স্বাক্ষর ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই তন্দ্রা ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল৷ কিছুক্ষণ আগ মুহুর্তের ঘটনাটা বারবার মনে পরছে তার। স্বাক্ষরের এতো কাছে ছিল‚ ভাবতেই তার বুকে দ্রিমদ্রিম করতে শুরু করল। চুল থেকে বেলীফুলের তীব্র সুবাস ভেসে আসছে৷ কেমন একটা ঘোরের মাঝে বিচরণ করছে তন্দ্রা। চোখের সামনে বারবার স্বাক্ষরের অমলিন হাসি মুখটা ভেসে উঠছে৷ লজ্জায় দু’হাতের আড়ালে মুখ লুকাল তন্দ্রা। লাইট অফ করে তুলির পাশে শুয়ে পড়ল সে। কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না তন্দ্রার। বারবার এপাশ ওপাশ করছে।
“তোমার ওই চোখে আমি নিজের সর্বনাশ দেখতে পারছি ভাইয়া। ওই চোখের গভীর অতলে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। তোমার প্রতি তীব্র কিছু অনুভব হয়। মোহে পরিনি, আমি তোমার ব্যক্তিত্বের মায়ায় পরেছি। আচ্ছা ভাইয়া আমার কী এই অনুভূতি গুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত?”
এইসমস্ত ভাবনা ভাবতে ভাবতেই একটা সময় তন্দ্রা ঘুমিয়ে পড়ল। আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। চারদিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে। এই মুহুর্তটা দুজন কপোত-কপোতীর জন্য একদম পারফেক্ট। স্বাক্ষর তার ঘরে এসে বেলকনিতে চলে যায়। ঘুম নেই তার চোখে। পুরো ঘর জুড়ে আঁধার বিরজ করছে। গ্রিল আঁকড়ে ধরে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে।
“খুব তাড়াহুড়ো করে ফেলছি না তো? আমার এমন কাজে তন্দ্রাবতী যদি আমাকে ভুল বুঝে? কিন্তু আদুরে তন্দ্রাবতীকে দেখলেই ভালোবাসা প্রকাশ করতে ইচ্ছে হয় আমার। আচ্ছা তন্দ্রাবতী তুমি কবে বুঝবে আমার অনুভূতি গুলো?”
সময় এভাবেই অতিবাহিত হয়ে যায়। দেখতে দেখতে তন্দ্রার সব গুলো এক্সাম খুব ভালো ভাবেই শেষ হয়। এখন সে একদম ছাড়া হাত পা। এইতো দুদিন হলো তুলি দুটো খরগোশ ছানা এনেছে। একদম সাদা রঙের। খুব সফট। বেলা করে দু’বার‚ সামনেই মাঠ থেকে তাদের জন্য তাজা ঘাস নিয়ে আসে তুলি। খরগোশ ছানা দুটো মূলত স্বাক্ষরই কিনে দিয়েছে তুলিকে। তন্দ্রার মাঝে মাঝে তাদের বাড়িটাকে চিড়িয়াখানা বলে মনে হয়। লাইক সিরিয়াসলি? একটা বিড়াল আর দুটো খরগোশ ছানা থাকলেই বাড়ি চিড়িয়াখানা হয়ে যায়! তন্দ্রা ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। তুলি নিজের হাতে ঘাসগুলো ধুয়ে খরগোশ ছানা দুটোকে দিচ্ছে। এখন সময়টা গোধূলি বিকেল৷ নীল আকাশে সাদা মেঘেরা বাতাসে ছুটে বেড়াচ্ছে। তন্দ্রা খোলা চুলে এক মনে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে। ওদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে আরেকটি ছাদ থেকে একটা ছেলে এদিকেই তাকিয়ে আছে। তন্দ্রা চলে যেতে নিলে‚
“ওই মাইয়া কোথায় যাইতাছ?”
কারো কথায় তন্দ্রা ছাদের গেইটের দিকে দৃষ্টি গেল। সেখানে শুভ‚ শিরিন‚ সাইফ‚ হেনা আর হাসনা দাঁড়িয়ে। তন্দ্রা ওদের দেখে খুশি হয়ে যায়৷ দৌঁড়ে ওদের কাছে যায়। খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“তোমরা কখন এলে?”
“এইতো কিছুক্ষণ!”
“তোমরা তো আমাকে ভুলেই গেছ!”
তন্দ্রার অভিমানী কথায় শুভ আবারও বলল‚ “আমরা তোমারে ভুইলা যামু এ হইতে পারে কহন?”
শুভর কথায় খুব হাসি পেল তন্দ্রার৷ হেসেই বলল‚ “তুমি আর বদলালে না ভাইয়া।”
তন্দ্রা এদিক সেদিক তাকাল। না! আশেপাশে এখন আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। তন্দ্রা ভাবল এখানে বসেই আড্ডা দেওয়া যাক। এই মৃদুমন্দ সমীরণে খুব একটা খারাপ লাগবে না। এতোক্ষণে শিরিন গিয়ে তুলির একটা খরগোশকে কোলে তুলেই নিয়েছে। তন্দ্রা নাক সিটকে তার দিকে তাকাল।
“কী হয়েছে তোর?”
“কী অবলীলায় না কোলে নিয়ে ফেললে এই ব্যাটাকে।”
“নিয়েছি তো কি হয়েছে? এত খুঁতখুঁতে স্বভাব কেন তোর?”
“কিছু না। আমার ভালো লাগে না এইসব।”
“তোর তো কিছুই ভালো লাগে না। আমার অ্যালভিনকেও দেখতে পারিস না। জানিস ও তোকে কতটা পছন্দ করে।”
এক নিশ্বাসে কথাটা বলে থামল স্বাক্ষর। অ্যালভিনকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। শুভ‚ সাইফ‚ হেনা আর হাসনা স্বাক্ষরের দিকে তাকাল। তন্দ্রাও চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। তাকে দেখে অ্যালভিন স্বাক্ষরের কোল থেকে নিচে নেমে তন্দ্রার পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পায়ের সাথে ঘেঁষে আহ্লাদী স্বরে ‘মিয়াও’ বলে উঠল। তন্দ্রা আজ কিছুতেই অ্যালভিনকে ভয়ে পাবে না বলে ঠিক করেছে। সে স্বাক্ষরকে অবাক করে দিয়ে অ্যালভিনের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। উপরে সে যতটাই সাহস দেখাক না কেন‚ ভেতরে তার অন্তরা’ত্মা কেঁপে উঠছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। না জানি কখন কামড়ে অথবা খিমচি দিয়ে দেয়। স্বাক্ষর গিয়ে তন্দ্রার কাছ থেকে অ্যালভিনকে নিয়ে নেয়।
“তুলি! অ্যালভিনকে নিচে নিয়ে যাও।”
“আচ্ছা ভাইয়া।”
তন্দ্রা একটা মাদুর বিছিয়ে দেয় ছাদের এক কর্ণারে। সবাই একসাথে বসে আছে। স্বাক্ষর ওদের থেকে দূরে অন্য কর্ণারে দাঁড়িয়ে। তার ইচ্ছে করছে তন্দ্রার পাশে বসে সন্তপর্ণে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে কিন্তু স্বভাবগতভাবে সে তা করতে পারছে না। আড়ালে আবডালে লুকিয়ে-চুরিয়ে বার কয়েক আড়চোখে তন্দ্রাকে দেখল সে। তন্দ্রা দুয়েকবার তাকিয়ে দেখে স্বাক্ষর তার দিকে তাকিয়ে। এরপর তার আর সাহস হয়নি সেদিকে তাকানোর।
রাতে সবাই একসাথেই খেতে বসেছে। ছেলে মেয়ে গুলোর জন্য আজ মিসেস সাহেরা এবং মিসেস তাহেরা নিজের হাতে হরেকরকমের খাবার রান্না করেছেন। বেশ অনেকদিন পর ওরা এখানে বেড়াতে এসেছে। খাবার খেতে খেতে শুভ খুব প্রশংসা করছে রান্নার।
“ওয়াও ফুপ্পি তোমাদের রান্নার হাত দারুণ। কী সুস্বাদু খাবার রান্না করেছ আমাদের জন্য!”
“এই প্রথম একটা সঠিক কথা বললি।”
হেনার কথায় শুভ কপট রাগ দেখিয়ে বলল‚
“মানে কী? আমি কী সবসময় ভুল কথা বলি নাকি?
“কোনো সন্দেহ আছে তোর?”
এমন কথায় সবাই হেসে দেয়। স্বাক্ষরের পাশে বসে তুলিও হাসছে। এখানে সবাই একসাথে গল্পগুজব করে খাবার খাচ্ছে‚ শুধু একজন বাদে। স্বাক্ষর নিজের মতো খাবার খেয়ে উঠে চলে যায়। তার এমন ব্যবহারে কারো উপর কোনো রকমের প্রভাব পড়ল না। স্বাক্ষর যে প্রয়োজন অনুযায়ী সবার সাথে কথা বলে সেই বিষয়ে সবাই অবগত।
ঘুমোনোর জন্য দুটো গেস্ট রুম পরিস্কার করে রেখেছেন তাহেরা মাহমুদ। একটাতে শুভ আর সাইফ আছে আরেকটাতে হেনা‚ শিরিন আর হাসনা। তুলি অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। খোলা জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস আসছে। তন্দ্রার কিছুতেই ঘুম আসছে না। শুয়ে থেকে বারবার এপাশ ওপাশ করছে। ঘড়িতে এখন সাড়ে বারোটা তন্দ্রার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে ফ্ল্যাশ লাইট অন করে। আজ সাথে করে পানি নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিল সে। তন্দ্রা রান্না ঘরে গিয়ে পানি খেয়ে বের হতেই দেখতে পায় স্বাক্ষরের ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। কৌতুহলবসত তন্দ্রা একবার উঁকি দেয় কিন্তু স্বাক্ষর তার ঘরে নেই। এই সময় কোথায় যেতে পারে‚ সেটাই ভাবতে থাকে তন্দ্রা। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট দিয়েই আশেপাশে দেখার চেষ্টা করে৷ তার চোখ যায় ছাদের দরজার দিকে। তার স্পষ্ট মনে আছে বিকেলে আড্ডা দেওয়া শেষ হলে সে নিজেই দরজাটা লক করে গিয়েছিল। “স্বাক্ষর ছাদে নেই তো” কথাটা ভাবনায় আসতেই তন্দ্রার মনে হলো একবার দেখা উচিত। হঠাৎ করেই তার মনে ভীষণ সাহস উদয় হলো। ভীষণ রকমের সাহস নিয়ে তন্দ্রা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে চলে এলো। অবশেষে তার ধারণাই সঠিক হলো। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে স্বাক্ষর। জোছনা আলোয় তার অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ তন্দ্রা ধীর পায়ে স্বাক্ষরের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।
“তুই এখানে?”
তন্দ্রার দিকে না তাকিয়েই কথা খানা জিজ্ঞেস করল স্বাক্ষর। তার শীতল কন্ঠে তন্দ্রা ঈষৎ কেঁপে উঠল। সত্যিই তো সে এখানে কেন এসেছে? উত্তর তার জানা নেই তাই নীরব থাকাই শ্রেয়। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে স্বাক্ষর আবারও বলল‚
“চুপ করে আছিস যে?”
“তুমি কী করে বুঝলে আমি এসেছি।”
“এটা আমার উত্তর হলো না।”
“এটা আমারও উত্তর হলো না।”
“এইযে তুই হাল্কা ঝুনঝুন শব্দে করে ধীর পায়ে এসেছিস এতেই আমি বুঝে গেছি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আমার তন্দ্রাবতী।”
“আমার তন্দ্রাবতী” কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তন্দ্রার সারা শরীরে যেন শিহরণ বয়ে গেল। তবে স্বাক্ষরের উত্তরটা তন্দ্রার খুব একটা পছন্দ হয়নি সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে সে আবারও প্রশ্ন করল‚
“হেনার পায়েও তো নূপুর আছে। সেও তো হতে পারত।”
“কিন্তু আমি যে তোকে অনুভব করছি।”
আবারও শীতল কন্ঠ। স্বাক্ষর এবার পলকহীন ভাবে পেছন ফিরে তাকায়। তন্দ্রা তার পাশে গিয়ে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল।
“আমার সাথে একটু বসবি?”
“হুম।”
জবাব দিতে খুব বেশি দেরি করল না তন্দ্রা। স্বাক্ষর তার হাত ধরে নিচে ফ্লোরে বসাল। এরপর হুট করেই তন্দ্রার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। চশমাটা খুলে হাতে রাখল।
“একটু চুলগুলো টেনে দিবি তন্দ্রাবতী?”
তন্দ্রা চুপটি করে স্বাক্ষরের আবদার গুলো শুনল। বিনা বাক্য ব্যয়ে তার কোমল হাতে স্বাক্ষরের চুলগুলো আলতো ভাবে ছুঁইয়ে দিতে শুরু করল। এতক্ষণ একা একা তন্দ্রার শূন্যতা অনুভব করছিল স্বাক্ষর। খুব করে চাইছিল তন্দ্রা এসে তার পাশে বসুক। মুহুর্তেই আল্লাহ তার ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলেন। চোখ বন্ধ করেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল সে।
এভাবেই প্রায় ঘন্টা পেরিয়ে গেল। স্বাক্ষর এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। তন্দ্রা তার চুলে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর এক দৃষ্টিতে স্বাক্ষরকে দেখে যাচ্ছে।
“এই মুহূর্তে তোমাকে প্রেমিক প্রেমিক লাগছে।”
তন্দ্রার কথায় স্বাক্ষর শোয়া থেকে উঠে বসল। মনে মনে ভাবল‚ “তন্দ্রাবতীকে কী সে নিজের প্রতি কিছুটা হলেও ভালোবাসা অনুভব করাতে পেরেছে?” আবছা আলোতেও গৌরবর্ণের গম্ভীর মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠল। এই হাসিটা কী তন্দ্রা দেখতে পেরেছে? হয়তো হ্যাঁ অথবা না! স্বাক্ষর কিছুটা ধমকের স্বরে বলল‚
“বেশি পাকা হয়ে গিয়েছিস। যা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।”