অফিডিয়ান

৬০. আহমেদ ভিলায় শোকের মাতম বইছে৷ আশ পাশ থেকে অনেক অনেক লোক জড় হয়েছে ইশতিয়াক আহমেদের বাড়িতে৷ পুলিশ সমস্ত জঙ্গল সার্চ করে বেড়াচ্ছে। খবর পেয়ে সাফওয়ানের কলিগ রা ও সব চলে এসেছে কলেজ থেকে। অনেক স্টুডেন্ট ও ভিড় জমিয়েছে আহমেদ ভিলায়৷

রুনিয়া হলরুমের মেঝেতে বসে বুক চাপড়ে হাহাকার করে কাদছেন। তার সাফওয়ান, তার নাড়িছেড়া ধন, তার প্রথম সন্তান সাফওয়ান নেই! তাকে কারা জানি মেরে ধরে নিয়ে চলে গিয়েছে কোথায়!

রুনিয়ার পাশে বসে আয়েশা সহ অন্যান্য আরও কিছু মহিলা রুনিয়া কে সামলাচ্ছেন। আয়েশা নিজেও কাদছেন। প্রথমে তার মেয়ে টা হারালো এখন তার মেয়ের জামাই টা ও নেই। নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা!

ওদের পাশে সোফায় বসে আছেন ইশতিয়াক। ছেলের শোকে তার বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে ঝড়ের প্রচন্ডতা তার মুখের ওপর স্পষ্ট হয়ে আছে৷ চোখ মুখ শক্ত করে তিনি সামলে রেখেছেন নিজেকে, নইলে যে তার স্ত্রী সন্তান কে সামলাতে পারবেন না৷

ইশতিয়াকের পাশে তার পিঠের ওপর হাত রেখে শামসুল বসে আছেন। তার প্রাণের রুমির হাসি মুখ টা বার বার ভেসে উঠছে তার মানস্পটে।
তাদের পরিবারের ওপর কোন শকুনের নজর পড়েছে সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না শামসুল। কোন পাপের কারণে আজ তাদের দুই পরিবারের এমন বিচ্ছিন্ন অবস্থা তা তিনি ঠাহর করতে পারছেন না৷

শাফিন বসে আছে বাবার অন্য পাশে। রাফসান ধরে রেখেছে ওকে৷ দূর থেকে প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের মাটিতে পড়ে যাওয়া নিথর দেহ দেখার পর থেকে আর ঠিক নেই ও৷

গতকাল রাতে সাফওয়ান ওকে পালাতে বলার পর ও ছুটে পালিয়ে যায়, কিন্তু একেবারে চলে যায় না। ওই লোক গুলোর থেকে একটা নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে ও। ভাইকে একা ছাড়ার সাহস ওর হয় না। কিন্তু ওরা সাফওয়ান কে শ্যুট করার পরই শাফিন দিশেহারা হয়ে ছুটে যায় বাড়ির দিকে, সাহায্য পাবার আশায়।
রাফসান জঙ্গলের ডোবার কাছটাতে দাঁড়িয়ে ছিলো সাফওয়ানের অপেক্ষায়। কিন্তু শাফিন কে এইভাবে ছুটে আসতে দেখে ও শাফিনের দিকে এগিয়ে আসে।

কিন্তু, শাফিন এর পর যা বলে তা শুনে ওর আত্মা ঠান্ডা হয়ে যায়। ওই অচেনা লোকগুলোর সাথে পেরে উঠবে না জেনেও দুজনেই ছুটে যায় সাফওয়ান কে বাচানোর শেষ চেষ্টা করতে। কিন্তু গিয়ে কোনো লাভ হয়না।
ওরা যাওয়ার আগেই সেই অচেনা লোক গুলো সাফওয়ান কে নিয়ে একদম হাওয়া হয়ে যায় যেন। শুধু রেখে যায় তাদের কিছু লোকেদের দ্বিখণ্ডিত লাশ।

লাশ গুলো পুলিশ খুজে পেয়েছে, সেগুলো পোস্টমর্টেম এর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে৷ লাশ গুলোর একটাও দেশি নয়, সবাই বিদেশি। তাদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি, যার কারণে তারা কোন দেশ থেকে এসেছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।

পুলিশ ধারণা করছে যারা সাফওয়ান আহমেদ কে নিয়ে গেছে তারা হয়তো রুমাইশা কাদের কে ও নিয়ে গেছে৷
এ কারণে রুমাইশা আর সাফওয়ানের নিখোজ মামলা এখন ইন্টারন্যাশনাল মামলা তে পরিণত হয়েছে। যশোর আদালত থেকে সেটা ঢাকা সেন্ট্রাল হাইকোর্টে চালান করা হয়েছে। পরিস্থিতি ঠিক কি দাঁড়াবে তা কেউ ধারণা করতে পারছে না।

৬১. আহমেদ ভিলা এখন পুলিশ, বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সহ সাধারণ জনগনের কারণে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে৷ কারণ সাফওয়ান যে স্বাভাবিক কেউ ছিলো না সেটা জানাজানি হয়ে গেছে৷

গতকাল ঢাকা থেকে একদল পুলিশ ফোর্স এসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইশতিয়াকের পরিবারের সবাইকে। এক বিন্দু পরিমাণ সত্যি ও গোপন করতে নিষেধ করেছে তারা, কারণ সাফওয়ান কে খুজতে হলে তাদের সব সত্য জানা প্রয়োজন৷ কোনো একটা তিল পরিমাণ তথ্য মিসিং হলেও তাদের পক্ষে সাফওয়ান কে খুজে পাওয়া টাফ হবে৷

আর তাদের কথা শুনেই রুনিয়া আর ইশতিয়াক সাফওয়ান এর ব্যাপারে সব সত্য বলতে রাজি হয়ে যান, শাফিন আর রাফসানের জোরালো বারণ সত্বেও।

কিন্তু রুনিয়া আর ইশতিয়াক পুলিশ ফোর্স টা কে সাফওয়ানের শারীরিক কান্ডিশনের কথা বলার আগে বলে নিয়েছিলেন, যে ব্যাপার টা খুবই গোপন, এবং এই কথা টা যেন শুধুমাত্র যাদের না জানালে নয় তাদের কেই জানানো হয়।
স্পেশাল ফোর্স ও ইশতিয়াকের কথায় সম্মতও হয়েছিলো। কিন্তু তাদের ভেতর থেকেই কোনো এক বিশ্বাসঘাতক টাকার লোভে এই গোপনীয় খবর টা সংবাদ মাধ্যমের কাছে জানিয়ে দিয়েছে। আর সেটা নিয়েই পুরো দেশ জুড়ে হচ্ছে তোলপাড়!

আর এখন এম এম কলেজের শিক্ষকগণ সহ, শিক্ষার্থীরাও জেনে গেছে তাদের সাফওয়ান স্যার কেন ওমন ভাবে চোখ মুখ ঢেকে চলা ফেরা করতো, আর কেনই বা সশরীরে ক্লাস না নিয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া কেই বেছে নিয়েছিলো। চারদিকে সাফওয়ান কে নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে সাফওয়ানের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে রুমাইশা কে নিয়েও জল্পনা কল্পনার শেষ হচ্ছে না৷

কিন্তু পাবলিক তখনও জানতো না যে সাফওয়ান ভেনোমাস, এবং তার দাঁতের ভেনোম বিশ্বের সবচাইতে বিষাক্ত ভেনোম গুলোর একটা। এই খবর টা চাপাই ছিলো। কিন্তু, বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ফোর্স সাফওয়ানের ব্যাপারে ভালো ভাবে খোজ খবর নিতে সিঙ্গাপুরে যোগাযোগ করে।
আর তারপর খোজ খবর নিতে নিতে তারা একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়, যে সাফওয়ান একাডেমিকালি বোটানি নিয়ে পড়াশোনা করলেও পার্সোনালি তার রেপটাইল নিয়ে ও ছিলো ব্যাপক পড়াশোনা। সেই সাথে সে একজন কেমিস্ট, যে খবর হাতে গোনা কয়েক জন ছাড়া আর কেউই জানতো না। ইভেন তার সেখানে নিজস্ব ল্যাব ও ছিলো৷

আর এরপর আর ও খোজ খবর নিতে গিয়েই বেরিয়ে আসে সাফওয়ানের সেই ভয়ঙ্কর তথ্য। সাফওয়ান একজন প্রফেশনাল হিটম্যান, এবং তার কিলিং স্টাইল হলো বডি পার্টস টেনে, ছিড়ে বা কেটে আলাদা করে ফেলা নয়তো চরম বিষাক্ত ভেনমের ব্যাবহার; যে ভেনম শুধুমাত্র তার নিজের শরীরেই পাওয়া যায়। এ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এই ভেনমের কোনো অস্তিত্ব নেই।

খবর টা জানামাত্রই সন্দেহবসত তারা যশোর পুলিশ ফোর্সের সাথে যোগাযোগ করে, এটা জানার জন্য, যে বডি পার্টস ছিড়ে বা কেটে যশোরে কোনো একজনের ও মৃত্যু হয়েছে কিনা!
এরপর যশোর পুলিশ ফোর্স যখন তাদের কে নিউজ দেয়, যে প্রায় মাসখানেক আগে ঝিকরগাছা ছাড়িয়ে পুবালির জঙ্গলের ভেতরে এরকমই বিভৎস রকমের বেশ কয়েক টা লাশ তারা উদ্ধার করেছিলো।
লাশ গুলোর সবার দেহই প্রায় দ্বিখণ্ডিত ছিলো। তার ভেতর থেকে একজনের গলার নলি ছিলো না৷ এ ছাড়া, তার ও প্রায় মাস পাঁচেক আগে যশোরের সাড়াপোলের মাঠের ভেতর এরকমই দুইটা লাশ পাওয়া যায় যাদের শরীর থেকে হাত, পা, জিহবা সহ আর ও কিছু পার্টস ছিড়ে ফেলা হয়েছিলো।

আর এ খবর শোনা মাত্রই স্পেশাল পুলিশ ফোর্স বুঝে যায় এই কাজ গুলো কার৷ এরপর তারা দেশের বাকি সমস্ত জেলাতেও খোজ নিতে থাকে এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু কারো হয়েছে কিনা৷ কিন্তু অন্যান্য জায়গা থেকে নেগেটিভ উত্তর আসে৷

স্পেশাল পুলিশ ফোর্স নিশ্চিত হয়, যে সাফওয়ান অন্য কোথাও হত্যা যজ্ঞ চালায়নি। কিন্তু এ খবর টা গোপন রাখতে চাইলেও সেটাও আর চাপা থাকে না৷ স্পেশাল ফোর্সেরই কেউ একজন আবার ও এই গোপন খবর টা পাবলিক করে দেয়, আর কিছুদিনের ভেতরেই এই বিভৎস তথ্য টা সারাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যায়৷ আর এরপর ই শুরু হয় যাবতীয় অসুবিধা।

যেখানে যে কোনো মূল্যে সাফওয়ান কে উদ্ধার করে দেশে ফেরত নিয়ে আসার যথাসম্ভব ব্যাবস্থা করা হচ্ছিলো, সেখানে মানুষ এখন সাফওয়ান কে মোটেও দেশে দেখতে চায় না।
এমন একজন প্রফেশনাল মার্ডারার, সাধারণ মানুষের জন্য মারাত্মক বিপদজনক কাউকে তারা দেশের ভেতর আনতে চায় না। তাদের মতে সাফওয়ান কে যারা এ দেশ থেকে তুলে নিয়ে গেছে তারা ভালো কাজই করেছে। এরকম কাউকে তো বাচিয়ে রাখাই উচিত না।

শাফিন, ইশতিয়াক বা রুনিয়া, কেউই বাসা থেকে বের হতে পারছে না। বের হলেই মানুষ তাদের কে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলছে। সাংবাদিক গুলো তক্কে তক্কে থাকছে সবসময়। এ বাড়ির কাউকে দেখলেই ক্যামেরা নিয়ে হামলে পড়ছে। এমনকি কাজের খালা কেও তারা ছাড়ছে না। বাধ্য হয়ে কাজের খালা তার কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে দেশের বাড়িতে।

আয়েশা শামসুল ও স্বস্তি তে নেই। এলাকার মানুষ নিউজে রুমাইশা কে দেখার পর থেকেই বিভিন্ন ভাবে তারা রুমাইশা সহ সাফওয়ান কে জড়িয়ে নানা কটু কথা শোনাচ্ছে। আর সাফওয়ানের মতো এমন বিপদজনক কারো সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়া নিয়ে শামসুল কে প্রতিনিয়ত কথা শোনাচ্ছে মানুষ। লোকটা যে মেয়ে জামাইয়ের শোকে পাগলপ্রায় সে কথা কারো মাথাতে আসছে না৷
রাফসান আবার রাজশাহীতেই ফিরে গেছে। চারপাশের এত চাপ ও আর নিতে পারছে না৷

সাফওয়ানের সাথে সাথে রুমাইশা কে খোজার চেষ্টা ও বাদ দিয়েছে পুলিশ। সে যে নির্দোষ সে কথা কারো মাথাতেই আসছে না। দেশবাসী ও এই বিষয় নিয়ে উচ্চ বাচ্য করছে না।
রাজশাহী তে ফিরে যাওয়ার আগে রাফসান শামসুলের সাথে থানায় ধর্ণা দিয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ, কিন্তু পুলিশ কোনো ধরনের কোনো স্টেপ নিতে পারবে না বলেছে৷ রাফসান এতবার করে তাদের বোঝাতে চেয়েছে যে রুমাইশা নির্দোষ, আর সে দেশেও থাকতে পারে, পুলিশ যেন তাকে অন্তত খুজে বের করার চেষ্টা করে, কিন্তু কেউই তার কথা শুনতে রাজি নয়। ক্ষোভে দুঃখে তাই আবার রাজশাহী তে ফিরে গেছে রাফসান।

রুমাইশা হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর রুমাইশার ভিসা হয়েছিলো, সেই ভিসার কাগজপত্র আর রুমাইশার পাসপোর্ট টা নিজের সাথে করে নিয়ে গেছে ও। রুমি কে ও একাই খুজবে, ওর কারো প্রয়োজন হবে না, সেই মনস্থির করেই ও ফিরে গিয়েছে।

আহমেদ ভিলায় রুনিয়া কান্নাকাটি করতে করতে চোখের পানি প্রায় শুকিয়ে ফেলেছেন। এর আগে ছেলে কে ফিরে পাওয়ার যা একটু আশা ছিলো সেটাও এই দেশের মানুষের জন্য বরবাদ হয়ে গেলো। নিজের সন্তান কে চাইলেও আর কখনো দেখতে পারবেন না ভেবে সারাটা দিন কান্না করে করে জায়নামাজ ভেজাচ্ছেন তিনি, আর মহান আল্লাহর কাছে নিজের গর্ভের সন্তান কে ফিরে পাওয়ার জন্য ফরিয়াদ করছেন৷

ইশতিয়াক আহমেদ মাঝে মাঝে এসে স্ত্রীকে স্বান্তনা দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি নিজেও ভেঙে পড়েছেন বলতে গেলে। সাফওয়ান তাদের প্রথম সন্তান, তাদের ভালোবাসার চিহ্ন, যাকে পেতে গিয়ে কতই না কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে আর তার স্ত্রী কে, সেসব কিছুই ভোলননি ইশতিয়াক।

সাফওয়ান কে জন্ম দিতে গিয়ে রুনিয়ার সেই মরমর অবস্থার কথা আজ ও ইশতিয়াকের মাথার ভেতর ঠোক্কর খায়। আর আজ তাদের সেই বিপুল সাধনায় প্রাপ্ত সন্তান কে ফিরে পাওয়ার জন্য আবার ও কতই না সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

শাফিনের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে কিছুদিন আগে থেকে। কিন্তু এতসব বিপদের ভেতর দিয়ে জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ফেজ পার করা ওর জন্য খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷
নিজের প্রাণপ্রিয় ভাই, সেই সাথে তার অতি আদুরে রুমি আপু, দুজনকেই হারিয়ে শাফিন যেন একটা ঘোরের ভেতর থাকছে সবসময়। রোবটের মতো নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম গুলো শেষ করছে ও আজকাল। অনুভূতি শূন্য মানুষের মতো রাস্তা দিয়ে হাটে ও। খাওয়ার সময় কোনোরকমে দুইটা খেয়ে সারাদিন রাত বইএর ভেতর ডুবে থাকে৷ খুব প্রয়োজন ছাড়া রুম থেকে বেরও হয় না৷

মায়ের সান্নিধ্যের খুব প্রয়োজন ওর এখন, কিন্তু তার মা নিজেই ছেলের শোকে দিনাতিপাত করছেন। তাই শাফিন চাইলেও মায়ের ভালোবাসার পরশ টা পাচ্ছে না। আর বাবার ওই কষ্ট ভরা মুখের দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না। বাবার দিকে তাকালেই চোখ ফেটে ওর পানি আসতে চায় প্রতিবার।
রাফসান ভাইয়া ও এসব থেকে দূরে থাকতে আর নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে রাজশাহী তে চলে গেছে। কষ্টের কথা গুলো বলার মতো আর কেউ রইলো না ওর। নিজের ঘরে বসে নিরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া ওর আর কিছুই করার নেই।

৬১. আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস স্টেটস এর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনের ল্যাবের একটি সিক্রেট রুমে স্ট্রেচারের ওপর ঘুমিয়ে আছে সাফওয়ান। ওর হাত, পা সহ দেহের আর ও কিছু অংশ ধাতব চেইন দিয়ে বেধে রাখা স্ট্রেচারের সাথে। শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন। ঠোটের ডান পাশ টার খানিক টা কেটে গেছে, সেখানের রক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে৷
হাতের উপরিভাগের আঙুলের সন্ধিস্থল গুলো রক্তাক্ত। আর স্ট্রেচারের পাশের দেয়াল জুড়ে হাতের মুষ্টিবদ্ধ ঘুষির রক্তের ছাপ। গত দেড়টা মাস ধরে এখানেই বন্দি করে রাখা হয়েছে তাকে৷

ঘুমন্ত সাফওয়ানের বুক ওঠানামা করছে নিঃশ্বাস এর তালে তালে৷ ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েক জন ডাক্তার আর গবেষক। তারা নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে সাফওয়ান কে নিয়ে কথা বলছে।
তাদের মধ্য থেকে মাইকেল নামের এক গবেষক বলে উঠলো,
— হারবার্ট যা চাইছে তা বাস্তবায়ন করতে গেলে ছেলেটাকে মেরে ফেলতে হবে। কিন্তু একে মেরে ফেললে আমরা একে নিয়ে রিসার্চ করতে পারবো না। আবার একে নিয়ে রিসার্চ করতে গেলে হারবার্ট যা চায় তা পাবে না৷ তাহলে আমাদের এখন করণিয় কি?

মাইকেলের প্রশ্নে বাকিরা চুপ করে থাকলো কিছুক্ষন। অত:পর জর্জ নামের অন্য এক ডাক্তার বলে উঠলো,
— এই ছেলে টাকে হারবার্ট আমাদের কাছে পৌছে দিয়েছে যেহেতু, সেহেতু তার কাজটাই আমাদের আগে করতে হবে। আর এরপর আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ছেলেটাকে বাচিয়ে রাখার। সে যদি বেচে থাকে তবে আমরা তার ওপর রিচার্স করবো নইলে করবো না। আমরা হারবার্টের ওপর দিয়ে কিছু করতে গেলে সেটা হবে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতো। ছেলেটা তো মারা পড়বেই, সাথে সাথে আমরাও মারা পড়বো।

জর্জের কথায় মাইকেল আবারও বলে উঠলো,
— তাই বলে এমন রেয়ার কন্ডিশনের কাউকে আমরা কিছুই না করে এমনিতেই মেরে ফেলবো! এমন অভাবনীয় এক সৃষ্টিকে আমরা একটু যাচাই করে দেখবো না? সে একটা হাইব্রিড। আমরা যদি তার ওপর রিসার্চ করতে পারি, আর তার এই হাইব্রিডাইজেশনের ভেতরের রহস্য বের করতে পারি, তবে আমরা অবশ্যই নোবেল জিতবো।
কিন্তু হারবার্ট যা চায় তা করার জন্য ছেলেটার বিষগ্রন্থি থেকে বিষ বের করে ফেলতে হবে সব৷ এতে তো ছেলেটার মৃত্যু নিশ্চিত! কারণ এটা তার শরীরেরই একটা অংশ, এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ!

মাইকেল, জর্জ আর অন্যান্যদের ভেতরে আর ও খানিক সময় হারবার্ট এর চাহিদা, আর তাদের রিসার্চ নিয়ে আলোচনা হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো হারবার্টের কথাই শুনতে হবে৷ নইলে তাদের নোবেল যেমন তেমন, প্রাণ টাই হাত ফসকে বেরিয়ে যাবে৷ যা তারা কেউই চায়না৷ নিজেদের লাইফ রিস্কে রেখে কেউ রিসার্চ করবে না। একমাত্র মাইকেল লোকটার সাফওয়ানের প্রতি একটু মায়া হলো। সে চাইছে না এমন রেয়ার কন্ডিশিনের, এমন হ্যান্ডসাম ড্যুড কে মেরে ফেলতে।

কিন্তু তার হাতে কোনো উপায় নেই। কারণ হারবার্ট খুবই নামকরা আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়া কিং, যার হয়ে এক সময় কাজ করেছে সাফওয়ান৷ যে খুব ভালোভাবেই জানতো সাফওয়ানের এই কন্ডিশন সম্পর্কে।
আর তার নির্দেশেই সাফওয়ান কে দেশ থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে, শুধুমাত্র ওর ভেনমের জন্য, যার এক মিলিগ্রামের মূল্য বিশ্ব বাজারে এক বিলিয়নের কাছাকাছি। আর সাফওয়ানের বিষগ্রন্থী থেকে একেবারে সব বিষ বের করলে প্রায় আড়াইশো গ্রামের মতো ভেনম পাওয়া যাবে৷ যা দিয়ে অনায়াসেই হারবার্ট বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনীদের কাতারে নাম লেখাতে পারবে৷

ঘুমন্ত সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাইকেল৷ তারপর সাফওয়ান কে ওইভাবে রেখেই চলে গেলো তারা সবাই।
সাফওয়ান কে সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে, যার প্রভাবে চব্বিশ ঘন্টার ভেতর আর ঘুম থেকে উঠবে না সাফওয়ান৷ আগামী সপ্তাহেই হারবার্টের দেওয়া কাজ সম্পন্ন কর‍তে হবে তাদের। তাই সময় নষ্ট না করে কাজ টা কিভাবে করবে সেই মিটিংয়ে অংশ নিলো সবাই।

৬২. সাফওয়ান নিখোজের প্রায় দুই মাস৷ শাফিনের পরীক্ষা শেষ হয়েছে পনেরো দিনের মতো। কিন্তু ওর ভেতরে কোনো বিকার নেই, নির্বিকার হয়ে গেছে ও পুরো৷ পরিবার ছাড়া আর কারো সাথেই কোনো প্রকার কথা হয় না ওর৷ মাঝে মাঝে রাফসান এর সাথে কথা হয়, কিন্তু সেটাও খুব কম।

রুনিয়া এখন আগের থেকে স্বাভাবিক আছেন, কান্নাকাটি করেন না, কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে গেছেন একদম। সাফওয়ান কে হারানোর পর থেকে ওনার মুখে আর হাসি ফুটেনি। ইশতিয়াকের ও তাই৷ সাফওয়ান নিজের সাথে যেন পুরো পরিবারের আনন্দ, হাসি, কান্না সব নিয়ে চলে গেছে৷

শাফিন রাতের অন্ধকারে রুমাইশা কে আর ও কয়েকবার খোজার চেষ্টা করেছে উত্তরের জঙ্গলের ভেতর। কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। রুমাইশা কে কোথাও পায়নি ও৷ রুমাইশা কে পেলেও হয়তো ওর বাবা মায়ের, আর মামা মামির কষ্ট একটু হলেও কমতো; কিন্তু দুর্ভাগ্য!

রাত অনেক হলেও শাফিনের ঘুম আসছিলো না। ও বসে ছিলো ওর ঘরের ভেতর। কিন্তু মানসিক অশান্তি তাড়া করছিলো ওকে। তাই মন টাকে শান্ত করার জন্য ও ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ভাইয়ের চিলেকোঠার কামরা টা একবার একটু দেখে আসবে, তাহলে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়!

চেয়ার ছেড়ে উঠে রুম থেকে বের হলো শাফিন৷ তারপর সইড়ি বেয়ে ছাদে উঠলো ও৷ চিলেকোঠার এ কামরায় বাতি জ্বলে না কতকাল তার হিসাব নেই। কেমন যেন ভুতুড়ে একটা আবহাওয়া বিরাজ করছে পুরো ছাদ জুড়ে। শাফিন গিয়ে বসলো ছাদের রেলিঙের ওপর৷

তারপর ছাদের মেঝের দিকে তাকিয়ে ও কল্পনার চোখে দেখতে পেলো, ওর বিশালদেহী, ফোলা ফোলা শক্ত পেশিযুক্ত সাফওয়ান ভাইয়া, আর তার পাশে খুব আদুরে, তার সাফওয়ান ভাইয়ার বুক পাজরের নিম্নাংশ ছুইছুই রুমি আপুর খুনশুটি; রুমি আপুর ওই খিলখিল হাসি, সাফওয়ান ভাইয়ার সেই জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে রুমির দিকে প্রেমপূর্ণ চাহনি; সব যেন শাফিনের চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে লাগলো। সব এখন অতীত স্মৃতি,

চোখে ফেটে পানি এলো শাফিনের। চিলেকোঠার রুমের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো ও৷ তারপর তাকালো বাড়ির পেছনের অন্ধাকারে নিমজ্জিত ঘন জঙ্গলের দিকে। আর সেদিকে কিছুক্ষণ খেয়াল করে তাকানোর পরই চমকে গেলো শাফিন।

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.