ক্যাফের সামনে এসে রিক্সা ভাড়া মেটাতে মেটাতে রিনিও পৌঁছে যায় তুর্যর সম্মুখে। এই সময়ে রিনিকে এখানে দেখে বেশ অবাকই হয় তুর্য। পরীরও রিনিকে চিনতে কষ্ট হয় না। ভাড়া মিটিয়ে রিনি তুর্যর কাছে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে,
“এই মেয়ে কে?”
এক পলক পরীর দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
“এই তোমার অফিসে যাওয়া?”
তুর্য শান্তস্বরে বলে,
“চলো ভেতরে গিয়ে কথা বলি।”
রিনি ক্ষেপে গিয়ে বলে,
“কীসের ভেতরে গিয়ে কথা বলব? এই মেয়ে কে? তুমি ওকে নিয়ে কেন ঘুরছো?”
তুর্যও এবার ধমক দিয়ে বলে,
“বেশি বাড়াবাড়ি করতেছ তুমি। না জেনে বুঝে কিছু বলা পছন্দ করি না সেটা তুমি জানো না?”
“জানি। কিন্তু তোমার যে আরো মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে সেটা জানতাম না।”
“আমার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।”
“এখনো পাশে অন্য একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপরও বলছ কারো সাথে সম্পর্ক নেই? বাহ্! দারুণ বলেছ।”
“না নেই। পাশে কেউ দাঁড়িয়ে থাকা মানে এই নয় যে তার সাথে আমার সম্পর্ক থাকতে হবে। তোমার তো কত ছেলে বন্ধুর সাথে চলাফেরা। আমি কখনো তোমায় কিছু বলেছি? নাকি সন্দেহ করেছি?”
“না, করোনি। কারণ তুমি জানতে ওরা আমার বন্ধু।”
তুর্য প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে হাত নাড়িয়ে বলে,
“না জানতাম না। তোমার নিত্যনতুন বন্ধুর কথা আমি জানতাম না।”
“কী বলতে চাইছ তুমি?”
“আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না।শুধু এটাই বোঝাতে চাচ্ছি, না জেনেবুঝে কোনো কথা বলবে না।
“ঠিকাছে। তাহলে তুমিই বলো ও কে?”
“ও পরী। পারিবারিক কিছু সমস্যা হয়েছে তাই দুজনে কথা বলতে ক্যাফেতে এসেছি।”
রিনি অবাক হয়ে বলে,
“যার কথা আমায় বলেছিলে সেই পরী? বাব্বাহ্! মেয়েটা পরিবারেও ঢুকে গেছে?”
এতক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা গিলছিল পরী। বারবার রিনিকে কয়েকটা কথা শোনাতে গিয়েও থেমে গিয়েছে। কিন্তু এই মেয়ের যা স্বভাব মনে হচ্ছে! বেশিক্ষণ চুপ থাকাটা কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই দুজনের কথার মাঝে পরী কপালে হাত দিয়ে বলে,
“মাথা ব্যথা করছে আমার। আপনারা কথা বলেন। আমি গিয়ে কফি খাই।”
উত্তরের অপেক্ষা না করেই পরী ভেতরে চলে যায়। পরীর কথাগুলো অপমানের তীরের মতো বিঁধল রিনির শরীরে। রাগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে গেছে। রাগগুলো তুর্যর ওপর ঝেড়ে বলে,
“দেখলে তুমি ও আমাকে কীভাবে অপমান করে গেল?”
তুর্য অন্যদিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রিনির দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমার সমস্যা কোথায় বলো তো? ওর মাথা ধরেছে কফি খেতে গেছে তাই। তোমাকে অপমান করল কীভাবে?”
“ওহ! এখন তুমি আমার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছ?”
“এটা তোমার স্বভাব। আমার না।”
“তোমার মতো ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ানোই আমার ভুল হয়েছে। আজকের পর থেকে আমার সাথে তুমি আর কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।”
রিনি কথাগুলো বলে চলে যাওয়া ধরলে তুর্য পেছন থেকে রিনির হাত ধরে বলে,
“এমনকিছু কোরো না যার জন্য পরে তোমাকে পস্তাতে হয়। সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে কতটুকু সময় তুমি আমায় দিয়েছ? এই পার্টি, সেই পার্টি, হ্যাংআউট, ফ্রেন্ডস আড্ডা সারাক্ষণ এসব নিয়েই থেকেছ। নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে দেখা করার সময় হলেও তোমার কখনো সময় হয় না আমার সাথে দেখা করার। এসব নিয়ে অভিযোগ করলে কী বলতে? আমি নাকি সো কলড বয়ফ্রেন্ডদের মতো লেইম অভিযোগ করি। একসময় অভিমানে অভিযোগ করাও ছেড়ে দিলাম। কিন্তু বুঝেছ তুমি কখনো আমার অভিমান? আজও হয়তো তোমাকে এসব কথা কিছুই বলতাম না। কিন্তু মানুষের ধৈর্য্য বলতে একটা কথা আছে। কিছু একটা হলেই তুমি সম্পর্ক শেষ হওয়ার হুমকি দাও। কেন? সম্পর্কর মূল্য শুধু আমি একাই দেবো? আমি একাই ভালোবাসি? তাহলে বেশ, তোমার যা করার করে নাও। করব না যোগাযোগ। তোমার যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই থাকো।”
এরপর তুর্য রিনির হাতটা ছেড়ে দিয়ে ক্যাফে চলে আসে। পরী তখন টেবিলের ওপর এক হাতে রেখে এবং সেই হাতে মাথা ভর দিয়ে কফি খাচ্ছিল। তুর্যকে আসতে দেখে পাশের চেয়ার থেকে ব্যাগটা নিয়ে কোলের ওপর রাখে। তুর্য চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বড় বড় শ্বাস নেয়। টাই খুলে শার্টের আরো দুটো বোতাম খুলে দেয়। তারপর শার্টের কলারটা ধরে একটু সরিয়ে দেয়। বাতাস লাগানোর চেষ্টা আরকি! মাথা কাৎ করেই তুর্যর কাহিনী দেখছিল পরী। পরীকে এভাবে তাকাতে দেখে তুর্য ধমক দিয়ে বলে,
“কী দেখছ?”
পরী ভ্রু কুঁচকে বলে,
“একদম গার্লফ্রেন্ডের রাগ আমার ওপর ঝাড়ার চেষ্টা করবেন না।”
তুর্য কী ভেবে যেন হেসে ফেলে। এতে পরী ভ্রু দুটো আরো কুঞ্চিত করে বলে,
“ভূতে ভর করেছে?”
“না। পরীতে ভর করেছে।”
“আমি কখন ভর করলাম?”
“হুশ যাও! সত্যিকারের পরীর কথা বলেছি।”
পরী ভেংচি দিয়ে বলে,
“ঢং!”
তুর্য আরেকটা কফির অর্ডার দিয়ে পরীর উদ্দেশ্যে বলে,
“আচ্ছা তারপর? এখন কী করা যায় বলো?”
“কোন বিষয়ে?”
“যেসব নিয়ে দুই পরিবারে ঝামেলা।”
“ঝামেলা তো আমায় নিয়ে। আব্বু নতুন বাড়ি খুঁজছে। পেলেই চলে যাব।”
“তুমি চলে গেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”
“হয়তো হবে না। তবে আব্বু-আম্মু এ বাসায় থাকবেও না।”
তুর্য ঠাট্টা করে বলে,
“ভাগ্যিস তোমার সাথে আমার রিলেশন নেই।”
“এই কথা বললেন কেন?”
“বললাম কারণ তাহলে বিয়ে হওয়া মুশকিল হয়ে যেত। কোনো পরিবারই মেনে নিত না।”
তুর্য একাই হাসতে থাকে। পরী চুপ করে শুধু তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে এই সম্পর্ক তো প্রথম থেকেই অসম্ভব ছিল। এখন আরো অসম্ভব হয়ে গেছে। এই সম্পর্কের কথা ভাবা আর আকাশ-কুসুম কল্পনা করা একই কথা। হঠাৎ হঠাৎ সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হয়। কেন যে এদের চোখে পড়েছিল উফফ!
পরীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে তুর্য বলে,
“পরী!”
“হু।”
“প্রান্তকে তুমি ভালোবাসো?”
“না।”
সোজাসাপ্টা উত্তর দেয় পরী। তুর্য ক্ষণকাল চুপ থেকে বলে,
“তিথির বিষয়টা নিয়ে আমি খুব চিন্তিত। কখন কী করে বসে বুঝতেছি না।”
“পাগলামী করে তো লাভ নেই। প্রান্ত তিথিকে না চাইলে কি জোর করতে পারবেন প্রান্তর ওপর?”
তুর্য একটু নড়েচড়ে বসে বলে,
“আচ্ছা তুমি কাউকে ভালোবাসো না?”
পরী একটু ভীতিগ্রস্ত হয়ে বলে,
“কেন?”
তুর্য টেবিলের ওপর হাত চাপড়ে বলে,
“তাহলে তার সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দিতাম। তখন তো প্রান্ত তোমাকে ভালোবাসলেও কোনো ফায়দা হতো না। ল্যাঠা চুকে যেত তাহলে।”
পরী একটা গোপন নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মনে মনে বলে,
“গাধা! তাহলে তুই’ই বিয়ে করে নে।”
কিন্তু মুখে বলে,
“সেটা হওয়ার নয়।”
তুর্য আপসোসের স্বরে বলে,
“হুম। আচ্ছা দেখা যাক কী হয়! আবারও আমি ক্ষমা চাইছি পরী মায়ের ব্যবহারের জন্য।”
“বারবার ক্ষমা চাইতে হবে না। আমার নিজেকে ছোট মনে হয়।”
তুর্য হালকা হেসে বলে,
“তাহলে চলো। এখন উঠি।”
“ঠিকাছে।”
—————————
পরীরা নতুন বাড়িতে উঠেছে আজ দুদিন। এই দুদিনের একদিনও পরীর তুর্যর সাথে কোনো দেখা বা কথা হয়নি। তবে প্রান্তর সাথে দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই পরী প্রান্তকে এড়িয়ে গেছে। কথা বলা তো দূরে থাক। মুখের দিকেও ফিরে তাকায়নি। কাল সকালের ফ্লাইটেই পরীর বড় ভাই প্রিয়ম আসবে বিদেশ থেকে। এই কারণে বাড়িতে একটা খুশির আমেজ চলে এসেছে। আগের সব খারাপ ঘটনা ভুলে গিয়ে রেহেনা বেগম সবকিছুর জোগার করে রাখছে। ভোরে উঠেই রান্না বসাতে হবে। কলেজ থেকে পরীকে দিয়ে ছুটিও নিইয়েছে রেহেনা বেগম। কতদিন বাদে ভাই আসবে বাড়িতে সেই খুশিতে পরী নিজেও গদগদ। ভাই দেশে ফিরবে মানে এত্ত এত্ত চকোলেট আর গিফ্ট নিয়ে আসবে। পরী অনলাইনে গিয়ে বেশকিছুক্ষণ ভাইয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে। খুনসুটি করে। ভাই-বোনের সম্পর্ক দুনিয়ার অন্যতম সুন্দর সম্পর্ক। ভাইর সাথে কথা শেষ করে পরী ঘুমিয়ে পড়ে। তখন রাত ছিল এগারোটা।
ভোরের আজান কানে আসতেই রেহেনা বেগম ডাকাডাকি শুরু করেন। পরী অনেকক্ষণ বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে থাকে। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হাই তুলতে তুলতে উঠে গিয়ে দরজা খুলে বলে,
“আসি।”
ফজরের নামাজ খুব একটা পড়া হয় না পরীর। আলসেমিতে জেঁকে ধরে। বাকি ওয়াক্তর নামাজগুলো তেমন কামাই দেয় না। আজ যখন উঠেছে তখন নামাজটা পড়ে নেবে বলেই ভাবে। গোসল সেরে ওযু করে নামাজ আদায় করে নেয়। এরপর মাকে সাহায্য করার জন্য রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। মনটা এখন অন্যরকম ফ্রেশ লাগছে। তাই পরী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে এখন থেকে সব আলসেমি বাদ দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করবেই। নিজেকে ভীষণ হালকা মনে হয়।
ভোরের আলো ফুঁটে সূর্যের দেখা মিলেছে। রান্নার সব গোছগাছ করে দিয়ে পরী সব রুমের বিছানার চাদর, বালিশের কাভার পাল্টে ফেলে। জানালার পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিতেই দক্ষিণা বিশুদ্ধ বাতাস পরীকে প্লাবিত করে দিয়ে যায়। শরীরটা শিরশির করে উঠে। সূর্যের মৃদুমিষ্টি আলো পরীর মুখ ছুঁয়ে দেয়। পরী চটজলদি রুম গুছিয়ে নেয়। মায়ের রান্নাও প্রায় শেষের দিকে। এদিকে পরীর ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থা। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। বাবা এয়ারপোর্টে গেছে ভাইকে আনতে। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। এই সুযোগে সোফায় শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না।
চোখটা প্রায় লেগে আসছিল আসছিল ভাব তখনই মায়ের বিকট চিৎকার শোনা যায়। রেহেনা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
“তোর ফোন বাজছে কখন থেকে? আর তুই এখানে কুমিরের মতো ঘুমাচ্ছিস।”
পরী ঢুলতে ঢুলতে নিজের রুমে যায়। ফোন হাতে নিয়ে দেখে বাবার কল। পরী কলব্যাক করে বলে,
“হ্যালো।”
ঐপাশ থেকে প্রিয়ম বলে,
“কীরে শাঁকচুন্নি এখনো ঘুমাস?”
প্রিয়মের কণ্ঠস্বর শুনে পরীর সব ঘুম উধাও হয়ে যায়। আনন্দে বিগলিত হয়ে বলে,
“ভাইয়া চলে এসেছ তুমি?”
“হ্যাঁ রে পাগলী। এখন গাড়িতে আছি। আব্বু বলল বাড়ির কাছাকাছি নাকি এসে পড়েছি।”
“আচ্ছা তাড়াতাড়ি আসো। আর আমার গিফ্ট এনেছ তো?”
প্রিয়ম হেসে বলে,
“এনেছি।”
পরী ফোন রেখে নাচতে নাচতে মাকে গিয়ে খবরটা দেয়। খুশিতে রেহেনা বেগমও আত্মহারা। মা-মেয়ের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না। রেহেনা বেগম একটু পরপর দরজার কাছে যাচ্ছেন আবার ড্রয়িংরুমে আসছেন। পরী সময় পার করতে ফেসবুকে লগিন করে। পরপর চারটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের নোটিফিকেশন আসে। এরমধ্যে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখে পরী ভারী অবাক হয়। তুর্য এড পাঠিয়েছে! এক্সেপ্ট করবে নাকি করবে না ভাবছে পরী। নিশ্চয়ই কোনো দরকারেই হয়তো এড দিয়েছে। পরী প্রোফাইল পিকটা আরেকবার দেখে। এরপর ব্যাকে গিয়ে কনফার্মে ক্লিক করতে যাবে তখনই কলিংবেল বাজে। রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করা আর হয় না। ‘ভাইয়া এসেছে!’ বলেই ফোনটা সোফার ওপর রেখে দৌঁড়ে দরজার কাছে যায়। ততক্ষণে রেহেনা বেগম দরজা খুলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। চোখের কোণে পানিও স্পষ্ট। প্রিয়ম মাকে ছেড়ে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ভালো আছিস পাগলী?”
“অন্নেক ভালো আছি ভাইয়া।”
প্রিয়ম পরীকে ছেড়ে দেওয়ার পরই বাবার পাশে দাঁড়ানো লাগেজ হাতে আরেকটা সুদর্শন ছেলেকে নজড়ে পড়ে। পরী ভাইয়ের দিকে তাকাতেই প্রিয়ম মিষ্টি হেসে বলে,
“আমার সাথে কয়েকদিন এখানেই থাকবে ও। আমার বন্ধু শাদাফ!”