রুম থেকে পরীর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তাড়াহুড়ো করে রুমে আসেন রেহেনা বেগম। এসে তিনি রীতিমত অবাক। পরী বিছানার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে। তিনি বারবার বারণ করা সত্ত্বেও শুনছে না। তিনি এটাই ভেবে পাচ্ছেন না হঠাৎ করে এমন কী হলো যে পরী অসুস্থ হয়েও নাচানাচি করছে? নাকি সবই জ্বরের ঘোরে করছে! বার কয়েক পরীর এত খুশি হওয়ার কারণও জানতে চেয়েছেন কিন্তু পরী যেন পাত্তাই দিচ্ছে না। তিনি এবার পরীর হাত ধরে টেনে খাট থেকে নামান। বিরক্ত নিয়ে বলেন,
“কী হয়েছে তোর? এমন নাচানাচি করছিস কেন?”
পরী রেহেনা বেগমের হাত ধরে ঘুরতে থাকে। রেহেনা বেগম বলেন,
“থাম! থাম!”
“থামব না মা। থামব না। আজ আমি খুব খুশি।”
খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল পরী। রেহেনা বেগম প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“এত খুশি হওয়ার কারণটা কী?”
“শুনবে?”
“অবশ্যই।”
“মা!”
“বল।”
“তুর্যর পরিবার আজকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে বাসায়।”
তিনি অবাক হয়ে বলেন,
“কী বলছিস এসব? সত্যিই?”
“হ্যাঁ মা। তুর্য আমায় মাত্রই ফোন দিয়ে সব বলেছে।”
“তাহলে তো ওদের জন্য রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করতে হবে।”
“আমিও তোমাকে সাহায্য করব মা।”
“না। তুই শুয়ে থাক। না হলে একটু পড়তে বোস। আমি রেশমাকে নিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফেলব।”
.
.
আয়নার সামনে বসে আছে পরী। পরনে ওর হালকা গোলাপি কালার শাড়ি। মারের দাগ ঢাকার জন্য ফুল হাতা ব্লাউজ পরেছে। রেহেনা বেগম খোঁপা করে দিয়ে কাঠগোলাপের গাজরা দিয়ে দিয়েছেন। নিজের হাতে মেয়েকে সাজিয়ে দিয়ে তিনি ড্রয়িংরুমে গেছেন। পরী নিজেকে অবাক হয়ে আয়নায় দেখছে আর বারবার মুগ্ধ হচ্ছে। মনের খুশিতে পুলকিত মনে হচ্ছে সবকিছু। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ফোন দিয়ে জানিয়েছিল তুর্য। এতক্ষণে বোধ হয় বাড়ির কাছাকাছি এসেও পড়েছে। ঐতো বাড়ির কলিংবেল বাজছে। পরী দৌঁড়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। পর্দার আড়াল থেকে দেখে মেহনুবা এসেছে। মেহনুবাকে পরীই ফোন দিয়ে আসতে বলেছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে না পেয়ে মনটা কিঞ্চিৎ খারাপ হয়। মেহনুবা সোজা পরীর রুমে আসে। পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কংগ্রেস পরী! আমি যে কত্ত খুশি হয়েছি জানিস না।”
পরী মেহনুবার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় বসে বলে,
“আগেই এত খুশি হোস না। আমি এখনো ভয়ে আছি। বাবা যদি তবুও কোনো অমত করে?”
“অমত করবে বলছিস কী রে? আঙ্কেল বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে আসলো জানিস?”
“তো? মিষ্টি আনলেই ধরে নিতে হবে মেনে নিয়েছে?”
মেহনুবা পরীর মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
“গাধী! যদি মেনে না’ই নিত তাহলে তো ভাইয়াদের বাড়িতে এলাউ-ই করত না।”
“বুঝতেছি না” ঠোঁট উল্টে বলল পরী।
.
অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। তুর্যরা এসেছে। ড্রয়িংরুম থেকে ওদের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বুকের ভেতর হাতুরী পেটানো শব্দ হচ্ছে এখনই। সামনে গেলে সেন্সলেসই না হয়ে যায় আবার। রুমে এসে পরীকে জড়িয়ে ধরে দিশান। পরী প্রথমে চমকে গেলেও পরে হেসে ফেলে। দিশানকে ধরে বলে,
“কেমন আছো দিশান বাবু?”
“অনেক বেশিই ভালো।”
“তাই? নতুন কোনো গার্লফ্রেন্ড হয়েছে?”
“না তো! পরীর মতো পরী ভাবি আমাদের বাসায় বউ হয়ে যাবে তাই এত খুশি।”
দিশানের কথায় পরী বেশ খানিকটা লজ্জাই পেল। দিশান বলে,
“তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে পরী আপু।”
“ভাইয়ার মাথা না নষ্ট হয়ে যায় আজ তোমায় দেখে।” রুমের ভেতর প্রবেশ করতে করতে বলল তিথি।
তিথির কথা শুনে এখন আরো বেশিই লজ্জা পাচ্ছে পরী। পাশ থেকে মেহনুবা বলে,
“মাথা নষ্ট হলে ডাক্তার তো আছেই।”
উত্তরে তিথি বলে,
“যেই সেই ডাক্তারে কিন্তু কাজ হবে না মেহু। এই ট্রিটমেন্ট শুধু পরীকেই করতে হবে।”
পরী লজ্জা পেয়ে বলে,
“থামবে তোমরা?”
“আহা! লজ্জাবতী।” বলে হেসে ফেলে মেহু। সাথে যোগ দেয় তিথি আর দিশানও। পরী মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে। রেহেনা বেগম পরীকে নিতে আসেন। শাড়ির আঁচল টেনে পরীর মাথায় ঘোমটা দিয়ে দেয়। তারপর পরীকে নিয়ে যান ড্রয়িংরুমে। শাড়ি পরা অবস্থায় দ্বিতীয়বার পরীকে দেখছে তুর্য। বুকের হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। পরীর দিক থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। পরীকে বসানো হয় একদম তুর্যর মুখোমুখি। দুই পরিবারের এত মানুষকে তোয়াক্কা না করেই লজ্জায় নুয়ে থাকা পরীর দিকে তাকিয়ে আছে তুর্য। তুর্য খেয়াল করেছে পরীর চোখের পাতা ঘনঘন নড়ছে। ঠোঁট কাপঁছে অনবরত। এক হাত অন্য হাতে পুরে মোচড়াচ্ছে। পরীর ছোট ছোট এসব কাজ যেন তুর্যর মনে পরীর প্রতি ভালোবাসা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশ থেকে তুর্যর বাবা কেশে বিড়বিড় করে বলেন,
“এমনভাবে কেন দেখছ বাবা? চোখ দুটোকে আপাতত একটু সংযত করো।”
বাবার কথায় তুর্য থতমত খেয়ে যায়। চোখ সরিয়ে নেয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও। বাবা হাসেন। পরীর বাবার উদ্দেশ্যে বলেন,
“পরীকে নতুন করে আর কী দেখব ভাই? লক্ষী একটা মেয়ে। ও’কে আমার বরাবরই পছন্দ। তারচেয়েও বড় কথা হলো আমার ছেলের জান পরী।”
পরীর বাবা রেশমার উদ্দেশ্যে বলেন,
“পরীকে রুমে নিয়ে যা।”
“আচ্ছা মামা।” বলে রেশমা পরীকে রুমে নিয়ে যায়। রুমে এসে পরী পায়চারী করছে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বাবা যদি মেনে না নেয়! মেহনুবা পরীর বিছানায় শুয়ে ছিল। পরীকে এত নার্ভাস দেখে বলে,
“আরে ইয়ার এত টেনশন কেন নিচ্ছিস?”
“বুঝবি না তুই শালী! যখন সাগর পরিবার নিয়ে তোকে দেখতে আসবে তখন বুঝবি।”
“আরে ধুর! তোর মতো এত টেনশন নেব না বুঝলি। পরিবার না মানলে সাগরের হাত ধরে সোজা পালিয়ে যাব।”
পরী মৃদু হেসে বলে,
“পরিবার মানিয়ে বিয়ে করার স্বার্থকতা বুঝিস?”
.
ড্রয়িংরুমে কিছুক্ষণ নিরবতা চলে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তুর্যর বাবা বলেন,
“ভাই আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু ভাই, এই বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ছেলে-মেয়ে দুটোর কথা ভাববেন। আপনার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে ওদের খুশি।”
“আমি মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত ভাই। নিজের রাগ বজায় রাখতে গিয়ে মেয়েটার ওপর খুব অত্যাচার করেছি। কী করব বলেন? আমি তো বাবা! আর বাবা হয়ে মেয়ের খারাপ চাইনি কখনো। আমি জানিনা আপনার স্ত্রী সত্যিই মন থেকে পরীকে মেনে নিয়েছেন কীনা! তবে এতটুকু বলতে পারি, তিনি মন থেকে না মানলেও আমি আপত্তি করব না। আমার মেয়ে সবার আগে আমার সম্মানের কথা ভেবেছে। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তুর্যর সাথে পালিয়ে যায়নি। তুর্যর ভালোবাসা নিয়ে আমি সন্দিহান নই। তুর্য পরীকে সুখে রাখবে আমি জানি। তাই এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি মেয়ে আর জামাইর মুখে হাসি দেখতে চাই সর্বদা।” বললেন পরীর বাবা।
“আলহামদুলিল্লাহ্।” বললেন তুর্যর বাবা।
খুশিতে এবার তুর্যরই বিশ্বাস হচ্ছে না। তুর্য পরীর বাবাকে সালাম করতে গেলে বাবা তুর্যকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে তুর্যর চোখে পানি চলে এসেছে। বাবার চোখের কোণেও পানি চিকচিক করছে।
“ইয়া হু! পরী আপু আমার ভাবি হবে। কী মজা!” বলে হাত তালি দিতে দিতে পরীর কাছে যায় দিশান। দিশানকে দেখে পরী এগিয়ে এসে বলে,
“ওখানে কী কথাবার্তা হলো দিশান?”
দিশান লাফাতে ঝাপাতে বলে,
“সবাই রাজি পরী আপু। ওহ্, না! এখন তো তুমি হবে ভাবি।”
“সত্যি বলছ তুমি?”
তিথি রুমে এসে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“দিশান সত্যিটাই বলেছে ভাবি।”
আনন্দে তিথিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে পরী। পরিবারকে রাজি করিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে পেতে চলেছে অবশেষে। দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরীক্ষা শেষ হলেই প্রান্ত-তিথির আর তুর্য-পরীর বিয়ে হবে। পরীক্ষার মাঝেই দুই জোড়ার এনগেজড করিয়ে রাখবে। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি পরীর রুমে এসেছে তুর্য। তুর্যকে দেখে মেহনুবা বলে,
“ওহহো! দুলাভাই এসেছে দেখি।”
মেহুর কথা শুনে পরী দরজার দিকে তাকায়। মেহনুবা, দিশান আর তিথি ওদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে রুমের বাহিরে চলে যায়। খুশিটা আর নিজের মধ্যে আটকে রাখতে পারে না পরী। তুর্যর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তুর্যও শক্ত করে পরীকে জড়িয়ে ধরে। পরী কেঁদে কেঁদে বলে,
“সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে আমার।”
তুর্য পরীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“স্বপ্ন নয় বাস্তব। আগে বলেছিলাম ভালোবাসি তোমাকে। এখন বলছি বউ বানাব তোমাকে।”