বিকেল পাঁচটা বেজে ঊনত্রিশ মিনিট৷ ফোনের রিংটোনে সহসা ঘুম ছুটে গেল সৌধর। স্ক্রিনে ‘ নিধি ‘ নামটুকু দেখেই বুক ধক করে ওঠল। সেদিন অল্প কথা-কাটাকাটি হওয়াতে নিধি তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। ওর রাগ ভাঙানোর সুযোগ হয়নি আর। রাগ না ভাঙাতেই মেয়েটা কল করেছে! বিশ্বাস করতে পারছিল না। মুহুর্তেই শ্বাস-প্রশ্বাস চঞ্চল হয়ে ওঠল। সটান হয়ে বসে রিসিভ করল প্রিয়তমার ফোনকল,
‘ কিরে সৌধ কই তুই? কখন আসবি? ‘
ভ্যাবাচ্যাকা খেল সৌধ। তার কোথাও যাওয়ার কথা ছিল নাকি? কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই দেখল, আইয়াজের সাতটা ম্যাসেজ, দু’টো মিসড কল ভাসছে। একটা ম্যাসেজে লিখা,
‘ দোস্ত নিধিরে নিয়ে সুহাসের বাড়ি যাচ্ছি। জলদি চলে আয়। ‘
মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল সৌধ। ফোন কানে চেপে ধীরেসুস্থে ওঠে দাঁড়াল। রুমের লাইট অন করে শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ ফোন রাখ, রেডি হবো৷ ‘
ওপাশ থেকে দু’জন মানুষকে ‘ হুররেএ ‘ বলতে শোনা গেল। সৌধ বাঁকা হেসে বিছানায় ছুঁড়ে রাখল ফোনটা। এরপর ত্বরিত ঢুকে পড়ল বাথরুমে। তাকে সুহাসদের বাড়ি যেতে হবে।
সৌধ আসার পর বাড়িটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠল৷ নিধি আইয়াজ মিলে এতক্ষণ যা যা পরিকল্পনা করেছিল সবটা জানাল সৌধকে। তারা বন্ধুরা মিলে অনেক সময় অনেক ভাবেই চেষ্টা করেছিল সুহাসকে বোঝাতে। নামী আর সুহাসের সম্পর্কের শুরুতেই তৈরি হওয়া দেয়ালটা ভাঙার চেষ্টা করেছিল প্রাণপনে। তাদের সে চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, সুহাস একদিকে মা ভক্ত অপরদিকে অসহ্য রকমের রগচটা। আর নামী প্রচণ্ড জেদি, তুখোড় আত্মমর্যাদাপূর্ণ মেয়ে। নিধি আইয়াজের পরিকল্পনা শুনে সৌধ সমর্থন করল। সৌধর সমর্থন পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে সুহাসকে ডাকল নিধি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিল সুহাস। নিধির ডাক শুনে ফোন কাটল। রুমে এসে দেখল সৌধ তার বিছানায় শুয়ে৷ আইয়াজ ডিভানে বসে ফোন টিপছে৷ নিধি তার হাত টেনে বিছানায় বসাল। বলল,
‘ সেলিনা আপার রান্না ভালো লাগে না৷ চল রাতে নিজেরা রান্না করি। ‘
সৌধ খোঁচা দিয়ে বলল,
‘ তুই রান্নায় পিএইচডি করলি কবে? ‘
আইয়াজ মুচকি হাসল। সুহাস ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘ ফুড পান্ডায় অর্ডার করে দিই? ‘
নিধি রান্নাবান্না খুব একটা পারে না। যতটুকু পারে নিজের জন্য চলে যায়। তাছাড়া বান্ধবী প্রাচীর জন্যই খুব ভালোভাবে রান্নাটা শেখা হচ্ছে না। মেয়েটা এত ভালো রাঁধে! ফাস্ট ইয়ারে রান্নার লোক এসে রেঁধে দিয়ে যেত। সেকেন্ড ইয়ারে প্রাচী আর সে মিলেই রান্না করে খায়। সুহাস জানে নিধিও রান্নায় পটু না না৷ তাই বাইরে থেকে খাবার আনার প্রস্তাব দিল। নিধি নাক কু্ঁচকে বলল,
‘ না না বাইরের খাবার খাব না৷ আমরা সবাই মিলে আজ পিকনিক করব। ‘
সুহাস চ্যাঁচিয়ে ওঠল,
‘ এ বইন আমি সৌধ রান্না পারি না৷ তুই আর আইয়াজ যতটুকু পারিস এতে পিকনিক হবে না। কেলেঙ্কারি ঘটাবার মতলব করিস না দোস্ত। ‘
চট করে সুহাসের পেটে গুঁতো দিল নিধি। বলল,
‘ আরে ব্যাটা, বলতে দে আমায়। ‘
নিধির মুখোভঙ্গি দেখে সৌধ মিটিমিটি হাসছে৷ এই মেয়েটা দারুণ বুদ্ধিমতী৷ সে জানে, পরিকল্পনা অনুযায়ী সুহাসকে ঠিক কনভিন্স করে ফেলবে। নিধির কথা শুনেই চিৎকার করে ওঠল সুহাস,
‘ অসম্ভব! নামীদামির কোনো সাহায্য নিব না আমি।’
সৌধ তড়াক করে ওঠে পড়ল। বলল,
‘ বা’ল আমার! কথা না শুনে না বুঝে খালি চিল্লাস। ‘
নিধি ভয় পেয়ে গেল৷ সৌধকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে সুহাসকে বলল,
‘ সুহাস, ছেলেদের এত হিংসেমি মানায় না। আন্টি তো এখানে নেই যে আজকে নামীকে নিয়ে আমরা পিকনিক করলে মহাবাংলাদেশ সমস্যা হয়ে যাবে। তাছাড়া আমরা এমনি এমনি ওকে পিকনিকে নিব না৷ মেয়েটা কী ভালো রান্না করে! ইস ঐ যে একবার ওর হাতের রান্না খেলাম স্বাদটা এখনো জিভে লেগে আছে। ‘
সুহাস চুপ মেরে গেল। মনে করল সেদিনের কথা। আহা বুকটায় শীতল হাওয়া বয়ে গেল যেন। জিভে টনটন করে ওঠল নামীর হাতে রান্না করা খাবারগুলোর স্বাদ। তার ভেতরের গোপন লোভটা চড়াও হলো। মাঝে মাঝেই নামীর হাতে রান্না খেতে লোভ জাগে তার৷ কত কষ্টই না হয় সে লোভ সংবরণ করতে৷ তিনটা গার্লফ্রেন্ড বানিয়েছে। কপাল মন্দ একজনও রান্না করতে পারে না। তিন ললনার কথা মনে করে কপাল কুঁচকে গেল সুহাসের৷ নিধি ওর বাহুতে ধাক্কা দিল,
‘ কিরে কিছু তো বল? ‘
‘ আমি কী বলব? যেই না দেমাকি মেয়ে। দেখ গিয়ে হাতে পায়ে ধরেও রাজি করাতে পারিস কিনা। ‘
সুহাসের এহেন কথায় ফিচেল হাসল সৌধ৷ সুহাসের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,
‘ তার মানে তুই রাজি? ‘
সুহাস টুঁশব্দটিও করল না। মৌণতা সম্মতির লক্ষণ বুঝে নিয়ে নিধি চলে গেল নামীর কাছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস নামী কথা রাখবে। অবাধ্যতা করবে না। মেয়েটা খুবই সুশীল জানে সে।
সুহাসের কথাই ঠিক হলো৷ নামী রাজি হলো না৷ সুহাসের প্রতি অভাবনীয় তিক্ততা জন্মেছে নামীর৷ যেই তিক্ততা রাজি হতে দিল না তাকে৷ নিধি অনেক বুঝাল৷ বলল,
‘ নামী, তুমি সুহাসকে ইম্পর্টেন্টস দিচ্ছ কেন? তুমি ভাবো না আমরা তোমার অতিথি। ‘
নামী বিষণ্ণ চোখে তাকাল। ম্লান হেসে বলল,
‘ এটাত সত্যি নয়। ‘
‘ এটাই সত্যি নামী। আমরা তোমার কলেজের বড়ো ভাই, বড়ো আপু৷ তোমার কাছে এসেছি কীভাবে আপ্যায়ন করবে এবার তুমি বুঝবে। কী ফারাহ ঠিক তো? ‘
নামীর পাশে শান্ত মুখে বসা ফারাহ হ্যাঁ সূচকে মাথা নাড়াল৷ নামী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ রোজ রোজ এত ঝগড়া ভালো লাগে না আপু৷ সুহাস আমাকে সহ্য করতে পারে না৷ দেখলেই যা-তা মন্তব্য করে। তাছাড়া আমারো ওর মুখ দেখতে মন চায় না৷ ভালো লাগে না ওর আশপাশে থাকতে৷ অপছন্দের মানুষটির ত্রিসীমানায় যেতেও পছন্দ করি না আমি৷ এ বাড়িতে রয়েছি শুধুমাত্র আংকেলের জন্য। ‘
‘ সবটা জানি বোন৷ একটা দিনই তো৷ মনে করো না আজ এ বাড়িতে সুহাস নেই। শুধু তুমি আর আমরা৷ তোমার কি মন চায় না একটা দিন আনন্দে কাটাতে? বন্ধুদের সঙ্গে কিছু সুন্দর মুহুর্ত কাটিয়ে বুকের ভেতরে জমানো কষ্টগুলো থেকে কিছুটা সময় দূরে থাকতে? ‘
নিধির কথা শুনে নামীর দু-চোখ টলমল করছিল। খেয়াল করে নামীকে জড়িয়ে ধরল নিধি৷ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের চোখের ভাষা বোঝা খুব কঠিন কিছু নয় নামী। তুমি আমাকয় আর সৌধ, আইয়াজকে বন্ধু ভাবতে পারো। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি৷ ‘
নিধির স্নেহময় সান্নিধ্যে গলে গেল নামী। কেঁদে ফেলল আচমকা। কতদিন এভাবে কেউ আদর করে না, ভরসা দেয় না৷ নেয় না মমতাভরে বুকে আগলে। নিধি টের পেল ওর অনুভূতি। তাই আরো গভীর করে বুকে জড়িয়ে নিল মেয়েটাকে। আদর করল নিগূঢ় ভাবে। অনুভব করল, মেয়েটা খুব ভালোবাসার কাঙাল। ইস, সুহাসটা কেন যে বেঁকে গেল। কেন যে আপন করে নিল না মেয়েটাকে। শুধুমাত্র মায়ের বশ্যতা মেনে নিয়ে একজন পুরুষ এতটা নির্দয় হতে পারে? ফুলের মতো মেয়েটাকে কষ্ট দিতে পারে এতটাই! বুক ভার হয়ে ওঠল নিধিরও। তার মনে হলো এরজন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সুহাসের বয়স৷ মানসিক ভাবে পরিণত থাকলে নিশ্চয়ই সুহাস এমনটা করত না? বড্ড আফসোস হতে লাগল তার। মেয়েরা একুশ, বাইশ বছর বয়সে যতটা পরিণত হয় ততটা যদি ছেলেরা হতো!
রান্নাবান্নার তোড়জোড় শুরু হলো৷ সুহাস বিশ্বাসই করতে পারছে না নামী রাজি হয়েছে। নিধির দিকে ক্ষণে ক্ষণে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে সে। নিধিও বেশ ভাব নিয়ে ভ্রু নাচাচ্ছে। ইশারায় বলছে,
‘ এই নিধির পক্ষে সব সম্ভব। ‘
রান্নায় নামীকে সহায়তা করছে নিধি, ফারাহ দু’জনই। ছেলেরা কিছু করবে না এ হয় নাকি? আশপাশে সুহাস নেই৷ সে দাম্ভ দেখিয়ে রুমের ভেতর বসে আছে৷ সৌধ আর আইয়াজ আশপাশেই আছে৷ ফারাহর সঙ্গে দৃষ্টিতে দৃষ্টিতে খেলা চলছিল আইয়াজের টের পেল নিধি৷ ঠোঁট টিপে হেসে হাঁক ছেড়ে ডাকল আইয়াজকে,
‘ এই আইয়াজ এদিকে আয় তো। আমরাই শুধু পরিশ্রম করব তোরা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলবি তা তো হয় না। ‘
আইয়াজের সুবিধাই হলো৷ সে চঞ্চল চিত্তে ড্রয়িংরুম থেকে চলে এলো কিচেনে। নিধি ফারাহকে বলল,
‘ ফারাহ তুমি গাজর কাটো আর আইয়াজকে শসা কাটতে দাও। ‘
নিধির মুখে দুষ্টুমি উপচে পড়ছে। আইয়াজ বুঝতে পারল তার বান্ধবীটি বুঝে ফেলেছে তাদের ভদ্রবেশে ইটিসপিটিশ। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল সে। নাকের ডগা ফুলে ওঠল৷ সরলা ফারাহর দিকে তাকাল করুণ চোখে। নিধির দুষ্টুমি বুঝতে পারেনি ফারাহ৷ তাই সে একটি বাটিতে শসা আর ছুরি এগিয়ে দিল৷ আইয়াজ বা’হাতে চশমা ঠিক করতে করতে বাটি নিয়ে ক্যাবিনেটের সামনে দাঁড়াল। পাশ থেকে নিধি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
‘ দোস্ত পানি খাবি? ‘
ঢোক গিলল আইয়াজ। ভীষণ নার্ভাস লাগছে তার৷ ফলে গলা শুকিয়েও গেছে৷ নিধি কি এটাও টের পেয়ে গেল? কয়েক পল পর আবারো শুনতে পেল নিধির ফিসফিস,
‘ দোস্ত বুক কাঁপছে? শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে কাউকে ডাকব? কাকে ডাকি বলত, ‘
একটু থেমে ভাবুক স্বরে বলল,
‘ এই ফারাহ বেশ নাদুসনুদুস। জড়িয়ে ধরলে বেশ আরাম পাবি৷ ওকে বলব? ‘
কেঁপে ওঠল আইয়াজ। নিধির মুখে এসব কী কথাবার্তা! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল সে৷ নিধি ঠোঁট টিপে হেসে গাল টেনে দিল তার। এরপর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বেশ উঁচু গলায় বলল,
‘ ডুবে ডুবে জল খেলে একটু অসভ্য তো হবোই বন্ধু।’
চমকে ওঠল ফারাহ। মাথা নুইয়ে গাজর কাটায় মন দিল সে। চুলোর আঁচ কমিয়ে ফারাহর দিকে তাকাল নামী। মুচকি হাসল বান্ধবীর লাজুক মুখখানি দেখে৷ নতুন নতুন প্রেমে পড়লে মেয়েরা কী ভয়ানক লজ্জাবতীই না হয়ে যায়! ছোট্ট নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ফারাহকে স্বাভাবিক করতে বলল,
‘ তোর তো গরুর মাংসে এলার্জি৷ তাই তোর জন্য মুরগির মাংস ভাজা করব। চলবে? ‘
মাথা দুলাল ফারাহ৷ চলবে তার। সৌধ রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে অনেকক্ষণ। আইয়াজের সঙ্গে নিধিকে ফিসফিস করতে দেখেই ঠাঁই রয়েছে সে৷ নিধি যখন বলল, ‘ ডুবে ডুবে জল খেলে একটু অসভ্য তো হবোই বন্ধু। ‘ শুনতে পেয়েছে সে৷ তা শুনেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেছে তার৷ এই মেয়ে সবার সব সমস্যা বুঝে৷ কে গোপনে কষ্ট পেল, কে কাকে গোপনে ভালোবাসলো, কে ডুবে ডুবে জল খেল সব জানে, সব বুঝে। শুধু তার বেলাই অবলা, অজ্ঞ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সৌধ৷ নিধি কাজের ফাঁকে তাকে দেখতে পেয়ে চ্যাঁচাল,
‘ কিরে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হাতে হাতে কিছু তো করতে পারিস? আরেক নবাবজাদা কোথায়? ওকে কি কান ধরে নিয়ে আসতে হবে? ‘
সৌধ জবাব দিল না৷ নিজের মতো রান্নাঘরে ঢুকল। ফ্রিজ খুলে ফলমূল থেকে একটা কমলা নিল৷ এরপর কমলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে নিধির পাশে খুব কাছাকাছি দাঁড়াল। দৃষ্টি কমলার দিকে রেখে ভাবুক স্বরে বলল,
‘ আইয়াজ ডুবে ডুবে জল খায় সেটা বুঝিস, আর কেউ যে প্রকাশ্যে জল খাচ্ছে ওটা বুঝিস না? ‘
প্লেট গোছানোর পাশাপাশি আনমনে উত্তর দিল নিধি,
‘ যেটা প্রকাশিত ওটা আলাদা করে বোঝার কিছু নেই। ‘
বিস্মিত হলো সৌধ। বলল,
‘ তার মানে তুই বুঝেও না বোঝার ভান করিস? ‘
অকপটে জবাব নিধির,
‘ ধরে নে তাই। ‘
‘ কারণ? ‘
‘ দুটো। ‘
‘ কীহ? ‘
‘ আমরা সেম এজ এণ্ড আমরা খুব ভালো বন্ধু। ‘
স্তম্ভিত হয়ে গেল সৌধ৷ তার মানে নিধি অনেক আগেই টের পেয়েছে সে তার প্রতি আলাদা কিছু অনুভব করে? নিধির ক্ষেত্রে টের পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না বরং স্বাভাবিকই। নির্বাক হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সৌধ৷ সহসা মৃদু চিৎকারে তার জড়ীভূত ভাব কেটে গেল। চিৎকারটি নিধির৷ আইয়াজ শষা কেটে ছুরি পাশেই রেখেছিল। নিধির হাত লেগে সেটা নিচে পড়ে৷ নিধির পায়ের পাতায়৷ অল্প কেটে গিয়ে অনেক রক্ত ঝড়তে শুরু করেছে নিধির৷ সৌধ, নামী, আইয়াজ, ফারাহ সবাই আঁতকে ওঠল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিচে বসে পড়ল সৌধ৷ দু’হাতে নিধির পা চেপে ধরে চ্যাঁচিয়ে ওঠল,
‘ আইয়াজ, ফার্স্ট এইডস বক্স নিয়ে আয় জলদি। ‘
আকস্মিক ঘটনায় সকলেই হতভম্ব! কী থেকে কী হয়ে গেল! রক্ত পরিষ্কার করে নিজ হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিল সৌধ৷ নিধির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। ব্যথায় মুখের আকৃতিই পরিবর্তন হয়ে গেছে মেয়েটার৷ সৌধ চোয়াল শক্ত করে নিধির পাশে বসে আছে৷ সুহাস আইয়াজকে ধমকাতে লাগল,
‘ শালা, দেখে রাখবি না ছুরিটা? ‘
এরপরই অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল নামীর দিকে।
‘ দু, তিনটা আইটেম রান্না করতে একশজনের সহায়তা লাগে? ‘
আশ্চর্য হয়ে গেল নামী। পরোক্ষণেই দৃষ্টিতে কাঠিন্য ফুটিয়ে তাকাল সুহাসের দিকে৷ সুহাস চোখ সরিয়ে নিধির দিকে তাকাল। বলল,
‘ উপরে চল শুয়ে রেস্ট নিবি। ঘেমে গেছিস একদম। ‘
নিধি করুণ মুখে তাকাল। হাঁটবে কী করে সে? সুহাস বুঝতে পেরে অভয় দিল,
‘ আমাকে ধর। ‘
হাত বাড়াল সে। সৌধ বাঁধ সেধে বলল,
‘ আমি নিয়ে যাচ্ছি। ‘
এ কথা বলেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ কোনোকিছু পরোয়া না করেই চট করে কোলে তুলে নিল নিধিকে। নিধি হতবুদ্ধি হয়ে চাপা আর্তনাদ করে ওঠল,
‘ সৌধ কী করছিস তুই! আরেহ… ‘
নিধিকে নিয়ে সৌধ চলে গেল উপরে৷ পেছন পেছন গেল সুহাসও। আইয়াজ তাকাল মন খারাপ করে থাকা নামী আর ভয়ে বাকরুদ্ধ চোখে তাকানো ফারাহর দিকে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। বলল,
‘ নামী রান্নাটা শেষ করা দরকার। আমি সাহায্য করছি তোমাদের চলো। ‘
***
নিধিকে সুহাসের বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে দিল সৌধ। সুহাস ব্যথা কমার মেডিসিন খুঁজে বের করে নিধিকে দিল। বেড সাইট টেবিল থেকে ওয়াটার বোতলও নিতে ইশারা করল। নাক টেনে ওষুধ খেল নিধি। আহাজারি করতে করতে বলল,
‘ এ কী হয়ে গেল সুহাস! আমি কাল ক্লাসে যাব কী করে? ‘
সুহাস বলল,
‘ আরে ইয়ার তুই চাপ কেন নিচ্ছিস। আমরা আছিত দোস্ত। তুই শান্ত হো এক কাজ কর কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থাক৷ ‘
সৌধর অসহ্য ঠেকল। নিধির কান্না সহ্য হচ্ছে না তার। কতখানি কেটে গেছে ! রক্তপাতও হয়েছে অনেক। চোখের সামনে ওর ব্যথা, কান্না দেখে বুক কাঁপছে তার। অশ্রুসিক্ত মুখশ্রী দেখলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে। ইচ্ছে করছে যতটুকু নিধির কেটেছে ঠিক ততটুকু নিজেকেও আঘাত করতে। সুহাস তাকিয়ে আছে সৌধর শক্ত মুখটার দিকে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওর ভেতর এখন কী চলছে। ছেলেটা পাগলের মতো ভালোবাসে নিধিকে। নিধির এই অল্প আঘাতটাই সৌধর বুকে বিশাল হয়ে বিঁধছে জানে সে৷ তাই কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ ওর পাশে বসে থাক তুই আমি আশপাশেই আছি৷ ‘
দু’জনকে একা ছেড়ে দিল সুহাস। সৌধও ধীরপায়ে গিয়ে দরজা লক করে দিল। নিধি সবেই চোখটা বুজেছিল। দরজা লকের শব্দ শুনে রুমে শুধু সৌধকে দেখে তড়াক করে ওঠে বসল। সৌধ এ দৃশ্য দেখে ভ্রু কুঁচকে কাছে আসল ত্বরিত৷ মুখে বিরক্ত সূচক শব্দ করে বসল মুখোমুখি। বলল,
‘ এভাবে ওঠলি কেন? ‘
‘ দরজা আটকালি কেন! ‘
আতঙ্কিত স্বর নিধির৷ সৌধ থমথমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘ ভয় পাচ্ছিস কেন? মনে হয় আমি তোকে নিষিদ্ধ কিছু করার জন্য দরজা আটকেছি! বন্ধুর প্রতি এটুকু ভরসা নেই? ‘
মুখ ঘুরিয়ে নিধি বলল,
‘ থাকবে কী করে? বন্ধুত্বের ভেতরে যে নিষিদ্ধ অনুভূতি আনতে পারে সে নিষিদ্ধ কিছু করে ফেলবে না তার কী গ্যারান্টি? ‘
‘ দুটো ছেলেমেয়ে বন্ধু হতে পারলে ভালোবাসতে পারবে না কেন? ‘
সহসা মুখ ফেরাল নিধি৷ সৌধর ধারাল দৃষ্টিজোড়া হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল ওর। যে কম্পন চায় না ও৷ যেই কম্পন নিষিদ্ধ ওর জন্য৷ তাই বলল,
‘ এভাবে তাকাবি না সৌধ এভাবে তাকাবি না প্লিজ। ‘
দৃষ্টিজোড়া আরো তীক্ষ্ণ হলো সৌধর৷ নিধির কম্পিত কণ্ঠস্বর হৃদয়জুড়ে অন্যরকম দুলুনি দিল তার।নিঃশব্দে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল সে। একদম মুখোমুখি হয়ে ছাড়ল একরাশ উত্তপ্ত নিঃশ্বাস। নিধি সরে যেতে উদ্যত হতেই হাত বাড়িয়ে ওর গাল বেয়ে চলা অশ্রুটুকু মুছে দিল। চোখ বুজে নিল নিধি। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে ওঠল নিমিষে। এমন অস্থির লাগছে কেন ঠাওর করতে পারল না সে। এ প্রথম এত কাছাকাছি এসেছে সৌধ তাই কি এমন অনুভূতি হচ্ছে? কেন হবে? সৌধ তাকে নিয়ে আলাদা কিছু অনুভব করলেও সে তো অনুভব করেনি। তাহলে কেন এমন লাগছে? এ প্রথম কোনো পুরুষ এতটা কাছে এসেছে বলেই কী? হ্যাঁ তাই হবে৷ যতই তারা ভালো বন্ধু হোক না কেন। তারা তো বিপরীত লিঙ্গ। নিধি চোখ বুজে অনুভূতির হিসেব কষতে ব্যস্ত। এদিকে সৌধর বুকের ভেতর চলা অনুভূতির তরঙ্গোচ্ছ্বাসটুকু বাধ্য করল, নিধির সিক্ত কোমল গালটায় নিজের পুরো ঠোঁটে আদর মিশিয়ে উত্তপ্ত স্পর্শ ছোঁয়াতে। আকস্মিক সৌধর এহেন স্পর্শে সারা শরীরে বিদ্যুৎ চমকাল নিধির৷ মস্তিষ্ক চেতনাশক্তি হারাল। বড়ো বড়ো চোখ করে অবিশ্বাস্য চাউনি নিক্ষেপ করল সৌধর প্রগাঢ় দৃষ্টিতে৷ ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
‘ এটা তুই কী করলি? ‘
আলগোছে সরে গেল সৌধ। মুচকি হেসে বলল,
‘ কিছু করিনি খেয়েছি, বুঝিসনি? আবার খাব? ‘
‘ মানে কী খাবি তুই? ‘
‘ অন্যকিছু নয়, চুমু। ‘
মুখ হা হয়ে গেল নিধির। সৌধ যে এমন কাণ্ড করবে এমন কথা কিছু বলবে ভাবনার বাইরে ছিল তার৷ এই ছেলের বন্ধুত্ব এত মসৃণ আর ভালোবাসা কী বেপরোয়া! কান দু’টো গরম হয়ে গেল বেচারির৷ নাকের ডগা রক্তবর্ণ হয়ে ওঠল নিমিষে। সহসা হো হো করে হেসে ওঠল সৌধ। বলল,
‘ এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমাদের প্রেম হয়নি তো ডিয়ার, লজ্জা পেতে হবে না৷ চুমুটা বন্ধু হিসেবেই খেয়েছি। প্রেমিক হিসেবে খেলে তো ঠোঁটে খেতাম গালে নয়। ‘
‘ বন্ধু হিসেবে চুমু খেয়েছিস? অসভ্য। ‘
কথাটা বলেই সৌধর কলার চেপে ধরল সে। সৌধ অমায়িক ভঙ্গিতে নিধির দুহাতের ওপর নিজের হাত রাখল। ঠোঁটে দুষ্টুমি ভরে হাসি ফুটিয়ে শুধাল,
‘ বান্ধবীকে চুমু খাওয়া কি দণ্ডনীয় অপরাধ? ‘
দাঁতে দাঁত চিবিয়ে নিধি বলল,
‘ নারে দোস্ত অপরাধ না, অধিকার। এ জন্যই তুই কাল প্রাচীকে চুমু খাবি। ইট ইজ ফাইনাল। ‘
‘ হোয়াট! ‘