পরিজান

বৈঠকে উপস্থিত সবাই স্বাভাবিক থাকলেও বধূ বেশে বসে থাকা তনয়ার মনে জাগলো কৌতুহল। বিষ্মিত চোখে তাকালো পর্দার অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তির পানে। কিন্ত মুখটা দেখে বোঝা যাচ্ছে না। পরী তবুও দেখার চেষ্টা করছে ঘোমটার ফাঁকে। কিন্ত সে ব্যর্থ। পরী কি ভুল শুনলো??যদি সঠিক শুনে থাকে তাহলে বাকি সবাই এতো স্বাভাবিক কেন? কিছু কি হয়েছে? মাথা ঘুরে উঠেলো পরীর। চেয়েও শান্ত থাকতে পারছে না।
ওদিকে কবুল বলার জন্য বারবার তাড়া দিচ্ছেন কাজি সাহেব। পরী রয়েছে অন্য ধ্যানে। ঘোর কাটছে না কিছুতেই। অনেকক্ষণ ধরে সবাই বলছে কবুল বলতে কারো কথা পরীর কান অবধি পৌঁছায়নি। শেষে আফতাব দিলো ধমক। সব মেয়েরা থেমে গেল। পরী চমকে উঠে বাবার দিকে তাকালো। আফতাব গম্ভীর সুরে বলে,’এতো দেরি করছো কেন পরী? তাড়াতাড়ি কবুল বলো।’

পরপর কয়েক ঢোক গিলে পরী তিন কবুল পড়ে ফেলে। কিন্ত শরীরের ভর আর ধরে রাখতে পারে না পরী। ঢলে পড়ে কুসুমের গায়ে। পরীর ঘোমটা আরো টেনে দিয়ে কুসুম ঝাঁপটে ধরে পরীকে। কুসুম জোরেই
বলে উঠল,’পরী আপা আপনের কি হইছে?’

সামনের পর্দাটা সরিয়ে ফেলা হলো। আফতাব মহিলাদের সব সামলাতে বলে কাজিকে নিয়ে চলে গেল। পরীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। এই মুহূর্তে ঘরে নিয়ে যাওয়া দরকার পরীকে। বৈঠকে আর মহিলাদের থাকা সম্ভব নয়। মেয়ের খবর শুনে মালা দৌড়ে এলো। কয়েকবার ডাকলো পরীকে কিন্ত পরী সাড়া দিলো না। শায়ের এখনও আগের মতোই বসে আছে। দৃষ্টি তার নত অবস্থায়। মালা শায়ের কে আদেশ দিলেন পরীকে নিজের ঘরে দিয়ে আসতে। আদেশ পেয়ে শায়ের উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে। তারপর অন্দরের পা ফেললো। অনেক গুলো বছর পর এই প্রথম আফতাব ব্যতীত কোন পুরুষ অন্দরে পা ফেলেছে। কুসুম আগে আগে গিয়ে পরীর ঘর দেখিয়ে দিলো।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলার একেবারে কোণার ঘরটা পরীর। পালঙ্কের উপর পরীকে শুইয়ে দিয়ে শায়ের কক্ষ ত্যাগ করলো। কুসুম আর মালা রইলো সেখানে।

নূরনগর গ্রামের প্রতিটা মানুষ আজ পরীকে নিয়ে কথা বলতেছে। চার গ্রামের জমিদার আফতাব। ধন সম্পদ কম নেই তার। যেন এক রাজা। আর মেয়েগুলো দেখতে রাজকন্যার থেকে কম নয়। সোনালী আর রুপালির থেকেও বেশি সুন্দর পরী। এমন সোনাবরণ মেয়ের বিয়ে হলো শেষে এক সামান্য কর্মচারীর সাথে!! এটা কেউই মানতে পারছে না। কোথায় রাজকন্যা আর কথায় প্রজা! আফতাবের এমন সিদ্ধান্ত মানতে পারছে না গ্রামবাসীরা। শায়ের ছেলে হিসেবে খারাপ না। সবাই ভালো জানে তাকে। কিন্ত তাই বলে জমিদার কন্যা বিবাহ করার যোগ্যতা ওর নেই। বড় মেয়ে তো নিজের কপাল নিজেই পুড়িয়েছে আর ছোট মেয়ের কপাল আফতাবই পোড়ালো। গোবরে পদ্মফুল মানায় না।
বাইরে সবাই নানা ধরনের কথা বললেও জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায় আসতেই সবার মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
থমথমে পরিবেশ। কারো মুখে কথা নেই। শেখর না আসায় এমনিতেই আফতাব বেশ চটে আছে। এখন কেউ ভালো কথাও আফতাবের সামনে বলতে পারছে না। সব কথাই তেঁতো লাগছে তার কাছে। এমনকি নিজের ভাই আখির কেও অসহ্য লাগছে।

জ্ঞান ফিরেছে পরীর। চোখ মেলে আশেপাশে তাকিয়ে পরী বুঝতে পারল সে নিজের ঘরে আছে। তাহলে কি পরী এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো? পরী চট করে উঠে বসলো। ঘরে কুসুম ছাড়া আর কেউই নেই। তাই কুসুম কে জিজ্ঞেস করল,’আমি এখানে কীভাবে এলাম কুসুম? আমি তো বৈঠকে ছিলাম। আর তখন,,,,’
পরী একটু থামলো তারপর বলল,’বিয়ে কি হয়ে গেছে?’
-‘কন কি আপা আপনের মনে নাই?আপনে তো কবুল কইয়া হুশ হারাইলেন।’
-‘আর বিয়েটা কার সাথে হয়েছে?’
-‘আপনে দেহি সব ভুইলা গেছেন। শায়ের ভাইয়ের লগে আপনের বিয়া হইছে।’
-‘তাহলে শহরের ওই ছেলেটা কোথায়?’

কুসুম থামলো বড় করেনিঃশ্বাসফেলে বলল,’জানি না আপা। আমরা সবাই তো বরের অপেক্ষা করতাছিলাম। দেরি দেইখা শায়ের ভাই তো লোক পাঠাইছিল। হেই লোক গুলান শহরে যাইয়া ফিইরা আইছে তাও বরযাত্রী আহে নাই। শহরে বাবুর বাড়িতে যাইয়া কেউরে পায় নাই। এখন কি হইবো? হের লাইগা বড় কর্তা শায়ের ভাইয়ের লগে আপনার বিয়া দিলো।’

-‘ওরা গেলো কোথায়? হঠাৎ করে তো কোন মানুষ উধাও হয়ে যায় না।’
-‘কি জানি? গত কাইল তো শায়ের ভাইয় সহ আরো মানুষ যাইয়া দেহা কইরা আইছে। এহন কই আছে কে জানে? তয় একখান কথা কই। শহরে পোলাডারে আমার ভালো লাগে নাই। হের লগে বিয়া হয় নাই শোকর করেন। হেগোরে নিয়া ভাববেন না। কোথায় যাইবো? বড় কর্তা একবার ধরতে পারলে মাইরা ফেলবো। জমিদারের লগে রসিকতা!!’
পরী আর কথা বাড়ালো না। হাঁটু মুড়ে ওখানেই বসে রইল। কিছুক্ষণ বাদেই মালা আর জেসমিন আসলো। মালা কুসুম কে বলল পরীর কাপড় গুছিয়ে দিতে। পরী বলে উঠল,’কাপড় গোছাবে মানে? আমি কোথায় যাবো?’
-‘শ্বশুড় বাড়ি।’
পালঙ্ক থেকে নেমে পরী বলল,’কিন্ত আম্মা উনি তো আমাদের এখানেই থাকে। আমরা এখানেই থাকি?’

মালা জবাব না দিয়ে কুসুমের সাথে পরীর কাপড় গোছাতে লাগলেন। জেসমিন এগিয়ে এসে পরীর হাত ধরে বললেন,’এখন শায়ের এই বাড়ির জামাই পরী। তার আর এখানে থাকা চলবো না। লোকে কি বলবে তখন?? তাই তোমারে নিয়া যাইবো এখনই। অনেক দূরের পথ পরী। তোমার গয়না সব খোলো আর শাড়ি বদলাও।’
পরী কিছু বলতে চাইলো কিন্ত জেসমিন বলতে দিলো না। নূরনগর থেকে সাত গ্রাম পার হয়ে নবীনগর। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে পরীকে। পথে যদি চোর ডাকাতের পাল্লায় পড়ে তো গয়না গুলো লুটে নেবে। তাই জেসমিন গয়না গুলো একটা ব্যাগে ভরে মালার কাছে দিলো। মালা সেগুলো পরীর জামা কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে দিলো। মায়ের কথামতো পরী বেনারশি খুলে সুতি শাড়ি পরলো। মালা পরীর মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে নেকাব বেঁধে দিলো। তারপর গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলে,’চাদর খুলবি না। বাইরে ঠান্ডা অনেক।’

-‘আম্মা আমাকে বিদায় করার এতো তাড়া আপনার?’
মালার বুক কেঁপে উঠল। মেয়ে তার দিকে আঙুল তুলছে!! পরী কি জানে না যে ওকে বিদায় দিতে কতখানি কষ্ট হচ্ছে মালার? জানলে এই প্রশ্ন করতো না। মালা জবাব দিলো না। পরীর হাত ধরে নিচে নেমে এলেন। পরী নিচে এসেই জুম্মান কে খুঁজতে লাগলো। আজ সারাদিন সে দেখেনি ছোট ভাইটাকে। সবার মাঝে জিজ্ঞেস করতেও পারেনি। এখন যাওয়ার সময় তো জিজ্ঞেস করতেই পারে। পরী মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই জুম্মান এসে হাজির। ভাইকে কাছে টেনে পরী বলে,’কোথায় থাকিস তুই?
আজ আমার সাথে দেখা করলি না কেন??’

-‘তোমারে দেখলে আমার কান্না পায় আপা। আমারে ছাইড়া চইলা যাবা।’
বলতে বলতে কেঁদে ওঠে জুম্মান। পরী বলে,’কাঁদিস না জুম্মান। আমি আবার আসবো। তুই আমাকে আনতে যাবি কিন্ত?’
জুম্মান মাথা নাড়ে। পরী বিদায়ের সময় যেন কাঁদা ভুলে গেছে। বাড়ির বাকি সবার একই অবস্থা। বিয়ে টা উলটপালট হওয়াতে কারো বিস্ময় এখনও কাটেনি। কিসের কান্নাকাটি?? পরী চোখের জল ফেলল রুপালির কোলের নবজাতক শিশুটিকে কোলে নিয়ে। অল্প দিন ধরে সে দুনিয়ার আলো দেখেছে। পরী চেয়েছিল নিজে লালন পালন করবে কিন্ত তা আর হলো না।
সবার থেকেই বিদায় নিলো পরী। মায়ের হাত ধরে বাইরের পা দিলো। যেই ঘর ওর নিজের ছিলো আজ সেই ঘর থেকেই বঞ্চিত হলো সে। আজকের পর থেকে নিজের বাড়িতে মেহমান হিসেবে আসতে হবে পরীকে। কথাটা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসে পরীর।
গরুর গাড়ি দাঁড় করানো। সেখানে যেতেই হুশ ফিরল পরীর। শক্ত করে মালাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। মালার চোখের পানিও বাধ সাধলো না। মেয়েকে কিছুক্ষণ আলিঙ্গন করে গাড়িতে তুলে দিলো।

গাড়ি চলতে শুরু করল। কেউই যাচ্ছে না পরীর সাথে। শুধু শায়ের আর পরী। গাড়ির ভেতরে হারিকেন জ্বলছে। রাত বাড়ছে বিধায় কোন মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শিয়াল,কুকুর,ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। সাথে গরুর পায়ের শব্দ।
শায়ের গম্ভীর হয়ে বসে আছে। পরীর থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। একবারও তাকায়নি পরীর দিকে। দেখে মনে হচ্ছে কিছু ভাবছে সে। পরী এতক্ষণ ধরে শায়ের কে দেখে চলছে। এই মুহূর্তে ওর স্বামীর মাথায় কি চলছে তা জানা দরকার। কীভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না পরী। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলেই ফেললো,’আপনি কিছু ভাবছেন?’
এতক্ষণ পর পরীর দিকে তাকালো শায়ের। অন্যমনস্ক ছিল বিধায় পরীর কথা তার কানে গেলো না। সে বলল,’কিছু বললেন?’
-‘বললাম আপনি কেন বিয়েতে রাজি হলেন? আমাকে দেখলেই তো দশ হাত দূরে যেতে বলতেন। এখন কেন বিয়ে করলেন?’
-‘আপনার বাবা বলেছে তাই।’
-‘আব্বা বললো আর আপনি রাজি হয়ে গেলেন?’
-‘আমি তো আপনাকে বলেছি যে আপনার বাবা আমাকে যতটুকু করতে বলেন আমি ঠিক ততটুকুই করি। আপনাকে বিয়ে করতে বলেছে তাই করেছি নাহলে করতাম না।’
শেষ কথায় অপমানিত বোধ করল পরী। কুসুমের মুখে শুনেছে কতো ছেলেরা নাকি পরীর জন্য পাগল অথচ এই ছেলেটাকে দেখো? পরী রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সে আর কোন কথা বলল না।

দুহাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে পরী। এতো রাত অবধি জেগে থাকা সম্ভব নাকি? আরো কতদূর কে জানে? শায়ের জেগে আছে। পরীর দিকে তাকিয়ে রইল এবার। এখনও মুখটা দেখা হলো না। নেকাবের আড়ালের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবছে শায়ের। কেমন দেখতে মেয়েটি? লোকজনের মুখে বলা চেহারার থেকে বাস্তব চেহারা কি বেশি মাধুর্যময়? একটু অপেক্ষা করলেই দেখতে পাবে শায়ের। মধ্যরাতে গাড়ি থামলো নবীনগর। বাকি পথটুকু হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। তবে সমস্যা হলো পরী। সে এখনও ঘুমাচ্ছে। এবার কীভাবে ডাকবে শায়ের? সেই চিন্তায় ঘামছে শায়ের। অস্বস্তিকর লাগছে ওর। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে উপায় খুঁজতে লাগল। কিন্ত কপাল খারাপ যে কোন উপায়ন্তর না দেখে শায়ের নিজেই ডাকলো পরীকে,’শুনছেন!!এইবার উঠতে হবে।’

চোখ মেলে তাকালো পরী। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,’কি হয়েছে??’
-‘আমরা পৌঁছে গেছি। নামতে হবে।’
পরী নামলো গাড়ি থেকে। শায়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে হাটা ধরলো। পরীর ঘুমভাব কমেনি। ঢুলছে আর হাটছে। শায়ের তা খেয়াল করে বলে,’এভাবে হাটলে পড়ে যাবেন তো। হাত ধরে হাটবেন?’
থমকে দাঁড়িয়ে পরী বলে,’আমি পারবো। আপনার হাত ধরতে যাব কেন??’
-‘বাকি জীবন তো আমার হাত ধরেই কাটাতে হবে।’

-‘তাহলে আজকে নাহয় বাদই দিলাম। বাকি জীবন আপনার হাত ধরবো।’
শায়ের আর কথা বলল না। পরীও হাত ধরল না। কিছুক্ষণ হেঁটে ওরা একটা বাড়িতে পৌঁছালো। অন্ধকারে ঠিক বুঝলো না পরী কিছু। বাড়িটা কেমন দেখতে তাও আন্দাজ করতে পারলো না। তবে উঠোনে দাঁড়িয়ে এটা বুঝলো যে এখানে বেশ কয়েক টা ঘর আছে। শায়েরের পিছু পিছু পরী একটা ছোট ঘরের সামনে গেলো। দরজায় কয়েকবার টোকা দিলো শায়ের। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,’কেডা রে?? এতো রাইতে দরজা গুতায় কেডা?’

শায়ের জবাব দিলো,’ফুপু আমি সেহরান।’
একটু পরে একজন পঞ্চাশের বেশি বয়স্ক মহিলা হারিকেন হাতে দরজা খুলল। শায়ের কে দেখে সে খুশি হয়ে বলে,’এতো রাইতে কই থাইকা আইলি?’

-‘ফুপু,,’ বলতে বলতে শায়ের ঘাড় ঘুরিয়ে পরীর দিকে তাকালো। মহিলাটি হারিকেন উঁচিয়ে পরীকে দেখে বলে,’এই ছুরিডা কেডা?’

পরী অবাক হলো মহিলার কথা শুনে। কিন্ত পর মুহূর্তেই থমকে গেল। কারণ শায়ের জবাব দিয়েছে,’আমার বউ।’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.