ফ্লোরেনসিয়া

মিলনায়তন কামরা প্রচন্ড নিস্তব্ধ ছিলো।যেন থমকে গেছে সময়।মনে হয় মেঝেতে পিন পড়ে যাওয়ার শব্দটুকুও স্পষ্ট কর্ণগোচর হবে।মেয়েদের ঠোঁটগুলো ঈষৎ পৃথক হয়ে আছে।থেমে গেছে হৃদস্পন্দন।অদৃশ্য কোনো আকর্ষণ বলে তাদের চিত্ত পুলকিত হয়ে উঠে।অতঃপর হঠাৎই পূর্বের তুলনায় আরও তীব্র গতিতে হৃদয় স্পন্দিত হয়।যেন ক্ষণে ক্ষণে বুকের অভ্যন্তরে অলৌকিক দামামা বাজে।ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্যের অধিকারী একজন সুদর্শন পুরুষকে দেখে দু’চোখের দৃষ্টি বিমোহিত হয়।ভয়াবহ কোনো ঘোরের মাঝে ডুবে যায়।কামরায় উপস্থিত থাকা সবগুলো পুরুষের মধ্যে লম্বা ছিলো সে। ছ’ফুট দু’ইঞ্চি উচ্চতার সবল সুগঠিত দেহের একজন ভয়ংকর সুদর্শন ছেলে।

যার তুষারের মতো শুভ্র মুখখানায় লাল টুকটুকে ঠোঁট।একজোড়া আকর্ষণীয় এমারেল্ড সবুজ চোখের মনি।কালো কুচকুচে লম্বা মোটা ভ্রুযুগল মৃদু কুঁচকে ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।যেন কোনো কিছুর প্রতি বেশ বিরক্তি প্রকাশ করছে।কালো রঙের শার্টের উপর মেডিভাল ব্রাউন লেদার কোট পরেছে সে।কালো প্যান্টের সাথে কালো রঙের বুট পায়ে বুক টানটান রেখে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।

কামরায় থাকা একজন মাস্টারের কথায় উপস্থিত প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়ের সম্বিত ফিরে আসে।তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কন্ঠস্বরে বলেন,,,

-ডিয়ার স্টুডেন্ট’স।তোমরা সবাই আমাদের চিফ মাস্টারকে সম্মান জানাতে ভুলে গেছো।

-ইট’স ওকে।____এদুয়ার্দো থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে।

তার পাশেই প্রিন্সিপালসহ আরও দু’জন মাস্টার দাঁড়িয়ে ছিলেন।এদুয়ার্দোর সামনে তারা সবাই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।তাদের মুখগুলো অত্যন্ত কালো দেখায়।হঠাৎ কামরাজুড়ে ফিসফিসানির শব্দ শোনা যায়।এতোগুলো মানুষের মাঝখানে দাড়িয়ে থাকতে এদুয়ার্দোর অস্বস্তি অনুভব হয়।বিশেষ করে মেয়েগুলো।ওরা যেন তাকে চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছিলো।

-সাইলেন্স প্লিজ।____উচ্চস্বরে বলে উঠেন প্রিন্সিপাল।

কামরা পুনরায় প্রগাঢ় নিস্তব্ধ হয়ে যায়।প্রিন্সিপাল গম্ভীর কন্ঠে বলেন,,,,

-তোমরা এভাবে কথা বলছো কেনো?নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখো।

বিস্মিত,বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ইনায়া।অথচ সিয়া ভীষণ শান্ত।আর্নি ভয়াল আতংকে মৃদু মৃদু কাঁপতে শুরু করে।ইনায়া একবার সিয়ার দিকে তাকায়,অতঃপর চোখ সরিয়ে এদুয়ার্দোর দিকে তাকায়।ওর মস্তিষ্কে কতগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।আর্নি কিছুটা পেছন দিকে সরে দাড়ায়।ভয়ে ওর হাত পা কাঁপছে।

-এই শ’য়’তা’ন টাই আমাদের রণশৈলী শেখাবে?___ইনায়া অনুচ্চস্বরে বিরবিরিয়ে কথাটা বলে।সিয়া কান পেতে শোনে।কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর দেয় না।

সবগুলো স্টুডেন্টদের পরনে ছিলো সাদা রঙের টেকউন্ডো পোশাক(ডো-বোক)।সাদা রঙের প্যান্ট এবং সাদা রঙের শার্ট।সাদা শার্টের কলার আর গলার অংশটুকু কালো রঙের ছিলো।কোমরে কালো রঙের বেল্ট।মেয়েদের চুলগুলো ছিলো পনিটেল করে বাঁধা।

সবগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝখানে শুধুমাত্র সিয়া,ইনায়া আর আর্নির পরনে ছিলো সিভিল ড্রেস।তন্মধ্যে সব সাদা পোশাকের মাঝখানে কালো রঙের শর্ট গাউন পরিধেয় সিয়া বাকি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো।

কামরার একপাশে ফুলের তোরা আর ব্রুজ হাতে দাড়িয়ে ছিলো দু’জন সুন্দরী মহিলা।এদুয়ার্দো দাঁড়িয়ে ছিলো সবার সামনে কামরার মাঝখানে।তখনো কামরাজুড়ে বিরাজিত পিনপতন নিরবতা।অকস্মাৎ হাতের ইশারায় সিয়াকে উদ্দেশ্য করে জোর গলায় ঢেকে উঠেন প্রিন্সিপাল,,,

-সিয়া,এদিকে এসো।

-জ্বি প্রিন্সিপাল স্যার।___সিয়া দৃঢ় কন্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়।একহাতের উপর অপর হাত রেখে মুষ্টিবদ্ধ দু’হাতে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রিন্সিপালকে সম্মান জানায়।

ইনায়া চমকায়।সিয়ার একহাত খামচে ধরে আর্নি।বাকিরা তাকিয়ে থেকে প্রিন্সিপালের আহ্বান করা মেয়েটাকে দেখে।সিয়া শান্ত কন্ঠে বলে,,,

-এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।নিজেকে সামলাও।

আলগোছে নিজের হাত ধরে রাখা আর্নির হাতখানা ছাড়িয়ে নেয় সিয়া।লাইনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে ফাঁকা জায়গা দিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটে।ওর মুখাবয়বে ফুটে উঠে অমিত তেজ।মাথা সোজা রেখে সগর্বে পা ফেলে সিয়া।প্রতিটা পায়ের পদক্ষেপে ঝরে যায় ক্ষোভ।এদুয়ার্দোর দিকে একবারও তাকায় না ও।

কালো রঙের ছোট গাউন পরিধেয় বেশ লম্বা দেখতে নিটোল স্বাস্থ্যের অধীকারী একজন সুন্দরী যুবতী সামনের দিকে এগিয়ে যায়।বীরদর্পে,স্থিরচিত্তে প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে পৌঁছায়।ওর পথ চলার ভঙ্গিমায় দুর্দমনীয় দাপট প্রকাশ পায়।বাইরে থেকে ওকে শান্ত দেখায়,অথচ ক্রোধের আধিক্যে ওর বক্ষস্থলে থাকা হৃদপিণ্ড জ্বলে পুড়ে যায়।

পেছনে দু’হাত বেঁধে প্রিন্সিপালের সামনে গিয়ে দাড়ায় সিয়া।কামরার একপ্রান্তে দাড়িয়ে থাকা মহিলা দু’জন ওর পাশে গিয়ে দাড়ায়।একগুচ্ছ হলুদ টিউলিপ দিয়ে বানানো ফুলের তোড়া আর ব্রুজ তুলে দেয় সিয়ার হাতে।প্রিন্সিপাল স্মিথ হেঁসে বলেন,,,,

-ব্রুজ টা আমাদের চিফ মাস্টারের পোশাকে আঁটকে দাও।

-জ্বি। ___সিয়া ফুলের তোড়া আর ব্রুজ হাতে নেয়।পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় এদুয়ার্দোর দিকে।এটা এই একাডেমির রুলস।ব্রুজ পরিয়ে আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিদের সংবর্ধনা জানানো হয়।এদুয়ার্দোর কাছে গিয়ে ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে।কিন্তু ওর দৃষ্টি নিজের পায়ে পরা বুট জুতোর দিকে ছিলো।এদুয়ার্দো ভেতরে ভেতরে তীব্র অপমানবোধ করে।ক্রোধিত হয়।ভ্রুুযুগল কুঁচকে ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।প্রিন্সিপাল বিষয়টা খেয়াল করেন।চাপা স্বরে ধমকে উঠে ডাকেন,,,,,,

-সিয়া!

সিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও এদুয়ার্দোর দিকে তাকায়।শান্ত গলায় বলে,,,

-আমাদের একাডেমিতে আপনাকে স্বাগতম মহামান্য মাস্টার।

এদুয়ার্দো ফুলের তোড়া হাতে নেয়।সিয়া আরও একটু কাছে গিয়ে দাড়ায়।এদুয়ার্দো ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে শীতল কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বলে,,,,

-তোমার দুর্ভাগ্য। শ’ত্রুকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিজের মৃ’ত্যুকে আলিঙ্গন করছো।

-আজ যেই হাত তোমাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে,একদিন সেই হাত তোমার হৃদপিণ্ডের মাঝখানে লোহার তলোয়ার বসাবে।____সিয়া দৃঢ় গলায় বলে।ওর কন্ঠস্বরে অদম্য,অসামান্য আত্মবিশ্বাস।এদুয়ার্দো উপলব্ধি করে।ঠোঁট বাকিয়ে মৃদু হাসে।

এদুয়ার্দোর বুকের কাছে হাত রাখে সিয়া।এদুয়ার্দো গর্বিত ভঙ্গিমায় মাথা উঁচু রেখে পুনরায় বুক টানটান করে দাড়ায়।সিয়াকে নিজের দাসী বলে মনে হয়।বেশ আনন্দ অনুভব করে।আলগোছে ব্রুজ আঁটকে দিতে গিয়ে তার বুকে ব্রুজের পিন ঢুকিয়ে দেয় সিয়া।নিজের অজান্তেই এদুয়ার্দো মৃদু আর্তনাদ করে উঠে।

-ক্লীভল্যান্ড! আর ইউ ওকে?___উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন প্রিন্সিপাল।

– ইয়াহ। আই এম ফাইন।____এদুয়ার্দো মেকি হেসে বলে।

ব্রুজের লম্বা পিনের তীক্ষ্ণাংশ এদুয়ার্দোর বুকে গেঁথে দিয়েছে সিয়া।যা কোট ভেদ করে অনেকটাই ভেতরে ঢুকে গেছে।সিয়া নিরপরাধ ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।প্রিন্সিপাল কঠিন গলায় বলেন,,,,

– নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াও।

সিয়া আর এক মুহূর্তও দেরি করে না।দ্রুতপায়ে হেঁটে নিজের জায়গার দিকে চলে যায়।ঠোঁট ছড়িয়ে ক্রুর হাসে।যা স্পষ্ট খেয়াল করে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা ইজাবেল।ও অবাক হয়।মেয়েটার একরকম অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাসার কারন বুঝতে পারেনা।

কামরার একপাশে একটা গোল টেবিল বসানো ছিলো।দু’পাশে দু’টো চেয়ার।টেবিলের উপর ফ্লাওয়ার ভাসে কতগুলো সাদা টিউলিপ আর তরতাজা লাল গোলাপ।এদুয়ার্দোকে চেয়ারে বসার অনুরোধ করেন প্রিন্সিপাল।

-দুঃখিত।আমার কাছে সময় সীমিত।এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।

-ঠিক আছে।আপনি আপনার ক্লাস শুরু করুন।___প্রিন্সিপাল সহাস্যে বলেন।

এদুয়ার্দো শিক্ষার্থীদের আরও একটু সামনে এগিয়ে যায়।গাম্ভীর্য মুখে ভরাট কন্ঠে দু’এক লাইন কথা বলে নিজের সম্পর্কে।অতঃপর দৃঢ় গলায় বলে,,,

-স্টুডেন্ট’স।আশা করি তোমরা জানো,যুদ্ধের মুলমন্ত্র হলো গতি।তোমাদের গতি যত দ্রুত হবে,শত্রুপক্ষের আক্রমণগুলো প্রতিহত করে তত দ্রুত তাকে পাল্টা আক্রমণ করতে পারবে।মনে রাখবে যেকোনো শ’ত্রুকেই বি’না’শ করা সম্ভব।

মার্শাল আর্টের একজন যোদ্ধা হিসাবে প্রথমে তোমাকে জানতে হবে,তুমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাও।একজন দুর্বল যোদ্ধা নাকি সব ধরনের রণকৌশলে পারদর্শী বীর যোদ্ধা।

এদুয়ার্দো একপা দু’পা করে হাঁটতে হাঁটতে নিজের কথাগুলো বলে।ছাত্রছাত্রীরা তার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে।ভীষন শ্রুতিমধুর লাগে শুনতে।শোনার চেয়েও বেশি তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।শুধু তিনজন মেয়ে মনোযোগ দিয়ে শোনে।সিয়া,ইনায়া আর ইজাবেল।আর্নি ভয়ে জর্জরিত হয়ে থাকে।

-একজন যোদ্ধার প্রধান লক্ষ্য কি?___এদুয়ার্দো সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।

এদুয়ার্দোর করা প্রশ্নে মেয়েদের ঘোর কেটে যায়।ছেলেদের মাঝখান থেকে কিছু ছেলে যোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্য সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করে।এদুয়ার্দোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কয়েকটা মেয়েও তাকে নিজেদের মন্তব্য জানায়।কিন্তু কারো উত্তর ই পছন্দ হয়না এদুয়ার্দোর।হঠাৎ নিজের অজান্তেই সিয়া দৃঢ় কন্ঠে বলে,,,,

-মা’রো না হয় ম’রো,যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকবে ততক্ষণ লড়ো।প্রাণপনে যুদ্ধ করে শত্রুপক্ষ’কে ধ্বংস করো।যোদ্ধাদের জীবনে এটাই একমাত্র লক্ষ্য।বলতে গেলে,যোদ্ধারা বেঁচে থাকে ম’রে যাওয়ার জন্য।তাদের মৃ’ত্যু ভয় নেই।

এদুয়ার্দো ক্ষণকাল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।অতঃপর রাশভারি কন্ঠস্বরে বলে,,,,

-যুদ্ধের আগেই ম’রে যাওয়ার কথা চিন্তা করে শুধুমাত্র দুর্বল যোদ্ধারা।একজন শক্তিধর প্রকৃত যোদ্ধা শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যর্থ পরিকল্পনা করে,শত্রুর দুর্বলতা খুঁজে বের করে এবং প্রাণ নাশক মোক্ষম আঘাত করে।যে আঘাতের কবল থেকে তার প্রতিপক্ষ বাঁচতে পারে না।শুধুমাত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহন করা নয়,শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা এবং যুদ্ধে জয়ী হওয়াই একজন যোদ্ধার প্রধান লক্ষ্য।

এতটুকু বলে এদুয়ার্দো পুনরায় নিশ্চুপ হয়ে যায়।কয়েক পল সময় গড়ায়।কামরায় উপস্থিত থাকা বাকি মাস্টার আর প্রিন্সিপাল এদুয়ার্দোর রণকৌশল দেখার অপেক্ষায়।এদুয়ার্দো সগর্বিত কন্ঠে বলে,,,,

-এখন আমি তোমাদের তায়কোয়ান্দোর কিছু রণকৌশল শেখাবো।তোমরা ভীষণ মনোযোগ দিয়ে দেখবে।

“তায়” অর্থাৎ পা দিয়ে লাথি মা’রা বা চূর্ণবিচূর্ণ করার উদ্দেশ্যে লাফিয়ে উঠা বা উড়ে যাওয়া। “কোয়ান” মুষ্টিবদ্ধ হাতে ঘুষি মা’রা বা ধ্বংস করা।এবং “দো” হলো একটি কৌশল বা পথ। এই তিন অংশের সংমিশ্রণে তায়কোয়ান্দো বলতে বোঝায় আত্মরক্ষার স্বার্থে শুধুমাত্র হাত পায়ের সাহায্যে অস্ত্রবিহীন লড়াই।

এদুয়ার্দো তায়কোয়ান্দোর কিছু রণশৈলী শিখিয়ে দেয়।থেকে থেকে নিজের কথা চালিয়ে যায়।ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে অনুসরণ করে তার দেখানো শৈলী আয়ত্ত করে।সিয়া,ইনায়া নিজেদের প্রশিক্ষণে মনোযোগ দেয়।প্রথমে শেখা জরুরী,তারপর প্রয়োগ।

বেশ কিছুক্ষণ পর,একজন মাস্টারের সাথে প্র্যাক্টিক্যালি লড়াই করে এদুয়ার্দো।যাতে শিক্ষার্থীরা আঘাত করা এবং আঘাত প্রতিহত করার বিষয়গুলো সম্পর্কে পূর্ন ধারণা লাভ করতে পারে।

দীর্ঘ সময় স্টুডেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর নিজের ক্লাস শেষ করে এদুয়ার্দো।প্রিন্সিপালসহ অন্যান্য মাস্টার’রা এতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার রণকৌশল দেখছিলো।সত্যিই এদুয়ার্দোর আর্ট স্কিলগুলো বেশ মারাত্মক ছিলো।যা অত্যন্ত প্রসংশনীয়।

_________

ওডেসা,দুভিল কোট।

ইউক্রেনের ধূসর আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়।বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস।সময়টা সন্ধ্যালগ্ন।বাগানে দাড়িয়ে সমুদ্রের স্বচ্ছ নীলাভ জলের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলো আব্রাহাম।খারকিভ থেকে ফিরে আসার পর কোন এক অজ্ঞাত কারনে বুকের ভেতরে অথৈয় শূন্যতা অনুভব করে।যেন বক্ষস্থলে থাকা হৃদযন্ত্রটা নেই।

কাউকে একঝলক দেখার অপেক্ষায় তার নীলকান্ত মনি চাতকের ন্যায় অস্থির হয়ে উঠে।আব্রাহাম সবই বুঝে,তবুও না বোঝার মতো আচরণ করে সে।ইদানীং কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ খুঁজে পায়না।লারা’কে স্পর্শ করেছিলো একপ্রকার বাধ্য হয়ে।কিন্তু ওকে বাজে ভাবে ব্যবহার করেনি।শুধু যাজককে ভয় দেখাতে মেয়েটার রক্ত পান করেছিলো।এই বিষয়টা নিয়েও কেমন অস্বস্তি বোধ করছে।কিন্তু সে চায় না এরকম কিছু হোক।এই অদ্ভুত অনুভূতিগুলো থেকে মুক্তি চায় আব্রাহাম।যেভাবেই হোক,ইনায়া ইবতিসাম নামের মেয়েটার মোহ কাটাতে চায়।নিজের স্বাধীন জীবন যাপনে একটা সাধারণ মেয়ের আধিপত্য মেনে নিতে কষ্ট হয়।

অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়।নিলসোন এসে তার পেছনে দাড়ায়।মাথা নত করে সম্মান জানায়,,,,

-এস্টীম রুলার।

পেছন ফিরে দেখে না আব্রাহাম।অশান্ত কন্ঠে ডাকে,,,

-নিলসোন।

-জ্বি এস্টীম রুলার।

-মাদাম কামালিকে বলো,আমার জন্য মেয়ে প্রস্তুত করতে।সবচেয়ে সুন্দরী হতে হবে।কিন্তু কারো অনিচ্ছার বিরুদ্ধে নয়।স্বইচ্ছায় যে রুলার আব্রাহামের সাথে রাত্রিবাস করতে চাইবে।শুধুমাত্র তাকেই আমার কাছে নিয়ে আসবে।

-জ্বি। কিন্তু আপনার সান্নিধ্য পেতে চায় না।এমন মেয়ে দুভিল কোটে নেই।

-আচ্ছা তুমি যাও।

আদেশ পেয়ে নিলসোন চলে যায়।আব্রাহাম ক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্ত মনে ধুসর রঙা আকাশটার দিকে তাকায়।মনে মনে বলে,,,

-আমি স্বাধীন।আমার চিন্তা-চেতনা জুড়ে অবাধ বিচরণ করার কোনো অধিকার তোমার নেই।আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই।আমি একজন র’ক্তপিপাসু।রক্তচোষা পি’শাচ রা কখনো কাউকে ভালবাসে না।তারা শুধু রক্ত চুষে খেতে ভালবাসে।রক্তের হলি খেলতে পছন্দ করে।মৃ’ত্যু দিতে আনন্দ পায়।আমিও তাই।

আব্রাহামের ভেতরে থাকা দুষ্ট আত্মা শব্দ করে হাসে।ব্যঙ্গ করে বলে,,,,

-রক্তের হলি আর তুমি?অপদার্থ পি’শাচ।তোমার দ্বারা কোনো কিছুই সম্ভব না।আজ পর্যন্ত একটা নিরীহ মা’নুষকে হ’ত্যা করতে পেরেছো?পারো নি।পেরেছো তো শুধু সুন্দরী মেয়েদের সাথে রাত্রিবাস করতে।কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার সেই ক্ষমতাও নেই।একটা তুচ্ছ মেয়ের মায়ায় বাজে ভাবে ফেঁসে গেছো তুমি।

-সাবধান করছি।ওকে তুচ্ছ বলবে না।____আব্রাহাম রাগান্বিত কন্ঠে বলে।

-তাহলে কি বলবো?কি এমন বিশেষ কিছু আছে ওর মধ্যে?

-তুমি বুঝবে না।

তার দুষ্টু আত্মা পুনরায় শব্দ করে হাসে।আব্রাহামের রাগ হয়।প্রচন্ড রাগ হয়।কিন্তু দুষ্টু আত্মার উপর নয়।নিজের অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বদলে যাওয়া অনুভূতিগুলোর উপর।

_________

ইম্যুভিল।

রাতের খাবার শেষ করে কামরায় ফিরে আসে ইনায়া আর সিয়া।হাতে খাবারের প্লেট।আর্নি খেতে যায়নি।হঠাৎ করেই ওর শরীর কাঁপানো জ্বর।সন্ধ্যার আগে ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন ফ্রাঙ্কলিন।ডাক্তার ঔষধ দিয়ে গেছেন।বলেছেন,কোনো কিছু দেখে অতিরিক্ত ভয় থেকে জ্বর এসেছে ওর।মেয়েটা অতিমাত্রায় দুর্বল।আর্নি এতোটা দুর্বল ছিলো না আগে।বরাবরই বেশ চটপটে আর চঞ্চল প্রকৃতির ছিলো।কিন্তু একের পর এক ভয়াবহ সব দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে ধীরে ধীরে ট্রমায় চলে যাচ্ছে ও।এরকমই বলে গেছেন ডাক্তার।

খাবারের প্লেটগুলো টেবিলের উপর রেখে আর্নিকে ডেকে তুলে ইনায়া।আদুরে স্বরে বলে,,,,

-আমি নিজ হাতে তোমার জন্য ডেরুনি,গোলুবটসি আর নালিসনিকি রান্না করেছি।সবগুলো তোমার প্রিয় খাবার।সাথে টক ক্রিম।খেয়ে নাও জলদি।

আর্নি দুর্বল চোখে তাকিয়ে থেকে দুদিকে মাথা নাড়ায়।খেতে পারবে না বোঝায়।ইনায়া করুন স্বরে বলে,,,,

-অল্প একটু খাও।ঔষধ খেতে হবে।

-আমি খেতে পারবো না ইনায়া।___আর্নি ক্ষীণস্বরে বলে।

-অন্তত একটু স্যূপ খাও।

এবার আর আর্নি বারণ করে না।ইনায়া চামচ দিয়ে অল্প অল্প করে ওকে স্যূপ খাইয়ে দেয়।সিয়া টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে মানচিত্র নিয়ে বসে।কিছু একটা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে।

আর্নিকে খাওয়ানো শেষ করে ঔষধ খাওয়ায় ইনায়া।বাকি খাবারগুলো রেখে আসে ডাইনিং টেবিলে।অতঃপর কামরায় ফিরে এসে ঘড়ির দিকে তাকায়।সিয়াকে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলে,,,,

-প্রায় এগারোটা বেজে গেছে সিয়া।ঘুমিয়ে পড়ো।

-কামরার বাকি মোমগুলো নিভিয়ে তুমি শুয়ে পড়ো।আমি একটু পরে ঘুমাবো।

ইনায়া দ্বিমত করে না।মোমবাতি গুলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে ও।চোখ বুজে নিতেই নেত্রপল্লব জুড়ে গভীর ঘুম নেমে আসে।

ধীরে ধীরে সময় গড়ায়।রাত গভীর হয়।টেবিলের উপর মৃদু আলোয় মোমবাতি জ্বলে।চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজে নেয় সিয়া।হঠাৎ দরজার বাইরে বারান্দার দিকে থেকে কারো কন্ঠস্বর শুনতে পায়,,,,,

-ফ্লোরেনসিয়া।

কন্ঠস্বর টা চিনে নিতে বিন্দুমাত্র সময় লাগে না সিয়ার।ও যেন এই সময়’টারই অপেক্ষায় ছিলো।ত্বরিত টেবিল থেকে মোমবাতি তুলে নেয়।নিঃশব্দে পা ফেলে দরজা খুলে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়।একটা ছায়াকে অনুসরণ করে বারান্দা পেরিয়ে জলাশয়ের দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে।হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ছেড়ে অনেকটা দুরে চলে যায়।ও অদৃশ্য হয়ে যেতেই ওদের কামরায় একটা কালো ধোয়ার কুন্ডলী প্রবেশ করে।

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.