পরিজান

“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়,দেখতে আমি পাইনি। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে বাহির পানে চোখ মেলেছি,বাহির পানে। আমার হৃদয় পানে চাইনি,আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি।”

রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে গাইতে রুমালের সেলাই খুলছে চম্পা। তার প্রিয় ব্যক্তিকে যখন দেওয়ার অধিকার নেই তাহলে এসব রেখেই কি হবে? খুব যত্ন করে সে এগুলো বানিয়েছিলো। সেলাইয়ের প্রতিটি ফোড়ে ছিল নিত্য নতুন অনুভুতি গাঁথা। যা সে শায়ের নামক পুরুষটির জন্য রেখেছিল। কিন্ত সে পুরুষ টি আজ অন্য কারো দখলে। অন্য কারো হাসিতে সে তৃপ্তি পায়। অন্য কাউকে নিয়ে ভাবে। আগে যদি জানতো এই পুরুষটি তার হবে না তাহলে কোন অনুভুতি সে জমিয়ে রাখতো না। দিতো না ওই পাষাণ পুরুষ কে মন।
শায়ের পরীকে বিয়ে না করলেও হেরোনা কিছুতেই শায়েরের কাছে চম্পাকে বিয়ে দিতেন না। দেখতে শুনতে তো মেয়েটা কম নয়। কোমড় ছড়ানো ঘন কালো চুল। ডাগর ডাগর চোখ,কি সুন্দর চেহারা!! এমন সুন্দর মেয়েকে তিনি অর্থহীন এতিম ছেলের কাছে কেন বিয়ে দেবেন? তার মেয়েকে তিনি আরো বড় ঘরে বিয়ে দেবেন। তবে যখন সে শুনেছে শায়ের জমিদারের মেয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে তখন থেকেই হিংসায় জ্বলে যাচ্ছেন। রূপবতী পরীকেও তার সহ্য হচ্ছে না। তাই তিনি খুসিনার সাথেও তেমন কথা বলেন না। কেননা খুসিনা খুব বড়াই করেন পরীকে নিয়ে। হেরোনার মেয়ের থেকেও দ্বিগুণ সুন্দরী মেয়েকে ঘরে তুলেছে শায়ের। এজন্য দুজনের মধ্যে চলে কথার প্রতিযোগিতা।
চামেলি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে বোনের কান্ড দেখতাছে। সে ভালোবাসার অর্থ বোঝে না বলেই বোনের কষ্ট বুঝতে ব্যর্থ। তাই চেয়ে চেয়ে দেখছে শুধু। পরীদের বাড়ি থেকে এসে অনেক গল্পই বলেছে পরীর বাড়ি সম্পর্কে। চম্পা শুধু শুনেছে।

বারান্দার মাটির তৈরি সিঁড়িতে চম্পা আর বারান্দার মেঝেতে চামেলি বসে আছে। পরী সেখানে আসতেই চামেলি খুশি হলো। তবে চম্পা পরীর উপস্থিতি পেয়েও নিজের কাজ করতে লাগলো। পরী কিছুক্ষণ চম্পার দিকে তাকিয়ে থেকে চামেলিকে বলল,’ঘরে একা একা লাগছিল তাই তোমার কাছেই ফুপু পাঠালেন।’
চামেলির বদলে চম্পা বলে,’কেন সেহরান ভাই নাই?’

-‘নাহ,উনি তো বাজারে গেছে। আসতে দেরি হবে।’

পরীর মুখে উনি শব্দটা শুনে মৃদু হাসলো চম্পা। চামেলি উঠে এসে পরীর হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। পরীকে চৌকির উপর বসিয়ে নিজেও বসলো। তারপর বলল,’নতুন ভাবী আপার লগে কথা কইও না। আপার মন ভালা না। দেখো না সেহরান ভাইয়ের লাইগা রুমাল বানাইছে এহন আবার খুলতাছে।’

-‘উনার জন্য রুমাল বানিয়েছে কেন?’
পরী বুঝেও না বোঝার ভান করলো। যাতে চামেলি সব কথা বলে।

-‘আর কইয়ো না নতুন ভাবি। খুসিনা ফুপু মা’রে কত্ত কইলো সেহরান ভাইয়ের লগে আপার বিয়া দিতে কিন্ত মা তোর রাজিই হয়না। আপা সেই আশায় রুমাল বানাইলো। কিন্ত দেহো শেষমেশ তোমারে ভাই বিয়া কইরা আনলো। যদি আপার লগে বিয়া হইতো তাইলে কি তোমার মতো সুন্দর ভাবি পাইতাম!!’

খিলখিল করে হেসে উঠল চামেলি। পরী আগেই বুঝেছিলো চম্পা শায়ের কে পছন্দ করে। কিন্ত পুরোপুরি সব সে জানে না। যদি হেরোনার মত থাকতো তাহলে হয়তো পরীর জায়গায় চম্পা থাকতো। পরী সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখে একটা ছেলের ছবি আর কিছু পোস্টার টানানো। পরী জিজ্ঞেস করে,’এসব কার ছবি?’

চামেলি যেন আকাশ থেকে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে বলল,’আল্লাহ গো!!হেরে চিনো না তুমি? সালমান শাহ,অনেক বড় নায়ক হেয়।’

-‘নায়ক!!’ পরী ঠিক বুঝলো না। ঘরবন্দি থাকাতে এসবের সাথে পরিচিত না সে। তাই বিখ্যাত নায়ককে চিন্তে পারলো না। চামেলি আবার বলল,’হ নতুন ভাবি। আমি আর আপা প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় টুনিগো বাড়িতে যাইয়া টেলিভিশন দেহি। তুমি দেখবা?’

-‘নাহ আমি দেখবো না। রাতের বেলা ফুপু বের হতে বারণ করেছে।’
-‘ওহ তুমি তো নতুন বউ। আহো আমরা তোমাগো ঘরে যাই। দেহি সেহরান ভাই আইছে নাকি?’

চামেলি গান ধরলো,’উওরে ভয়ংকর জঙ্গল দক্ষিণে না যাওয়াই মঙ্গল পূর্ব পশ্চিম দুই দিগন্তে নদী।’
চামেলি নাচতে নাচতে যেতে লাগল আর পরী হেঁটে হেঁটে। মেয়েটার দূরন্তপনা দেখতে ভালোই লাগে পরীর। কিন্ত চম্পার জন্য খারাপ লাগছে।

সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেছে শায়ের। পরী মাগরিবের নামাজ শেষ করে বসেছিল। একাই ছিল সে,ফুপু পাশের বাড়িতে খোশ গল্প করতে গেছেন। চামেলি চম্পা টেলিভিশন দেখতে গেছে। পরী ঘরে সম্পূর্ণ একা। দরজার ঠকঠক আওয়াজ শুনে পরী দরজা খুলল। শায়ের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলো। পরী খেয়াল করেছে আসার পর থেকে শায়ের কেমন যেন আচরণ করছে। পরীর থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। কোন কারণে শায়ের এরকম করছে পরী তা ভেবে পাচ্ছে না!!
এতে খারাপ লাগছে পরীর। কেননা এই পুরুষটিকে যে তার ভিশন মনে ধরেছে। সেই প্রথম যেদিন সম্পানের নৌকাতে দেখা হয়েছিল সেদিন থেকেই। শায়েরের কথা গুলো শ্রুতিমধুর মনে হতো পরীর কাছে। এত সুন্দর আর গুছিয়ে বোধহয় কেউ কথা বলতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে যখনই পুরুষটির সাথে দেখা হতো তখন সে আবারো পরীকে মুগ্ধ করতো। আর আজ সেই পুরুষই পরীর স্বামী। স্বামীর অবহেলা তো প্রতিটি নারীকেই ব্যথিত করে। সেজন্য পরীর মনটাও ভিশন ব্যথিত। কাল থেকে শায়ের কোনো কথা বলেনি পরীর সাথে। পরী কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দিয়েছে শুধু। এর বাইরে একটা কথাও সে বলেনি।
পরনের পাঞ্জাবি খুলে একটা গেঞ্জি পরছে শায়ের। পরী তাকিয়ে আছে শায়ের দিকে। নিজেকে পরিপাটি করে পিছন ফিরতেই পরীর চোখে চোখ পড়ল। সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পরী বলে উঠল,’কোথায় যাচ্ছেন??’

শায়ের না তাকিয়েই জবাব দিল,’কাজ আছে।’
-‘আমাকে একা রেখে যাবেন না।’

থমকে দাঁড়াল শায়ের। পিছন ফিরে বলল,’কেন? ফুপু নেই?’
-‘পাশের বাড়িতে গেছে।’
-‘আপনি একা থাকতে ভয় পান??’

পরী কয়েক কদম এগিয়ে এলো। শায়েরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,’সূর্যাস্তের পর হৃদয়ের একাকীত্ব বাড়ে। তখন মানুষ সূক্ষ্ম একটা হৃদয় খোঁজে তার হৃদয়কে বাঁধার জন্য। একাকীত্ব দূর করতে চায়। ভয়ের থেকে মানুষ একাকীত্বে বেশি ভোগে। আপনি কি আমার একাকীত্ব বোঝেননি??’

এবারও পরীর চোখে চোখ রাখলো না শায়ের। তবে চোখ দুটো যেন অনেক কথা বলতে চাইছে। নিজেকে সংযত করে শায়ের চলে এলো। বাইরে গেলো না। পরী বলল,’কিছু বলবেন না??’
এবার শায়ের মুখ খুলল। কন্ঠে গম্ভীরর্যতা এনে বলল,’আমার জন্য একাকীত্ব ভোগ করতে হবে না আপনাকে। যেখানে আমি আপনার যোগ্য নই সেখানে আমার জন্য আপনি নিজেকে দূর্বল করবেন না। যদি কখনও আফসোস হয় তাহলে বলবেন আমি সরে যাবো আপনার পথ থেকে।’

পরীর মনে জানান দিলো যে শায়ের কিছু শুনেছে। তাহলে কি রুপালির বলা কথা শায়ের শুনেছে? তাই হবে নাহলে শায়েরের এতো পরিবর্তন হতো না। বাড়ি থেকে আসার আগে রুপালি পরীকে কিছু কথা বলে। শায়ের ছোট ঘরের ছেলে,পরীর যোগ্য না,বামুন হয়ে চাঁদে হাত দিয়েছে এমনকি অনেক আফসোস করেছিল। কিন্ত পরী তখন একটা জবাব দিয়েছিল,’যদি টাকা পয়সা সুখ দিতো তাহলে তুমি কেন সুখি হলে না আপা?’
রুপালি তারপর আর একটা কথাও বলেনি। শায়ের বোধহয় অর্ধেক কথা শুনেই এসব বলছে।

-‘আমার মনের পথে যে একবার আসে তার ফিরে যাওয়ার পথ নেই। আপনি ফিরবেন কীভাবে??’

শায়ের জবাব দিলো না। পরীর সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বললে নিজেকে সংযত রাখা অসম্ভব। তাই পরীর থেকে সরে গিয়ে পালঙ্কে বসলো। পরী এগোলো না শায়েরের দিকে। সে ভাবলো রুপালির মাথা খারাপ বলে কি শায়ের কেও মাথা খারাপ করতে হবে নাকি? রুপালি সবসময় পরীর সুখ চেয়েছে বিধায় এসব বলেছে। পরী তখন ভেবেছিল সে নিজের সুখকে দেখিয়ে দেবে বোনকে। কিন্ত শায়ের নিজেই তো বুঝতেছে না কিছু। পরী এগিয়ে গেলো জানালার দিকে। হাত বাড়িয়ে খুলে দিলো জানালা। হুড়মুড়িয়ে বেলি ফুলের সুবাস ঘরে এসে ঢুকলো। পরী পেছন ফিরে শায়েরের দিকে তাকালো। শুয়ে আছে শায়ের। অস্থিরচিত্ত নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আবারো জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।

এশার নামাজ পড়েই শুয়ে পড়ল পরী। শায়ের আগেই ঘুমিয়ে গেছে। ফুপু বলে গিয়েছেন শায়ের এলে যাতে ওরা খেয়ে শুয়ে পড়ে। তার আসতে দেরি হবে। পরীর খাওয়ার জন্য শায়ের কে ডাকলো না এবং নিজেও খেলো না। অর্ধেক রাত কাটলো এপাশ ওপাশ করে।

সকালে শায়ের আগেই ঘুম থেকে ওঠে। কালকে সে একটা কাজ যোগার করেছে। গ্রামের মাতব্বর শায়ের কে বেশ পছন্দ করেন। তিনিই তার আড়তে কাজ করতে বলেছেন শায়ের কে। আজকে সেখানেই যাবে শায়ের।
পরীও উঠে ফুপুর কাছে গেল। কাজ না পারলেও কিছু কিছু সাহায্য সে করে। রান্নাঘরে ছিলো পরী। তখনই একজন বৃদ্ধ মহিলা এলেন আজহারি করতে করতে। খুসিনা দৌড়ে গেলেন উঠোনে আর পরী বসে রইল। মিহিলাটি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘সেহরান কই?ওর বউ কই?’
শায়ের ও সেখানে গেলো। বাড়ির সকলেও উপস্থিত। মহিলাটি কাঁদছে আর বলছে,’হ্যারে সেহরান কোন অপয়া মাইয়া ঘরে তুললি। যে কিনা আমার পোলাডারে খাইয়া দিলো??’
কথাটা বুঝলো না শায়ের তাই জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে চাচি??’
-‘কি হয় নাই ক?? তোরে আর তোর বউরে আইনা আমার পোলাডা মইরা গেলো!! অলক্ষী মাইয়া আইতেই আমার পোলা খাইলো। তুই থাকবি কেমনে? তোরেও খাইবো দেহিস।’

শায়েরের মনে পড়ল এই চাচির ছেলের গাড়ি করে পরীকে প্রথম এই বাড়িতে এনেছে। ছেলেটা মারা গেছে!!সে বলে,’আপনার ছেলে মারা গেছে কখন?’

-‘কাইল রাইতে ভালা পোলা ঘুমালো সকালে আর উঠলো না। অহন বউ পোলাপান খাইবো কি? সব তোর বউর লাইগা হইছে। অলক্ষি,এই সংসার টিকবো না সেহরান। টিকবো না।’

শায়ের ধমকে মহিলাটিকে বের করে দিলেন। অতঃপর নিজের ঘরের দিকে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পরী। ছলছল নয়নে সে শায়েরের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে সেখানে না দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। শায়ের বুঝে গেল এতক্ষণের সব কথাই পরীর কানে গিয়েছে। সে দ্রুত ঘরে গিয়ে পরীর হাত টেনে ধরলো। পরী কাঁদছে দেখে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো সে।

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.