ত্রিধারে তরঙ্গলীলা

সুহাস, নামী এক সঙ্গে এক রাত বদ্ধ ঘরে থাকা মানে ভয়াবহ সুনামি ঘটবেই ঘটবে। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল বন্ধুরা। কিন্তু সেই সুনামির পরিণাম যে সুহাসকে এভাবে বদলাতে শুরু করবে ভাবতে পারেনি ওরা। ভাবতে পারেনি স্বয়ং নামীও। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেদিনের পর সুহাস আর নামীর পেছনে লাগেনি৷ কখনো সামনে পড়লে অল্প সময় চোখাচোখি হয়েছে শুধু৷ নামী ঐ চোখে পূর্বের মতো ক্রোধ দেখতে পায়নি। পায়নি বিন্দুমাত্র দুরন্তপনাও। ও চোখের ভাষা ঠিক কী বুঝতেও পারেনি সে। বুঝতে চায়ও না৷ শুধু কৌতূহল জাগে একটি বিষয় নিয়ে। ডিভোর্সের ব্যাপারে সুহাস আগাচ্ছে না কেন? সে যেভাবে আশ্বাস দিয়েছে তাতে সুহাসেরই বেশি আগ্রহী থাকার কথা। তাহলে সুহাস নিশ্চুপ কেন? সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সেদিনের পর রোজ ফজর ওয়াক্তের পর সুহাসকে বাড়ির বাইরে যেতে দেখা যায়। জিমের পোশাক পড়ে সাইকেল নিয়ে চলে যায় সৌধদের বাড়িতে৷ তাদের বাড়ি থেকে সৌধদের বাড়ির দূরত্ব সাইকেল করে পঁচিশ মিনিট। এ বাড়িতে যে মহিলা কাজ করতে আসে তার সঙ্গে নামীর খুব ভালো সম্পর্ক। তার কাছেই শুনেছে সুহাস সৌধর ব্যক্তিগত শরীরচর্চা কেন্দ্রে যোগ দিয়েছে। এ কথা সেলিনা আপাকে বলেছে সিমরান৷ সে নাকি খুব ভাব নিয়ে বলেছে,
‘ সেলিনা আপা, খুব তাড়াতাড়ি আমার ব্রোও সৌধ ভাইয়ের মতো ড্যাশিং ম্যান হয়ে যাবে। এই একটা কমতিই ছিল আমার ভাইয়ের। কত বলেছি, ভাগ্যিস এতদিনে উইজডম হলো। ‘
সুহাস ড্যাশিং ম্যান হোক বা ফাঁসিং ম্যান, যায় আসে না নামীর। তার ফোকাস কেবল ক্যারিয়ারের দিকে।
সকালবেলা নাস্তা সেরে রেডি হয়ে নিল নামী। হলুদ রঙের ঘেরওয়ালা সূতি একটি গাউন পরে তার ওপর সাদা অ্যাপ্রোন পরে নিল ঝটপট। এরপর কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে বা’হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বেরিয়ে পড়ল। গেটের সামনে আসতেই পাশের বাসার ভদ্রমহিলা মিষ্টি হেসে এগিয়ে এলেন৷ যেন নামীর অপেক্ষাতেই ছিল সে। এর আগে পরিচয় হয়েছিল উনার সাথে তাই সৌজন্যতা দেখিয়ে সালাম দিল নামী। ভদ্রমহিলা সালাম ফিরিয়ে বলল,
‘ তোমার আংকেল, আন্টি কবে ফিরবে জানো? ‘
নামী অটো দাঁড় করিয়ে তাড়াহুড়োয় উত্তর দিল,
‘ আংকেল সাতদিন পর, আন্টির কথা জানি না। আমার সাথে কথা হয়নি তার সাথে। আসি আন্টি। ‘
ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে মাথা কাত করল। নামী চলে গেলে সে ভাবল, আপাতত সোহান খন্দকারের ছেলেমেয়ের সাথেই কথা বলে যাবে। ভাবা অনুযায়ী কলিং বেলে চাপ দিল বারকয়েক। ভিতর থেকে সেলিনা এসে গেট খুলে বলল,
‘ চাচা, চাচি বাসায় নাই। ‘
‘ উনার ছেলেমেয়েরা আছে? ‘
‘ সিনু আপা কলেজে। আর সুহাস ভাই মাত্রই জিম থিকা ফিরল। ‘
ভদ্র মহিলা হাসল। বলল,
‘ আমি সুহাসের সাথেই কথা বলব। ‘
সেলিনা সন্দেহের চোখে তাকিয়েই তাকে ভেতরে নিয়ে বসতে দিল। এরপর দোতলায় গিয়ে ডেকে আনল সুহাসকে৷ সুহাস রেডি হচ্ছিল ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য৷ এরই মধ্যে পাশের বাসার মহিলা চলে আসায় ভীষণ অবাক হলো। হঠাৎ তার কাছে কী প্রয়োজন? সে তো এদেরকে ঠিকভাবে চিনেই না। আলাপও হয়নি কখনো। কৌতূহলী চিত্তে নিচে নেমে এলো সে। বসল ভদ্রমহিলার মুখোমুখি হয়ে। ভদ্রমহিলা এক গাল হেসে বলল,
‘ আমি তোমাদের প্রতিবেশী। আমার ছেলে ইয়ামিন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার। খুব ব্রিলিয়ান্ট! দেখতে লম্বা, চওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। শুধু গায়ের রঙই কালো। প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে অফিসে যায়। দেখেছ বোধহয়। ‘
সুহাস তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। ভদ্রমহিলার বেশভূষায় বলে দিচ্ছে সে যথেষ্ট শিক্ষিত আর রুচিশীল। কিন্তু আচমকা এসে এসব কথাবার্তা বলায় বিব্রত হলো সে। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,
‘ হ্যাঁ দেখেছি কয়েকবার। ‘
সুহাসের এ কথায় মহিলাটির জোশ বাড়ল। বলল,
‘ তোমার বাবা, মায়ের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি অনেকদিন৷ দু’জনই ব্যস্ত মানুষ বলে সুযোগ পাচ্ছি না। তুমি কি তোমার বাবা, মায়ের নাম্বারটা দিতে পারবে? ‘
সুহাস দেরি করল না। ইয়ামিন সাহেবের মাকে বাবা, মায়ের নাম্বার দিয়ে উদ্ধার হতে চাইল। কিন্তু ইয়ামিনের মা তাকে উদ্ধার হতে দিল না। সে নাম্বার নিয়ে হঠাৎ চাপা স্বরে বলল,
‘ একটু আগে বের হলো মেয়েটার নাম তো নামী রহমান? ‘
সুহাসের ভ্রু জোড়া কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিল,
‘ হুম। ‘
‘ তোমার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে তো? ডাক্তারি পড়তেছে। তুমি যেখানে পড়ো ওখানেই তাই না? ‘
বাবার বন্ধুর মেয়ে নামী। এ মহিলা মায়ের বলছে কেন? তবে কি নামী বলেছে? নাকি বাবাই সবাইকে এটা বলে ম্যানেজ করেছে? আর ভাবতে পারল না সুহাস। একই তো হলো। তাই বলল,
‘ হ্যাঁ। ‘
মহিলাটি এবার আরো নিচু স্বরে বলল,
‘ মেয়েটা বেশ সুশীল আছে তাই না? কারো সাথে রিলেশনশিপেও নেই। জিজ্ঞেস করেছিলাম সেদিন। ‘
এবারে অস্বস্তি ঠেকল সুহাসের। এমন স্মার্ট একজন মহিলা ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছে তাকে বোধগম্য হলো না। শুধু অপেক্ষা করতে লাগল পরের কথা গুলো শোনার জন্য৷ তার মন বলছে আরো কিছু বলবে সে। হলোই তাই। মহিলাটি বলল,
‘ আমার ছেলেকে তো দেখেছ? ওর জন্য পাত্রী খুঁজছি। সমস্যা হচ্ছে ফরসা চামড়ার মেয়েরা ওকে পছন্দ করে না৷ গায়ের রঙ বেশি ডার্ক হওয়াতে ওর ছবি দেখে মেয়ে তো দূরে থাক মেয়ের পরিবারই প্রস্তাব নাকোচ করে দেয়৷ এজন্য আমিও আর ফরসা মেয়ে খুঁজি না। আমার ছেলেও বলে দিয়েছে ফরসা মেয়ে না দেখে সুশীল মেয়ে খুঁজো গায়ের রঙ যাই হোক ওর সমস্যা নেই। ‘
আকস্মিক কপালের রগ দপদপিয়ে ওঠল সুহাসের। এই মহিলা কী বলতে চাচ্ছে? কী বোঝাতে চাচ্ছে তাকে? নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রেখে চোয়াল শক্ত করে সে বলল,
‘ আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন। ‘
‘ নামী মেয়েটাকে আমার ছেলের বউ হিসেবে খুব পছন্দ হয়েছে। মেধাবী মেয়ে। দেখতে শ্যামলা হলেও মুখের আদল মাশাআল্লাহ। আমার ছেলের উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় আর ওর পাঁচ ফুট পাঁচ। আমার ছেলের ওজন পচাত্তর আর নামীর ওজন তিপ্পান্ন। একদম পারফেক্ট ম্যাচ। শুনেছি ওর মা নেই সৎ মা আর বাবা আমেরিকায় থাকেন৷ ওর সব দায়িত্ব এখন তোমার বাবার। শুনো তোমার বাবার সাথে আমি কথা বলব। তুমিও উনাকে বলো আমার কোনো মেয়ে নেই৷ তিন ছেলের মধ্যে ইয়ামিনই বড়ো। ওর বউকে একদম নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসবো আমি। ‘
কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে সুহাসের। আর সহ্য করতে পারছে না সে। নামীর সাথে তার সম্পর্কটা হয়তো স্বাভাবিক না। তাই বলে তাদের ডিভোর্স না হতেই অন্য একজন বিয়ের প্রস্তাব আনবে? আর নামী। সেই বা কোন লজ্জায় নিজের ব্যাপারে এত কিছু বলতে গেছে? তবে কি সে নতুন করে কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইছে? এজন্যই কি সেদিন ওভাবে ডিভোর্স চাইল? দু-হাত শক্ত মুঠ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল সুহাস। ইয়ামিন সাহেবের মা খেয়াল করলেন সুহাসের চোখ, মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। কপাল চুইয়ে চোয়াল বেয়ে ঝড়ছে ঘাম। তাই বললেন,
‘ কী হয়েছে বাবা, গরম লাগছে? ‘
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সুহাস। চাপা গলায় বলল,
‘ হ্যাঁ গরম লাগছে। আপনি বসুন আমি উপরে যাচ্ছি। ‘
‘ না, না বাবা আর বসব না৷ কথা তো সব বলেই দিলাম। বাকিটা তোমার বাবা, মায়ের সাথে বলব। ‘
চমকে ওঠল সুহাস। মহিলাটি বিদায় নিল। তার হৃদয় জুড়ে শুরু হলো প্রবল তরঙ্গ। বাবার সাথে কথা বললে কী হবে জানে না। কিন্তু মায়ের সাথে কথা বললে মা নির্ঘাত এর সুযোগ নেবে! মা চাইবে নামী তার জীবন থেকে পুরোপুরি চলে যাক। বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক চাপ অনুভব করল সুহাস৷ দুরুদুরু বুকে
ঢোক গিলল সে। মাথাটা জাস্ট ধরে গেল। সহ্য করতে না পেরে পকেট থেকে দ্রুত মোবাইল বের করে কল করল সৌধকে। আজ সিমরানের জন্মদিন। মা, বাবা নেই। তাই বন্ধুদের নিয়ে ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করেছে সে। তারা ভাই, বোন মা, বাবাকে খুব কম সময়ই পেয়েছে। সরকারি ছুটি ছাড়া মাকে তো পাওয়াই হয় না। জন্মদিনে সিমরান খুব মন খারাপ করে মা কাছে থাকে না বলে৷ এবার তো বাবাও কাছে নেই। তাই বন্ধুদের সঙ্গে প্ল্যান করেছে এবার অন্যভাবে সিমরানের জন্মদিন পালন করবে৷
সিমরান তার বন্ধুদের সাথে সারাদিন এনজয় করে রাতে ভাই আর ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে কেক কাটবে। সেই কেক এর দায়িত্ব দিয়েছে সৌধ আর আইয়াজের ওপর৷ ওরা কেকের সাথে মেয়ে বান্ধবী নিয়ে সিমরানের জন্য গিফট কিনতেও গেছে৷ সব কেনাকাটা শেষে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ক্লাসে যাবে। ক্লাস শেষ হবে বিকাল পাঁচটায়। সন্ধ্যার পর জন্মদিনের পার্টি। সব পরিকল্পনা মাফিকই আগাচ্ছিল। এর মধ্যে ইয়ামিনের মা এসে গণ্ডগোল করে দিল। সুহাসও প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বাসায় আসতে বলল সৌধদের।
আধা ঘন্টার মধ্যে সৌধ, আইয়াজ, নিধি, প্রাচী এসে উপস্থিত হলো৷ ড্রয়িংরুম সাজানোর দায়িত্ব নিল নিধি, প্রাচী আর আইয়াজ। সাথে সেলিনা আপাও৷ ওরা ওদের কাজে লেগে পড়ল ঝটপট। ক্লাস টাইম হওয়ার পূর্বে যতটা করা যায়। এদিকে সুহাস সৌধকে নিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে খুলে বলল সমস্ত ঘটনা। এরপর নামীর ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপা সুরে বলল,
‘ সব ঐ নামীদামির কারসাজি। ও ইচ্ছে করে এটা করেছে। ‘
বলতে বলতেই নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরল। সৌধ বেআক্কলের মতো তাকিয়ে। বলল,
‘ বুঝলাম না, এখানে নামীর দোষটা কী? ‘
সুহাস বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে ওঠল। সৌধও বাদ রইল না। তেড়ে এসে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলল ওকে। এরপর ওর পেটের ওপর বসে গলা চেপে ধরে বলল,
‘ শা’লা, ম্যাঁ ম্যাঁ করে বউকে স্বীকৃতি দিবা না। সেই বউ তোমার পা চেটে পড়ে থাকব আশা করো? ‘
দুই বন্ধুর বদ্ধ ঘরের কীর্তি কেউ দেখল না৷ ওরা একে অপরের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করতে থাকল৷ সৌধর ভাষ্যে যা হয়েছে বেশ হয়েছে। এটাই সুহাসের প্রাপ্য ছিল। সুহাসের ভাষ্যে নামীদামি কেন এসবে আগ্রহ প্রকাশ করবে তারা এখনো স্বামী- স্ত্রী। কোন সাহসে ঐ মহিলাকে নিজের হাইট, ওয়েট সম্পর্কে অবগত করেছে। কী প্রয়োজন ছিল উনার সাথে মিষ্টি স্বরে আলাপ করার? তার বেলায় তো ঠিকি নিম পাতার রসের মতো তেঁতো স্বর বেরোয়। প্রচণ্ড ডেসপারেট হয়ে পড়ল সুহাস৷ ভাবগতিক স্বাভাবিক না, টের পেয়ে সৌধ প্রশ্ন করল,
‘ তুই নামীকে ভালোবাসিস? ‘
সুহাস তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল,
‘ জিন্দিগি তে না। ‘
সৌধর মেজাজ খারাপ হলো। এই ছেলে ভাঙবে তবু মচকাবে না৷ তাই সে ঠাণ্ডা মাথায় বলল,
‘ দেখ সুহাস ইগো টিগো দূরে রেখে ভালোই ভালোই সবটা বল। ‘
সহসা শান্ত হলো সুহাস। ধীরেসুস্থে গিয়ে বসল সৌধর পাশে। বলল,
‘ তুই নামীকে বলবি না কিছু। ‘
‘ ওকে বলব না। ‘
‘ সেই রাতের পর আমি ফিল করেছি ওর প্রতি আমার তীব্র ফিলিংস আছে। আর আজ সেই ফিলিংস একদম পরিষ্কার। ‘
হো হো করে হেসে ওঠল সৌধ। বলল,
‘ তবু বলবি না তুই ওকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবেসে ফেলেছিস। ‘
মুখ নিচু করে সুহাস বলল,
‘ না বলব না৷ আমি কোনো নামীদামি কে ভালোবাসি না। ‘
মিটিমিটি হাসল সৌধ। তার বন্ধুর অতিরিক্ত ইগো এরওপর আবার মায়ের ন্যাওটা। সবটা বুঝে ভরসার স্পর্শ রাখল সুহাসের কাঁধে। বলল,
‘ কুল ম্যান। নামীকে ভালোবাসা লজ্জার বা অস্বস্তির না৷ ওর মতো কঠিন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়েকে ভালোবাসা গর্বের। ‘
হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। বলল,
‘ দরজার চিপায় পড়েছিরে দোস্ত। ‘
‘ আমি আছি চাপ নিস না। বের করে ফেলব। ‘
চমকে তাকাল সুহাস৷ সৌধ চোখ উপর নিচ করে বলল,
‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য রাখ, সবচেয়ে বড়ো কথা নিজের মনকে স্থির কর। কোনটা সঠিক কোনটা ভুল সুক্ষ্ম মনে বোঝার চেষ্টা কর। স্যালিউশন পাবি। না পেলে আমরা আছি৷ ‘
শেষ কথাটা বলেই চোখ টিপ দিল সৌধ৷ মাথার ওপর থেকে অনেক বড়ো একটি বোঝা নেমে গেল নিমেষে। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। বলল,
‘ পার্টিতে নামীদামিকে রাখার ব্যবস্থা করিস। ‘
ফিচেল হেসে সৌধ বলল,
‘ নিধির ওপর ছেড়ে দিছি। ও সিমরানকে বোঝাবে। সিমরান যেচে ইনভাইট করলে নামী প্রেজেন্ট থাকবে৷ সিমরান না বললে সিয়র দিতে পারছি না৷ ‘
***
জমকালো আয়োজনে ড্রয়িংরুম সজ্জিত করা হয়েছে। নামী জানত আজ সিমরানের জন্মদিন। সেলিনা আপার কাছে শুনল, সন্ধ্যায় পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। নিধি আপুও ম্যাসেজ করেছিল তাকে উপস্থিত থাকতে হবে৷ ম্যাসেজটা দেখে নামী বাঁকা হেসেছে। তার আত্মসম্মানকে এতটা ঠুনকো ভাবে কেন এরা? সিমরান তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। সে না হয় ছোটো মেয়ে। কিন্তু সুহাস তো এতটাও ছোটো নয়৷ সুহাসও তাকে বলেনি জন্মদিনের আয়োজনে উপস্থিত থাকতে। তাহলে সে কেন থাকবে? নিধি আপুর কথায়? অসম্ভব। নিধি আপু সুহাসের বান্ধবী। তার দেয়া দাওয়াতে সে তার ননদের জন্মদিনে উপস্থিত থাকবে? ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর আর অপমানের। তাই কলেজ থেকে এসে লম্বা ঘুম দিয়েছিল সে। ভেবেছিল রাতের আগে ওঠবে না। অথচ সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দিলেই আচমকা ঘুম ছুটে যায়৷
আজান শেষে আচমকা দরজার বাইরে সিমরানের গলা শুনে চমকেও ওঠে সে।
‘ নামী আপু, নামী আপু, আসব? ‘
এ প্রথম সিমরান তার সঙ্গে কথা বলছে৷ ভাবি হিসেবে মানতে পারেনি বলেই বোধহয় আপু বলছে। অস্বস্তি হলো না নামীর বরং মন থেকে না মেনে ভাবি ডাকলেই তীব্র অস্বস্তিতে ভুগত৷ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল,
‘ দরজা খোলা আছে, ভেতরে এসো। ‘
বলতে বলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকল সিমরান। হাতে দু’টো শপিং ব্যাগ। সে এসেই চটপটে গলায় বলল,
‘ শোনো তোমার ওপর আমার যত রাগ ছিল সব একপাশে রেখে এসেছি। আশা করি তুমিও সব রাগ একপাশে রেখে আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। ‘
কথাগুলো বলেই নামীর সামনে এসে বসল। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে হঠাৎ নামীর হাত দু’টো ধরে বলল,
‘ আমাকে একটু সিম্পল সাজে সাজিয়ে দাও তো। ‘
বিস্মিত হলো নামী৷ যতটুকু জানে সুহাসের বোন সিমরান প্রচণ্ড গর্জিয়াস একটা মেয়ে। চুলে করা ব্রাউন কালার, ভ্রু প্লাক করা, চেহারার চাকচিক্যেই সেটা বোঝা যায়। সে মেয়ে হঠাৎ সিম্পল সাজতে চাইছে। তাও আবার তার কাছে! সিমরান বুঝতে পারল আকস্মিক তার এত ভালো আচরণে অবাক হচ্ছে নামী। তাই তাকে স্বাভাবিক করতে বলল,
‘ শোনো আমি নিজের স্বার্থেই তোমার কাছে এসেছি এত সন্দেহ করার দরকার নেই। ‘
সতেরো বছর বয়সী মেয়েটার স্পষ্টভাষী স্বভাবে যারপরনাই বিস্মিত হলো নামী। সুহাসের বিপরীত এই মেয়ে টের পেল৷ সেই সঙ্গে মুগ্ধ হলো, ওর চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে। মুখের আদল মা ভাইয়ের মতো হলেও চোখ দু’টো তাদের মতো হয়নি৷ কাজল কালো টানা চোখ দুটোর জন্যই নিখুঁত রূপবতী তকমা দেয়া যাচ্ছে। যুবতী বয়সে না জানি কত রূপবতী লাগবে!
এই বাচ্চা মেয়েটার রূপে তারই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মেয়ে হয়েই যদি তার এ অবস্থা হয় ছেলেদের না জানি কি হাল! ঢোক গিলল নামী। বলল,
‘ তুমি তো খুব সুন্দর দেখতে! ‘
আকস্মাৎ কথায় ভড়কে গেল সিমরান। লজ্জা পেয়ে গেল খুব। নিচু গলায় বলল,
‘ থ্যাংকিউ। ‘
নামী বলল,
‘ ড্রেস কি এটাই থাকবে এভাবেই সাজাব? ‘
সিমরানের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। নিচু গলায় বলল,
‘ এখানে দুটো জর্জেট গাউন আছে। একটা চুজ করে দাও। নিধি আপু বা প্রাচী আপুকে হেল্প করতে বলতে পারতাম৷ কিন্তু খুব লজ্জা পাচ্ছি ওদের সামনে। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল নামীর। লজ্জা পাচ্ছে কেন? মেয়েটা কি অনেক লাজুক? কোথায় এতদিন তো এ কথা মনে হয়নি। সিমরান গাউন দু’টো বের করে দেখাল। দুটোই আকাশি রঙা। নামী অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ ওমা, দুটোই আকাশি রঙের কেন? ‘
‘ আমার তো সব রঙেরই ড্রেস আছে। জন্মদিন উপলক্ষেও সব রঙের ড্রেস কিনেছি। তার মধ্যে এই দুটোর সঙ্গে আজ সৌধ ভাইয়ের পরা শার্টের মিল পেয়েছি! ‘
মুখ ফসকে কথাটা বলেই জিভ কামড়াল সিমরান। নামী হকচকিয়ে গেল। এই মেয়ে বলে কী? সিমরান তৎক্ষনাৎ নামীর হাত ধরে বলল,
‘ প্লিজ প্লিজ কিছু ভেবো না। আসলে আই এম ইন লাভ উইথ সৌধ ভাই ফর টু ইয়ার্স। সেই ক্লাস নাইন থেকে৷ এই সিক্রেটটা কিন্তু কেউ জানে না। আমি আরেকটু বড়ো হলেই আই মিন ইন্টারটা শেষ করলেই ওকে মনের কথা জানাব। এখন বললে ভাববে বাচ্চা বয়সের আবেগ। তুমি কিন্তু কাউকে বলো না৷ বললে খুব খারাপ হবে তোমার সঙ্গে। ‘
দম ছাড়ল সিমরান। নামী নির্বাক দৃষ্টিতে এক আনাড়ি মেয়ের প্রেমের পাগলামি প্রলাপ শুনছে। সিমরান তাড়া দিয়ে আবার বলল,
‘ সৌধ ভাই একদম সিম্পল সাজ লাইক করে। শুনেছি আমি, তাই আজকে তার পছন্দ অনুযায়ীই সাজব। এবার বুঝতে পেরেছ তো কেন তোমার কাছে এসেছি? নিধি, প্রাচী আপুকে তো এসব বলে কনভিন্স করতে পারতাম না৷ লজ্জা পেতাম, লাভ সিক্রেটটাও সবাই এখনি জেনে যেত। তাই তোমার কাছে আসা। ‘
আরো একবার দম নিয়ে পুনরায় বলল,
‘ আর শোনো আমাদের মধ্যে যে সমস্যা আছে এটার প্রভাব কিন্তু সাজে ফেলো না৷ তাহলে কিন্তু ব্রো’কে বলে তোমাকে খুব অপদস্ত করাব। একদম অনেস্ট ভাবে সাজিয়ে দেবে। দেখতে ভালো না লাগলে কিন্তু বাড়ি মাথায় তুলব, তোমার রুমের সব জিনিস ভাঙচুরও করব৷ রেগে গেলে আমি খুব ভয়ানক হয়ে যাই৷ কেউ সামলাতে পারে না। এবার বলো কোনটা পড়লে বেশি সুন্দর লাগবে। বলো বলো। ‘
সিমরানের পরিবর্তে অন্য কেউ হলে নামী দুটো কঠিন কথা বলে দিত। এমন উদ্ধতস্বভাব তার একদম পছন্দ না৷ কিন্তু সিমরান যখন কথা গুলো বলছিল একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল। রাগ তো হলোই না বরং খুব আদর পেল এই মেয়ের প্রতি। সেই সাথে আরো একটা জিনিস অনুভব করল। ওরা দুই ভাই বোনই খুব সরল মনের। ওদের ভেতরে রাগ, জেদ, অহংকার এসব ছাপিয়ে খুব সরল একটা মন আছে। শুধুমাত্র সঠিক গাইডলাইনের অভাবে এরা অনেকটা বেঁকে গেছে। যাবে নাই বা কেন? বাবা, মা ছেড়ে কাজের লোকের কাছে বড়ো হওয়া সন্তানরা আর কতোই সুশীল হবে? কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে আর যাইহোক সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করা যায় না।

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.