আমজাদ সিকদারের চকচকে গাড়িটা লম্বা জ্যামের কবলে । বারবার তিনি হাত ঘড়ি দেখছেন। এই নিয়ে বিশ মিনিট হতে চলল,জট ছোটার নাম নেই। এই জ্যামের মুখাপেক্ষী হবেন না বলেই প্রতিদিন ভোরে বের হন। কিন্তু আজ,আজ আর রক্ষে পাওয়া গেল না। তিনি পাশ ফিরে একবার ভাইয়ের দিক চাইলেন। আফতাব ঘুমে ঢুলছেন। একটু পরপর মাথাটা হেলে পরছে,আবার সোজা করছেন উনি। ভদ্রলোকের এটা দৈনন্দিন রুটিন। নাস্তাও কোনও রকম নাকে মুখে ঠুসে বের হন। এত বছরেও অভ্যাসে দাঁড়াল না বলে মাঝেমধ্যে আমজাদ বিরক্ত হন বটে৷ এই, এখনও হলেন। গাড়ি যে জ্যামে আটকে,দেখো গিয়ে হুশই নেই এর। তিনি কাঁচ নামালেন। জানলা থেকে বাইরে তাকালেন। গলা উঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন,জ্যামের লাগাম কতটা! না,এই জ্যাম ছুটতে আরো মিনিট দশেক লাগবে৷ কোন কুক্ষণে যে ফ্যাক্টরি টা এদিকে নিয়েছিলেন!
হঠাৎ একটা পরিচিত মুখ দেখে ভ্রু বেঁকে এলো ওনার। সতর্ক করলেন দৃষ্টি। চেনা মুখটি রাস্তা পাড় হচ্ছে একটু দূর থেকে। আমজাদ চিনতে পেরেই ডাক ছুড়লেন,
‘ ফয়সাল! এই যে, ফয়সাল! ‘
অকষাৎ উচু কণ্ঠে, ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠলেন আফতাব।
‘ কে, কে, কে?’
‘ কেউনা,তুমি ঘুমাও।’
প্রথম দফার ভ*য় কা*টল ভাইয়ের শান্ত গলায়। আফতাব নিশ্চিন্তে আবার মাথা এলিয়ে দিলেন সিটে৷ নিজের নাম শুনে চটপট থামল ফয়সাল। ভুল শুনেছে ভেবে পা বাড়ালে আমজাদ ফের ডাকলেন। সাথে হাত নেড়ে চেষ্টা করলেন মনোযোগ পাওয়ার। ফয়সাল এতক্ষণে ওনাকে দেখল। কোঁচকানো কপাল মসৃন হলো সবেগে। বিনম্র পায়ে এগিয়ে এলো। সালাম দিলো হাত উঁচিয়ে৷ এত ভদ্রতায় আরো একবার মুগ্ধ হলেন আমজাদ। জবাব ফিরিয়ে শুধালেন,
‘ কেমন আছো?’
‘ জি আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল,আপনি কেমন আছেন?’
‘ ভালো। এত সকালে,কোত্থেকে এলে?’
‘ বিকেলে এক্সাম আছে তো,তাই ওই সময়ের টিউশনিটা এখন পড়িয়ে এসছি।’
আমজাদ অবাক হলেন ভীষণ,
‘ টিউশনি? এখনও টিউশন করছো কেন? তোমার না চাকরি হয়েছে? ‘
ফয়সাল ওনার চেয়েও অবাক হয়ে বলল,
‘ চাকরি? নাতো আঙ্কেল! কে বলেছে আপনাকে?’
আমজাদ থেমে থেমে বললেন,
‘ হয়নি? তাহলে পিউকে পড়ানো হুট করে ছাড়লে যে?’
‘ আমি ছাড়িনি তো আঙ্কেল। আন্টিই ফোন করে আমাকে নিষেধ করেছিলেন পড়াতে যেতে।’
আমজাদ দুই চোখ ঝাপটে বললেন, ‘ কীহ?’
তারপর মনে পড়ল সেইদিনের ঘটনা। যখন পিউ মারিয়াকে দেখে হা হুতাশ লাগিয়ে কাঁ*দল, আর সে রে*গেমেগে ফিরে এলো কামড়ায়। মিনা তো ইনিয়েবিনিয়ে বলেছিলেন,’ ফয়সাল চাকরি পেয়েছে,তাই পড়াবেনা। ‘
ব্যস্ততায় উনিও আর খোঁজ নেননি৷ অথচ মিথ্যে ছিল ওটা?
আমজাদ বিরক্ত শ্বাস নিলেন। তারপর বললেন,
‘ মানা করলেন আর তুমিও গেলেনা? আমাকে একবার জিজ্ঞেস করবেনা? তোমার বাবাকে এত বড় মুখ করে বললাম আমি….’
ফয়সালের চেহারাটা এ যাত্রায় ছোট হয়ে এলো। নীচু কণ্ঠে বলল,
‘ আমি আপনাকে জানাতে চেয়েছিলাম আঙ্কেল। কিন্তু… ‘
‘ কিন্তু কী?’
সে একটু চুপ থেকে জানাল,
‘ কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যায়ই ধূসর ভাই এসে আমায় ধমকা ধমকি করে গেলেন। তাই আর… ‘
আফতাব সচকিতে তাকালেন ধূসরের নাম শুনতেই। তার ঘুম শেষ! আমজাদ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
‘ ধূসর? কী,কী বলেছে?’
‘ উনি যে ঠিক কী বলেছে আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। তবে আপনাদের বাড়ির ধারেকাছেও যেতে মানা করেছেন আমায়। উনি হয়ত পিউ আর আমাকে নিয়ে ব্যতিক্রম কিছু ভেবেছিলেন৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন আঙ্কেল,আমি কিন্তু পিউকে ছোট বোনই ভাবি।’
আমজাদ থম ধরে গেলেন৷ ওমন থমথমে কণ্ঠেই বললেন,
‘ ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।’
কথার পীঠে এমন উত্তর আশা করেনি ফয়সাল। তার আঁদোলে হতাশা দেখা গেল। নালিশ টা কি গুছিয়ে করতে পারল না? এই সুযোগে টিউশনিটা আবার ফেরত পেলে ভাগ্য খুলতো। মাস শেষে আট হাজার টাকা!
অগত্যা ফলাফল শূন্য দেখে কথা বাড়াল না সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় সালাম ঠুকে বিদেয় নিলো। আমজাদ তপ্ত চোখে আফতাবের দিক চাইলেন৷ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন তিনি। আমজাদ রেগে বললেন,
‘ তুমি যে ঘুমের ভাণ করছো,আমি কিন্তু জানি আফতাব।’
আফতাব চোখ মেললেন। ধরা পরেছেন বলে ঠোঁট উলটে সোজা হয়ে বসলেন। ভেতর ভেতর আহাজারি লাগালেন সমানে। এখন ছেলের নামে আবার দু কথা শুনতে হবে। নাহ,এই বাঁদড় ছেলে এ যাত্রায় এই বুড়ো বাপটাকে শান্তি দেবেনা।
‘ দেখেছো তোমার ছেলের কান্ড? দেখেছো? ফয়সাল টাকে তাড়িয়ে একটা বন্ধু আনিয়েছে। তা সে বন্ধু পড়াতে আসে? পনের দিন এসে আর খবর নেই। আর তোমার ভাবি,সেই বা কম কীসে? দুজন মিলে আমায় কাহিনী বানিয়ে শোনাল? দাঁড়াও, এর একটা বিহিত আমি করছি।’
আমজাদ ফোসফোস করলেন। অথচ বিড়ালছানার ন্যায় গুটিয়ে বসে রইলেন আফতাব। ওনার চুপ থাকাটা সহ্যে না কূলোলে, তিনি খ্যাক করে বললেন,
‘ কী, কথা বলছো না কেন? ‘
আফতাব মিনমিন করে বললেন,
‘ কী বলব ভাইজান? কম তো বলিনা ছেলেটাকে! এতেও কাজ হচ্ছেনা যখন,আর শুধরাবে বলে মনেও হয়না।’
সাথে একটা লম্বা আক্ষেপের নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি৷
‘ শুধরানোর দরকার নেই আর। এবার সোজা এর রাস্তাতেই আগাব৷ ও ভুলে যায় যে আমরা ওর বাপ। আগে তোমার ছেলে, মানে পালের গোঁদাটাকে দেখছি, তার পর তোমার ভাবিরও হচ্ছে।”
আফতাব গো-বেচারা ভঙিতে মাথা নাড়লেন। ভাবলেন,
‘ কী যে করবেন কে জানে! অত বড় দাঁমড়া ছেলের ত্যাড়া ঘাড়ের রগ কি আর সোজা হবে? এ ছেলে ঠিক হবেনা ভাইজান! আমি আশা ছেড়েছি,আপনিও ছেড়ে দিন।’
*******
আজ টানা তিনদিন পর সাদিফের পা পড়ল অফিসে। এমন নয় সে ছুটিতে ছিল,ইচ্ছে করে আসেনি। একমাত্র অনুষ্ঠান ব্যাতীত,ঝড় -তুফানেও যে ছেলে কামাই করেনা, সে অফিসমুখো হয়নি কদিনে। অফিসের বস,তাকে ফোন করে করে হয়রান প্রায়। একটা বার সংযোগ পাননি। পাবেন কী করে! সাদিফ সিম শুদ্ধ খুলে রেখেছিল। খেতেও নীচে নামেনি। সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে আসেনি। হৈচৈ করেনি পিউদের সাথে। রুমে খেয়েছে,ঘুমিয়েছে,কাজ শেষে বন্ধ করেছে দোর। ওইদিনের পর জবা বেগম যতবার ঘরের সামনে যেতেন,দরজা বন্ধ। পিউও ডাকেনি। তবে ভেতর ভেতর সবাই চিন্তিত ছিল ওকে নিয়ে।
সাদিফকে দেখে কিয়ৎকাল তৃষ্ণা সমেত চেয়ে রইল মারিয়া। নিষ্পলক, নিশ্চল সেই দৃষ্টি। যেন তিনদিন নয়,তিন যুগ পর মানুষটা সামনে এসেছে ওর। এই তিনদিন কী মারাত্মক ছটফট সে করেছে কেউ জানেনা। কতবার ফোন দিয়েছে,বন্ধ। একবার চেয়েছিল ও বাড়ি যাবে,পারেনি।
প্রতিদিন সাদিফ তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় একবার তাকাতো,মৃদূ করে হাসতো অথচ আজ সোজা ঢুকে গেল কেবিনে৷ যেন এক যন্ত্রমানব হেঁটে গেল। ফিরেও দেখল না ওকে। মারিয়া সারাটা বেলা কাজে মন বসাতে পারল না। আঁচ করতে পারছে,মানুষটা ভালো নেই। হয়ত পিউ রাজী হয়নি। হওয়ার তো কথাও না। কিন্তু…..!
সাদিফকে নিয়ে ভাবতে বসে সব গড়মিল হচ্ছিল তার। কাজে ভুল করছিল বারবার। সব ভুলে,মাথা খারাপ হওয়ার মত অবস্থা।
লাঞ্চ টাইম পড়তেই মারিয়ার উশখুশ প্রগাঢ় হলো। চাতকের ন্যায় খানিকক্ষণ অপেক্ষা চালাল। এই বুঝি সাদিফ বের হয়! গতবারের মত এসে আবদার ছো*ড়ে একসাথে খাওয়ার৷ কিন্তু সময় কাটলেও তার দেখা নেই। শেষে অধৈর্য হয়ে পড়ল সে। নিজেই সাহস যুগিয়ে উঠে দাঁড়াল। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী, একজন সামান্য কর্মচারী চাইলেই ম্যানেজারের কক্ষে যেতে পারেনা,যতক্ষণ না তাকে ডাকা হয়। কিন্তু মারিয়া এই নীতির ধার, ধারলনা আজ। তার মন বলছে সাদিফ ঠিক নেই। যখন পাশ থেকে যাচ্ছিল কেমন মনমরা লাগছিল দেখতে! এসব জেনেবুঝেও এভাবে পুতুল সেজে বসে থাকার মানে হয়না।
মারিয়া ত্রস্ত এগিয়ে যায়। কাঁচের দরজায় দু বার টোকা দিয়ে নরম গলায় প্রশ্ন পাঠায়’ আসব স্যার?’
‘ আসুন।’
মারিয়া বুক ভরে শ্বাস টেনে ভেতরে ঢুকল। সাদিফ কপালে এক হাত ঠেস দিয়ে আরেক হাতে কলম ধরে ছিল। একজন ঢুকেছে টের পেয়ে আলসে ভঙিতে চোখ তুলল। মারিয়াকে দেখতেই সচেতন হলো সেই দৃষ্টি। মসৃন ভুরু গুছিয়ে এলো এক জায়গায়। বলল,
‘ আপনি! ‘
কণ্ঠে অল্পস্বল্প বিস্ময়। মারিয়া এগোচ্ছেনা। স্থির দাঁড়িয়ে। তবে চাউনী অবিচল। যেন পরোখ করছে ওর ফর্সা, গোল মুখবিবর। সাড়াশব্দ না পেয়ে সাদিফ বলল,
‘ আপনাকে কিছু বলেছি। ‘
মারিয়া নড়ে ওঠে। নিজেকে সামলে নেয় দ্রুত। অগোছালো দৃষ্টি মেঝেতে ফ্যালে। সাদিফ কী বুঝল কে জানে! সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলল,
‘ বসুন মারিয়া।’
মারিয়া চকিতে তাকায়। বুক মুচড়ে ওঠে মুহুর্তে। প্রথম বার সাদিফের মুখে নিজের ঠিকঠাক নামটা কদাচিৎ ঠেকে। হৃদয় নিঙড়ে কা*ন্না পায়। অথচ সামলে নেওয়ার প্রবল ক্ষমতা আজও বাঁচিয়ে দেয় ওকে। ঢোক গেলার সাথে, সেই কান্নাটুকুও গিলে ফেলল প্রযত্নে।
‘ কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে থাকবেন? আসুন।’
সাদিফের কণ্ঠ সুস্থির। তবে বেশ ভাঙা।
মারিয়া ঘাড় ঝাঁকায়। ধীরুজ কদম সামনে বাড়ায়। প্রথম বার ওর কেবিনে এলো সে। ছোট খাটো কেবিন,দেয়ালে একটা মাঝারি আকারের এসি ঝুলছে। তার পাশের দেয়ালে এক হাত বড় সাইজের ঘড়ি। একটা চৌকোনা টেবিল,সামনে দুটো ফোমের চেয়ার। ওহ,কোনায় একটা কেবিনেট,আর পানির ফিল্টার। মারিয়া আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে কাছে এল। বসল সাদিফের সামনের কেদারায়। চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে দূর্বল মনে হলো খুব। যতটা সাহস নিয়ে এসেছিল,এখন তার কিচ্ছুটি নেই। সবটা গুলিয়ে গিয়েছে কেমন । তার মত চটাং চটাং কথা বলা মেয়েটাও,ভালোবাসার মানুষের সামনে এলে চুপ মেরে যায়?
সাদিফ ফাইল বন্ধ করে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকায়। মারিয়াকে অপ্রতিভ লাগছে! যেন কত কিছু বলবে,আসছেনা মুখে। সে স্থির গলায় শুধাল,
‘ হঠাৎ এলেন যে!’
মারিয়া জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। কথা খোঁজে। সময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
‘ ঠান্ডা লেগেছে আপনার?’
‘ না, কেন?’
‘ গলা বসে গেছে। ‘
সাদিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। ওইদিন অত কাঁদার পর থেকেই গলা ভে*ঙেছে। এখনও ঠিক হয়নি। শেষ কবে এত চিল্লিয়ে কেঁ*দেছিল সে জানেনা।
মারিয়া চিন্তায় পড়েছে। সে কী কথাটা তুলবে? ওঠাবে প্রসঙ্গ? সাদিফের মুখ দেখে দ্বিধাবোধ হচ্ছে। যদি কা*টা ঘাঁ*য়ে নুন ছেটানো ভাবে!
অথচ সাদিফ নিজেই বলল,
‘ পিউকে আমি উপহারটা দিতে পারিনি! ‘
কথাটা কেমন শোনাল না? যেন হাজার খানেক ব্য*র্থতা আর মর্ময*ন্ত্রণা মিশে হেথায়৷ মারিয়ার হয়ত খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু সাদিফের ব্যথাতুর আওয়াজ, সরাসরি বুকে গিয়ে বিঁধল। মনে হলো একটা তীর এসে শাই করে গেঁথে গেল বক্ষের বা পাশে।
সব কিছু জেনেও শুধাল,
‘ কেন? পিউ নেয়নি?’
এ যাত্রায় হাসল সাদিফ। উদাস তার স্বর,
‘ নেবে কী,ওর কাছেই তো যাইনি মারিয়া। এর আগেই কিছু দৃশ্য আমাকে সারাজীবনের মত থামিয়ে দিলো। ‘
মারিয়ার আগ্রহ জন্মাল খুব। কী সেই দৃশ্য জানার জন্য উচাটন লাগল। আগেভাগে কিছু না জানলেই ভালো হোতো হয়ত। এতটা অস্বস্তি থাকতোনা। তবু, খুশুখুশে জ্বিভ নিয়ে চুপ রইল সে। সাদিফ নিজেই বলল
‘ খুব খুশি ছিলাম আমি! উত্তেজিত ও। পিউ কী বলবে,ওর রিয়াকশন কেমন হবে এসব নিয়ে ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শেষমেষ এমন কিছু জেনেছি,এমন অপ্রিয় কিছু সত্যি,যার স্রোত আমার সব আনন্দ খড়কুটোর মত ভাসিয়ে, ডুবিয়ে দিলো। ‘
মারিয়া নিশ্চুপ। মাথাটাও নামিয়ে নিলো নীচে।
‘ জানতে চাইবেন না,কী সত্যি?’
‘ পিউ, ধূসর ভাইকে ভালোবাসে, তাইত?’
কথাটা মুখ ফস্কে বলে ফেলল সে। খেয়াল পড়তেই থমকে গেল নিঃশ্বাস। আ*তঙ্কিত,কম্পিত নেত্রে তাকাল। সাদিফ অত্যাশ্চর্যর ন্যায় চেয়ে তার দিক। চোখেমুখে চমক,হকচকানোর ছাপ। যা দেখে তার শ*ঙ্কা বাড়ল,ভ*য় হলো।
সাদিফ বিস্ময়াহত কণ্ঠে বলল,” আপনি জানতেন?’
মারিয়া অস্বীকার করল না। ওপর নীচে মাথা ঝাঁকাতেই সাদিফ আহ*তের ন্যায় বলল,
‘ জেনেও চুপ ছিলেন? কেন বলেননি আমায়? সেদিন যখন যাব বলেছি,আটকালেন না কেন? কেন?’
শেষ কেন টায় উচু হলো আওয়াজ। মারিয়া কেঁপে ওঠে। থেমে থেমে জানায়,
‘ আমি বললে আপনি ভুল বুঝতেন। হয়ত বিশ্বাসও করতেন না। ভালোবাসার ক্ষেত্রে এই ব্যাপার গুলো খুব অদ্ভূত হয়। চাক্ষুশ প্রমাণ ছাড়া আমরা অপর পাশের মানুষটাকে অবিশ্বাস করতে পারিনা। ‘
তারপর ওর দিক চেয়ে কাতর কণ্ঠে বলল,
‘ আমি চেয়েছিলাম বলতে, বিশ্বাস করুন! কিন্তু সেদিন আপনার মুখে পিউয়ের প্রতি দৃঢ়তা দেখে আর পারিনি। যার প্রতি আপনার এত আস্থা,সেসব আমার সামান্য কিছু কথায় নষ্ট হোক আমি চাইনি। ‘
সাদিফের সাদাটে চিবুক শক্ত। চশমার কোনা থেকে দেখা যাচ্ছে দুটো তপ্ত আঁখি। মারিয়া থামলে সেই নেত্র এক হলো। খুব জোরে এলো শ্বাস ফ্যালার আওয়াজ। তারপর তাকাল,সোজাসুজি শুধাল,
‘ কবে থেকে জানতেন? ‘
মারিয়া জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। আস্তে-ধীরে বলে,
‘ অনেক আগে থেকে৷ ভাইয়ার কাছে শুনেছিলাম। ধূসর ভাই পিউকে ভালোবাসেন,এটা ওনার কাছের দূরের প্রায় সবাই জানে।’
সাদিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ক্লান্ত ভঙিতে মাথা এলিয়ে দিলো চেয়ারে। ঢোক গিলে বলল,
‘ সবাই জানে? কী আজব!এক বাড়িতে থেকে শুধু আমিই জানলাম না। ‘
মারিয়া বলতে নেয়,’ এখানে তো আপনার…. ‘
সে থামিয়ে দেয়। হেসে বলে,
‘আপনি ঠিকই বলতেন মারিয়া,চারটে চোখ লাগিয়েও আমি অন্ধ। নাহলে আমার এত কাছে,এত সামনে দুটো মানুষের লুকোচুরি প্রেম ধরতে পারলাম না? মাঝেমধ্যে মনে হোতো কি জানেন,পিউ ভাইয়াকে নিয়ে আগ্রহী। যেখানে আমি ডেকেও পাইনা,সেখানে ভাইয়ার সব কাজে ও যেঁচে, ছুটে হাজির হয়।
কিন্তু যেদিন চশমা ভা*ঙায় আমি পিউকে বকলাম,আর ভাইয়া আমায় শাসাল? সেদিন মনে হলো,ভাইয়া ওকে বকলেও, অধিক স্নেহ করেন৷ তাইত আমার বকা-ঝকাটা তার সহ্য হয়নি৷ আর অত আদর করলে ছোটরা তার পেছনে ঘুরবে স্বাভাবিক। আমি কত বোকা! ওইদিন ভাইয়ার শা*সানোর আড়ালে যদি স্নেহ না খুঁজে বুঝতাম,ওটা পিউয়ের প্রতি ওর ভালোবাসা, ওর টান! হয়ত আমার ভালোবাসা সেদিনই লাগাম টেনে নিতো। এতখানি গড়াত না। আফটার অল, আমি তো আর সিরিয়ালের বেহায়া ভিলেন নই,যে কেউ ভালোবাসে না জেনেও তাকে পাওয়ার লোভে উঠেপড়ে লাগব। ‘
সাদিফ প্রসস্থ হাসল। কিন্তু এর পেছনের নিঃসৃত ক*ষ্ট কড়ায়- গণ্ডায় অনুভব করল মারিয়া। সে নিজেওত একই নৌকার মাঝি। যেই নৌকার বৈঠা চলে এক তরফা প্রেমে। ছেড়া, পাতলা পাল ওড়ে মন ভা*ঙার নামে।
সাদিফের ভীষণ ফর্সা মুখের দিক চেয়ে জ্বলে উঠল তার দৃষ্টিযূগল। বুক চিড়ে নির্গত হলো কিছু নি*হত প্রশ্বাস। সাদিফ অতটা কাছে গিয়েও তার ভালোবাসার মানুষকে কিছু বলতে পারেনি,যেমন পারছেনা সে। এর থেকে পীড়া-দায়ক আর কী আছে? তাদের মধ্যে আগে যেই ঠাটবাটের ভেদ ছিল,এখন আরো একটা কারণ যোগ হলো শুধু। সাদিফের চাউনীতে পিউয়ের প্রতি অঢেল ভালোবাসা দেখেও,সে ওই মনে নিজেকে বসাতে চায়না। তার চেয়ে চলুক না, জীবন যেমন চলছে!
‘ আপনি কখনও জানবেন না সাদিফ, আপনার এই শুভ্র মুখবিবর আমার স্বস্তি নিদ্রার সন্ধি। কখনও জানবেন না, আপনার কণ্ঠ শোনার আশায় আমি কতটা ব্যকুল,ছটফটে! কখনও জানবেন না, আপনার সাথে এই গোপন বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় আমি নিঃশেষ প্রায়।
তবুও,আমার মনের অবস্থা আপনার কাছে এমনই অপ্রকাশিত থাকুক। থাকুক এমন অজ্ঞাত। প্রার্থণা করি এসব যেন কখনও না জানেন। এইভাবেই, আপনি হবেন, আমার জীবনের আরেকটি না পাওয়া সুখ। আমার হৃদয়ের প্রথম প্রেমে পড়া,ব্যর্থ ভালোবাসা। ‘
সাদিফ বলতে গেল,
‘ জানেন মারিয়া…’
কিন্তু কথা সম্পূর্ন হলো না তার। মারিয়ার চিন্তার ভেতর থেকেই কা*ন্নার বাধ ভে*ঙে এলো। হাঁসফাঁস করে ফুঁপিয়ে কেঁ*দে উঠল সে। অনুরোধ করল,
‘ প্লিজ আমাকে মারিয়া ডাকবে না। দোহাই লাগে, শুনতে পারছিনা আমি।’
বলতে বলতে তার কা*ন্নার গতি বাড়ে। সাদিফ তাজ্জব হলো। গোল চোখে চেয়ে রইল। হঠাৎ কা*ন্নায় সে বিহ্বল বনে গিয়েছে।
মারিয়া কেঁদে-কেটে ভণিতাহীন জানাল,
‘ আপনার মুখে আমি ম্যালেরিয়া শুনতে চাই। অন্য কিছু নয় সাদিফ।’
একটা বিস্ময় না কাটতেই, আরেকটার তোপে স্তম্ভিত সাদিফ। কণ্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে, নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘ আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকলেন?’
সহসা, মারিয়ার কা*ন্না থামে। সজাগ চোখে তাকায়। জ্বিভ খসে ডেকে ফেলেছে বলে সাফাই দিতে বলল,
‘ না মানে…..’
তার ভীত,ভেজা লোঁচন দেখে হেসে ফেলল সাদিফ। টেনেটুনে আনা হাসি নয়,বরং প্রাণখোলা হাসিটা ওষ্ঠপুটের রাজ্যের কানায় কানায় বিছিয়ে গেল এবার। বলল,
‘ আমি কখনও আমার জুনিয়রের মুখে নিজের নাম শুনিনি। আজই প্রথম। মন্দ লাগেনি কিন্তু। ‘
মারিয়া আই-ঢাই করে বসে রয়। দুহাতের আঙুল কচলায় সমানে। তার অপ্রস্তুত চেহারা দেখে সাদিফ বলল, ‘ রিল্যাক্স! আমি কিছু মনে করিনি।’
এর মধ্যে টেবিলে রাখা টেলিফোন শব্দ করে বাজে। সাদিফ রিসিভার তুলল, কথা শেষ করে তাকাল,জানাল,
‘ বস ডাকছেন। বিনা নোটিশে তিনদিন ছুটি কাটিয়েছি,অপেক্ষায় ছিলাম এটার। যাকগে, শুনে আসি।’
সে উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথে দাঁড়াল মারিয়াও। মেয়েটা তখনও বিভ্রান্ত। সাদিফ এগোতে গেলে ইতস্তত করে বলল,
‘ আপনি সত্যিই কিছু মনে করেননি তো?’
সে ঘুরে চায়। মারিয়া যত্র চোখ নামাল।
সাদিফ বলল,
‘ না।’
‘ সত্যি তো?’
‘ কী করলে বিশ্বাস হবে?’
কথাটা এমনি বলেছিল,অথচ মারিয়া ব্যস্ত ভঙিতে প্রস্তাব ছু*ড়ল,
‘ ছুটির পর আমার সাথে বের হলে।’
সাদিফ কপাল কোঁচকাতেই বলল,
‘ আপনি কিছু বললে আমি কিন্তু কখনও না করিনি। আজকে কি আমি না শুনব?’
সাদিফ হাসল। যেতে যেতে বলল,
‘ ঠিক আছে। ‘
মারিয়ার ঠোঁট দুদিকে সরে গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচার ন্যায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানল। কোমল নেত্রে দেখল সাদিফের প্রস্থান। এই মানুষটার থেকে যত দূরে যেতে চাইছে,প্রকৃতি যেন তত টেনে আনছে কাছে।
******
পিউয়ের কিচ্ছু ভালো লাগছে না আজকাল। কোথাও মন বসছেনা। হোক সেটা ফোনে,হোক পড়ার টেবিলে,হোক বসার ঘরের আড্ডায়। সেই কক্সবাজার থেকে ফেরার পর ধূসরের সাথে ঠিক ভাবে দেখা হচ্ছে না ওর। না একটু কণ্ঠ শুনছে মানুষটার। না হচ্ছে আগের মত চোখাচোখি। সে যে ভীষণ ব্যস্ত! দৌড়-ঝাপ করছে খুব। ভোরে বেরিয়ে অফিস করছে,এরপর ছুটছে পার্টি অফিসে। সেখান থেকে আবার অফিস। ফিরতে ফিরতে রাত গড়ায়৷ পিউ কূলোতেই পারেনা তার রুটিনের সাথে। ক্লান্ত হয়ে ফেরে বিধায় রুমেও ঢোকেনা। আর এই নিয়েই তার অবস্থা করূণ!
মন আর চোখ দুটোর দখলেই যে সেদিনের রাত,সেদিনের মুহুর্ত। অথচ তারপর থেকে মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেখেনি। ওনার সময় কই তার কাছে আসার! তার দিকে তাকানোর! আজ সকালেও কী তাড়াহুড়ো করে বের হলো। আজকেই যে নির্বাচন। ফিরেও দেখল না ওকে। একটু তাকালে কী হোতো শুনি? সপ্তদশী মেয়ের অভিমান হয়। প্রেমিকা সুলভ মনের প্রতিটি কোনায় অন্ধকার নামে সেই অনুরাগের তোপে। জবার ন্যায় লালিত অধর ভে*ঙে, উঠে আসে উঁচুতে। বিড়বিড় করে বলে,
‘ আবার আসুক বলতে, পিউ বিয়ে করব তোকে। বউ হবি আমার?
হব না আপনার বউ। পার্টি অফিস কে বিয়ে করুন গিয়ে। ইকবাল ভাইকে বউ বানান। থাকেন তো সারাদিন ওদের সাথেই৷ আমাকে কী দরকার?’
বলতে বলতে বারান্দা থেকে এসে বিছানার ওপর ধপ করে বসল সে।
কিছুক্ষণ পর ফোন বাজল ৷ রিংটোন শুনে তিঁতিবিরক্ত হয়ে তাকাল পিউ। স্ক্রিনে তানহার নম্বর দেখে রিসিভ করল। অথচ হ্যাঁ -না বলার আগেই ভেসে এলো মেয়েটির উদ্বীগ্ন, অধৈর্য কণ্ঠস্বর,
‘ টেস্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে,দেখেছিস?’
_____
ধূসর হূলস্থূল বাধিয়ে কাজ সাড়ছে। ব্যস্ত ভাবে দেখছে ঘড়ির কাঁটা। দুটোর দিকে কেন্দ্রে পৌঁছানো জরুরি। আজকে ভোট। কার্যক্রম শুরু হবে যোহরের পর।
পাশাপাশি চিন্তিত সে। ওইদিন প্রতিপক্ষের হঠাৎ আ*ক্রমণ। সোহেল যতটা বলেছিল অতটা হয়নি,তবে হুমকি দিয়েছে সত্যি। এই নিয়ে বেশিরভাগ সদস্যরাই সিটিয়ে আছে ভ*য়ে। সামনে নির্বাচন বিধায় তারাও পালটা কিছু করেনি। একবার খলিল জিতলে উচিত জবাব পাবে ওরা।
কিন্তু এখন, ইকবাল একা কী করবে কে জানে! কেউ না ম*রা অবধি ও সিরিয়াস হতে পারেনা। সারাক্ষণ ফাজলামি! চিন্তায় ধূসরের মাথা ব্য*থা উঠল। এদিকে কক্সবাজারের গ্যাপটুকুতে অসংখ্য ফাইল জমা পরেছে অফিসে। ইদানীং আমজাদ ভীষণ কড়াকড়ি লাগিয়েছেন। সঙ্গে তার ভাই ভক্ত বাপ তো আছেই। নতুন নিয়ম করেছেন দুজন,প্রতিটি ফাইল পাশ হওয়ার আগে ওকে দিয়ে দেখাবেন,ওর সই নেবেন, এরপরে ডিলে নামাবেন তারা। ধূসর বুঝে পেলোনা এতটা করার কী দরকার! আগে তো এসব ওনারাই করতেন।
ধূসর তাড়াহুড়োতে,কিন্তু মনোযোগী। হাতের কাজ যত দ্রুত শেষ হয় তত ভালো। এর মধ্যে একবার ইকবালকে কল করল । সে ধরলও রাতা-রাতি। কিন্তু প্রচুর শব্দ, গাড়ি,ঘোড়া,চেচামেচির। ইকবাল একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
‘ হ্যাঁ বল।’
ধূসরের ফোন স্পিকারে দেওয়া।
‘ কী অবস্থা ওখানকার?’
‘ এই মাত্র এজেন্ট বসালাম। একটু পর শুরু হবে। তুই কখন আসবি?’
‘ চলে আসব। আশরাকের লোকজন আছে?’
‘ হ্যাঁ থাকবে না আবার! কেমন করে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। তবে হাত খালি,অস্ত্র টস্ত্র তো দেখছিনা। পুলিশ আছেনা? ভ*য় পেয়েছে বোধ হয়।’
ইকবাল হা হা করে হাসল। ধূসর বলল,
‘ আচ্ছা ছাড়,তোরা এক সাথে থাকিস। খলিল ভাইকে ওখানে যেতে মানা করেছি। আপাতত ওনার কেন্দ্রে না আসাই ভালো। আর আমি দেড়টার ভেতর পৌঁছে যাব।’
‘ আচ্ছা ঠিক আছে,তাড়াতাড়ি আসিস। ভালো লাগেনা তোকে ছাড়া। একা একা লাগছে! মনে হচ্ছে শ্বশুর বাড়িতে বউ ছাড়া বেড়াতে এসেছি।’
ধূসর ফোনের দিক চেয়ে নাক-চোখ কোঁচকাল। এই ছেলের ফাজলামো কোনও দিন যাবে না। অতিষ্ঠ ভঙিতে দুপাশে মাথা নেড়ে লাইন কা*টল সে ।
ঘড়ির কাঁটায় যখন ১:২০ বাজে তখনও কাজ শেষ হলোনা। আজ কি একটু বেশিই ফাইল রেখে গিয়েছে?
ধূসর বুঝল,এগুলো শেষ করতে বিকেল গড়াবে তার। বাকীটা নির্বাচন শেষে এসে করে যাবে,নাহলে বাড়িতে দেখবে, ভেবে উঠে দাঁড়াল। গেল সোজা আমজাদের কেবিনে। আফতাব সামনের চেয়ারে বসে তার। চা খাচ্ছেন দুজন৷ সাথে হাসিমুখের গভীর আলোচনা। সে যেতেই সেই আলোচনা স্থগিত সেখানে। সাথে চোখমুখ গম্ভীর হল। ধূসর ভেতরে ঢুকে বলল,
‘ আমি বের হচ্ছি বড় আব্বু। ‘
আমজাদ দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘ ফাইল গুলো শেষ করে ফেলেছ? এত তাড়াতাড়ি! ‘
‘ না,শেষ হয়নি। হামিদ(পিওন) কে বলেছি বাড়িতে পাঠাতে,ওখানে দেখে নেব। ‘
‘ এত তড়িঘড়ি করে যাচ্ছো কোথায়,জানতে পারি?’
ধূসর হাতঘড়ি তে একবার চোখ বুলিয়ে জানাল,
‘ রাতে বলেছিলাম,আজ নির্বাচন আমাদের। আম অলরেডি লেইট বড় আব্বু,আই হ্যাভ টু গো।’
ধূসর ঘুরতে গেলেই
আমজাদ চায়ের কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালেন,বললেন,
‘ এটাত কথা ছিল না ধূসর। এভাবে মাঝপথে অফিস ফেলে যখন তখন পার্টি অফিসে ছুটবে, কই এরকম তো আগে বলোনি।’
‘ আমার আজকে ওখানে থাকাটা দরকার।’
আমজাদের কণ্ঠ ভারী হলো,
‘ দরকার সেটা ব্যবসায় আসার আগে ভাবোনি ধূসর? এটা তোমার বাপ- চাচার ব্যবসা বলে যখন ইচ্ছে বের হবে,যখন ইচ্ছে ঢুকবে? কেন? অফিসের নিজস্ব নিয়ম নেই? এমনিতেই বেড়াতে গিয়ে তিনদিন কাটিয়েছ। এসে থেকে একটা গোটা দিন তোমাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। তুমি আসার পর আমার এত গুলো ফাইল পেন্ডিং থাকে এর আগে এরকম কখনও হয়নি। তোমাকে আমরা ব্যবসায় লাভের জন্য এনেছি,লসের জন্যে নয়। ‘
এক নাগাড়ে বলে দম নিলেন তিনি। ধূসরের এতক্ষণের নরম চিবুক শক্ত হলো। আমজাদ বললেন,
‘ দুই নৌকায় পা দিয়ে আর কত? শেষ মেষ নিজের সাথে ব্যবসাটাও ডুবিওনা। এরকম খামখেয়ালি করলে,কোন ভিত্তিতে ব্যবসা তোমার ওপর ছেড়ে দেব আমরা? আমাদেরও বয়স হচ্ছে,আর কদিনই বা কাজের হাত শক্ত থাকবে? নিশ্চয়ই তোমার বাবা আর আমার এত পরিশ্রমের অফিস,কোনও বেখেয়ালি, উদাস,অযোগ্য লোককে তুলে দেব না তাইনা?’
আফতাব নিরব দর্শক। একবার ভাইকে দেখছেন, একবার ছেলেকে। মাঝেমধ্যে চুমুক দিচ্ছেন চায়ে। ধূসর হাত মুঠো করল। আত্মসম্মানে প্রচন্ড ঘা লেগেছে তার। আমজাদ ফের বললেন,
‘ অফিসে ঢুকলে কেউ বস না,কেউ বসের ছেলেও না। সবাই এক। সবার লক্ষ্য এক, আর সেটা কোম্পানিকে টপে পৌঁছানো। সেখানে তুমি কেন ছাড় পাবে?তাছা…’
ধূসর মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে,শক্ত গলায় বলল
‘ আর কিছু বলতে হবেনা। আমি আমার কাজ শেষ করে তবেই যাব।’
আর একটা কথাও শুনল না। গটগট করে কেবিনের দিক হেঁটে গেল । আমজাদ সেদিক চেয়ে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলেন। গ্লাস তুলে ঢকঢক করে পানি খেলেন। মেকি রা*গ নিয়ে এতগুলো কথা বলতে,ভীষণ বেগ পোহাতে হয়েছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে আফতাবের দিক চাইলেন তারপর। ভ্রু উঁচিয়ে বিজয়ী হেসে শুধালেন,
‘ কী? কেমন জব্দ করলাম?’
আফতাব হেসে দুপাশে মাথা নেড়ে বললেন,
‘ তুমি পারোও ভাইজান! ‘
_______
দুপুর গড়িয়ে বিকেল তখন। ধূসর রাগে খেতেও বের হয়নি। হামিদকে দিয়ে খাবার পাঠালে,ওমনই ফেলে রেখেছে। ওদিকে ভোট গ্রহনের সময় শেষ । ইকবাল সহ,পার্টি অফিসের মোটামুটি সবাই, লাগাতার ফোন করছিল তাকে। এমনকি খলিলও। শেষে অসহ্য হয়ে ধূসর সাইলেন্ট করে রেখেছে। হাতের একটা ফাইল শেষ না হতেই পিওনকে দিয়ে আরেকটা পাঠানো হয়৷ ধূসরের বুঝতে বাকী নেই, এইসব দুই ভাইয়ের ইচ্ছেকৃত। অন্য সময় বের হলে কিচ্ছু বলে না। কারণ সে ফাঁকই রাখেনি বলার। আজ একটু সুযোগ পেয়েছে, ওমনি দশ কথা শোনাল। ধূসরের মেজাজ তেঁতে আছে। ভোটের ফলাফল কী হলো কে জানে! সে একবার ফোনের সাইড বাটন চাপল। ঘড়িতে চারটে পার হয়েছে। ভোট গণনা কী শুরু হয়েছে? এতক্ষণে তো হওয়ার কথা। কে জিতেছে কে জানে! ফলাফল জানতে ভেতরটা উশখুশ করছে। কেবিনে টিভি থাকলেও বোঝা যেত।
সব চিন্তা ঝেড়ে সে মন দিলো ফাইলে। বুঁদ হয়ে পরল যখন, ঠিক তখন ইকবাল কল দিলো আবার। আলো জ্বলতে দেখে ধূসর একবার আড়চোখে তাকায়। তবে ধরল না। ধরলেই এক কথা বলবে,
‘ কখন আসবি, আসছিস না কেন?’
ধূসর কপাল ঘষল আঙুলে। এর মধ্যে কেবিনে টোকা পড়ে।
আফতাব মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিলেন। শুধালেন,
‘ কী করছো? ‘
ধূসর নাক ফুলিয়ে তাকায়। জবাব দেয়,
‘ ক্রিকেট খেলছি। ‘
আফতাব থতমত খেলেন। ছেলে যে বেজায় চটে আছে! নাহলে ফাইল সামনে নিয়ে বলছে ক্রিকেট খেলছে? বাপের সাথে মশকরা?
কিন্তু না,তিনিও দমে যাবেন না৷ ভাইজান বলেছেন,আজ শক্ত থাকতে হবে।
‘ ইয়ে,খাবার খাচ্ছোনা কেন?’
ধূসরের নিরুৎসাহিত উত্তর, ‘ কাজ করতে দাও,বিরক্ত কোরোনা।’
আফতাব আর কথা পেলেন না। বললেন,’ কিছু লাগলে হামিদকে ডেকো।’
ধূসর উত্তর দেয় না৷ চোখ ফাইলে। ছেলেকে নিরুদ্বেগ দেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন৷
এরমধ্যে স্ক্রিন জ্বলল। ইকবালের মেসেজ এসছে। ছোট ছোট কটা অক্ষর উঁকি দিচ্ছে সেথায়।
‘ tandob ghote gese dhuso…….
ধূসরের বুক ছ্যাত করে উঠল। তীব্র ভ*য় হানা দিলো মনে। আশরাক কি কিছু করেছে? অস্থির চিত্তে , অবিলম্বে ইকবাল কে কল দিলো সে। রিসিভ হতেই রুদ্ধশ্বাসে শুধাল,
‘ কী হয়েছে?’
প্রথম দিকে প্রচন্ড আওয়াজ। কিচ্ছু শোনা যায় না। ধূসর হ্যালো, হ্যালো করে অশান্ত হয়ে পড়ল। ইকবালের সাড়া নেই। শেষ দিকে একটু গোঙানির শব্দ এলো কানে। সেই শব্দ মস্তিষ্কে তূখোড় ভাবে বাজল তার। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটল।
‘ কী হয়েছে ইকবাল? হ্যালো,শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? হ্যালো? ‘
কথা বলতে বলতে দাঁড়িয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ সাড়া নেই। সব নিশ্চুপ। একটু পর ইকবালের নিভু স্বর ভেসে এলো,
‘ ওরা হামলা করেছে ধূসর। গুলি লেগেছে আমার। আমি,আমি…’
তারপর ফোন কেটে গেল। ধূসরের মাথার শিরা দপদপ করে লাফিয়ে ওঠে। হৃদপিণ্ড থমকে যায়। উৎকণ্ঠিত ভঙিতে কপাল মুছে কল দিতে থাকে। ইকবাল ধরছেনা। পরপর সোহেলকে দিলো,সেও না। একে একে পার্টি অফিসের যাদের নম্বর আছে, সবাইকে কল দিলো,এমনকি খলিলকেও। কেউই ধরছেনা দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। ফাইলপত্র ওমন ফেলে রেখেই একপ্রকার ছুটে বের হলো ধূসর। আমজাদ ওকে ছুটতে দেখে বাইরে এলেন। পিছু ডাকবেন এর আগেই ধূসর হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। তিনি অবাক হলেন। যা ডোজ দিয়েছিলেন,ওর তো যাওয়ার কথা নয়। গেল কেন তবে?