লাজুকপাতা

মাস পেরোনোর আগেই আমার রান্নাঘরে ঢোকার সৌভাগ্য হলো। আমাকে অবশ্য পরী আপা বুদ্ধি দিলো। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“জরী শোন, শ্বশুরবাড়ি মামাবাড়ি না। খেয়েদেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমানো ভালো কথা না। শাশুড়ী এখন কিছু বলছেন না মানে সবসময় ই চুপ করে থাকবে এমন না। তুই আগ বাড়িয়ে কাজ কর।”
আমি আগ বাড়িয়ে টুকটাক কাজ করতে লাগলাম। আলু,পিয়াজ, মরিচ টা কেটে দেই। বোতলে খাবার পানি ভরে রাখি। বিছানা, বালিশ গুলো ঝেড়েমুছে পরিস্কার করি। আম্মা অবশ্য প্রথমদিকে বললেন,
“থাক, তোমার কিছু করা লাগবে না। আর কয়টা দিন যাক। ”
তার গলার স্বরে মনে হয় বলার জন্যই বলা। আসলে সেও চায় আমি তাকে সাহায্য করি।
যেদিন প্রথম রান্নার সুযোগ পেলাম সেদিন আম্মা একটু অসুস্থ ছিলেন। সন্ধ্যে থেকে বিছানায় শুয়ে আছেন। আমিই গিয়ে বললাম,
“আম্মা আজকে আমি রান্না করি?”
আম্মা আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন,
“তুমি রাঁধতে পারো? আচ্ছা করো। আলু সেদ্ধ দাও, আর ভাত করো। আজ সবাই আলুভর্তা আর মরিচ ভর্তা খাবে। আমি রোজ রোজ পারি না।”
আমি তার কথার অবাধ্য হয়ে অনেক কিছু রান্না করে ফেললাম। আলু ভাজা, ঘন করে মসুর ডাল, পেপে দিয়ে মুরগিরর ঝোল, বেগুন দিয়ে একটা তরকারি।
খাবার টেবিলে আম্মা এত পদ দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন,
“এতকিছু তুমি রানলা? ক্যামনে পারলা!”
আমি হাসলাম। রান্নাটুকু হাতে ধরে মা আর চাচিমা’ই শিখিয়েছেন। শুধু রূপ দিয়ে কী আর সংসার চলে! তবে পরী আপা, নিরু আপাদের মতো সেলাই,ফোড়াই শেখার সুযোগ আমার হয় নি। আমি সেই সময় টা কাটাতাম বইয়ের সঙ্গে।
আমার রান্না করা খাবার খেয়ে নাবিদ প্রথমেই বলল,
“জরী রান্না করছে। ওর রান্নার হাত তো ভীষণ ভালো। মাঝেমধ্যে ওরে রাঁধতে দিও মা, তোমারও কষ্ট কম হবে আর আমাদেরও সুবিধা হবে।”
নাবিদের কথা আম্মার মন:পুত হলো না। তিনি আমার সামনে মুখ ফুলিয়ে কপাল কুঁচকে থাকলেও কিছু বললেন না। রান্নাঘরে থালাবাসনের আওয়াজে বুঝলাম যে জড়বস্তুর উপর দিয়েই রাগ টা ঝাড়ছেন।
আমার ননদ কুটিলা রান্না নিয়ে কিছু না বললেও জটিলা বলে ফেলল,
“তোমার রান্না ভালো হইছে ভাবী। মায়ের সামনে বলিনাই। মায়ের রান্নায় তো মাঝেমধ্যে হলুদ এতো দেয় যে মুখেও তোলা যায় না। তার চোপার ভয়ে আমরা তো কিছু বলিও না।”
মুক্তার কথার ধরনে আমি হেসে ফেললাম। ওর সঙ্গে আমার একটু একটু ভাব হচ্ছে৷ একমাস বাদেই ওর পরীক্ষা শুরু। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছে। অংক ভুলে যায়। সম্পাদ্য আঁকতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে অবস্থা একাকার। আমিই ওকে একটু দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করি। সেই সুবাদেই বোধহয় ও আমাকে একটু পছন্দ করে।
কুটিলা তার স্বভাবেই আছে। সে নিজের মতোই থাকে। এস এসসি দুইবার দিয়েও পাশ করতে পারে নি। প্রথমবার পাঁচ সাবজেক্টে ফেল করার পর দ্বিতীয়বার আবারও পরীক্ষায় বসানো হয়। সেইবার ছয় সাবজেক্টে ফেল করেছে। আম্মা এর পিছনে আর খরচ করতে চান না। ওরও পড়াশোনায় তেমন মন নেই। সাজগোজেই বেশী মন৷
***
দুপুরে খাবার পর সবাই ঘুমায়। টাপুর টুপুর কে অনেক কষ্টে ঘুমের অভ্যাস করিয়েছি। আগে নাকি ওরা ঘুমাতো। ভাবী যাওয়ার পর মেয়ে দুটো আরও বিচ্ছু হয়ে গেছে।
আমার ঘুম হয় না। নাবিদের বইগুলো থেকে বেছে বেছে কিছু বই পড়া হচ্ছে। আজ আর বই নিলাম না। বারান্দায় এমনিই বসলাম। গ্রিল গলে সোনালী রোদ পড়েছে। এই বছর শীতও মনে হয় বেশি দিন থাকবে।
বিয়ের এই একমাসে আমি নিজেকে অন্যরকম ভাবে আবিষ্কার করলাম। আমার মধ্যে এই ঘর, এই সংসারের মানুষ জনকে আপন করে নেয়ার তাড়না আছে। বাপের বাড়িতে আমি প্রায় একাই ছিলাম। অথচ এই বাড়ির মানুষজনের ভালোবাসা পাওয়ার লোভ জন্মে গেছে।
আর নাবিদ! সে এক অন্য মানুষ। আমার বিবাহিত বন্ধুদের কাছে স্বামীর ভালো, মন্দ যে গুণকীর্তন শুনেছি নাবিদ সেদিক থেকে একদম আলাদা। বিছানায় ঘুমানোর সময় মাঝখানে বেশ দূরত্ব থাকে। দুজনের কম্বলও আলাদা। তবুও প্রায় প্রতিদিনই আমার পায়ের কাছের কম্বল ঠিক করে দেয়। কি লাগবে না লাগবে সেদিকেও ভীষণ নজর। তবুও আমার মনে হয় কোথাও কোনো কিন্তু আছে। কিছু অংক সরল মনে হলেও মেলাতে পারি না।
আমার বিয়েটা আচমকা হয় নি। অনেক দিন ধরে কথাবার্তা চলছিল। টেস্ট পরীক্ষার পর চাচাজানের মাথায় ভুত চাপলো জরীর বিয়ে দিতে হবে। আমার মামাশ্বশুর তার পূর্বপরিচিত। তার মাধ্যমেই বিয়ের কথাবার্তা এগোয়। আমার ছবি পাঠানো হয়। ছবি দেখে সবাই পছন্দ করে। কথা হয় একদিন দেখতে আসবে। সব আয়োজন ঠিকঠাক, মা চাচিরা পিঠা বানাচ্ছেন, ঘর গোছাচ্ছেন। এই বৈঠকেই বিয়ে হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু আসার দুদিন আগেই জানান যে তারা আসতে পারবে না। একটু সমস্যা আছে। কিছুদিন পর জানানো হয় যে ছেলের একটু সময় লাগবে। চাকরি তো বেশীদিন না, হাতে আরও একটু পয়সাপাতি জমুক।
চাচাজান একটু নরম হলেন। আমার পরীক্ষা পর্যন্ত চুপই ছিলেন৷ পরীক্ষার পর আবারও বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। নাবিদ দের ওখান থেকে সরাসরি কিছু বলে না। অন্য জায়গায় সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে। এরমধ্যে আমার মামাশ্বশুর গিয়ে জানালেন যে তার ভাগ্নের জন্য এই মেয়েই চাই।
আমাকে সেদিন মুক্তাও বলল,
“মায়ের ইচ্ছে ছিলো শহুরে মেয়ে আনার। কিন্তু ছোট্ট ভাই বলল জরীর সঙ্গে বিয়ে না হইলে সে আর কাউকেই বিয়ে করবে না। ”

চলবে….

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.