নিজেকে। এমনিতেও মানুষটার আঁদলের সামান্যতম কাঁ*টাছে*ড়াও তার মুখস্থ,আত্মস্থ। পিউয়ের দেখা সর্বাধিক সুদর্শন পুরুষ ধূসর ভাই। তার চোখদুটো যেন পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর জাদুঘর। আর তামাটে মুখটা কাঁচের ভেতর গোছানো সাজানো আঁকি-বুকি পেপার ওয়েটের মত। যতবার সে দ্যাখে ততবার খু*ন হয়। নির্ম*মভাবে ধূসর ভাই হ*ত্যা করে ওকে। আচ্ছা,এই দুনিয়ায় ওর আগমনের কারণ কী? এই মানুষটাকে দেখে দেখে বারবার মন হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার জন্য? এই নিঃস্ব হওয়ায় এত সুখ কেন? কেন এত প্রশান্তি? কেউ বুঝি মন খুঁইয়ে এত উল্লাসে মাতে? মন চুরি করা স্বয়ং চোরকে পাশে বসিয়ে আনন্দ পায়? এই বসুন্ধরায় ভালোবাসার নিয়ম গুলো এমন অদ্ভূত কেন? কেন এত যুক্তিহীন? ভালোবাসা তাকে শেখাল,শ্যামলা বর্নের এক যুবকের প্রেমে পাগল হওয়া। গুরুভার এক পুরুষের প্রতি অনুভূতির জাল বিছিয়ে নিজেকে সপে দেওয়া। এর শেষ কোথায়? কোথায় সমাপ্তি?

ধূসর হাত উঁচিয়ে কাউকে ডাকল। পিউয়ের ধ্যান ভা*ঙল তখন। মাথার ওপরে বড় পলিথিন বোঝাই করা পানির বোতল নিয়ে এক নারী এগিয়ে এলেন। একটা বোতল ধরিয়ে দিলেন তার হাতে। টাকা নিয়ে ফেরত গেলেন আবার। পিউ সবটা দেখল। তবে খুব একটা মনোযোগ ওতে ছিল না। ধূসর বোতলের ছিপি খুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে সচেতন চোখে তাকায়।
মুচকি হেসে নিয়ে নেয়। ঢকঢক করে খায়। গলবিল ওঠানামা করে। পুরোটা সময় ধূসর চেয়ে থাকে। পিউ বোতল নামাতেই তার চোখ ফিরে আসে। নিবদ্ধ হয় সামনে। পিউ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছল। আস্তে করে শুধাল,
‘ এখানে আমরা কেন এসেছি ধূসর ভাই?’
ধূসরের বক্র জবাব,
‘ মন চাইল তাই।’

পিউ চিকণ চোখে তাকাল। আরেকদিক ফিরে ভেঙচি কা*টল। পণ করল আর একটা কথাও জিজ্ঞেস করবেনা। বো*ম মা*রলেও শব্দ বের হবেনা মুখ দিয়ে। এই লোকের পা থেকে মাথা অবধি ত্যাড়ানো । মানুষটাও ত্যাড়া,ঘাড়টাও ত্যাড়া,কথাবার্তাও ত্যাড়া। সে নিজেকেই শা*সাল,
‘ চুপ থাক পিউ! আরেক একটা কথাও না।’

তারপর অদৃশ্য আঙুলে ঠোঁট চে*পে ধরল নিজের। আচমকা ধূসর উঠে গেল। রীতিমতো আড়াল হলো সামনে থেকে। পিউ বসে বসে দেখল। ভালো*মন্দ জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করল না। করলেও বা,উত্তর পাবেনা সুনিশ্চিত।
সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। ইনবক্স চেক করে ব্যস্ত হাতে। অদ্ভূত ব্যাপার, পুষ্প এখনও লোকেশন পাঠায়নি। পিউ বিস্মিত হয়। সাথে একটু আধটু মেজাজ খারা*প। তাকে বের হতে বলে এই মেয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে বসেছে? ধূসর ভাই না এলে সে কি এতক্ষণ পথিমধ্যে ঘুরতো? হারিয়ে যেত না? কলেজ আর কোচিং ছাড়া ও কি একা কোথাও গিয়েছে কখনও? তার কিশোরি মনে রা*গ ছেঁয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নিলো, আজ বাসায় গিয়ে নালিশ করে দেবে আম্মুকে। বিচার বসাবে। কেন আপু এত দায়িতজ্ঞানহীন হবে, কেন? পরপর নিজেই মিইয়ে গেল। ভাবল,আম্মু যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে তুই কোথায় ছিলিস? কী বলবে সে? তোমার আদরের দুলাল আমাকে মাঝপথে রিক্সা সহ কিড*ন্যাপ করে এখানে এনেছেন, বলবে এটা? এটাতো সত্যি। সাথে অল্পস্বল্প মিথ্যে। তার মন জানে,কী বা*জে রকমের নেঁচেকুদে সাথে এসছে সে। ধূসর ভাইয়ের সঙ্গে কোথাও যাওয়া,তাও এই ভাবে একা? সেটাও আবার ভালোবাসা দিবসে? উফ! ভাবা যায়না এসব। সে এখনও পারছেনা ভাবতে। তার চিন্তাধারা, আবেগে আত্মহারা!

পিউ স্ক্রিনের দিক তাকিয়ে হাসছিল। আকষ্মিক মুখের সামনে এক গুচ্ছ গোলাপ দেখে চট করে মাথা তুলল। প্রচন্ড ধা*ক্কা খেল পরপর। নিজের চোখের প্রতিই যেন উঠে গেল ভরসা,আস্থা। তীব্র বিশ্বাসহীনতায় পল্লব গুলো কেমন ভারি হয়ে বসল। ধূসর হাটুমুড়ে বসতেই পিউ থমকে গেল। তার শরীর শিরশির করছে। হাত পা বিবশ। ধূসর বসেছে। শার্টের ওপর দিকের একটা বোতাম খোলা,উঁকি দিচ্ছে তার শ্যামলা বুক। পিউয়ের বেহায়া চাউনী ঘুরপাক খায় সেখানে। টেনেটুনে আনে তার মুখবিবরে। অজানা আনন্দাশ*ঙ্কায় কাঁ*পতে থাকা বুক নিয়ে ধূসরের দিক চেয়ে রইল। তবে কি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসছে? ধূসর ভাই এখনি বলবেন মনের কথা?
পিউয়ের আকুল,উদগ্রীব মুখটা মন দিয়ে দেখল ধূসর। চোখ সরিয়ে নিল, তারপর আবার তাকাল। ঠোঁটের কোনে মিহি,অথচ ভূপৃষ্ঠের সবথেকে সুন্দর হাসিটি নিয়ে বলল,

‘ বহুদিন ধরে কিছু কথা নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলাম পিউ। আজ সময় এসেছে সেসব বলে দেয়ার। আমি যে আর পারছিনা! তোর এক সমুদ্র প্রেমের কাছে আমার শক্ত*পোক্ত ধৈর্যের জাহাজটা ডু*বে গিয়েছে। আজ আর বলতে মানা নেই,
‘ ভালোবাসি পিউ।’
তুই যতটা চাস,তার চেয়েও অনেক বেশি চাই তোকে। তুই যতটা ভালোবাসিস,এর চেয়েও অধিক ভালোবাসি!’

পিউয়ের কণ্ঠনালি স্তব্ধ। ধুকপুক করছে বুক। নিজের কানের প্রতি বিশ্বাস খোঁয়াল। স্তম্ভিত সে। সেকেন্ডে চোখের কোটর ভরে উঠেছে। ঠোঁট দিয়ে বহুক*ষ্টে কা*ন্না চে*পে ধরে। এই কা*ন্না, আনন্দের, অপেক্ষার। ধূসর ভাইয়ের মুখ থেকে এতদিনে ভালোবাসার কথা শুনল সে। অবশেষে এলো সেই সময়। ধূসর উঠে দাঁড়াল,এগিয়ে এলো। সেই গতদিনের মত স্বযত্নে চোখ মোছাল। পিউ হুহু করে কেঁ*দে ওঠে। জাপটে ধরে, মুখ লোকায় বুকে। অতঃপর কানের পাশে স্পর্শ পায় দুটো তপ্ত ঠোঁটের। ফিসফিসিয়ে বলছে,

‘ চোখের জলে তোকে, এতটা আদুরে লাগবে কেন বলতো! তোর এই রুপ কারো সহ্য সীমার খুঁটি নড়বড়ে করে দেয়। ভে*ঙে দেয় নিয়মের বাঁধ। কাঁদিস না পিউ,একদম কাঁদিস না। তোর কান্নায় কেউ সংযম হারালে দোষী হবে সে,যে বহুবার তোর ভেজা চোখমুখ দেখে ধ্যান বিসর্জন দিয়েছে ।’

বলতে বলতে তার উষ্ণ অধর পিউয়ের কানের লতি ছুঁয়ে গেল। কেঁ*পে ওঠে মেয়েটা। অতি শীর্ন শরীর স্পষ্ট ঝাঁকুনি দিতে দেখা যায়। জোর খাটিয়ে মুখ তুলতে চায়,অথচ পারেনা। এর আগেই কেউ ধ*মক ছোড়ে,
‘ ধরবি? এই মেয়ে!’
পিলে চমকে গেল তার। সম্বিৎ ফিরল। সম্মুখে দাঁড়ানো, কপাল গোছানো ধূসরকে দেখে হতবাক হলো। আশ্চর্য বনে দেখল নিজেকে,সামনের জায়গাটাকে। এখানেই না ধূসর ভাই বসেছিলেন? পিউ এলোমেলো পাতা ফেলল। মস্তিষ্ক পার করে চলে যাচ্ছে সব। চোখ পিটপিট করে ধূসরের দিক তাকাল আবার। কোথায় ফুল? কীসের গোলাপ? অধৈর্য হাতে নিজের চোখ ছুঁয়ে দেখল। একি! সে না কাঁ*দল? এইত এক্ষুনি কাঁ*দছিল,তবে চোখ শুকনো কেন?এসব তাহলে স্বপ্ন? কল্পনা?

পিউয়ের উদ্বোলিত তনুমন নেতিয়ে পরল। বক্ষ চি*ড়ে নির্গত হলো আ*ক্ষেপের শ্বাস। চোখেমুখে লেপ্টে এলো অন্ধকার। এই জনমে বোধ হয় ভালোবাসার কথা শোনা হবেনা। ধূসরের মেজাজ বিগড়ায়। সে যে এত্তক্ষণ ধরে ডেকে হয়রান,এই মেয়ের হুশ আছে? আইসক্রিম টাও গলে যাচ্ছে।
সে দ্বিতীয় বার ধ*মক দিল,
‘ পিউ তুই নিবি,না ফেলে দেব?’
পিউ চকিতে ফেরে,সতর্ক হয়। হাত এগিয়ে আইসক্রিম নিয়ে আসে। কিন্তু তার জ্বিভ থেকে গলবিল, সব তিঁতকুটে। অনীহ চোখে চেয়ে রয় কোন আইসক্রিমটার পানে। একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেই দুচোখ ছাপানো আশা নিয়ে এসেছিল,ভাবল,আজ বুঝি ধূসর ভাই কিছু একটা বলবেন।
তার ওপর এসব জল্পনা-কল্পনা সেসব বাড়িয়ে দিল কয়েক গুন। ধূসর পাশে বসেছে। তার হাতে ওয়ান টাইম কাপে ভরা দুধ চা। পিউ আশা*হত,ভ*গ্নহৃদয়-বিবর্জিত। মনে মনে বিলাপ করে,
‘ কবে ভালোবাসার কথা বলবেন ধূসর ভাই? কবে?’

পিউয়ের মন শুরু থেকে যতটা স্ফূর্ত ছল,এখন ততটাই সংকীর্ণ। গম্ভীরতায় গা ঢেকে বদলে গিয়েছে আগের রুপ। ভালো লাগছেনা কিছু। ধূসর ভাই ভালোবাসার কথা বলবেন না। আচ্ছা সে নিজেই তো বলবে ভেবেছিল। বলে দেবে এখন? এটাই সময়। কেউ নেই, দুজন শুধু। বলে দিক বরং। শুভস্ব শীঘ্রম!
পিউ ঢোক গি*লে তাকাল। আমতা-আমতা করে বলল,
‘ ধূসর ভাই! একটা কথা বলব?’
ধূসর চায়ের কাপে,পাতলা ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
‘ পরে। ‘
‘ অনেক জরুরি। ‘
‘ হু,পরে।’
পিউ সন্তর্পনে চ বর্গীয় শব্দ করল,যাতে ধূসরের কানে না যায়।
‘ কিছু খাবি?’
পিউ মাথা নাড়ে। বীতস্পৃহায় দাঁতে -দাঁত পি*ষে ধরে। মনে মনে ব*কেঝকে গুষ্টি উদ্ধার করে ধূসরের। আজকের দিনে, এরকম জায়গায় এনে জিজ্ঞেস করছে কিছু খাবি?
কেন ,দুটো ভালোবাসার কথা বললে জাত যাবে?
সে কি অন্ধ? দেখতে পাচ্ছেনা চারপাশে কত জোড়া জোড়া ঘুরছে? ওইতো, তাদের বাম দিকে বসে দুজন। আহা মেয়েটির মাথা ছেলেটির কাঁধে। কী নয়ানভিরাম দৃশ্য! তার যে কবে এরকম দিন আসবে?
পিউয়ের অন্তঃপুর পরিতাপে ভরে যায়। তন্মধ্যে ভেতর থেকে কেউ ঘোষণা করল,
‘ আসবেনা পিউ,আসবেনা। তোর কপালে যে আনরোমান্টিক গরিলা জুটেছে, তাতে এসব আশা ছাড়।’

পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রেম-ভালোবাসা বোঝার পর থেকে চার-চারটে বসন্ত গেল,অথচ প্রেমটাই হচ্ছে না। হায়রে ধূসর ভাই! আপনাকে ভালোবেসে আমি ম*রেছি। না পারছি বলতে,না পারছি চলতে। এইভাবে আমাকে বিকল বানিয়ে, কী মজা পাচ্ছেন আপনি?

সময় পেরোচ্ছে। ধূসরের মুখে কথা নেই। সে একইরকম বসে।
মুখমন্ডলে কেমন অদ্ভূত ছাপ। যেন কত কী বলবে,অথচ পারছে না। পিউ ব্যকুল নেত্র তাক করে রাখে ওই চেহারার পানে। তার মন চায়,সে চায়,একটু কিছু বলুক মানুষটা। নাহয় তাকে বলতে দিক। পিউ আই-ঢাঁই করে আবার ডাকল,
‘ ধূসুর ভাই!’
সে তাকায়। ধা*রাল চোখজোড়ায় কী অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ! পিউ বলল
‘ একটা কথা…. ‘
‘ পরে শুনব।’
পিউ বিদ্বিষ্ট, মহা*বিরক্ত। মুখমন্ডলে দাগ কা*টে সেই চিহ্ন। নিজেও কিছু বলবেনা,তাকেও বলতে দেবেনা। কেন? এভাবে চুপচাপ বসে থেকে কী মহাভারত উদ্ধার হচ্ছে শুনি?

হাঁটু অবধি ফ্রক পরা এক বাচ্চা মেয়ে এগিয়ে এলো। হাতে ঢোকানো কতগুলো কাঁচা,সতেজ ফুলের চাকা। ইতোমধ্যে পুরো সরোবর সে কয়েকবার চক্কর কে*টেছে। এই জুটি নতুন পেয়ে ছুটে এলো প্রায়।পিউ জিনিসটা বহুবার দেখেছে। কিন্তু নিজের জন্যে কেনেনি। মেয়েটি কাছে এসে দাঁড়াল। দুজনকেই অনুরোধ করল,
‘ একটা ফুল নেবেন?’
পিউ দুপাশে মাথা নাড়ে। অথচ ধূসর বলে,
‘ দাও।’
পিউ অবাক চোখে তাকাল। পল্লব ঝাপ্টাল বিভ্রমে। ফুলের চাকা ধূসরের দিক বাড়িয়ে দিল মেয়েটি। সে টাকা বার করতে করতে বলল,
‘ ওকে দাও।’
কথামতো মেয়েটি তার হাতে ধরিয়ে দেয়। টাকা নিয়ে প্রস্থান নেয়। পিউ তখনও বোকার মত বসে।

ধূসর কপাল কুঁচকে বলল,
‘ এটা কি হাতে নিয়ে বসে থাকার জিনিস?’
পিউ উত্তর দিলো না। কী বলবে জানেনা সে। ধূসর অপেক্ষাও করল না উত্তরের। টেনে নিয়েই পরিয়ে দিল মাথায়। পিউয়ের নেত্রদ্বয় মূক । গালে লেপ্টে থাকা চুল ধূসর সরিয়ে দেয়। পূর্ন,গহীন দৃষ্টি বোলায় তার মুখস্রীতে। সেই দৃষ্টিতেই পালটে যায় পিউয়ের অনেক কিছু। চট করেই বুঝে নেয়,মানুষটার মনে জমিয়ে রাখা প্রগাঢ় অনুভূতির কথা। ধূসরের চাউনী
আস্তেধীরে বদলায়। শিথিল হয় অভিপ্রায়। চোখমুখের পেশীতে খেলে যায় পরিবর্তন। পরপর হন্তদন্ত হয়ে চক্ষু সরালো। শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে চারপাশে অগোছালো,উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি ছু*ড়ল। পরিচ্ছন্ন অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ ভাব মাথা তোলে তাতে।

কাপের কোনায় ফের চুমুক বসাতে গিয়ে দেখল ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। কৃত্রিম বিরক্তি ঘিরে ধরল তাকে। বিলম্ব ব্যাতীত চা শুদ্ধ কাপটাকে ছু*ড়ে ফেলল সামনে।
পিউয়ের ওষ্ঠজুড়ে লাজুক হাসির ভিড় জমেছে। ফুলের চাকায় চলে যাচ্ছে হাত। ধূসর ভাই ভালোবাসি না বলুক,এই যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপার গুলো, এতেই তো কত ভালোবাসা মিশে! নিজ মুখে কয়েকটা শব্দের ভিত্তিতে নয়,তার আচার-আচরণ আর চোখের দৃষ্টিতে ভালোবাসাটা বিশ্বাস করে নিলো পিউ। কিছু মানুষের ভালোবাসা এমনই হয়,মুখে নয়,কেবল আর কেবল চাউনীতে ভাসে। ইঙ্গিত দেয় প্রতিটি দর্শনে। বুঝিয়ে দেয় গভীরতা!

ধূসর গলার শ্লেষা পরিষ্কার করল। আচমকা আবদার ছুড়ল ‘ গান শোনা।’
পিউ চকিতে তাকায়।
‘আমি?’
‘ এখানে আর কেউ আছে?’
কণ্ঠে তার রাশভারী, স্বাভাবিকত্বের প্রভাব।
পিউ বলল,
‘ না মানে এখন?’

ধূসর নেত্র সরু করল। মেঘমন্দ্র গাম্ভীর্য নিয়ে বলল,
‘ গান গাওয়ার জন্যে আলাদা সময়সূচি দরকার? ক্যালেন্ডার আনব? ‘
পিউ নিরীহ কণ্ঠে বলল,
‘ কী গান গাইব?
ধূসর ছোট করে বলল
‘ যেটা ইচ্ছে।’
পিউ ঠোঁট কাম*ড়ে, চোখ নামিয়ে ভাবে। এই মুহুর্তে ধূসর ভাইয়ের পাশে বসে তার আওয়াজ বের করতে ক*ষ্ট হচ্ছে,সেখানে গান? অথচ মানুষটার প্রথম আবেদন, ফেরানোর সাধ্যও যে নেই। পিউ
চোখ বোজে। মাথার মধ্যে খুঁজে বেড়ায় কোনও মনকাড়া সঙ্গীত।
হাতাহাতি করে যা পেলো সেই নিয়ে সুর তুলল,

❝ Tasafer ke hasi lamhein, tera ehsas karte hain.. Tera jab jikre atahein,to milne ko tadaptehein….
Humara hal na pucho,ke duniya bhool beithehain.
Chaleen aayoon tumharen bin,na marte hain na jitehein..
Suno accha nehi hotaaa, kisiko aise tadpana…
Mohabbat mein koyeen ashiq kyun ban jata hain dewana.
Agar a peyar hota hain,kisi pein dil jo atahein..
Bada muskil hotahein dil ko samhalna….

মিহি,মিষ্টি স্বরে সম্পূর্ন গান শেষ করে থামল সে। মনে যা এসেছে তাই গেয়েছে। প্রতিটি বাক্য ধ্রুবসত্যি। ধূসর ভাইয়ের ছোড়া প্রণয় বাণ তার অন্তঃস্থল এ ফোড় -ও ফোড় করে দিয়েছে।
ধূসরের অভিব্যক্তি বুঝতে আগ্রহভরে ওর দিক তাকাল পিউ। তার পুরুষালি ঠোঁটে মিটিমিটি পাতলা হাসি। সে তাকিয়েছে বুঝতেই চট করে গম্ভীর করল চোখমুখ। পিউ অপেক্ষা করল একটু প্রসংশার। করল না সে। হঠাৎ সটান দাঁড়িয়ে বলল,
‘আয়।’

পিউ মর্মা*হত হয়,তবে বলা মাত্র উঠে যায়। মাথার ভেতর কিছু অদ্ভূত ইচ্ছে উঁকিঝুঁকি দেয়। ইতস্ততা আর ভ*য়ডর কাটিয়ে ধূসরের এক বাহু আকড়ে ধরে। ধূসর শান্ত চোখে একবার অবলোকন করল সেই স্পর্শ স্থান। মুখের দিক তাকাতেই, পিউ অল্পবিস্তর ঘা*বড়ে গেল। হাত ধরা ঠিক হলো না বোধ হয়। সে সরাতে চায়,এর আগেই ধূসর পা বাড়াল সামনে।
পিউ গাল ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। অধর ভরে আসে হাসিতে। স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে সাথে সাথে কদম মেলায়। কিছু দূর এসে ফুলের দোকান দেখে ধূসর দাঁড়িয়ে যায়। দোকানির বড় প্লাস্টিকের মগ ভর্তি গোলাপ পরিদর্শন করে,জিজ্ঞেস করল,
‘ কতগুলো ফুল এখানে?’
দোকানি একে একে গুনে বললেন ‘ ৪৩ টা।’
‘ পিস কত?’
‘ ৫০ টাকা।’
‘ দিন।’
‘ কয়টা?’
‘ সব।’
লোকটা অবাক হলেন। মুখে প্রকাশ পেল সেই ছাপ। চুপচাপ একটা একটা মিশিয়ে স্কচটেপ দিয়ে আটকে গুচ্ছ বানালেন। পিউকে সাথে দেখে নিজের মত হিসেব কষলেন। বলতে হয়নি,নিজেই এগিয়ে ধরলেন ওর দিক।
‘ নিন আপা।’
পিউ মনঃদ্বিধা সমেত চেয়ে। ধূসরের জবাবের অপেক্ষায় সে। এগুলো কি ওর জন্যে? ও কি ধরবে? ধম*ক খাবে নাতো?
ধূসর তখন মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করছে। তন্মধ্যে একবার তাকিয়ে ভ্রু উঁচায়
‘ কী?ধর!’
পিউ অনতিবিলম্বে হাতে নিলো। পরিতোষের অতিউচ্চ উর্মী, আছ*ড়ে পরল বক্ষে। হৃদকম্পন জোড়াল হয়। ধূসর টাকা মিটিয়ে রিক্সা ডাকল। পিউকে আগে উঠিয়ে, পাশে বসল নিজে। একইরকম সাবধানে,উরুর কাছটা চে*পে রাখল হাত দিয়ে। পিউ এক ধ্যানে তাকিয়ে তার দিকে। বিমূর্ত,বিমোহিত, বিস্মিত সেই চাউনী। ঝরঝর করে ঝরছে, যেখানে বৃষ্টিস্নাত ভালোবাসা।

পুরো রাস্তায় সে মুখ খোলেনি। প্রচন্ড ভালোলাগা দখল করেছে তার বক্ষপট। আজকের দিনের কাছে সে ঋনী। না হোক প্রেমময় কথোপকথন ,না হোক রোমাঞ্চকর বাক্য বিনিময়,এই কয়েক ঘন্টা ধূসর ভাই পাশে ছিলেন যে! এই বা কম কীসে? এতেই সে আপ্লুত,উচ্ছসিত। গতকাল রাতভোর,যে স্বপ্ন সে বুঁনেছে,আঁখিদুটি ছাপিয়ে যে অলীক কল্পনা এঁকেছে, তার যৎকিঞ্চিত হলেও তো পূরন হয়েছে। পিউ আফসোস করল ভীষণ, কেন যে পুষ্পর কথায় শাড়ি পরল না! তাহলে যে ইচ্ছেটা পুরোপুরি পূর্নতা পেত!

সে ললিত নেত্রে গোলাপ গুলোর দিকে তাকায় একবার।ধূসর ভাই পাশে রয়েছেন বিধায়,নাহলে এই ফুলে চুমু দিয়ে ভরিয়ে ফেলত এখন। জীবনে প্রথম পুষ্প উপহার,তাও দিয়েছে প্রিয়তম সে। এর চেয়ে হৃষ্টতার কিছু হয় বুঝি!

সে অতিক*ষ্টে চিত্তচাঞ্চল্য সামলে নেয়। নিরুদ্বেগ ভঙিতে বসে থাকে। দেখতে দেখতে রিক্সা পৌঁছায় গলিতে। তখন, ধূসর চালককে থামতে বলল। যাওয়ার সময় যেখান থেকে উঠেছিল, সেখানে এসেই নামল। ভাড়া মিটিয়ে পিউয়ের দিক চেয়ে বলল,
‘ যা তাহলে। ‘
‘ আপনি যাবেন না?’
‘ পরে।’
পিউ ঘাড় কাত করল। রিক্স চলতে থাকে,অথচ তার চোখ সরেনা। সামনে এগোলেও মাথা ঘুরে থাকে পেছনে। ধূসর ভাইওতো তাকিয়ে আছেন। নিষ্পলক,নিবিষ্ট সেই চাউনী। যতক্ষণ পিউকে দেখা গেল সে দেখল৷ অতঃপর বাম হাতটা আনল চোখের সামনে। এই হাতেই ছিল পিউয়ের ছোট্ট হাত। হাসল সে, অন্যরকম, আলাদা,অদ্ভুত হাসি।

**

পিউ গেট থেকে ঢুকতে যায় আচমকা কেউ মাথায় চাটি মেরে ডাকল ‘ ওই।’
সে চমকে তাকাল,অবাক হলো। পুষ্প দাঁত বার করে হেসে ভ্রু উঁচায়।
‘ কী রে!’
পিউ তৎক্ষনাৎ চোরা-পথে ফুলগুলো ওড়নার পেছনে লুকায়। চোখ বড় বড় করে বলল,

‘ তুই? তুই কোত্থেকে এলি? ‘
পুষ্প দুপাশে, দু-হাতের তালু বিছিয়ে বলল,
‘ সারপ্রাইজ! ‘
‘ কীসের সারপ্রাইজ? আমাকে বের হতে বলে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলি? লোকেশন পাঠিয়েছিস? ‘

পুষ্প, পিউয়ের গোলাপ ফুল দেখে নিয়েছে আগেই। সে ঠোঁট চেপে হাসি আটকায়। ধরা দেয়না। আগে আগে মেইন গেট পার হয়। হাঁটা-পথে জবাব দেয়,
‘ আমি লোকেশন না পাঠিয়ে তোর অনেক বড় উপকার করেছি।’
পিউ পেছনে আসতে আসতে শুধাল ‘ কী উপকার?’
‘ একদিন বুঝবি।’
‘ আমি এখন বুঝতে চাই।’
‘ উহু, সময় হোক।’
তারপর থেমে দাঁড়াল। সচেতন কণ্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা শোন,আম্মু বা কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি এতক্ষণ আমরা একসাথে ছিলাম, ওকে? ‘
পিউ কপাল কোঁচকায়
‘ মিথ্যে কেন বলব?’
পুষ্প বুকের সাথে হাত ভঁাজ করে বলল,
‘ তাহলে কী বলবি শুনি? কোথায় ছিলিস এতক্ষণ? ‘
পিউ চুপ করে গেল। সে যে ধূসর ভাইয়ের সাথে ছিল সেটাতো বলা যাবে না। পুষ্প হেসে, আবার চলতে থাকে। বলে যায়,
‘ যা বললাম, মনে থাকে যেন। ‘

***
ঘড়িতে তখন ছয়টা বাজে। ধূসর দুপুরে খেতে আসেনি। ফোন করলেও লাভ হয়নি। যতবার রিসিভ করেছে আশেপাশে তীব্র কোলাহলের শব্দ। কিছু ক্ষণ হলো মারিয়াও চলে গিয়েছে।

প্রতি শুক্রবারের মত আজকেও বসার ঘরে বসেছে চায়ের আসর। নরম বিকেলে ছাদের সেই চারখানা চেয়ারে বসে, গল্পে মেতে ছিলেন চার সহোদর। মাগরিবের আজানের আগে আগে নীচে এলেন তারা।

মিনা বেগম চা বানিয়ে জবার কাছে পাঠালেন। তিনি এসে সবার হাতে হাতে দিলেন। পিউ ঘুম সেড়ে কেবল নীচে নামল। বলতে গেলে সেই পৌঁছেছে সবার শেষে। রিক্ত আর রাদিফ বাদে বাকী সকলে উপস্থিত। পুষ্প, সাদিফ প্রত্যেকেই আছে। পিউ নামতেই সে এক পাশে সরে বসার জন্যে জায়গা দেয়।
পিউ বসল, হাই তুলতে তুলতে সেজো মায়ের কাছে চা চাইল।

আজমল লুঙ্গি পরেছেন,সঙ্গে আবার ঢিলেঢালা ফতুয়া। আয়েশ করে, তৃপ্তি সমেত চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘ ভাবির হাতের লেবু চা যে কতদিন পর খাচ্ছি ভাইজান। ওখানে ভীষণ মিস করি জানো।’
আমজাদ হাসলেন। নিজেও প্রসংশা করলেন,
‘ তোর ভাবির চা বানানোর হাত আসলেই মাশআল্লাহ।’
সুমনা বললেন,
‘ আমি যে কতবার চেষ্টা করলাম,আমারটা হলোইনা। আপার লেবু চা সত্যিই স্পেশাল। ‘

মিনা বেগম ভাজা-পোড়ার ট্রে নিয়ে হাজির হয়েছেন মাত্র। সবার তারিফ শুনে লজ্জা পেলেন। বিশেষ করে স্বামী নামক মানুষের। লোকটা সামনাসামনি তার গুনগান কখনওই করেনা। তিনি আস্তেধীরে এগিয়ে এসে ট্রে রাখলেন টেবিলের ওপর।
বললেন
‘ কী ছাতার মাথা বানাই, তা আবার তোদের এত ভালো লাগে!’

আফতাব প্রতিবাদ করলেন,
‘ মোটেই ছাতার মাথা নয় ভাবি। আপনি জানেন না আপনার হাতে জাদু আছে।’
মিনা গদগদ হেসে বললেন ‘ কী যে বলো না ভাই!’

সেই সময় ধূসর বাড়িতে ঢুকল। তার জুতোর শব্দ সকলের মনোযোগ ফেরাল। আমজাদ দেখতেই আরেক দিক মুখ ঘোরালেন। ওর ওপর তার রা*গটা এখনও পরেনি। আর কী ঢ্যামনা ছেলে,গুরুজন রে*গে আছে বুঝেও মাফ চাইছেনা। আশ্চর্য!
মিনা দেখতেই উজ্জ্বল কণ্ঠে বললেন,
‘ এসে গেছিস ধূসর? দুপুরে তো কিছু খাসনি বোধ হয়,যা ফ্রেশ হয়ে আয়,খাবার দিতে বলি।’

‘ হু।’
ধূসর যাচ্ছিল ওপরে। আজমল ডাকলেন ‘ ধূসর! ‘
সে থেমে তাকায়, ‘ জি চাচ্চু।’
‘ আমার একটু কথা ছিল সবার সাথে। তুমিও থাকো।’

‘ মিছিলে গিয়েছিলাম চাচ্চু। সমস্ত গায়ে ধূলোময়লা। লম্বা শাওয়ার নিতে হবে। আপনি বাকীদের বলুন,আমি জয়েন করব। সমস্যা নেই।’

‘ ঠিক আছে, যাও।’
আমজাদের মুখটা আরো বেশি তিক্ত হলো। দাঁত কপাটি খিঁ*চে স্তম্ভ হয়ে রইলেন। রাজনীতি,মিছিল,স্লোগান তার অপছন্দের শীর্ষে,অথচ ঘরের ছেলে বুক ফুলিয়ে সেসবই ঘোষনা করে।

আফতাব ভাইয়ের চোখমুখ দেখে ঘটনা ঠাওড় করতে পেরেছেন। গো-বেচারা লোকটা টু শব্দ করলেন না। চোরা চোখে ভাইয়ের দিক তাকিয়ে থেকে চুপচাপ কাপের প্রান্তে চুমুক দিতে থাকলেন। মনে মনে দোয়া করলেন ‘ ইয়া আল্লাহ! ধূসরকে নিয়ে আর কোনও কথা না উঠুক। ‘

জবা বেগম চোখ দিয়ে স্বামীকে ইশারা করলেন, বলতে বললেন কিছু। আজমল মাথা নাড়লেন। গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন,
‘ বড় ভাইজান! ভাবি! আমার একটা কথা ছিল আপনাদের সাথে।’
আমজাদ ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন। মিনা শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে তটস্থ হলেন। পিউয়ের ঘুমের রেশ তখনও কাটেনি। পিয়াঁজু তে কা*মড় দিতে দিতে অন্য হাতে চোখ ডলছিল সে। সেজো চাচার কথাতে থমকাল। খাবার মুখে পু*ড়ে ভুলে গেল চিবোতে।
ত্রা*সে বুক লাফাচ্ছে। আন্দাজে অসুবিধে হচ্ছেনা, চাচ্চু কী বলবেন!
সে আ*তঙ্কিত লোঁচনে বোনের দিক তাকায়। পুষ্প মনের সুখে খাচ্ছে। তার চোখ আজমলের ওপর। যেখানে পরিষ্কার আগ্রহ।
আজমল ওকেই ডাকলেন। নিজের পাশ দেখিয়ে বললেন,
‘ পুষ্প মা,এসো দেখি চাচ্চুর কাছে।’
পুষ্প স্ফুর্ত মনে উঠে গিয়ে বসল সেখানে। আজমল তার মাথায় হাত বুলিয়ে সেটা কাঁধে রাখলেন। আমজাদ কে বললেন,
‘ ভাইজান,আমার নিজের মেয়ে নেই। পুষ্প আর পিউই আমার মেয়ে। ওদের আমি সন্তান থেকে আলাদা দেখিনা। আমরা কেউই ভাইয়ের ছেলেমেয়েকে আলাদা করিনা তুমি জানো। আমাদের এই একান্নবর্তী পরিবারে যতটা মিল,আমি মনে করি এই মেলবন্ধন হয়ত দেশে হাতে গুনলেও কম হবে। ‘

আমজাদ হেসে বললেন
‘ সেত ঠিকই। আমার পরিবার সোনার টুকরো পরিবার! লাখে একটা!’
আজমল বললেন,
‘ আমি যদি তোমার কাছে একটা আবদার করি, রাখবে? আপনি রাখবেন ভাবি?’

মিনা উৎফুল্ল গলায় বললেন ‘ রাখব না মানে? খালি চাও তুমি ভাই। ‘
‘ কী চাও আজমল,বলেই দ্যাখো।’
বাকীরা কৌতুহলী। চেহারায় শুনতে চাওয়ার প্রবণতা। পিউয়ের গলা শুকিয়ে আসছে। বিচলিত ভঙিতে বারবার ওপরের দিক তাকাচ্ছে। প্রার্থনা করছে ধূসর আসার।
আজমল বিনীত হাসলেন। পুষ্পর দিক একবার দেখে বললেন,
‘ আপনার মেয়েটাকে আমি আমার ছেলের জন্যে চাই। পুষ্পকে আমি সাদিফের বউ করতে চাই ভাবি। ‘

সাদিফ কেশে উঠল। কাশির দমকে কাপ থেকে গরম চা উত্থলে পরল গায়ে। পুষ্প কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বিস্ফোরিত চোখে চাচার দিকে তাকাল। হাত পা কাঁ*পছে,দুনিয়া দুলছে। পিউয়ের মুখ কাঠ-কাঠ। সে ব্যথিত,অসহায় নজরে বোনের দিক চেয়ে রয়। ফের আরেকবার তাকায় সিড়ির দিকে। এই সমস্যার সমাধান,তার ধূসর ভাই,
‘কখন আসবেন আপনি?

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.