মার্শাল আর্ট একাডেমি।
একাডেমির প্রধান ফটকের সামনে এসে দাড়ায় ফিটন। প্রথমেই নেমে দাড়ায় ইনায়া। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে ও। পেছনে আর্নি আর ক্রিস্তিয়ান। একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে ইনায়ার কাছে পৌঁছায় দু’জন। ক্রিস্তিয়ান ম্লান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
– দিনলিপিটা সম্পূর্ণ পড়েছিলে?
– ওটা পড়ার ক্ষমতা নেই। সিয়া আমার বোন। ওকে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনবো।
– আজ একাডেমিতে না এলেও পারতে। কি এমন প্রয়োজন ছিলো তোমার?
– ইজাবেলের সাথে কথা বলা জরুরী। ঐ জিনিসগুলো এদুয়ার্দোর হাতে তুলে না দিই, ওর বোনের সাথে কথা বলতেই পারি। মেয়েটা কোমল মনের অধিকারী৷ আমাকে সাহায্য করতে রাজি হবে হয়তো। আমি সিয়ার থেকে দুরে থাকতে পারছি না। ওর জন্য আমার খুব বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এখন বাড়িতে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়। তোমরা কেনো বুঝতে পারছো না?_____ইনায়া কাতর কন্ঠে বলে।
ওর জন্য তোমার থেকে আমার কম দুশ্চিন্তা হচ্ছে না ইনায়া। তোমাকে কিভাবে বোঝাবো আমার বুকের অভ্যন্তরে কি চলছে। ঠিক কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে।_____ক্রিস্তিয়ান মনে মনে বলে।
– তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আমি ইনায়ার সাথে থাকবো।___ ক্রিস্তিয়ানকে আশ্বস্ত করে কথাটা বলে উঠে আর্নি।
– আমিও তোদের দু’জনের সাথে যাবো।
– তোমরা কেউ না। আমি একা কথা বলবো ইজাবেলের সাথে। ___ইনায়া দৃঢ় গলায় বলে।
স্ট্রিকল্যান্ড কুরী, ফ্রাঙ্কলিন এবং মাদাম ল্যারি কেউ’ই ইনায়াকে একাডেমিতে আসতে দিতে চাননি। কিন্তু মেয়েটা এতো বেশি জেদ ধরেছিলো যে, সবাই বাধ্য হয়েছিলেন ওর জেদের কাছে হার মানতে।
– ক্রিস্তিয়ান এখানেই দাড়াও। আর্নি আমার সাথে প্রথম শ্রেনীর কামরা পর্যন্ত যেতে পারবে।
– ক্লাস শুরু হতে এখনো অনেক দেরি। মেয়েটা কি এসেছে একাডেমিতে?___ক্রিস্তিয়ান জিজ্ঞেস করে।
– জানিনা। ক্লাসে গিয়ে দেখতে হবে।
– তোমার ক্রুশ লকেট?___শঙ্কিত কন্ঠে ইনায়াকে জিজ্ঞেস করে আর্নি।
– আছে। ইজাবেলের সাথে কথা বলবো, তাই লুকিয়ে রেখেছি।
ইনায়ার শুকনো গম্ভীর মুখখানার দিকে তাকিয়ে ক্রিস্তিয়ানের বুক চিরে হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে বিষন্ন বদনে শীর্ণ কন্ঠে বলে,,,
– আচ্ছা। যাও তাহলে। আজ ক্লাস করার প্রয়োজন নেই। ইজাবেলের সাথে কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমি এখানেই তোমার দু’জনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবো।
– হুম।
আর্নিকে সাথে নিয়ে প্রথম শ্রেনীর কামরার দিকে এগিয়ে যায় ইনায়া। দ্রুতপায়ে হেঁটে কামরার সামনে গিয়ে দাড়ায়। দরজাটা হালকা করে চাপিয়ে রাখা ছিলো। দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করে। ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা বাজে। এখনো কোনো শিক্ষার্থী আসেনি। ইনায়া অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইজাবেলের সাথে কথা বলে তবেই বাড়ি ফিরে যাবে ও।
_____________
কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।
কামরাজুড়ে ইতস্তত পায়চারি করছিলেন পিদর্কা স্যাভেরিন। সোফার উপর বসে ছিলো ক্যারলোয়েন, ভিক্টোরিয়া আর অ্যালিস। অকস্মাৎ সশব্দে দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করে একজন সুদর্শন যুবক। উদ্বিগ্ন মুখে চমকে তাকান পিদর্কা স্যাভেরিন। কপট রাগ মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,
-কোথায় গিয়েছিলে?
নীলাভ নেত্র মেলে তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে যুবক। ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। সামান্য ঘাড় বাঁকা করে হেলে দুলে হাঁটে। পিদর্কার সামনে গিয়ে দাড়ায়। অকপটে বলে,,,
– শিকারে গিয়েছিলাম। কেনো? কোনো সমস্যা?
– তুমি ক্যাসলের বাইরে গিয়েছিলে!___প্রশ্ন নয়, আশ্চর্য হলেন পিদর্কা।
– না, মা। বেসমেন্টে। ওখানে থাকা মেয়েগুলোর মধ্যেই একজনকে নিজের শিকার বানিয়েছি। ওর শরীরের সমস্ত রক্ত শুয়ে খেয়েছি।
– ফ্লভেয়ার!! এরকম করার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো? আমরা সবাই দুর্গের ভিতরে বন্দি। মেয়েটার লাশ কোথায় লুকাবো?_____ক্রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন পিদর্কা স্যাভেরিন।
– তুমি একটু বেশিই ভয় পাচ্ছো মা।____ কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে কথাটা বলে গুস্তাভ ফ্লভেয়ার।
– ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এদুয়ার্দোর বিরুদ্ধে যাওয়া অসম্ভব। তুমি কতটুকু জানো ওর সম্পর্কে?
– জানতেই তো চাই মা। কেনো এতো ভয় পাও ওকে?
– বাদ দাও। সময় হলে সবাই সবকিছু জানতে পারবে। স্যান্ড্রির কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?
– না। কোথায় গায়েব হয়ে গেছে কেউ জানে না।___চিন্তিত স্বরে কথাটা বলে ক্যারলোয়েন। ভিক্টোরিয়া সোফায় গা এলিয়ে দেয়। ভীষণ মন খারাপ তার। যেন কাল কুঠুরীতে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে সবাই। কোনো স্বাধীনতা নেই। কামরায় প্রবেশ করে ব্রাংকো আর উড্রো উইলসন। দু’জনকে দেখা মাত্রই পিদর্কা স্যাভেরিন ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,,
– স্যান্ড্রিকে খুঁজে পেয়েছ?
দু’দিকে মাথায় নাড়িয়ে না বোঝায় উড্রো উইলসন। ব্রাংকো সোফার উপর বসে। খুব কম কথা বলে সে।প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলেনা বললেই চলে। নিশ্চুপ থাকতে পছন্দ করে। বাবা উইলসনের একান্ত বাধ্য ছেলে। গুস্তাব ফ্লভেয়ার বিরক্ত কন্ঠে বলে,,,
– স্যান্ড্রির কথা ভুলে যাও। মরুক গে। আমাদের কি যায় আসে? তুমি বরং আমাকে বলো, দুর্গ থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো রাস্তা বা উপায় আছে কিনা।
ফ্লভেয়ারের কথা শুনে কিছু একটা মনে পড়ে যায় পিদর্কা স্যাভেরিনের। তিনি নিজের উপর বেশ বিরক্তবোধ করেন। এতোদিন এই বিষয়টা একদমই খেয়াল ছিলো না তার। অধৈর্য হয়ে উঠে ফ্লভেয়ার। ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,
– কি হলো? উত্তর দিচ্ছো না কেনো?
– দুশ্চিন্তায় আমার মনেই ছিলো না। বেসমেন্টের একটি কামরায় সুরঙ্গ পথ আছে। শত্রুদের অতর্কিত হামলায় নির্বিঘ্নে নিরাপদে দুর্গের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তোমাদের বাবা এই সুরঙ্গ পথ তৈরী করেছিলেন। যা দুর্গের বাইরে অনেকটা দুরে গিয়ে পৌঁছে। আমরা চাইলেই সেই সুরঙ্গ পথ ব্যবহার করতে পারি।
অত্যাধিক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে ফ্লভেয়ারের চোখজোড়া। কিন্তু পরমুহূর্তেই সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
– এই সুরঙ্গের কথা কি এদুয়ার্দোও জানে?
– ওভারলর্ড কিভাবে জানবে? আমি আর ক্যারলোয়েনও জানিনা।___কথাটা বলে ভিক্টোরিয়া।
– এদুয়ার্দো যখন বড় হয়। সবকিছু বুঝতে শিখে। ভ্যাম্পায়ার সাম্রাজ্যের মহারাজ হিসাবে সিংহাসনে বসে। তখন থেকেই ও ইজাবেলকে সাথে নিয়ে ওয়াভেল কোটে থাকতে শুরু করে। মুলত আমিই চেয়েছিলাম এদুয়ার্দো ওয়াভেল কোটে থাকুক। শুধুমাত্র এদুয়ার্দোই নয়, আব্রাহাম আর ইজাবেলকেও সবসময় স্যাভোরিন ক্যাসল থেকে দুরে রাখতে চেয়েছি আমি। কেনো জানো?
– যাতে স্যাভেরিন ক্যাসলে করা তোমার সমস্ত কুকীর্তির ব্যাপারে ওরা কেউ জানতে না পারে।____ফ্লভেয়ার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে।
– হ্যাঁ। এই দুর্গের নকশা শুধুমাত্র আমার কাছে আছে। সে যাই হোক। যেহেতু আমরা এখন দুর্গের বাইরে বের হতে পারবো। আমি একটা পরিকল্পনা করেছি। তোমরা সেটা মনোযোগ দিয়ে শোনো।
– জ্বি বলুন।____কথাটা বলে উড্রো উইলসন।
– জোসেফাইন আমাকে দেখা করতে বলেছিলো। কিন্তু আমিতো দুর্গের বাইরে যেতে পারবো না। কারন যে কোন সময় এদুয়ার্দো চলে আসতে পারে। আমাকে খুঁজে না পেলে কি হবে বুঝতে পারছো? তাই দুর্গের বাইরে বের হবে তুমি।
– আমি?___বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ফ্লভেয়ার।
– হ্যাঁ। তুমি দুর্গের বাইরে বের হলে কোনো সমস্যা হবে না। তোমাকে একসাথে দু’টো কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আশা করি তুমি সফল হবে। আমি দেখতে চাই তুমি কতটা যোগ্য। আমার এদুয়ার্দো কখনো কোনো কাজে অসফল হয়নি। অসফল হয়নি আব্রাহামও। তিল তিল করে আমি ওকে গড়ে তুলেছিলাম। বহু নারীর প্রতি আসক্ত করেছিলাম। কিন্তু ডিয়েটসের নাতনি ওর সাথে এমন কি করেছিলো, বহুনারীগামি ছেলেটা আমার এক ঝটকায় বদলে গেল। ইনায়া ইনায়া করে উন্মাদ হয়ে উঠলো। জাদুকর বংশের মেয়ে। নিঃসন্দেহে কোনো জাদু করেছিলো।
শব্দ করে হেসে উঠে ফ্লভেয়ার। বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলে,,,,
– অপদার্থ ছোট ছেলে তোমার। তারপর কি করতে হবে বলো।
– প্রথমে, জোসেফাইনকে আমার সাথে দেখা করতে বলবে। ওকে সুরঙ্গ পথ দেখিয়ে দিবে। দ্বিতীয়ত, ক্রিসক্রিংগলের যেকোনো একজন মেয়েকে তুলে আনবে। আর যাই করো, মেয়েটা যেন জীবিত থাকে।
– এখানে তুলে আনবো? এই স্যাভেরিন ক্যাসলে?
– না। প্রাসকোভিয়া জঙ্গলে। দক্ষিণের দিকে। ওখানে একটা জরাজীর্ণ কুটির আছে। ওদিকে কখনো কোনো মানুষ যাতায়াত করে না। যদি পারো, দু’জনকেই তুলে আনো। প্রথমে ওদের নিয়ে এসো, বাকিটা পরে বলবো। ক্রিসক্রিংগলের মেয়েরা মার্শাল আর্ট জানে। সাবধান, ওদের হাত পা যেন খোলা না থাকে। যদি বাড়িতে প্রবেশ করার সুযোগ না পাও, তবে খারকিভ শহরের মার্শাল আর্ট একাডেমিতে চলে যাও৷ সকাল নয়টা থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত ওদের ক্লাস।
– আপনি এতো কিছু কিভাবে জানেন?____কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ক্যারলোয়েন।
– এই সবকিছু আমাকে জানিয়েছিলো স্যান্ড্রি। ও খুব কাজের ছেলে। অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আব্রাহাম আহত হওয়ার পর একে একে সব তথ্য সংগ্রহ করে। আমিও প্রস্তুত ছিলাম একটা মোক্ষম সুযোগের। কিন্তু এদুয়ার্দো আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়, আমাদের সবাইকে দুর্গে বন্দী করে রেখে। স্যান্ড্রি আমার ভীষণ বিশ্বস্ত সেবক। এখন বুঝতে পারছো ওকে খুঁজে না পাওয়ায় কেনো আমার এতো দুশ্চিন্তা হচ্ছে?
– ঠিক আছে। আমাকে সুরঙ্গ পথ দেখিয়ে দাও। আমি যত দ্রুত সম্ভব নিজের কাজ সমাপ্ত করে ফিরে আসবো।___ফ্লভেয়ার দৃঢ় কন্ঠে বলে।
পিদর্কা স্যাভেরিন বাকিদের রেখে শুধুমাত্র ফ্লভেয়ারকে সাথে নিয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে যান। উড্রো উইলসনের গলা শুকিয়ে আসে। না জানি তার বোনের পরিকল্পনা সবাইকে কত বড় শাস্তির সম্মুখীন করে। এবার আর ছাড় নেই। এদুয়ার্দো যদি ঘুনাক্ষরেও জানতে পারে, এক এক করে সবগুলোর গলা কেটে তাদের দ্বিখণ্ডিত দেহে আগুনে জ্বালিয়ে দিবে।
★★
বেসমেন্টের একটি দ্বারবদ্ধ কামরা থেকে একজন মহিলার আর্ত কন্ঠের চিৎকার ভেসে আসে। সে ডাকছে, করুন স্বরে কাউকে আহ্বান করে বলছে,,,
– পাওলো, বাবা আমার। তুমি ঠিক আছো? সাড়া দাও।
কফিনে শুয়ে থাকা নীল চোখের ছেলেটা উৎকর্ণ কানে শোনে। অপরিচিত নারীকণ্ঠ। তবুও কেনো হৃদপিণ্ড নাড়িয়ে দিচ্ছে? কী ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে বক্ষস্থলে। নিজের অজান্তেই যেন তার চোখ ভিঁজে উঠে। রক্তচোষারা কি কখনো কাঁদে?
– পাওলো কে?
আব্রাহাম মনে মনে ভাবে। কতদিন ধরে কফিন বন্দি হয়ে আছে জানা নেই। সহসা দু’চোখের নেত্রপল্লব বুজে নেয়। পিপাসিত, অভুক্ত আর বন্দিদশায় থেকেও তার দৃষ্টির সম্মুখে একজোড়া গাঢ় ধূসর চোখ ভেসে উঠে। সুদীর্ঘ লালচে-সোনালি চুলের অধিকারীনি সেই মায়াবী মুখের মেয়েটার কথা মনে পড়ে। পুরুষ প্রেমে পড়ে কোমলতার। কিন্তু সে প্রেমে পড়েছিলো এক ভয়ংকর রাগান্বিত মুখশ্রীর। ভাবতেই ম্লান হাসে। হঠাৎই বুক পোড়া জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। নিমেষেই হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ে। তার তৃষ্ণার্ত আঁখিযুগল মরিয়া হয়ে উঠে ইনায়াকে একনজর দেখার জন্যে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, কফিন থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে সেই বিধ্বংসী মানবীর সাথে দেখা করবে।
– মহব্বত একধরনের প্রাণনাশক বিষ। যা একবার পান করলে ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ড পঁচে যায়। আমি প্রতি মুহূর্তে সেই বিষের যন্ত্রণা অনুভব করছি। তোমাকে একবার দেখার আকাঙ্ক্ষা রক্ত পিপাসার থেকেও ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এখন কোনো কিছুই আমার আয়ত্তে নেই। আমি আমার মনের কথা অবশ্যই শুনবো। তোমার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো, যেন আমি এই বন্দিদশা থেকে কোনোদিনও মুক্ত না হই। যেন আর কখনো মুখোমুখি হতে না পারি তোমার। আমাদের পরবর্তী দেখা তোমার জন্য সুখকর হবে না। যেভাবে আমি বন্দি হয়ে আছি। ঠিক সেভাবে বন্দি থাকবে তুমিও। এভাবে আমার মৃ’ত্যু হবে না। অপেক্ষা করো। আমি আসবো।
– মরতে মরতে বেঁচে গিয়েও তোমার শিক্ষা হয়নি? কিভাবে মুক্ত হবে সেই চিন্তা না করে, আবারও ওর কথা ভাবছো? ___ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠে তার পি’শাচ সত্তা।
আব্রাহাম প্রত্যুত্তর দেয় না। শক্তি প্রয়োগ করে কফিনের বাইরে বের হতে চায়।
__________
প্রাসকোভিয়া, কেইভ অব জুপিটার।
গতকাল রাতেই আহত হওয়া ছেলেটা মা’রা যায়। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে অসাবধানতা বশত উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছিলো সে। ভোর বেলার দিকে তার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। যার আদি-অন্ত দায়িত্বে ছিলো মার্কস। কেন জানি ক্রিসক্রিংগলের মন অস্থির হয়ে উঠে। ভীষণ মনে পড়ে সিয়া ইনায়াকে। কতদিন হলো নিজের প্রাণপ্রিয় মেয়েদের দেখেননি তিনি।
পাথরের মতো কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষটাও মানসিক দিক থেকে কেমন দুর্বল হয়ে পড়েন। খুব বেশি অসহায় বোধ করেন। তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে যায়। এতো এতো বিপদ, এতো ঝুঁকি নিয়ে মার্টিনের কাছে পৌঁছেও কি তাকে একলা একা ফিরে যেতে হবে? এই ব্যর্থতা আর হেরে যাওয়ার যন্ত্রণা তিনি কিভাবে সহ্য করবেন? সহসা ক্রিসক্রিংগলের পাশে এসে দাড়ায় মার্কস। সবিনয়ে বলে,,,
– চলুন। আপনার ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
ক্রিসক্রিংগলকে বিদায় জানাতে আসেন মার্টিন। মুখাখানা অদ্ভুত রকম গম্ভীর। রাশভারি কন্ঠে তিনি বলেন,,,,
– আর কখনো আমার সাথে সাক্ষাৎ করার দুঃসাহস দেখিয়ো না।
অর্থাৎ সত্যি তিনি ফিরে যাবেন না। এতোটা নির্দয় হবেন? ক্রিসক্রিংগলের সামনে দাড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটা কি আদৌও মার্টিন লরেন্স? বিশ্বাস হয় না। দিশেহারা হয়ে পড়েন ক্রিসক্রিংগল। কেমন জ্ঞানশূন্য বোধ করেন। আচম্বিতে দু’হাটু মুড়ে বসে পড়েন। নিমেষেই মার্টিনের বুক কেঁপে উঠে। তিনি একপা পেছনে সরে দাড়ান। স্তব্ধ দৃষ্টিতে অনিমেষ তাকিয়ে থাকেন। ক্রিসক্রিংগল ব্যথাতুর করুন কন্ঠে বলেন,,,,
– দয়া করে আমাকে বিশ্বাস করো মার্টিন। তুমিতো জানো, আমি আমার জীবনে কোনোদিনও মিথ্যা কথা বলিনি। আমার ফ্লোরেনসিয়াই তোমার মেয়ে ক্লারেসিয়া। সবচেয়ে বড় প্রমাণ ওর কাঁধে থাকা ক্রুশ চিহ্ন। আর কিছুদিন পর হয়তো ওর ঐশ্বরিক সত্তা জাগ্রত হবে। তুমি বুঝতে পারছো তখন কি কি করতে পারে ও? এদুয়ার্দো আর সিয়া একে অপরের প্রাণ বিনাশক হয়ে দাড়াবে। একজন অপর জনকে মা’রার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। তখন একমাত্র তুমিই পারবে ওদের দু’জনকে সামলাতে। ওদের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে। ঈশ্বরের দোহায় লাগে। আমাকে বিশ্বাস করো। ওকে একবার দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে। ও অবিকল ওর মায়ের মতো দেখতে। যদি আমার কথা এক বর্ণও মিথ্যে প্রমাণিত হয়, তুমি আমার শিরশ্ছেদ করে পুনরায় ফিরে এসো কেইভ অব জুপিটারে।
মার্টিনের মুখখানা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠে। চোখের কোনো আনন্দের অশ্রু চিকচিক করে। ফ্লোরেনসিয়া যদি সত্যিই ক্লারেসিয়া হয়, তাহলে এই সমগ্র পৃথিবীতে তার থেকে বেশি খুশি আর কে হতে পারে?
________
খারকিভ, ওয়াভেল কোট।
সোফার উপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিলো সিয়া। পরনে কালো রঙের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ফ্রক। খাবার না খাওয়ায় মুখখানা একদম শুকিয়ে গেছে ওর। ঘুমায়নি। ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিলো কেবল। ওর পরিকল্পনা ছিলো কেউ কামরায় প্রবেশ করলে, তাকে আঘাত করে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাবে ও। কিন্তু বোকা সিয়া জানতো না, এরকম আরও কতগুলো বিশাল বিশাল দরজার সম্মুখীন হতে হবে ওকে। সবগুলো দরজা বাইরে থেকে আঁটকে রাখা ছিলো। দ্বারপ্রান্তে হৃষ্টপুষ্ট প্রহরী দাড়ানো। সোফার পাশেই একটা ফ্লাওয়ার ভাস রেখেছিলো সিয়া। যদি এদুয়ার্দো কামরায় প্রবেশ করে, সোজা মাথায় আঘাত করবে ও। কিন্তু যদি ঐ মহোদয়া কামরায় আসেন? ভাবতেই মন খারাপ হয়।
কয়েকপল সময় গড়ায়। খট করে শব্দ হয় দরজায়। কেউ একজন কামরায় প্রবেশ করে। সিয়া মটকা মে’রে শুয়ে থাকে। বিন্দুমাত্র নড়চড় করে না। কামরায় প্রবেশ করা ব্যক্তি পুনরায় দরজা লাগিয়ে দেয়। সিয়া মুহূর্তেই আশাহত হয়। কিন্তু হাল ছাড়েনা। নিশ্চয়ই শ’য়তানটার আগমন ঘটেছে কামরায়। তাইতো বুদ্ধি করে প্রথমে দরজা আঁটকে দিলো।
– অ’সভ্য র’ক্তপিপাসু। ____ মনে মনে গালি দিতে গিয়েও থেমে যায় সিয়া। পাছে বে’য়াদবটা শুনে ফেলবে এই ভয়ে। ঘাপটি মে’রে শুয়ে রইলো। এদুয়ার্দো! হ্যাঁ এদুয়ার্দোই তো। এতো আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? সে ছাড়া আর কে আসবে সিয়ার কাছে?
এদুয়ার্দো পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সিয়ার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সিয়ার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে। ওর ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। এদুয়ার্দো অনুচ্চস্বরে বলে,,
– নির্বোধ।
এদুয়ার্দো বিছানার দিকে তাকায়। এভাবে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে, সিয়াকে কোলে তুলে নেয়। একজোড়া পেশিবহুল হাত ওর শরীর স্পর্শ করতেই জ্বলে উঠে সিয়া। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। মৃদুমন্দ শরীর কাঁপতে শুরু করে। ক্রোধের আধিক্যে নাকি এদুয়ার্দোর স্পর্শে? নিজেই বুঝতে পারে না ও। রন্ধ্রে রন্ধ্রে অজানা শিহরন জাগে। চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠে। কিন্তু চোখ মেলে তাকায় না। পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। কে বলতে পারে ভাগ্য সহায় হলে, আজই ও এই কামরার বাইরে বেরিয়ে যাবে। তাই ধৈর্য ধরতে হবে।
ধীরপায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায় এদুয়ার্দো। দুঃসাহসী সিয়া হঠাৎই ভয় পেতে শুরু করে। র’ক্তচোষা শ’য়তানটা ওর সাথে কোনো অসভ্যতামি করবে নাতো? সিয়ার ভয়টুকু সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত করে এদুয়ার্দো ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সিয়া নিজের বাম চোখ সামান্য খুলে পুনরায় তা বুজে নেয়। এদুয়ার্দো ফিরে আসার সময় মেঝেতে লুটিয়ে পড়া সিয়ার চুলগুলোর দিকে তাকায়। আলতো হাতে সবগুলো চুল একত্র করে আলগোছে বিছানার উপর রাখে। লাল টুকটুকে ঠোঁট মৃ’দু হাসে। উড়নচণ্ডী মেয়েটা এই সুদীর্ঘ চুলগুলো সামলায় কি করে? এদুয়ার্দো বোঝে না। বোঝার চেষ্টাও করে না। একটু পর খাবার নিয়ে মাদাম কর্নিলিয়া আসবেন। এদুয়ার্দো ঠিক করেছে জোর করে সেসব গিলাবে সিয়াকে। ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নিক ও।
টেবিলের সামনে চেয়ারটাতে নিঃশব্দে বসে এদুয়ার্দো। পেছন দিকে গা এলিয়ে দেয়। দু’চোখের পল্লব বুজে নেয়। কতশত ভাবনারা উঁকি দেয় হৃদয়কোণে। অনেকগুলো অমীমাংসিত ঘটনা। কতশত প্রশ্ন। ক্ষণকাল সময় গড়ায়। হঠাৎই তার মনে হয় পেছন থেকে কোনো আক্রমণ ঘনিয়ে আসছে। চট করে আঘাতটা প্রতিহত করে এদুয়ার্দো। সিয়ার হাতে থাকা ফ্লাওয়ার ভাসটা মেঝেতে পড়ে যায়। এদুয়ার্দো ওকে এক ঝটকায় পেছন থেকে পাশে এনে দাঁড় করায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হেসে বলে,,,,
– অভিনয়টাও ভালো ভাবে করতে পারো না। আঘাতটা অন্তত সঠিকভাবে করতে। বোকা ফ্লোরেনসিয়া। এই শিখিয়েছি আমি তোমাকে?
– মহামান্য মাস্টার। এই ব্যর্থতা আপনার। কি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন নিজের ছাত্রীকে? লোকে আমার দিকে নয়, আপনার দিকে আঙ্গুল তুলবে। ____সিয়া বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলে।
– তোমার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
পুরনো অপমানবোধ জেগে উঠে সিয়ার। ভীষণ অপমান বোধ করে ও। এদুয়ার্দো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। এগিয়ে যায় দরজার দিকে। কিন্তু সিয়া তার সামনে গিয়ে দাড়ায়। রাগমিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,
– কেনো আঁটকে রেখেছ? ইনায়া আমার অপেক্ষায় আছে। আমাকে যেতে দাও।
– আমার উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার পর।____ এদুয়ার্দো থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে।
– কি উদ্দেশ্য তোমার?____বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সিয়া।
– তোমাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
সিয়ার রাগ হয়। এদুয়ার্দোকে আক্রমণ করে বসে। একের পর এক আঘাত করতে থাকে। ওর আঘাতগুলো প্রতিহত করে এদুয়ার্দো। দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হয়। বেশ কয়েক মিন ধরে চলে। যুদ্ধের একপর্যায়ে ধপাস করে মেঝেতে পরে যায় সিয়া। ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে ও। ওর উপর পড়ে যায় এদুয়ার্দো। সিয়ার কুঁচকে যাওয়া আরক্তিম ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দেয় এদুয়ার্দোর লাল টুকটুকে ঠোঁট। স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এদুয়ার্দো। শীতল বরফের মতো জমে যায় সিয়ার সর্বাঙ্গ। গলা শুকিয়ে আসে। দু’বার চোখ পিটপিট করে তাকাতেই সম্বিত ফিরে পায়। দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। ত্বরিত উঠে দাড়িয়ে পড়ে এদুয়ার্দো। মস্তিষ্ক ভোঁতা ভোঁতা লাগছে। সে অনুমতি দেয়,,,
– এসো।