অফিডিয়ান

১০৬. নিজের কেবিনে কাগজ পত্রের ভিড়ে বসে আছেন আহনাফ হাসান, তার বিপরীতে টেবিলের অন্য পাশে চেয়ারে বসে আছে কবির৷ সংবাদ সম্মেলনের জন্য সাংবাদিক দের সময় দেওয়া হয়েছে বেলা এগারোটা। এখন আট টা বেজে চল্লিশ মিনিট৷

কাল রাত থেকে দুজনে থানাতেই আছেন তারা। কেইস টাকে কিভাবে সাজালে কিভাবে উপস্থাপন করলে জনগন ব্যাপার টা বুঝবে সেই চেষ্টাই করে গেছেন সারা রাত দুজনে মিলে। বর্তমানে গভীর মনোযোগ দিয়ে নিজেদের লেখা গুলো আবার ও পড়ছেন আহনাফ হাসান আর কবির। কোথাও কোনো গলদ থেকে গেলে যেন সেটা ঠিক ঠাক করে নিতে পারেন৷

আহনাফ হাসান কাগজের লেখা গুলো পড়া শেষ করে সে গুলো টেবিলের একপাশে রেখে দিয়ে, চোখের চশমা টা খুলে চোখ ডললেন কিছুক্ষন। সারারাত না ঘুমানোর কারণে এখন চোখের ভেতর জ্বালা করছে তার, যদিও শেষ রাতের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিলো দুজনেরই, কিন্তু আযান শুনতেই আবার উঠে পড়েছিলেন৷

চশমা টা খুলে টেবিলের ওপর ভাজ করে রেখে দিয়ে আহনাফ হাসান কবির কে বললেন,
— আমাদের দেশের মানুষের সমস্যা কি জানো কবির? আমরা মানুষের কদর করতে বুঝিনা। আমরা আবেগে পথ চলি, ভালো মন্দ না বুঝেই এক এক ডিসিশন নিয়ে ফেলি, কোনো ইফেক্টের তোয়াক্কা করিনা! আর এইকারণেই আমাদের দেশ থেকে দেশ রত্ন গুলো হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে৷ আর সেখানে গিয়ে ঠিকই তারা কদর পাচ্ছে। হিসেব করে দেখো, কত গুলো মেধাবী বাংলাদেশে থাকে! সবাই বাইরের দেশে গিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যাস্ত। ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু অধিকাংশই বাইরে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা নিয়েই আগায়, কারণ এ দেশে না চাকরির পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা আছে, আর না মানুষের কদর। আমরা যদি কদর করতে জানতাম তাহলে হয়তো সেই সমস্ত জেম গুলো আজ আমাদের দেশেই থাকতো। সাফওয়ান আহমেদ কে ই দেখো! সে দেশে ফিরেছিলো ঠিকই, কিন্তু মানুষ তার কদর করলো না, অথচ সে বাইরের দেশে গিয়ে নিজের একটা কোম্পানি খুলে ফেললো। ওই কোম্পানি টা যদি আজ এ দেশে হতো তাহলে আমরা ঔষধ খাতে কত লাভই না করতাম! আমাদের দেশ টাকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারতাম ওই কোম্পানি টার মাধ্যমে।

আহনাফ হাসানের কথায় কবির বলল,
— আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। আমরা মানুষের কদর করতে জানিনা। আমাদের আজকের সংবাদ সম্মেলনের পর ও দেখবেন কিছু মানুষ তখনও সাফওয়ান আহমেদের বিরুদ্ধে কথা বলবে। তার ভালো দিক গুলো কারো নজরেই পড়বে না, সবাই তার পাস্ট নিয়ে পড়ে থাকবে। ওপর ওয়ালার কাছে দুয়া করি তিনি যেন সব ভালোয় ভালোয় ঠিকঠাক করে দেন!

আহনাফ হাসান কবিরের কথার প্রতিউত্তরে আমিন’ বলে আবার কাগজপত্রের দিকে মনোযোগ দিলেন।
.

সকাল বেলা উঠে রান্নাবান্না করে এখন সবাইকে খাবার দিচ্ছে রুমাইশা। সানিয়া টুকটাক হেল্প করে দিয়েছে। রুনিয়ার শরীরটা রাত থেকে খারাপ হয়েছে কিছুটা। তাই সকালে আর তাকে রান্না করতে দেয়নি রুমাইশা। একা একাই সব সামলে নিয়েছে৷

সাফওয়ান বাচ্চাদের কে টেবিলে বসিয়ে নিজেও বসেছে। রাশা মেঝেতে খেলা করে বেড়াচ্ছে। টুক টুক করে সে উঠে দাড়াচ্ছে মাঝে মাঝে, হাটার চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে না। সাফওয়ান খাওয়ার ফাকে ফাকে তার ছোট্ট আম্মাজান টার এই বিশাল ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে, আর মাঝে মাঝে রুমাইশার দিকে তাকাচ্ছে মেয়ের এই প্রোগ্রেস দেখানোর জন্য। কিন্তু রুমাইশা সাফওয়ানের দিকে খেয়াল দিচ্ছে না।

রুমাইশা নিজেও মেয়ের হাটার প্রচেষ্টা দেখছে, দেখছে যেন মাতবারি করতে গিয়ে পড়ে না যায়! সবাইকে খাবার দিয়ে নিজেও সাফওয়ানের বিপরীতে চেয়ার টেনে বসলো রুমাইশা। বসতেই সাফওয়ানের দিকে চোখ গেলো ওর। সাফওয়ান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে৷ রুমাইশা তাকাতেই সাফওয়ান ঠোঁট টিপে অদ্ভুত সুন্দর করে হাসলো। রুমাইশা সাফওয়ানের এমম হাসি দেখে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো হাসির কারণ। সাফওয়ান চোখের ইশারায় রাশা কে দেখালো। রাশা এখন কোনো কিছুর সাহায্য ছাড়াই স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর রুমাইশা তাকাতেই কাঁপা কাঁপা পায়ে এক কদম বাড়ালো ও৷

রুমাইশা অভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। চোখে ওর মুগ্ধতা ফুটে উঠলো নিমিষেই। সন্তানের প্রথম পা ফেলানোর অনুভূতি পিতা মাতার কাছে সর্বদাই রোমাঞ্চকর! রুমাইশা আর সাফওয়ান কে খাওয়া থামিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাফিন ও তাকালো ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে, আর রাশা কে পা ফেলতে দেখেই হৈহৈ করে উঠলো ও,
— আরে! আমার আম্মা দেখি হাটে! ওরে সর্বনাশ!

শাফিনের হঠাৎ চিৎকারে রাশা চমকে উঠে নিজের ব্যালান্স হারিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো মেঝেতে, তা দেখে সবাই হেসে কুটি কুটি হলো। হাসির মাঝেই ইশতিয়াক আহমেদ রুমাইশা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
— রুমি মা, তুই যখন রাশার মতো ছিলি তখন যতটুকু সময় সাফওয়ান তোর আশেপাশে থাকতো সারাটাক্ষণ শুধু তোর পিছে পিছেই ঘুরতো, তুই পড়ে যাস কিনা সেই ভয়ে। আর যদি বাই চান্স পড়ে যেতি তাহলে আবার তোর দুইহাত ধরে টেনে তোরে দাড় করিয়ে দিতো সাথে সাথেই!

রুনিয়া পাশ থেকে বলে উঠলেন,
— তাহলে শোনো, একদিন সাফওয়ান ওকে হাটানোর প্রাকটিস করাতে করাতে আমাকে এসে বলছে, আচ্ছা মা, এই রিমু টা এত আস্তে হাটে কেন? ওর মোটে পা চলেই না, মামি ওকে সারাদিন চেপে চেপে খাওয়ায় বলে ও মনে হয় মোটা হয়ে গেছে, তাই ও এতো স্লো, হাটতে পারে না জোরে। মামিকে বলে দিবা ওকে যেন কম কম খাওয়ায়।

বলেই রুনিয়া খিলখিল করে হাসলেন। শাফিন রুমাইশার দিকে তাকিয়ে মুখে হাত চেপে হাসতে লাগলো। তারপর রুনিয়া কে জিজ্ঞেস করলো,
— ছোটবেলায় ভাইয়া সারাক্ষণ রুমি আপুর পিছে লেগে থাকতো মা?

রুনিয়া বললেন,
— তা না তো কি! রুমি দুষ্টামি করলেও ওর জ্বালায় রুমি কে কিচ্ছু বলা যেত না! একবার, রুমি তখন তিন বছরে, আয়েশা রুমি কে দুটো চড় দিছিলো পাছায়, খাবারের বাটি রাগ করে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার অপরাধে! আর চড় দিবি না দিবি সাফওয়ানের সামনেই! সাফওয়ান সেবার সিক্সে উঠেছে, ও তখন স্কুল থেকেই ফিরছিলো। আর রুমিও ছিলো ভাইয়ের আহলাদি! কেউ কিছু বললেই গিয়ে সাফওয়ানের কাছে নালিশ দিতো, কথা তো তখনও স্পষ্ট না, কোনো রকমে যা বলতো তা সাফওয়ান ঠিকই বুঝে যেতো। তো আয়েশা ওকে মেরেছে, যখন মেরেছে তখন কিন্তু ও কাদেনি, যেই দেখেছে সাফওয়ান দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, অমনি আকাশ বাতাশ কাপিয়ে চিৎকার জুড়ে দিছে! আর কাদতে কাদতে ছুটে গিয়ে সাফওয়ানের হাটু জড়িয়ে ধরে বলছে যে, বাইয়্যা, মা আমালে মালিতে! এই পর্যন্ত তো ঠিক ছিলো, এবার দেখি, ওর পেছনে যে আয়েশার চড় গুলো খুব লেগেছে সেটা প্রমাণ করার জন্য আবার প্যান্ট খুলে পাছাও দেখাচ্ছে কি সুন্দর করে। আমি আর আয়েশা হেসে বাচিনা! আর এইবার সাফওয়ান তো আয়েশাকে মেজাজ দেখাচ্ছে, যে কেন আপনি ওকে মেরেছেন! ওকে আপনি কথায় কথায় মারেন! ওর কি মার খাওয়ার বয়স হয়েছে? একটু খানি বাচ্চা মানুষ! মোটেও আর মারবেন না! মারলে আমি আর রিমু কে ও বাড়িতে যেতে দেবো না! সে কি হুমকি বাপরে বাপ!

শাফিন আর সানিয়া রুমাইশার পাছা কাহিনি শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে! রুমাইশা লজ্জা পেয়ে চুপ করে আছে প্লেটের দিকে তাকিয়ে! আর সাফওয়ান রুমাইশার দিকে তাকিয়ে গোফের তলে হাসছে। রুমাইশার চকিতে একবার চোখ পড়লো সাফওয়ানের দিকে, আর চোখ পড়তেই সাফওয়ান ঠোঁট নাড়িয়ে কোনো শব্দ না করে বলল,
— এহ হে, তোমার পাছা দেখিয়ে দিছো আমাকে! ছিঃ ছিঃ!

সাফওয়ানের এমন কথায় গা জ্বলে গেলো রুমাইশার। সাফওয়ান কে টেবিলের নিচ দিয়েই পা দিয়ে একটা গুতা দিলো ও জোরেসোরে, তারপর চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে সাফওয়ানের মতো করেই বলল,
— এমন নাটক করছো যেন জীবনে আর দেখোনি! অসভ্য কোথাকার!

সাফওয়ান রুমাইশার চোখ পাকানো দেখে আর এমন কথা শুনে হেসে উঠলো। রুমাইশা কটমট করে তাকালো ওর দিকে, তারপর রুনিয়ার উদ্দ্যেশ্যে অভিযোগের সুরে বলল,
— ফুপ্পি! তুমি মোটেও এত মানুষের সামনে আমার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি লাগাতে পারো না! এই টপিক্স এখনি বন্ধ করো বলছি কিন্তু! নইলে কিন্তু আমি উঠে চলে গেলাম!

রুনিয়া নিজেও হাসছিলেন, রুমাইশার কথায় হাসি থামিয়ে বললেন,
— আচ্ছা আর বলছিনা, তুই খেয়ে নে!

কিন্তু তার মুখে হাসি লেগেই রইলো! সাদমান আর শাহমীর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে! মায়ের ছোটবেলার কাহিনী শুনে মজা পাচ্ছে ওরা অনেক! রুমাইশা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম দিয়ে বলল,
— সাদমান, শাহমীর, হাসি বন্ধ করে চুপচাপ খেয়ে নাও!

সাফওয়ান ছেলেদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় ওদের কে চুপচাপ খেতে বলল, নইলে বউ রেগে গেলে অসুবিধা আছে!
কাল রাত থেকে পুলিশি ব্যাপার গুলো নিয়ে যত উদ্বেগ ছিলো সবার মাঝে তা এই হাসাহাসির জের ধরেই হালকা হয়ে গেলো অনেক টা। পাতলা হয়ে গেলো সবার মন আর মস্তিষ্ক।

১০৭. ঘড়িতে এখন কাটায় কাটায় এগারোটা বাজে। সাংবাদিকরা সবাই থানার কনফারেন্স রুমে বসে আছে পুলিশ সুপার আহনাফ হাসান মিরাজের অপেক্ষায়৷ নিজেদের ভেতর তারা টুকটাক কথা বলছে। নরখাদক দের এই পুরো বিষয় টা জনগনের সামনে চটকদার ভাবে খোলাসা না করা পর্যন্ত তাদের শান্তি হচ্ছে না৷

তাদের কথা বার্তার মাঝখানেই কনফারেন্স রুমে এসে উপস্থিত হলেন আহনাফ হাসান, আর তার পেছন পেছন কবির হোসেন সহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা। আহনাফ হাসান এসে সাংবাদিক দের সামনে, মাইক্রোফোন রাখা টেবিলের চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর সবাই কে সালাম জানিয়ে কনফারেন্স শুরু করলেন৷
সাংবাদিক দের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বললেন,
— এই কেইস সম্পর্কে আমি সব তথ্য একে একে আপনাদের কে জানাবো। আপনারা আমার কথার মাঝে কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমার কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর যদি আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকে তবে করবেন, আমি তার যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর আজ আমরা এইখানে একটা নয়, দুইটা ভিন্ন টাইম লাইনের, ভিন্ন মামলা নিয়ে কথা বলবো, আর আজ এই দুইটা মামলারই সমাধান হবে, এইখানে।

আহনাফ হাসানের কথার সাথে সাথেই সাংবাদিক দের ভেতর গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। দুইটা মামলা একসাথে নিষ্পত্তি হবে জেনে তারা নিজেদের ভেতর আলোচনায় লেগে গেলো অন্য মামলা টা কি হতে পারে তা নিয়ে। রিসেন্ট বড় কোনো ইস্যু আছে কিনা সেটা নিয়েও তারা নিজেদের ভেতর কথা বলতে থাকলো।

আহিনাফ হাসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাংবাদিক দের কথা বলা দেখলেন, তারপর মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে তিনি, শান্ত, নির্বিকার গলায় বললেন,
— আপনাদের কথা বলা শেষ হলে আমাকে জানাবেন, আমি তখন আমার কথা শুরু করবো।

সাংবাদিকেরা আহনাফ হাসানের শান্ত কন্ঠে সবাই চুপ মেরে গেলো, তারপর নিজেদের সম্পুর্ন মনোযোগ আহনাফ হাসানের দিকে দিলো। আহনাফ আসানের সাথে সাংবাদিক দের এ কনফারেন্স সারাদেশে লাইভ টেলিক্যাস্ট করা হচ্ছে। আহমেদ ভিলায় সাফওয়ান রুমাইশা সহ সবাই বসে আছে টিভির সামনে। আর ও বাড়িতে শামসুল, আয়েশা, আফসানা, রাফসান, সবাই বসেছে টিভির সামনে৷ কিন্তু তারা সাফওয়ানের ব্যাপার টা এখনো জানে না৷ তারা শুধু নরখাদকদের বিষয়টা জানার জন্যই টেলিভিশনের সামনে বসেছেন৷

সাংবাদিকেরা সবাই চুপ হলে আহনাফ হাসান মিরাজ কথা বলা শুরু করলেন,
— গত এপ্রিলের উনত্রিশ তারিখ রাতের বেলা আমরা গোপন সূত্রে খবর পাই, যে নাম না জানা দলটি গত ছমাসে সারাদেশে হওয়া গুম খুনের সাথে জড়িতে সে দলটি বর্তমানে যশোরের দিকে এসেছে, এবং তারা এখন মেহেরপুরে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের যশোর থানার পুলিশ টিম এ খবর পাওয়ার পর দেরি না করেই রওনা দেয় সন্দেহজনক জায়গাটার উদ্দ্যেশ্যে। আমরা মেহেরপুর থানায় খবর দেওয়ার পর তারা বলেন যে আমরা যেহেতু টিম পাঠিয়েছি তাই তারা আর আপাতত বের হবেন না, আমাদের যদি সাহায্য লাগে তাহলে তারা টিম পাঠাবেন৷
আমাদের পাঠানো টিমের প্রধান ছিলেন রাশেদ খান, তার আন্ডারেই ত্রিশ জন পুলিশ কর্মকর্তা কে আমরা পাঠিয়ে ছিলাম অস্ত্র সহ। তারা সন্ধ্যার পরপরই বেরিয়ে পড়ে মেহেরপুরের উদ্দ্যেশ্যে। প্রথম থেকেই আমাদের সাথে তারা সকলেই কানেক্টেড ছিলো৷ কিন্তু রাতের নয়টার পরপর হঠাৎ করেই তাদের সাথে আমাদের সমস্ত কানেকশন বন্ধ হয়ে যায়, সবার ফোনই নট রিচেবল বলছিলো। ওইদিকে এমনিতেও নেটওয়ার্কের সমস্যা দেখা দেয় বলে এই বিষয়টা নিয়ে আমরা কেউ তেমন মাথা ঘামাইনি প্রথমে, কিন্তু ক্রমে ক্রমে যখন রাত বাড়তে থাকলো তখন আমরা আবারও তাদের সাথে কনটাক্ট করার চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু ফলাফল শূন্য। এরপর আমরা এই খবর পাঠালাম মেহেরপুর থানায়, কিন্তু তারা জানালো যে তারা এই মুহুর্তে ওই গভীর জঙ্গলে পুলিশ ফোর্স পাঠাতে পারবে না, কারণ তাদের পুলিশ ফোর্সের একটা বড় অংশ অন্য একটা কাজে আটকে আছে, আর যে কয়েক জন থানায় উপস্থিত আছে তাদের সাহসে কুলাচ্ছে না, কারণ কে কখন গুম হবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এইসবের মাঝেই রাতের দুইটার দিকে আমার ফোনে কল আসে আমাদের থানার একজন পুলিশ সদস্য আফতাব হোসেনের৷

পুলিশ সুপার তার পাশে দাঁড়ানো আফতাব হোসেনের দিকে ইশারা করলেন, এরপর বললেন,
— আফতাব হোসেন বললেন যে আমাদের পুলিশ সদস্যের সবাইকে বিশাল লোকবলের একটা গ্রুপ এসে ধরে নিয়ে গিয়ে বেধে রেখেছিলো, এবং অলরেডি তারা দুজন পুলিশ কর্মকর্তা কে বার্বিকিউ করে ঝুলিয়ে রেখেছে। এমনকি তারাও ওই নরখাদকদের পেটেই যেত, যদিনা সেই অসম সাহসী ব্যাক্তিটা, যার এই পুরো পুলিশি কারবারের সাথে কোনো সম্পর্কই নেই, এবং যাকে এই দেশের মানুষই একসময় দূর দূর করে দূরে ঠেলে দিয়েছিলো, সে এসে আমাদের পুলিশ টিম টাকে ওই নরখাদকদের হাত থেকে উদ্ধার না করতো!

আহনাফ হোসেনের বাক্য শেষ হতে না হতেই সাংবাদিক দের ভেতরে আবারও গুঞ্জন শুরু হলো, সবাই নিজেদের ভেতর সেই ব্যাক্তিটা কে হতে পারে সেটা নিয়ে ফিসফিস সুরে কথা বলতে লাগলো। আহনাফ হোসেন তাদের চুপ করতে বলে সেদিনের পুরো ঘটনার এ মাথা থেকে ও মাথা বিস্তারিত বলে, নরখাদকদের লিডারের পরিচয় দিয়ে, তার এই কাজের পেছনের কারণ উল্ল্যেখ করে, এবং অন্যান্য বাংলাদেশী গুলো কিভাবে এই লাইনে এসেছে সবকিছু বিষদ ভাবে বর্ণনা করলেন৷

শুনতে শুনতে সাংবাদিকেরা পুরো থ’ বনে গেলো, কারো মুখে আর কোনো আওয়াজ আসছে না৷ নরখাদকগুলোর কর্মকান্ডের এমন লোমহর্ষক বর্ণনা আর সে নরখাদকদের হাত থেকে পুলিশ টিম সহ অন্যান্য সাধারণ মানুষদের উদ্ধারের রোমাঞ্চকর বর্ণনা শুনে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো সবার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আহনাফ হাসানের বলা প্রতিটা কথা গিলতে লাগলো তারা।
শুধু সাংবাদিকেরা নয়, দেশের প্রতিটা অলিগলিতে যারাই এই কনফারেন্সের লাইভ দেখছিলো সবাই বাকশূন্য হয়ে গেলো এই বিভৎস ঘটনার প্রতিটা মুহুর্তের বর্ণনা শুনে৷ আর সেই নাম না জানা ব্যাক্তিটার পরিচয় জানার জন্য সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে রইলো।

আহনাফ হাসান কথা বলা থামানোর পর সবাই যেন সম্বিত ফিরে পেলো, নিজেদের জায়গায় নড়েচড়ে বসলো আবার সবাই। একজন সাংবাদিক কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
— স্যার, যে লোকটা এমন দুঃসাহসিক কাজ করেছে সে কে? আর যে দ্বিতীয় বিষয়টার কথা আপনি বলছিলেন সেটাই বা কি?

আহমাফ হাসান কিছুক্ষণ সময় নিলেন, তারপর দম ছেড়ে বললেন,
— এই লোকটার ব্যাপারে জানতে হলে আপনাকে আজ থেকে এক যুগ পেছনে চলে যেতে হবে৷ আপনারা এখানে উপস্থিত সবাই প্রায় তরুণ। আপনারা কেউ অতগুলো দিন আগের ঘটনা জানেন কিনা, বা জানলেও আপনাদের মনে আছে কিনা আমি জানিনা। কিন্তু তারপর ও পুরো ব্যাপার টা আমি আপনাদের সামনে খুলে বলবো।
আজ থেকে এক যুগ আগে আমাদের যশোর জেলা থেকেই, আমাদের এম এম কলেজের, বোটানি ডিপার্টমেন্ট এর একজন প্রফেসর কে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছিলো আমেরিকান একদল সন্ত্রাসী, যার স্ত্রী তার কিডন্যাপ হওয়ার কিছুদিন আগেই কিডন্যাপ হয়েছিলেন, এবং সে মেয়েকে আমরা রাতদিন এক করে সমস্ত যশোর জেলার প্রতিটা অলিগলি খুজেছিলাম।
আমরা প্রথমে জানতাম না যে সে কিডন্যাপ হয়েছে, এবং তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই অসাধারণ মেধাবী, কঠিন ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন লোকটাকে আমরা খুজতে নেমেছিলাম বিশাল টিম নিয়ে, কিন্তু এরপর যখন জানলাম যে সে কিডন্যাপ হয়েছে এবং তাকে একদল আমেরিকান সন্ত্রাসী এসে তুলে নিয়ে গেছে, তখন আমরা তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে থাকি।
কিন্তু সেই মুহুর্তেই সারাদেশে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যে সেই কিডন্যাপ হওয়া লোকটি একজন প্রফেশনাল মার্ডারার যে কিনা টাকার জন্য বড় বড় ব্যাক্তি বর্গের থেকে বায়না নিয়ে তাদের কাঙ্খিত কাজ গুলো করে দেয়। এবং আরও গুজব শোনা গেলো, যে সে নাকি সাধারণ কোনো মানুষ নয়, তার শরীরে এমন কিছু সমস্যা বিদ্যমান যা অন্যান্য সাধারণ মানুষের শরীরে পূর্বে কখনো দেখা যায় নি!
আর এ গুজব ছড়ালো আমাদেরই থানা থেকে, এ থানারই একজন মহাপুরুষ টাকার লোভে সেদিন এই কাজ টা করলেন, পুরো দেশে এই খবর টা ছড়িয়ে দিলেন, আর এই খবর টাও অসুখের মতো সমস্ত দেশের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়লো। আর এ গুজবের সত্যতা বিচার না করেই আমাদের দেশের সমস্ত মানুষ সেই সম্মানিত ব্যাক্তিটার বিরুদ্ধে চলে গেলো, যে কিনা নিজের পরিবার, পরিজন, আত্মীয় স্বজন সবার থেকে আলাদা হয়ে, সম্পুর্ন একাকি ভাবে কোথাকার কোন জরাজীর্ণ এলাকাতে নিজের দিনাতিপাত করছিলো!
আর তাকে কিডন্যাপ করার কারণ টা জানেন? কারণ ছিলো তার শরীরে পাওয়া এক বিশেষ ধরণের লিক্যুইড, যার বাজার মূল্য ছিলো আমাদের ধারণারও অনেক অনেক বাইরে। আর এ কারণেই, শুধু মাত্র এ কারণেই তারা সেই সম্মান্নিত ব্যাক্তিটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছিলো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। আর এই আজগুবি গুজব টাও তারাই রটিয়ে দিয়ে গেছিলো, যেন তাদের ব্যাবসায় কোনো ভাটা না পড়ে, কেউ যেন তাদের কাজে বাধা দিতে আসতে না পারে, আর হলোও তাই।
আমাদের দেশের জনগন আবেগে তাড়িত হয়ে, গুজবে কান দিয়ে সে লোকটিকে দেশে ফিরিয়ে আনার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে বসলো! আর আমরাও জনগনের আন্দোলনের চাপে পড়ে তাকে এই দেশে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলাম, তাকেও, তার স্ত্রী কেও। তার পরিবার হাজার চেষ্টা করলেও, হাজার কাকুতি মিনতি করলেও আমাদের কানে সে কাকুতি মিনতি ঢোকেনি! আমরা কিছুই করতে পারিনি তাদের জন্য। আর সম্পুর্ন বিনা অপরাধে, আমাদের আবেগের কারণে সেই অসম্ভব রকম মেধাবী মানুষ টা নিদারুণ, অসহনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে নিজের দিনাতিপাত করেছে।
কিন্তু সে দমে যায়নি, সে আবার ঘুরে দাড়িয়েছে। এই দেশের মানুষের প্রতি হওয়া তীব্র বিতৃষ্ণায় সে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য আবারও শক্ত হয়েছে! নিজের পায়ে দাড়িয়েছে, নিজের পরিচয় পরিবর্তন করেছে, নিজের চেহারা পরিবর্তন করেছে, নিজের সবকিছুই পরিবর্তন করেছে! নিজের হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী কে খুজে বের করে আবার ও তাকে ভালোবাসার পরশে আগলে নিয়ে তার সাথে নিজেকে আগের থেকেও শক্ত বন্ধনে বেধে নিয়েছে, আর সেই নতুন পরিচয়েই এই দেশে আবার ফিরে এসেছে সে! শুধুমাত্র নিজের পরিবার টাকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য! আর তার এই দেশে ফেরার কারণেই এক বিশাল নরখাদক গোষ্ঠীর হাত থেকে বেচে গিয়েছে আমাদের পুরো দেশের মানুষ, যে নরখাদকেরা আমাদের থেকে মাত্র ছ মাসেই কেড়ে নিয়েছে দুশো সতেরোটি প্রাণ!
সে রাতে, সেই সম্মানিত ব্যাক্তি টি চাইলেই আপনাদের আপন জনদের করুন চিৎকার উপেক্ষা করে চলে যেতে পারতো ওই রাস্তা থেকে, যেভাবে আপনারা তার, আর তার পরিবারের করুন চিৎকার উপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সে তা করেনি, সে নিজের জীবন হুমকির মুখে ফেলে আপনাদের জীবন বাচানোর জন্য আগুনের ভেতর ঝাপ দিয়েছে, শুধু সে নয়, তার স্ত্রী ও!

আহনাফ হাসান থামলেন কিছুক্ষণ, সাংবাদিক রা তাকিয়ে আছে তার দিকে হা হয়ে, এই ঘটনা তারা অনেকেই শুনেছে, অনেকে বিশ্বাস করেছে, অনেকে করেনি, কিন্তু আজ আহনাফ হাসানের মুখ থেকে শুনে যেন সম্পুর্ন টা অন্যরকম লাগছে তাদের কাছে।

সারা দেশের মানুষ মুখিয়ে আছে সেই ব্যাক্তিটার নাম শোনার জন্য যাকে কিনা তারা পায়ে ঠেলেছে! যার পরিবারের আহাজারি কেউ শোনেনি, যাকে সবাই মানব জাতীর জন্য হুমকি মনে করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে এক সময়, সেই তার নামটা শোনার জন্যই টেলিভিশনের পর্দায় চোখ লাগিয়ে রেখেছে সবাই।

ফেইসবুকে লাইভ টেলিক্যাস্ট হচ্ছে, স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা, যাদের এই সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তারা ফেসুবুকের লাইভে চোখ লাগিয়ে আছে। সেই ঘটনার সময়ে যে সমস্ত ব্যাক্তিরা যুবক ছিলেন, আন্দোলনে নেমেছিলেন রাস্তায় তারাও চোখ লাগিয়ে আছেন। অনুশোচনা হচ্ছে তাদের এখন, না জেনে শুনে আবেগে গা ভাসানোর জন্য।

কনফারেন্স রুমে সাংবাদিকদের সামনে বসা আহনাফ হাসান টেবিলের ওপর থেকে পানির বোতল উঠিয়ে তা থেকে অল্প একটু পানি খেলেন, তারপর আবার বোতল টা জায়গায় রেখে দিয়ে সাংবাদিক দের দিকে তাকালেন তিনি, তারপর থেমে থেমে বললেন,
— সে লোকটার বর্তমান পরিচয়, আমেরিকার ওকলাহোমা সিটির ‘এস এস আর ফার্মাসিউটিক্যালস’ কোম্পানির ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ারার, সাদ্দাত হুসেইন। যার আসল পরিচয়, সিঙ্গাপুরের এন এস ইউ এর বোটানি বিভাগের মেধাবী স্টুডেন্ট, হোয়াংহো ড্রাগ এন্ড কেমিক্যালস এর ফার্মাসিস্ট, এবং পরবর্তীতে এম এম কলেজের বোটানি বিভাগের প্রফেসর, সাফওয়ান আহমেদ।
যার পিতা ইশতিয়াক আহমেদ এবং মাতা রুনিয়া রহমান।

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.