প্রাসকোভিয়া।
গুহার ভিতরে জলাশয়ের ডানদিকে। বিশাল জায়গা জুড়ে একসাথে কতগুলো পুরুষ যুদ্ধবিদ্যার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো। তারা প্রত্যেকে দু’জন দু’জন করে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সামিল হয়েছিলো। একজন বলশালী যুবকের সাথে বীরদর্পে লড়াই করছিলো ছাই রঙা কিমোনো পরিধেয় দীর্ঘদেহী মার্কস। দু’হাতে দু’টো ভারী তলোয়ার। মার্কসের প্রয়োগ করা রণকৌশলগুলোয় অসাধারণ ক্ষিপ্রতা ছিলো। সিদ্ধহস্তে প্রতিটা আক্রমণ প্রতিহত করে দুর্দান্ত পাল্টা আক্রমণ করছিলো সে। যেন চোখের সামনে কোনো বীরযোদ্ধা দাঁড়িয়ে। ক্রিসক্রিংগল স্তম্ভিত দৃষ্টিতে দেখেন। স্বচক্ষে দেখা দৃশ্যটাকেও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। যা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় ছিলো। এটা কি সত্যিই মার্কস নাকি তার চোখের ভ্রম?
বেশ কিছুক্ষণ সময় গড়ায়। ক্রিসক্রিংগল স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রশিক্ষণ শেষ হয়। হঠাৎই ক্রিসক্রিংগলের দিকে তাকায় মার্কস। থমথমে পা ফেলে এগিয়ে যায় তার দিকে। ভরাট কন্ঠে বলে,,,
– জনাব ক্রিসক্রিংগল। আপনি প্রস্তুত হন। আমি আপনাকে ইম্যুভিলে পৌঁছে দিয়ে আসবো।
– এসবের মানে কি মার্কস? কে তুমি?
একটা কমবয়সী ছেলে এসে দাড়ায় মার্কসের পাশে। নত মস্তকে সম্মান জানিয়ে সবিনয়ে বলে,,,,
– মাস্টার গ্রোসিয়াস। খাবার প্রস্তুত।
– ঠিক আছে, তুমি যাও।____মার্কস শান্ত গলায় বলে।
ছেলেটা চলে যায়। ক্রিসক্রিংগল বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,
– তুমি ওদের প্রশিক্ষক?
– জ্বি।
– তাহলে আমাকে বিভ্রান্ত করেছিলে কেনো? কেনো শক্তিহীন নির্বোধের মতো অভিনয় করেছ? তুমি এভাবে আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে দিলে? ওরকম বোকা সেজে থাকার কি প্রয়োজন ছিলো?
– মহামান্য মাস্টারের আদেশ ছিলো। তিনি বলেছিলেন যেভাবেই হোক, আপনার যাত্রাপথে বাঁধা প্রদান করতে হবে। আপনি যাতে উনার কাছে পৌঁছতে না পারেন। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। বিষাক্ত তীরের আঘাত সহ্য করেছিলাম। ভেবেছিলাম আমি গুরুতর অসুস্থ দেখে, আমার জন্য আপনি প্রাসকোভিয়া ছেড়ে যাবেন। নিজের বাড়িতে ফিরে যাবেন। কিন্তু আপনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। একদিকে মাস্টার চাননি আপনি কোনো বিপদে পড়েন। তাই সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা অবলম্বন করে আপনাকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি। আপনি আমাকে নন, আমি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। সবটাই হয়েছে আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী। এখন আপনাকে পৌঁছে দেওয়াও আমার দায়িত্ব। এটাই মহামান্য মাস্টারের নির্দেশ।
একরাতের ব্যবধানে মার্কসের ব্যক্তিত্বে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। সুদৃঢ় কন্ঠ। ক্রিসক্রিংগল কথা বলার জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পান না। ক্ষণকাল নির্বাক চোখে দেখেন। অতঃপর নির্জীব কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,,
– আমি কি শেষ বারের মতো মার্টিনের সাথে দেখা করতে পারবো?
_______
কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।
নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত কামরায় ছ’ফুট লম্বাকৃতির একটি পুরনো কফিন দেখা যায়। শক্তপোক্ত ওক কাঠের কফিনটার উপরের পাটার চারপাশে লোহার ব্যারিয়ার লাগানো ছিলো। একটা বড়সড় লোহার তালা ঝুলছে। বিন্দুমাত্র ফাঁকফোকর নেই। একটু খানি অক্সিজেন প্রবেশ করছে কিনা সন্দেহ। সহসা কফিনের ভিতরে থাকা অচেতন ব্যক্তিটা চেতনা ফিরে পায়। হা করে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। দম আঁটকে আসে। হাত-পা নাড়ানোর জো নেই। দুর্দম্য রক্তপিপাসা জাগে। যেন কতশত বছর ধরে অভুক্ত আছে সে। মনে পড়ে যায় সেদিনকার সেই নির্মম নিষ্ঠুর দুর্ঘটনার কথা। কোনো অপরাধ না করেও যে ভয়ংকর শাস্তি পেয়েছে সে, সেই শাস্তিদাতাকে চরম মূল্য চোকাতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কোথায়? এই কফিনটা অন্যসব কফিনগুলোর থেকে আলাদা মনে হয়।
জায়গাটা কোথায়? তাকে কফিনে কে রাখলো? দিন, মাস, নাকি বছর পেরিয়ে গেছে? মনের গহীনে উঁকি ঝুঁকি দেয় হাজারো প্রশ্ন। সে পাটা তুলে কফিনের বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়। বাইরে থেকে কফিনটা তালাবদ্ধ ছিলো। সে চিৎকার দিয়ে ডাকে,,,
– কে কোথায় আছো? কফিনের পাটা খুলে দাও। আমি বাইরে বের হবো।
তার চিৎকার করে বলা কথাগুলো কফিনের ভিতরেই যেন বিলীন হয়ে যায়। বাইরে থেকে কোনো প্রত্যুত্তর আসে না। কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে হাঁসফাঁস করতে শুরু করে। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগে কফিনের বাইরে বেরুতে চায়। চিৎকার দিয়ে ডাকে। বদ্ধ কামরার দরজার ওপাশে পিদর্কা স্যাভেরিন দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসেন। কয়েকপল দাড়িয়ে থেকে কান পেতে শোনেন। অতঃপর দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করেন। অন্য একটি বদ্ধ কামরার সামনে গিয়ে দাড়ান। দ্বাররক্ষী দরজা খুলে দিতেই কামরায় প্রবেশ করেন। যেখানে একজন মধ্যবয়স্ক রমনী করুন আর্তনাদ করে ডাকেন,,,
– পাওলো। বাবা আমার। তোমার মা আছে। ভয় পেয়ো না।
পিদর্কা স্যাভেরিনকে দেখে রমনী ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকান। তেড়ে গিয়ে গলা চেপে ধরেন। অভুক্ত অসহায় দুর্বল শরীরের হাত দু’টোতে জোর ছিলো না তেমন। পিদর্কা ধাক্কা দিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দেন। রাগান্বিত কন্ঠে বলেন,,,
– আমার গলা চেপে ধরো!! তোমার এতো বড় স্পর্ধা? ভুলে গেছো আমি কে?
– ডা’ই’নী। পি’শা’চী’নি। স্যাভেরিন পরিবারে নেমে আসা ভয়াবহ অভিশাপ তুমি। আমার পাওলো তোমার কি ক্ষতি করেছে? কেনো ওকে কফিনে আঁটকে রেখেছ?
– আমার ইচ্ছে।____ পিদর্কা স্যাভেরিন সহাস্যে বলেন।
– আমি তোমাকে মে’রে ফেলবো।
রমনী ত্বরিত মেঝে থেকে উঠে দাড়ান। পুনরায় তেড়ে যান পিদর্কা স্যাভেরিনের দিকে। পিদর্কা পেছন থেকে তার দু’হাত মুচড়ে ধরেন। রমনী ব্যথায় কুকিয়ে উঠেন।
– ক্লারেসিয়া। আহা! স্বর্গ থেকে আসা বেচারী স্বর্গীয় শিশুটা। ওকে আমি আবারও স্বর্গে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওর রক্ত, যেন অমৃত। দেখো, মনে হচ্ছে সেই রক্ত এখনো আমার ঠোঁটে লেগে আছে।
রমনী প্রচন্ড ঘৃণায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেন। আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলেন,,,
– তোমার এই পাপের সাম্রাজ্য ধ্বং’স হবে। তোমাকে বি’নাশ করতে একদিন কেউ না কেউ অবশ্যই আসবে।
– কি মুশকিল! এজন্যই কারো উপকার করতে নেই। কোথায় ওকে দুনিয়ার যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে মুক্ত করে দিলাম। আমাকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে অভিশাপ দিচ্ছো? তোমরা মানুষগুলো এরকমই। পুরাদস্তুর অকৃতজ্ঞ।____পিদর্কা বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলেন।
রমনী নীরবে সহ্য করেন। আশায় বুক বেঁধে থাকেন। ঈশ্বর আছেন। তিনি এই পি’শাচ রাজ্য ধুলোয় মিশিয়ে দিতে ওকে পাঠাবেন। অবশ্যই পাঠাবেন। যদি ওর মৃ’ত্যু হয়ে থাকে। তবুও ও ফিরে আসবে। প্রয়োজনে দ্বিতীয়বার জন্ম নিবে শুধুমাত্র এই ডাইনীকে বধ করার জন্য। এতোদিন যাবৎ ওর অপেক্ষাতেই প্রহর গুনছেন রমনী। ক্লারেসিয়া, স্যাভেরিন পরিবারে জন্মানো ঐশ্বরিক শক্তি সম্পন্ন কন্যা শিশু। “ক্লারেসিয়া স্যাভেরিন”। পিদর্কার দৃষ্টির অগোচরে রমনী মৃদু হাসেন।
– মার্টিন কোথায় গায়েব হয়ে গেছে বলোতো? ওর রক্ত শুষে খাওয়ার প্রবল ইচ্ছে। দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে। কত খুঁজেছি ওকে। তুমি নিশ্চয়ই জানো, ও কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে?____ পিদর্কা কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
– জানিনা।____ রমনী দৃঢ় কন্ঠে বলেন।
অকস্মাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। বাইরে থেকে ভিক্টোরিয়ার কন্ঠস্বর ভেসে আসে,,,
– মা, আপনার চিঠি এসেছে। জনাব জোসেফাইন পাঠিয়েছেন।
পিদর্কা স্যাভেরিন রমনীর হাত ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে দেন। গটগটে পায়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে যান। দ্বাররক্ষী দরজা আঁটকে দেয়। পাশের কামরা থেকে চিৎকারের শব্দ আর শোনা যায় না। রমনী গুনগুনিয়ে কাঁদেন। ভীষণ একাকীত্ব বোধ করেন। একসময়কার দাপুটে রানী আজ কতটা অসহায়। অর্ধাঙ্গের সাহচর্য কামনায় ব্যাকুল হয়ে উঠে হৃদয়।
– জোসেফাইন পত্র পাঠিয়েছে?___ভ্রু কুঞ্চিত করে জানতে চান পিদর্কা স্যাভেরিন।
– জ্বি মা।
– দাও দেখি।
ভিক্টোরিয়া পত্রখানা তার মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ওটা ত্বরিত হাতে তুলে নেন পিদর্কা স্যাভেরিন। সাদা রঙের খামের উপর লাল রঙের সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা ছিলো। যা দেখে সহজেই বোঝা যায় পত্র পাঠানো ব্যক্তি জোসেফাইন। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পত্রখানা পড়তে শুরু করেন পিদর্কা স্যাভেরিন।
সুহৃদ ,,
আমি তোমার সাথে দেখা করতে স্যাভেরিন ক্যাসলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি পায়নি। দুর্গের চারদিকে এতো কড়া পাহারা ছিলো যে লুকিয়ে দেখা করার সুযোগ হয়নি। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তোমাকে অবগত করা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমার মনে হয় চিঠির মাধ্যমে সেটা জানানো ঝুঁকিপূর্ণ। যতদ্রুত সম্ভব তুমি আমার সাথে দেখা করো।
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।
পিদর্কার কপালে সূক্ষ্ণ দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠে। ক্রিসক্রিংগল সবাইকে নিয়ে কাস্ত্রোরুজ ছাড়ার পর, পিদর্কা স্যাভেরিন জোসেফাইনসহ নিজের কিছু বিশ্বস্ত সেবকদের ডিয়েটসের বাড়ি, স্ট্রিকল্যান্ডের বাড়ি এবং সমাধিক্ষেত্রের আশে পাশে পাহারায় নিয়োজিত করেছিলেন। তার ধারণা ছিলো, হয়তো কোনো একদিন, কোনো একসময় ওরা নিজেদের বাড়ি বা সমাধিক্ষেত্রে অবশ্যই যাবে। কিন্তু এরই মধ্যে কয়েকদিন আগে পিদর্কা জানতে পেরেছিলেন, ওরা সবাই ইম্যুভিলে ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে আছে।
সেদিন আব্রাহামের পিছু নিয়ে পিদর্কা স্যাভেরিনের অনুগত একজন ভাম্পায়ার গুপ্তচর ফ্রাঙ্গলিনের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায়। এদুয়ার্দো জানে না তার মা কতটা ধূর্ত। নিজের মায়ের কাছে সে দুগ্ধপোষ্য শিশু সমতুল্য। তবে হ্যাঁ, এদুয়ার্দো নিজের মাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো বলেই পিদর্কা এতো বেশি সুযোগ নিতে পেরেছিলেন। সেই ভাম্পায়ার গুপ্তচর আর কেউ নয়, স্বয়ং স্যান্ড্রি ছিলো। যে কিনা আব্রাহামকে সর্বদা নজরে নজরে রাখতো। প্রায়শই সে রুলারকে ইম্যুভিলের একটি বাড়িতে যেতে দেখতো। সবচেয়ে অদ্ভুত এবং আশ্চর্যের বিষয় ছিলো, বাড়িটার আশে পাশে এদুয়ার্দোর ভাম্পায়ার সেনারা পাহারায় থাকতো। তখনো পিদর্কা জানতেন না, ওটা ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি ছিলো।
ফ্রাঙ্কলিন পিয়ারসন। পিদর্কার ভীষণ পরিচিত। মার্টিনের মতো এই লোক আর তার স্ত্রী মাদাম ল্যারিও সেদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলো। স্যান্ড্রি শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। বাড়িটা কার এবং আব্রাহাম সেখানে কেনো যায় তা জানার জন্য। এদুয়ার্দোর সেনারাই বা কেনো বাড়িটা পাহারায় রেখেছিলো?
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর স্যান্ড্রি অবশেষে সুযোগ খুঁজে পায়। আব্রাহামকে যেদিন আক্রমণ করা হয়, সেদিন বাকি সবার মতো ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে সেও ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে প্রবেশ করে। দেখতে পায় স্ট্রিকল্যান্ডকে। পরদিন আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। জানতে পারে, বাড়িটা ফ্রাঙ্কলিন পিয়ারসনের। যার সহধর্মিণীর নাম মাদাম ল্যারি। স্যান্ড্রির থেকে সবটা জানার পর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান পিদর্কা স্যাভেরিন।
ফ্রাঙ্কলিন পিয়ারসন, মাদাম ল্যারি এবং উইজার্ড ডিয়েটসের পরিবার। দুয়ে দুয়ে চার করতেই পিদর্কা স্যাভেরিনের কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আনন্দের আধিক্যে তার চোখ দু’টো উজ্জ্বল হয়ে উঠে। মুখাবয়বে ছড়িয়ে পড়ে অসম্ভব অকল্পনীয় খুশি। পরদিন মাঝরাতে ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে তিনি একশতাধিক সেনা পাঠান। কিন্তু ওরা সবাই অসফল হয়। পিদর্কা স্যাভেরিনকে সবিনয়ে জানায়, আকাশ থেকে এক ধরনের সাদা রঙের অদ্ভুত আলোকরশ্মি এবং কোনো শক্তিশালী অদৃশ্য ব্যারিয়ারের জন্য তার ভাম্পায়ার সেনারা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। পিদর্কা এই বিষয়টা নিয়ে খুব একটা ভাবার সময় পাননি। তার আগেই এদুয়ার্দো কাস্ত্রোরুজ থর্পের ঘটনাটা জেনে যায়। ফলস্বরূপ সবাইকে দুর্গের ভিতরে বন্দি করে রাখে। দুর্গের চারপাশে নিজের সৈন্যদের পাহারায় রাখে সে। কিন্তু এদুয়ার্দো তার মায়ের ক্ষমতা সম্পর্কে জানে না।জানে না, তার অগোচরে পিদর্কা স্যাভেরিনের অসংখ্য, অগনিত ভাম্পায়ার সেনা লুকায়িত আছে। যারা এদুয়ার্দোর অধীনে থেকেও পিদর্কার হয়ে কাজ করে। ওরা সবাই পিদর্কার বিশ্বস্ত দাস।
জোসেফাইন এই চিঠিটাও দুর্গের ভিতরে থাকা কোনো বিশ্বস্ত ভাম্পায়ারের মাধ্যমে ভিক্টোরিয়ার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চায় সে? পিদর্কা মনে মনে ভাবেন। তার আফসোস হয়। উড্রো উইলসন কিভাবে এতটা বোকামি করতে পারে? স্ট্রিকল্যান্ড মা’রা গেছে কিনা নিশ্চিত না হয়েই মৃ’ত ভেবে ছেড়ে দিলো তাকে? যদি ঐ অপদার্থটা বেঁচে না থাকতো, তাহলে আজ এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না তাকে।
__________
মার্শাল আর্ট একাডেমি।
দুপুর দু’টো। প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছে। একাডেমির মাঠে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে কাঠের বেঞ্চ বসানো হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর সেরা ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর দু’জন শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এবার ইনায়ার পালা। ওর পরনে সাদা রঙের টেকউন্ডো পোশাক। প্রথম শ্রেণীর সেরা ছাত্র অ্যালেন সিলোসির সাথে লড়তে হবে ওকে। সামনের সাড়িতে একটা বেঞ্চের উপর সিয়া বসে আছে। আসবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েও সঠিক সময়ে একাডেমিতে এসে পৌঁছে গেছে ইজাবেল। সিয়ার পাশে বসে আছে সে। দ্বন্দ্বযুদ্ধ দেখায় মনোযোগ না দিয়ে পাশে বসে থাকা সিয়ার নিষ্প্রাণ মুখখানার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। দু’জনে একসাথে বসেছে অথচ কেউ কারো সাথে কথা বলেনি এখনো।
কাঠের বেঞ্চগুলো পেরিয়ে বিশাল ফাঁকা জায়গা। তার সামনে মাস্টারদের জন্য বেশ কয়েকটা চেয়ার বসানো হয়েছিলো। প্রিন্সিপালের ডানপাশের চেয়ারটায় দাপুটে রাজার মতো এদুয়ার্দো বসে ছিলো। তার মুখাবয়বে রাজ্যের গাম্ভীর্য। এখানে বসে থাকা অহেতুক সময় নষ্ট। কিন্তু প্রিন্সিপালের অনুরোধে আসতে হয়েছিলো। তাছাড়া আরও একটা বিশেষ কারণ আছে। এদুয়ার্দোর দৃষ্টির সম্মুখে অদুরে বসে আছে সিয়া। ওকে দেখেও না দেখার ভান করে এদুয়ার্দো। সিয়াও তার দিকে তাকায়নি একবারও। যেন একে অপরের উপস্থিতি মোটেও সহ্য করতে পারছে না ওরা। দু’জন দু’জনের প্রতি সাপ আর নেউলের মতো অনুভূতি অনুভব করছিলো। বক্ষজুড়ে অসামান্য প্রতিহিংসার অনলে জ্বলছিলো।
সিয়ার পরনে সিভিল ড্রেস। সাদা রঙের শর্ট গাউন আর পায়ে পরেছিলো উঁচু হিল জুতো। পনিটেল করে বেঁধে রাখা ওর ঘন মসৃণ সুদীর্ঘ বাদামী চুলগুলো বেঞ্চের উপর গুটিয়ে পড়েছিলো। মেয়েটা চোখ ধাঁধানো সুন্দর দেখতে। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। ইজাবেল মনে মনে ভাবে। গলা ঝেড়ে সিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করে। সিয়া অকপটে জানতে চায়,,
– কিছু বলবে?
মিষ্টি মধুর কন্ঠস্বর। শান্ত থাকা অবস্থায় যতটা মোহনীয় শোনায়, রেগে গেলে ঠিক ততটাই তেজী মনে হয়। ইজাবেল বিমুগ্ধ চোখে দেখে। পুরুষ হলে নিঃসন্দেহে এই শান্ত হরিণীর প্রেমে পড়তো সে। সিয়া স্থির নেত্রে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়। এখুনি ইনায়ার সাথে অ্যালেনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হবে। কয়েকপল সময় গড়ায়। ইজাবেল মিষ্টি হেসে বলে,,,,
– তুমিতো প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে গেছো। এখন থেকে আমি তোমার সহপাঠি। আমার নাম ইজাবেল স্যাভেরিন। তোমার নাম ফ্লোরেনসিয়া তাইনা?
– হ্যাঁ।
– আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
– না।_____সিয়ার থমথমে ভরাট কন্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়।
ইজাবেল মনঃক্ষুণ্ন হয়। মুখখানা কেমন শুকনো দেখায়। চোখের সামনে অদুরে দাড়িয়ে থাকা ইনায়া আর অ্যালেনের দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকায়। ততক্ষণে দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইজাবেল দু’বার চোখের পল্লব নাড়ায়। নিজের অজ্ঞাতেই সিয়ার কিঞ্চিত মন বিষন্ন হয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের মনকে আরও শক্ত করে নেয় ও।
– দুঃখিত। মন খারাপ করো না। আমি তোমাকে তেমনভাবে চিনি না। হঠাৎ করেই দু’জন মানুষ কিভাবে বন্ধু হতে পারে?___সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে সিয়া শান্ত গলায় কথাটা বলে।
ইজাবেল ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। নিমেষেই তার মন ভালো হয়ে যায়। সিয়া তো ঠিকই বলেছে। বন্ধু হওয়ার জন্য প্রথমে একে অপরকে জানা প্রয়োজন। একসাথে অনেকটা সময় কাটানো প্রয়োজন। ইজাবেল সিয়াকে সময় দিতে চায়। সিয়ার মন জিতে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
অ্যালেনের সাথে ইনায়ার অসাধারণ লড়াই চলছিলো। একজন মেয়ে হয়েও ছেলেটার সাথে সমান তালে টিকে ছিলো ও। অ্যালেন থেকে থেকে ওর রণকৌশল দেখে হতবাক হচ্ছিলো। শুরুর দিকেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে আর্নি হেরে গিয়েছিলো। অথচ ওর মুখখানা প্রচন্ড উচ্ছ্বসিত ছিলো। জেতা হারা নিয়ে ওর বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। সিয়ার পাশের বেঞ্চে ক্রিস্তিয়ানের সাথে বসে আছে ও।
সহসা ইনায়ার দিকে মারাত্মক আক্রমণ ঘনিয়ে আসে। দক্ষ হাতে আঘাতটা প্রতিহত করে। হেরে গেলে চলবে কি করে? ওকে জিততে হবে। ওদের বাবার বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
ইনায়ার শক্তপোক্ত একহাতের মুষ্টিবদ্ধ আঘাতে অ্যালেন অনেকটা দুরে গিয়ে পড়ে। ত্বরিত উঠে দাড়ায়। তীব্র বেগে ছুটে যায় ইনায়ার দিকে। অনেকটা উঁচুতে উঠে উড়ে গিয়ে ইনায়ার দু’কাধে আঘাত করতে চায়। ইনায়া দ্রুত সরে দাড়ায়। বাম পা দিয়ে ঘাড় বরাবর লাথি মে’রে ছেলেটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। শুধুমাত্র একটা মোক্ষম আঘাত। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় অ্যালেন। চেতনা হারায়। আর্নি দু’হাতে তালি বাজায়। কত সহজে ইনায়া জিতে গেল।
সিয়া মৃদু হাসে। ওর এক চিলতে মৃদু হাসি এদুয়ার্দোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে পড়ে সিয়া। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ইনায়ার দিকে। শান্ত গলায় বলে,,,,
– একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো।
– আমিও তোমার সাথে যাবো।
– আচ্ছা।
সিয়া ইনায়া ওয়াশরুমের দিকে যায়। কিন্তু ইনায়ার নাম ধরে ডেকে উঠেন মাস্টার জো। ও দাঁড়িয়ে পড়ে। সিয়া ওকে আশ্বস্ত করে বলে,,,
– তুমি এখানের কাজ শেষ করো। আমি এখুনি ফিরে আসবো।
ইনায়ার মন কেমন করে উঠে। এদুয়ার্দো শ’য়তানটা যে এখানেই উপস্থিত আছে। ওর ভয় হয়। ওদিকে মাস্টার জো পুনরায় ডাকে ওকে। অনিচ্ছা স্বত্তেও ইনায়া সেদিকে পা বাড়ায়। সিয়া চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে। মাঠ পেরিয়ে একাডেমির ভবনের বারান্দায় উঠে ও। করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় ওর ক্রুশচিহ্নটা জ্বলতে শুরু করে। সিয়া ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়ে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সজাগ হয়ে উঠে। বাতাসের বেগে কেউ ছুটে আসে ওর কাছে। সিয়াকে কোনো ধরনের সুযোগ না দিয়ে ওর কানের পাশে সজোরে মাথায় আঘাত করে। মূহুর্তেই অচেতন হয়ে যায় সিয়া। এদুয়ার্দো কিঞ্চিত ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসে। সিয়ার আরক্তিম কোমল ঠোঁটের পবিত্র মুখখানার দিকে তাকিয়ে থেকে অনুচ্চস্বরে বলে,,,
– তোমার বাবার শেখানো রণকৌশলে তুমি নিজেই কপোকাত হয়ে গেলে।
এদুয়ার্দো সিয়াকে কোলে তুলে নেয়। ঝড়ের বেগে চোখের পলকে একাডেমি ভবনের বাইরে বেরিয়ে যায়। ক্ষণকাল সময় গড়ায়। সিয়ার ফিরে আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ইনায়ার দুশ্চিন্তা হয়। মাস্টারদের বসার আসনগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে, র’ক্তচোষাটা নেই। ইনায়ার শিঁরদাড়া বেয়ে অজানা আতংকের ভয়াবহ শীতল স্রোত গড়িয়ে যায়। রক্ত হিম হয়ে আসে। দৌড়ে যায় একাডেমির ভবনের দিকে। ক্রিস্তিয়ান আর আর্নি ওর দৌড়ানো দেখে বিস্মিত হয়। বেশি দুর যেতে হয় না। সহসা সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ইনায়া ঘাবড়ে যায়। মেয়েটা ওর হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দেয়। মিনমিনে স্বরে বলে,,,
– এটা চিফ মাস্টার দিয়েছেন তোমাকে দেওয়ার জন্য।
ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ইনায়া চিরকুট টা হাতে তুলে নেয়। ওর ভীষণ গলা শুকিয়ে যায়। ছোট কাগজের উপর ছোট ছোট অক্ষরের লেখাগুলো মনে মনে পড়তে শুরু করে,,,
– ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। ও আমার কাছে সম্পূর্ণ নিরাপদে থাকবে। তোমাকে বড়জোর দু’দিন সময় দিচ্ছি। তোমার দাদুর সযত্নে রাখা বই, পাথর আর তলোয়ারটা আমার বিশ্বস্ত সহচর অ্যাভোগ্রেডোর হাতে তুলে দিও। অ্যাভোগ্রেডো ফাঙ্কলিনের বাড়ির পাশে থাকা বরফে ঢাকা বিস্তর প্রান্তরে অপেক্ষা করবে।
স্তম্ভিত হয়ে প্রস্তর মূর্তির ন্যায় ইনায়া ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। ক্রিস্তিয়ান আর আর্নি ছুটে আসে। চারপাশে নজর বুলিয়ে যতদুর চোখ যায়, সিয়াকে কোথাও দেখতে পায় না ওরা। ক্রিস্তিয়ান উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,
– কি হয়েছে? তুমি এভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেনো? সিয়া কোথায়?
– ওকে নিয়ে গেছে এদুয়ার্দো।
ইনায়া নিষ্প্রভ কন্ঠে বলে। ওর দু’চোখ থেকে শব্দহীন অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে। আর্নি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। ক্রিস্তিয়ানের হৃদয় মুষড়ে উঠে। এবার কি হবে?