বিয়ে বাড়ির আমেজ এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কাছের অতিথিবৃন্দের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত আছে। তাই সুজা চৌধুরীর ব্যক্তিগত মিটিং রুমে নেয়া হলো সৌধ, নিধিকে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সৌধর মা আর দাদুনিকে রাখা হয়েছে৷ বন্ধুদের মধ্যে রাখা হলো শুধু সুহাস, আইয়াজকে। ছোটোবেলা থেকেই সৌধ ভীষণ শান্ত প্রকৃতির হলেও জেদটা মারাত্মক।
ব্যক্তিভেদে প্রচণ্ড গম্ভীরও এই ছেলে। মেজাজের ব্যাপারটা কালেভদ্রে দেখা যায়। কিন্তু এমন উশৃংখল মেজাজের দেখা মিলল এবারি প্রথম। সুজা চৌধুরী স্তম্ভিত মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে। ছোটো ছেলের এ কোন রূপের সঙ্গে পরিচয় ঘটল তার? সে জানত বড়ো ছেলেটা তার স্বভাবের হয়েছে। ছোটোটা পেয়েছে মায়ের স্বভাব। মাথায় রক্ত ওঠা, খু ন চাপা ক্রোধ তো স্ত্রী তানজিমের নয়। এই ক্রোধ তো তারই অংশ। ঘোর কাটল সুজা চৌধুরীর। তার পাশের চেয়ারে দৃষ্টি মেঝেতে স্থির রেখে সৌধ বসা। সম্মুখের চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে কাঁদছে নিধি৷ তার ডান পাশে তানজিম চৌধুরী, বামপাশে দাদুনি। সুহাস আর আইয়াজ একপাশে উদ্বিগ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে। সকলের দিকে একবার শীতল দৃষ্টিপাত করে মুখ খুললেন সুজা চৌধুরী। টেবিলে দু’হাতের কনুই ভর দিয়ে নিধিকে উদ্দেশ্য করে দৃঢ়স্বরে বললেন,
‘নিধি মা, তুমি আমার ছেলের সাথে কমিটেড ছিলা?’
তৎক্ষনাৎ দু’দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে হুহু করে কেঁদে ওঠল নিধি। দু-হাত মুখ চেপে একাধারে কেঁদেই গেল সে। নিজেকে বড্ড এলোমেলো লাগছিল সৌধর। মাথাটা ঘুরাচ্ছে। মস্তিষ্কে চাপ পড়ছে খুব। বুকের ভেতর একটা অংশ জুড়ে অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করছে। কোনোভাবে হিসেব মেলাতে পারছে না সে৷ তার এই এলোমেলো অবস্থায় বাবার প্রশ্নে নিধির উত্তর বিস্ফোরণ ঘটাল। তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে উদ্যত হলো নিধির দিকে তেড়ে আসতে। সুজা চৌধুরী বুদ্ধিমান মানুষ। তুখোড় রাজনীতিবিদ। এক মাথায় ঘরে, বাইরে রাজনীতি করে বেড়ায়। তার তীক্ষ্ণ জ্ঞানে ছেলের প্রতিক্রিয়া আর নিধির প্রতিক্রিয়ায় ভীষণ অমিল লক্ষ্য করলেন। তাই ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহসা হাত টেনে ধরে গরম চোখে তাকালেন। বাবার তোপের মুখে পড়ে কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রণ হলো সৌধ। ধীরগতিতে বসল আগের ন্যায়। সুজা চৌধুরী ফের ক্রন্দনরত নিধির পানে তাকালেন। বললেন,
‘ দেখো মা আমার বিশ্বাস সৌধকে আমি যতটুকু চিনি তার চেয়ে বেশি তুমি, সুহাস, আইয়াজ চিনো। আমার ছেলের প্রতি কিছুটা বিশ্বাস রাখাকে তুমি অন্যায় ভাবে দেখো না। ‘
কথাটা বলে শেষ করতেই হঠাৎ তার চোখ পড়ল সুহাসের দিকে। সুহাস যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। অনুমতির অভাবে সাহস পাচ্ছে না। তাই অনুমতি, সাহস দু’টোই দিলেন তিনি বললেন,
‘ সুহাস এদিকে আসো। ‘
সঙ্গে সঙ্গে সুহাস এগিয়ে এলো। সুজা আংকেল বলল,
‘ বসো তোমার কিছু বলার থাকলে বলো। আমি শুনতে চাই। ‘
সুহাস যেন এই সুযোগটারি অপেক্ষায় ছিল। তাই চেয়ারে না বসে চট করে নিধির সম্মুখে মেঝেতে বসে পড়ল৷ এরপর তাকাল সুজা আংকেলের দিকে। বলল,
‘ আমি নিধির সাথে কথা বলতে চাই আংকেল। আমার মনে হয় এতে করে সবাই সবার উত্তর পাবে। কী সত্যি, কী মিথ্যা সেটাও জানা হবে। ‘
‘ বেশ কথা বলো। ‘
কিয়ৎক্ষণ নীরবতা চলল। সুহাসও তৈরি হয়ে নিল নিধির সঙ্গে বোঝাপড়া করার। নিধি দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। যে কথাগুলো ঠান্ডা মাথায়, ঠান্ডা পরিস্থিতিতে বন্ধুদের বলতে চেয়েছিল। আজ এই বিধ্বস্ত মুহুর্তে সে কথাগুলো বলতে বাধ্য হলো সে। তার পূর্বে অবশ্য সুহাসের ক্রোধ মিশ্রিত কিছু কথার উত্তর দিয়ে নিল। সুহাস বলল,
‘ তুই জানতি না সৌধ তোকে ভালোবাসে?’
নিধি মাথা নাড়াল। সুহাস আবারো প্রশ্ন করল,
‘ তুই ওকে সময় দিসনি? ‘
এবারেও মাথা নাড়াল নিধি। চোয়াল শক্ত করে রক্ত বর্ণ চোখে তাকিয়ে সুহাস বলল,
‘ স্মৃতি আপুর বিয়ের পর পরিবারকে জানিয়ে তোর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার কথা ছিল না? ‘
সুহাসের প্রতিটা প্রশ্নে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল নিধি। এতে সুহাসের ক্রোধ প্রগাঢ় হলো। বলল,
‘ তাহলে এই বেইমানিটা কীভাবে করতে পারলি? সৌধকে তুই ভালোবাসা, সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দিসনি মানলাম। কিন্তু গত তিন বছরে তোদের চালচলন, হাবভাবে কিছু সুপ্ত অনুভূতি ছিল। যা খোলা চোখে দেখা না গেলেও আমি এবং আমরা দেখতে পেয়েছি। তুই কেন সৌধর অনুভূতি নিয়ে খেললি? অর্পণ স্যারের প্রতি তুই ক্রাশড ছিলি। তাই বলে তাকে ভালোবাসিস বা তার সাথে সম্পর্কে আছিস এমন কিছু না দেখেছি আর না শুনেছি আর না তুই বলেছিস। কেন করলি এমন বল? যদি অর্পণ স্যারকেই ভালোবাসিস গত তিন বছরে কেন আমাদের বা সৌধকে জানাসনি। সৌধর অনুভূতিতে কেন নীরব ছিলি, কেন এভাবে ধোঁকা দিলি? খুব কষ্ট হচ্ছে নিধি খুব। তোকে বেইমান ভাবতে, তোর এই নতুন রূপ দেখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সবশেষে সৌধর অনুভূতি নিয়ে এভাবে খেলাধুলা জাস্ট মেনে নিতে পারছি না। ‘
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল সুহাস। ওপাশ থেকে আইয়াজ বলল,
‘ মুখ খোল নিধি। নয়তো আজ এখানেই আমাদের বন্ধুত্ব শেষ। ‘
আকস্মিক কেঁপে ওঠল নিধি। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে ত্বরিত স্বরে বলল,
‘ সব বলব আমি। বলতে চেয়েছিলামি। কিন্তু সেই সুযোগটা পাইনি। ভেবেছিলাম স্মৃতি আপুর বিয়ের ঝামেলা কে টে গেলে বলব। আমি চাইনি আমার জন্য সৌধর আনন্দ মাটি হয়ে যাক। ‘
সুহাস স্তব্ধ মুখে বলল,
‘ একটা কথা বল, অর্পণ স্যারের সঙ্গে তোর প্রেম কত দিনের? ‘
ঢোক গিলল নিধি। মাথা নিচু করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘ আমাদের মধ্যে কখনো প্রেম ছিলই না। উনার প্রতি আমার সফট কর্ণার ছিল তবু তিন বছর আগে। ‘
‘ এখন? ‘
‘ আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী! ‘
ঠান্ডা কণ্ঠ নিধির । বাবার পাশে বসা সৌধ অস্থির হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সুজা চৌধুরী তার মুখে হাত চেপে ধরল। দৃঢ়স্বরে বলল,
‘ আব্বা শান্ত হও। আমার ওপর ভরসা রাখো। বলতে দেও ওরে, আগে শুনি সব। ‘
সৌধ শান্ত হতে পারল না। তবু বাবার কথায় কান সজাগ করে বসে রইল ঠাঁই। নিধির কথা শুনে সুহাসের কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। আর কোনো প্রশ্ন করতে পারল না সে৷ কিন্তু নিধি নিজে থেকেই বলতে শুরু করল সবটা –
***
সৌধকে আমি বন্ধুর চোখে দেখেছি মাত্র দু’বছর। এরপরই ওর দৃষ্টিতে বন্ধু ছাড়া আলাদা কিছু টের পাই। এর সত্যতা মিলে যায় সেদিন যেদিন নিজ মুখে ও স্বীকার করে ও আমাকে ভালোবাসে। যা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম তা সত্যি হয়ে যাওয়াতে একদিকে খুশি আরেকদিকে দুঃখ হচ্ছিল। সৌধ নিঃসন্দেহে চমৎকার একজন মানুষ। প্রতিটা মেয়েই ওর মতো ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওর মতো ছেলের ভালোবাসা পাবার আকাঙ্ক্ষায় থাকে। তাছাড়া চৌধুরী বাড়ির মতো পরিবার আমি খুব কমই দেখেছি। সব মিলিয়ে সৌধর ভালোবাসা পাওয়াটা আমার জন্য সৌভাগ্য ছিল৷ এর আগে ওদের মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের বলতাম৷ এরপর থেকে মনে মনে সব সময় নিজেকে সৌভাগ্যবতী ভাবতাম। কিন্তু কোনোদিন ওকে নিজের করে পাবো বা আমি ওর বউ হতে পারব বিশ্বাস হতো না৷ এর কারণ আমার পারিবারিক সমস্যা। সেই সমস্যা গুলোই তিনবছর আগে খোলাখুলি বলি ওকে। সবটা শুনে ও আমাকে এত সুন্দর করে বোঝায়, ভরসা দেয় আমি জাস্ট বিমোহিত হয়ে যাই। আশার আলো খুঁজে পাই ওকে পাওয়ার। সেদিন থেকে বন্ধুত্বের বাইরেও ওর প্রতি একটা দুর্বল জায়গা সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু সেটাকে আজ আমি ভালোবাসা বলতে পারছি না, তখনো পারিনি৷ যেহেতু আমরা বন্ধু ছিলাম সেহেতু ভালোবাসাবাসির ব্যাপারটা আসলে সেভাবে আসেনি। সৌধর দিক থেকে এলেও আমার দিকে আসেনি। চেষ্টা করিনি তা না চেষ্টা করেছি কিন্তু সেই অনুভূতি আসেনি। তবে নিজেকে তৈরি করছিলাম ওর জন্য৷ কারণ আমি সিয়র ছিলাম একদিন সৌধকেই বিয়ে করতে হবে আমাকে। কারণ ওর ভয়ংকর রকমের ভালোবাসার কাছে হারতে বাধ্য আমি। সব ঠিকঠাকই ছিল। অর্পণ স্যারের প্রতি আমি ক্রাশড ছিলাম ঠিকি। কিন্তু গত তিন বছরে সেসব মুছে গিয়েছিল। আমরা আমাদের মতো পড়াশোনা করেছি৷ বন্ধুদের সময় দিয়েছি, আড্ডা জমিয়েছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেছি। তখন বুঝতে পারিনি, খেয়াল হয়নি আমাদের চেয়েও বড়ো পরিকল্পনাকারী একজন আছেন। সৃষ্টিকর্তার লিখন খণ্ডানোর সাধ্য আমাদের মতো নগন্য মানুষদের নেই। সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময়। যেইদিন হঠাৎ মামার অসুস্থতার খবর পেয়ে ময়মনসিংহে ছুটতে হয়েছিল। আমার মামার একপাশ প্যারালাইজড হয়ে যায় সেদিন। কারণ, মামার একমাত্র মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে। মান, সম্মানের ভয়ে মামার ওই অবস্থা হয়নি। মামার ওই অবস্থা হয়েছিল প্রিয় বন্ধুকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারল না বলে। মামার বন্ধু মারা গেছে দেড় বছর আগে৷ মামির থেকে জানতে পারি, মামা তার বন্ধুকে কথা দিয়েছিল তার একমাত্র মেয়েকে বন্ধুর বড়ো ছেলের কাছে বিয়ে দেবে। কোনো এক কারণবশত মামা তার বন্ধুর কাছে ঋণী ছিল। যা আমি জানি না৷ আমি ওখানে পৌঁছে যখন এসব শুনলাম তার ঘন্টা খানিক পরই অর্পণ স্যারের দেখা পাই। আমার মতো সেও মামাকে দেখতে হসপিটালে এসেছে। প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম সেদিন কারণ কোইন্সিডেন্সলি অর্পণ স্যারই ছিলেন আমার মামাত বোনের হবু বর৷ আমি যেমন স্যারকে দেখে বিস্মিত ছিলাম স্যারও ছিলেন। সেদিন স্যারকে দেখেই মামা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ হাত জোর করে বার বার ক্ষমা চায়। সবাই খুব আতঙ্কে ছিল প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার যন্ত্রণায় মামার আরো ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে না তো? অর্পণ স্যার একজন ডক্টর, আমিও ইন্টার্ন ডাক্টার। সে মুহুর্তে মামার মানসিক, শারীরিক উভয় অবস্থাই আমরা টের পাচ্ছিলাম। অর্পণ স্যার মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো। তাই মামাকে স্বান্তনা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, যা ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে এসব নিয়ে তার সমস্যা নেই। উপরওয়ালা নিশ্চয়ই তার ভাগ্যে ব্যাটার কিছু রেখেছেন৷ কিন্তু মামা এসব কানে তুলেনি৷ ভেঙে পরছিল খুব। মা, মামি সবার অবস্থাই দিশেহারা। একদিকে বোন নিখোঁজ অন্যদিকে মামার এই অবস্থা মাথা কাজ করছিল না আমার। এরপর অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। আমরা সবাই হসপিটালেই ছিলাম। হঠাৎ অর্পণ স্যার মামার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চায়। তারা কথা বলার পর আমাকে আর আম্মুকে ডাকা হয়। মামা জানায় মামার শেষ একটা ইচ্ছে আছে তা হলো, অর্পণ স্যারের সঙ্গে আমার বিয়ে। স্যার নাকি বলেছেন, সে আমাকে বহুদিন ধরেই পছন্দ করে। মেয়ে আর ভাগ্নি আলাদা কী? এক মেয়ে দিতে পারেনি তো কী হয়েছে আরেক মেয়ে আছে তো? মামার চোখে আমি ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পাই। দেখতে পাই তার প্রতিশ্রুতি ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা ক্ষীণ হতেও। আম্মুরও আপত্তি দেখলাম না। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমিও আপত্তি করতে পারলাম না। সেদিন রাতে বিয়ের আগে স্যারের সঙ্গে যখন আলাদা কথা বলতে দেয়া হয়, স্যার বলেন, তার আমাকে অপছন্দ নয়। কিন্তু মামাকে যেভাবে কনভিন্স করেছে তা পুরোপুরি সত্যি নয়। মামার গ্লানিবোধ কাটাতেই একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আমার যদি আপত্তি থাকে তাহলে জানাতে পারি। ওই মুহুর্তে আমি আপত্তি করতে পারিনি। আমি জানতাম সৌধ আমাকে ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে ছেলেটা আমাকে। কিন্তু ওর ভালোবাসা আমাকে ওই সময়ে একটুও ছুঁতে পারেনি। নিজেদের স্বার্থে ঠিক অর্পণ স্যারকে বিয়ে করে নিয়েছি। মামার প্রতি ঋণী ছিলাম আমি আর আম্মুও। টাকা পয়সার ঋণ শোধ করা গেলেও ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যায় না। কিন্তু মামার ভালোবাসার ঋণ আমি শোধ করেছিলাম তাকে আত্মগ্লানি থেকে রক্ষা করে। এত সব ঝড় মোকাবিলা করার পর আরো একটা ঝড়ের জন্য নিজেকে তৈরি করছিলাম। অনুভব করছিলাম আমার জীবনে খুব সহজ কিছু ঘটে যায়নি, সামনেও সহজ কিছু ঘটবে না। সৌধ আমার বন্ধু, খুব ভালো বন্ধু। ওর প্রতি আমি দুর্বল ছিলাম। ও ছিল আমার প্রতি ভয়ানক দুর্বল। তাই সেভাবেই সবটা সামলাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই যে এতকিছুর সম্মুখীন হতে হবে বুঝতে পারিনি। সবকিছুর পরও সৌধকে আমি খুব ভালো বন্ধু ভাবি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভেবেও যাব। সৌধ ভাবুক আর না ভাবুক৷ তবু ভালোবাসা বিহীন ওর জীবনে জড়াব না। ওর প্রতি আমার উইকনেস থাকলেও ভালোবাসা ছিল না এটার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ আমি অর্পণ স্যারের বউ। আমার শেষ কথা এটাই, আমাকে যদি বন্ধু ব্যাতীত সৌধর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করা হয় এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত স্টেপ আমি নিব৷ আজ যা হয়েছে তার জন্য হয়তো ওকে ক্ষমা করতে পারব কিন্তু এরপর কোনোভাবেই ক্ষমা সম্ভব না। সবকিছুর পর আমি নিজের কাছে স্বচ্ছ এটাই আমার সাহস এটাই আমার শক্তি।
***
নিধির চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে। তার বলা প্রতিটি বক্তব্য বাকরূদ্ধ হয়ে শুনল উপস্থিত সকল ব্যক্তি। সবার শরীর বরফের মতো শীতল আর শক্ত। শুধু সৌধ ব্যাতীত৷ সে একধ্যানে নিধির দিকে তাকিয়ে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। হাত, পা ছড়িয়ে রক্তশূণ্য মুখে তাকিয়ে আছে কেবল নিধির পানেই। নিধি এক পলক তাকিয়ে দেখল সৌধকে। ত্বরিত চোখ সরিয়ে মুখ নিচু করে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টাও করল। সৌধকে সে ভালোবাসতে পেরেছিল কিনা জানে না৷ কিন্তু সবার সামনে ভালোবাসি না বলাটা খুব জরুরি ছিল বলেই বলা। অন্যের বউ হয়ে এটুকু তো তাকে বলতেই হতো। সবকিছুর পর বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক যন্ত্রণা হচ্ছে। যতক্ষণ সৌধর সামনে থাকবে ততক্ষণ এই যন্ত্রণা উপশম হবে না। বুঝতে পারল নিখুঁত ভাবেই।এদিকে অর্পণ স্যারকে নিয়েও দুঃশ্চিন্তায় বুক ভার৷ যা কিছু লুকোনো ছিল সব প্রকাশ করে দিয়েছে। সবাইকে জানিয়েও দিয়েছে সে স্বেচ্ছায় কিছু লুকোয়নি। পরিস্থিতি তাকে তৎক্ষনাৎ সবাইকে জানাতে দেয়নি। আর কিছু বলার নেই তার। নেই আর কিছু জানানোরও। এখন বিদায় নেয়ার পালা। চলে যাওয়া উচিত তার। নিজের স্বামীর মরণাপন্ন অবস্থায় পাশে থাকা উচিত। এতকিছুর পরও যদি সৌধ তাকে জোর করে জবরদস্তি করে আটকাতে চায় তাহলে আর বন্ধুত্বের খাতিরে চুপ থাকবে না। ভেবেচিন্তে সুহাসের বাকরূদ্ধ মুখটায় তাকাল নিধি। কান্নারত মুখে ঈষৎ হাসল। এরপর তাকাল সুজা চৌধুরীর চিন্তান্বিত মুখপানে। অসহায় ভঙ্গিতে কান্নারত কণ্ঠে বলল,
‘ আংকেল, আমার হাজব্যান্ডের অবস্থা খুব খারাপ। আমি তার কাছে যেতে চাই।‘