মনি যাবার পর খেয়াল করলাম যে আমার গোছানো আলমারিটা একটু এলোমেলো। বুঝলাম যে এই আলমারিতেও হাত দিয়েছে। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে কিছু নিতে পারে নি। আলমারিতে আমার পরার নরমাল কাপড়গুলো ছাড়া আর কিছুই নেই। ভালো শাড়ি, জামা, গয়না সবকিছু ট্রলিতে লক করা। সেটা খোলার চেষ্টাও নিশ্চয়ই চালিয়েছে বেচারি।
আম্মা অধিক শোকে পাথর হয়ে আছেন। তার বহুদিনের জমানো টাকা। ষোলো হাজার তিনশ টাকা। খুচরো পঁচিশ টাকা অবশ্য রেখে গেছে। তবে মুক্তার জুতাটা নেবার রহস্য উদঘাটন করতে পারছি না। নিরু আপার মতো বেশী কথা বলার স্বভাব থাকলে নাবিদ কে হয়তো জিজ্ঞেস করতাম।
আমার মামাশ্বশুর আসেন কালেভদ্রে। বিয়ের পর দু’বার তাকে এবাড়ি দেখেছি। একবার আমাকে তার বাড়িতে নেবার জন্য এসেছিলেন, আরেকবার এসেছিলেন জামিল ভাইয়ের ঝামেলার সময়।
এবার এসে আমার শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“আপনি এইগুলা কেমন পোলাপাইন বানাইছেন? আর ওর হাতে মোবাইল কে দিছে?”
নাবিদ দূর্বল গলায় বলল,
“মামা, জরী কলেজে যায় দেখে ওরে মোবাইল কিনে দিছিলাম। তারপর আম্মার জোড়াজুড়িতে ওরেও দেয়া লাগছে। ”
আম্মা ফোস করে উঠে বললেন,
“নাবিদ, কি বলিস এইগুলান! আমি জরীর মোবাইল দেখে হিংসায় মরি। ”
আমি অবাক হলাম। কী কথা হচ্ছিলো, আর সে কী অর্থ বের করেছেন।
মামা থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“আপনি থামেন, আপনার বিন্দুমাত্র লজ্জা নাই! ঘরের বউ থাকে না, মেয়েরে সামলাইতে পারেন না। ”
আম্মার মুখ টা ছোট হয়ে গেল। আমার শ্বশুর কোনো কথা বলছেন না। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।
মামা আমাকে বললেন, রাতে এখানে খাবেন। আমি রান্নার আয়োজন করতে গেলাম। ফ্রিজে একটু মুরগির মাংস আছে। ওটা নামিয়ে ভিজিয়ে রেখে ডিম সেদ্ধ দিলাম। কৌটায় রাখা পোলাওয়ের চাল টা বাছতে শুরু করলাম। বাবা তখন ডাকলেন,
“মা একটু এইদিকে আসো। ”
আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তার কাছে গেলাম। বসার ঘর, আর রান্না ঘরের মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা। বাবা বললেন,
“মনির মোবাইল নাম্বার টা আমারে একটু লিখে দিবা। আমি দোকান থেকে ফোন করে দেখি। ”
আমি ভীষণ অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষন। বললাম,
“বাবা ওর নাম্বার টা তো বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ”
“তবুও একবার চেষ্টা করে দেখি। ছোটমানুষ কই আছে, কেমন আছে!”
আমি কাগজে নাম্বার লিখে বাবাকে দিলাম। কাগজ নেয়ার সময় মুক্তা জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবী কি করবা?”
“বাবা চাইলেন। দোকান থেকে ফোন করবেন বললেন।”
মুক্তা হঠাৎ আমার হাত ধরে বলল,
“আমার খুব ভয় করে। লোকজন দেখতে কেমন পিশাচের মতো। ওরে নিয়ে যদি বিক্রি করে দেয়!”
আমি আশ্বস্ত করে বললাম,
“চিন্তা কোরো না। ও বোকা টাইপ না। ও’কে ঠকাতে পারবে না।
***
মামা রাতে তৃপ্তি করে খেলেন। খাওয়ার সময় বললেন,
“পোলাও টা খুব ভালো হয়েছে জরী। ডিমের কোর্মায় নারকেল বাটা দিছো! কী সুন্দর ঘ্রাণ! তোমার শাশুড়ী জীবনেও এমন রানতে পারবে না। সে শুধু পারে এক পাতিল পেপের মধ্যে মুরগি দিয়ে ঝোল টাইপের একটা অখাদ্য রানতে। এরচেয়ে টুম্পার রান্নার হাত ভালো ছিলো”
এতো টেনশনের মধ্যেও সবাই পেট ভরে খেল। জামিল ভাইয়ের জন্য পোলাও বাড়তে গিয়ে দেখি কম হয়ে যায়৷ জলদি করে আরও এক পট চাল চড়িয়ে দেই।
নাবিদ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। ওর আবার সকালে জলদি অফিসে যেতে হবে। আমি জামিল ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করি। উনি একটা মার্কেটিং প্রজেক্টে কাজ করছেন। খুব সকালে বেরিয়ে যান, রাতে ফিরেন।
***
জামিল ভাই ঘরে ঢুকে বললেন,
“খাবারের গন্ধে আরও বেশী খিদে পেয়েছে জরী। গোসল না করে খেতে বসলে কী দোষ হবে? ”
আমি হেসে বললাম,
“না দোষ হবে না। কিন্তু গোসল করে খেলে ভালো লাগবে আপনার ই।”
জামিল ভাই হেসে বললেন,
“ঠিক বলছ।”
জামিল ভাই খেতে বসে বললেন,
“আমার মেয়েরা খেয়েছে?”
“হ্যাঁ। আমি দুজনকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। ”
“আমি জানি, তবুও প্রশ্ন করলাম মেয়েদের খোঁজ নেবার জন্য। ”
আমি হাসলাম। জামিল ভাই অতি দ্রুত খাচ্ছেন। আমার ভীষণ মায়া লাগলো। এই মানুষ টা যে জীবন কাটাচ্ছে সেটাকে কী আসলে কোনো জীবন বলে! পরী আপা বলে, মানুষের জীবনে খারাপ ঘটে দুটো কারণে। এক আল্লাহ যখন ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়। দুই তার নিজ কর্মগুনে। জামিল ভাইয়ের জীবনের খারাপ সময়টুকু যেন সাময়িক থাকে। মেয়ে দুটোর কারনেও যেন সব ঠিক হয়।
জামিল ভাইকে আমি বললাম,
“আপনার মনির জন্য টেনশন হয় না? ”
“না জরী, আমার সবকিছু জুড়েই শুধু আমার দুই মেয়ে। ”
“আজ মামা বলছিলেন, ভাবী নাকি ভালো রাঁধতেন।”
“অতো ভালো না। তবে কিছু আইটেম খুব ভালো করতো। ”
জামিল ভাই খাওয়া শেষ করতে পারেন না। হাত ধুয়ে চলে যায়। আমি সব গুছিয়ে ঘরে যাই। জামাকাপড় ঘামে ভিজে বিশ্রী অবস্থা। ঘুমানোর পোশাক পাল্টে বিছানায় বসি সাবধানে। নাবিদের ঘুম টা যেন না ভাঙে। তবুও বালিশে মাথা দিতেই ও হাত বাড়িয়ে কাছে টানে।
“তুমি ঘুমাও নি?”
“না। ”
“টেনশনে?”
“মনে হয়। ”
আমি শব্দ করে হাসি। নাবিদ বলে,
“আমার টেনশনে তুমি হাসো।”
“আমাকে একটা কথা বলবে?”
“কি?”
“ভাবী কেন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন?”
“এই প্রশ্নের জবাব না দিলে কী সূর্য কয়েক ঘন্টা দেরি করে উঠবে?”
আমি আবারও হাসি শব্দ করে। নাবিদও হাসে।
নিজের হাসিতে চমকে উঠি। এই বাড়িতে কতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে! অথচ কোনো কিছুই থেমে নেই। বাড়িতে ভালো রান্না হলো, তৃপ্তি করে সবাই খেলো। এখন যে যার মতো ঘুমাচ্ছে। সত্যিই কারো জন্য সময় থমকে যায়। সবকিছু চলে নিয়মমাফিক।
***
মনির খোঁজ পাওয়া গেল দুদিন পর। মাদারিপুরের সস্তা এক হোটেল থেকে পুলিশ ধরেছে। মেছো ব্যটাও সঙ্গে ছিলো। পুলিশের কাছে পরিচয় দিয়েছে স্বামী, স্ত্রী। কিন্তু প্রমাণ দিতে পারে নি। মেছো লোকটা কয়েক ঘা পিটুনি খেয়ে মুখ খুলল। ওরা আসলে বিয়ে করে নি। বাড়ি থেকে যাবার সময় টাকা, পয়সা নিয়ে গেলেও বার্থ সার্টিফিকেট নিলো না। সেই কারণে বিয়ে আটকে গেছে।
মনি ফিরে এসে নির্লজ্জের মতো বলল,
“আম্মা তোমরা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো। অবশ্য আমাদের বিয়া আগে হইছে দুইবার। ”
আম্মাও প্রশ্ন করলেন,
“আগে কবে হইছে?”
“একবার মোবাইলে। শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আমরা দুইজন আল্লাহর কালাম পড়ে বিয়া করছি। আরেকবার মাদারিপুরে, আকাশ বাতাস সাক্ষী রাইখা। ”
আম্মা এতসব হজম করতে পারলেন না। প্রথমে জুতা তারপর ঝাড়ু,বালতি, পাতিল সবকিছু দিয়েই মারলেন। মারতে মারতে নিজেই ক্লান্ত হলো। এতো মার খাচ্ছে দেখে আমি গিয়েছিলাম ভালো মানুষের মতো ধরতে। আমিও দুটো খেলাম।
সপ্তাহ খানেক পর মেছো ব্যটার বাড়ি থেকে ফোন করলো আম্মার নাম্বারে। মেয়েটা নিজের পরিচয় দিলো। সে পাশা মিয়ার স্ত্রী শিল্পী আক্তার লাভলি। সে ম্যাট্রিক পাশ, তার একটা মেয়েও আছে, মেয়ে স্কুলে যায় না তবে আমপাড়া শিখতেছে। পাঁচটা সূরা তার মুখস্ত। ব্রেন ক্লিয়ার। সে চাচ্ছে তার স্বামী পাশা মিয়ার সাথে মনির বিয়ে হোক। সতীনের সংসার করতে তার আপত্তি নাই। আল্লাহ তারে অনেক টাকা, পয়সা না দিলেও বড় মন দিছে। মনিরে সে ছোট বোনের মতোই দেখবে।
মেছো লোকটার নামই পাশা মিয়া।
চলবে…