বাইজি কন্যা

প্রণয়ের জীবনের সঙ্গে খু’ন শব্দটি জড়িয়েছে। খু’ন শব্দটির সাথে শুধু অশ্রুজল, শূন্যতা ও হাহাকার জড়িয়ে থাকে না৷ খু’নের মাঝেও পার্থক্য রয়েছে।সকল খু’নই অপরাধমূলক নরহত্যা। কিন্তু সব অপরাধমূলক নরহত্যা খু’ন বলে বিবেচিত হয় না। দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩০০ ধারা বিশ্লেষণ করলে খু’নের ক্ষেত্রেও কয়েকটি উপাদান পাওয়া যায়। উপাদানগুলোর সমন্বয়ে কোন ব্যক্তির মৃত্যূ ঘটানো হলে তা অপরাধমূলক নরহত্যা নয়, বরং খু’ন হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই রাতে একজন গর্ভবতী নারীকে, অর্থাৎ শাহিনুরকে ধ’র্ষণ করার চেষ্টা করে পলাশ চৌধুরী। স্ত্রীকে রক্ষা এবং নিজ আত্মরক্ষা করতে গিয়েই প্রণয় চৌধুরীর হাতে দূর্ভাগ্যবশত খু’ন হয় অপরাধী পলাশ চৌধুরী। যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘটেছে। যেটাকে একটি অপরাধমূলক নরহত্যা বলা যায়। প্রণয়ের বিরুদ্ধে করা শেষ মামলাটি একেবারে দুর্বল করার জন্য শক্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মামলার শেষ প্রান্তে এসে হঠাৎ কঠিন এক সত্যের মুখোমুখি হলো অঙ্গন। সে সত্যিটা প্রমাণ সহ প্রণয়কেও জানালো। সবটা নিজ কানে শুনে হতভম্ব হয়ে গেল প্রণয়। তারমানে গোপন শত্রু রোমানার বাবা! তাদের খালুজান!

কে নিষ্ঠুর? মানুষ নাকি ভাগ্য। চোখ বন্ধ করে বারকয়েক ঘনঘন নিশ্বাস ফেলল প্রণয়। মাত্রই অঙ্গন তাকে পুরো রেকর্ডটি শুনিয়েছে। মাজহারুল বা মুনতাহা কাউকে সে পর মনে করে না। আবার আপনও ঠিক ভেবে ওঠতে পারেনা। পৃথিবীতে বসবাস করা প্রতিটি মানুষের জীবনেই বোধহয় এমন কিছু মানুষ থাকে, যাদের’কে পর মনে হয় না আবার আপন ভাবতেও ভীষণ দ্বিধা অনুভব হয়৷ দীর্ঘ সময় পর চোখ খুলল প্রণয়। শীতল দৃষ্টিতে অঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘মুন যদি সত্যিই শাহিনুরের ক্ষতি করে দেয়?’
চিন্তান্বিত হয়ে অঙ্গন বলল,
-‘তুমি কি এসিড ছোঁড়ার কথাটায় ভয় পাচ্ছো? চিন্তা করো না ও বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে৷ মুখে যা আসে তাই বলে। স্বাভাবিক থাকলে নতুন ভাবির কাছে গিয়ে এভাবে এসব কখনোই বলতো না।’
-‘আমি কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ছি অঙ্গন৷ আর সময় নিতে পারছি না। ওদের কাছে ফিরতে হবে আমায়।’
-‘এসবের পেছনে খালুজান রয়েছে ভাই। আমি খালুজানের সাথে দেখা করব শিঘ্রই। আর বেশি দিন তোমাদের কষ্টে রাখব না।’
সহসা শান্ত হয়ে গেল প্রণয়। চোখমুখে অদ্ভুত এক ধীরতা এসে ভর করল। শান্তকণ্ঠে বলল,
-‘খালুজানের সাথে দেখা করতে গেলে বিশেষ একটি জিনিস নিয়ে যাবি।’
ভ্রু কুঁচকে অঙ্গন বলল,
-‘কী?’
-‘জিনিসটা আম্মার কাছে আছে বোধহয়। নয়তো আমার সেই সুটকেসেই রয়েছে। ওটা দিয়ে খালুজান’কে বলিস, তার প্রতি আমার কোন রাগ নেই, অভিযোগ নেই। শুধু নিজের প্রতিই নিজের আফসোস আমি আমার সন্তানকে এখন পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারিনি। উপলব্ধি করতে পারিনি, আমি একজন বাবা৷’
অঙ্গন নিশ্চুপ বসে ছিল। প্রণয় ওর দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল,
-‘ যে সত্যি আমরা ছাড়া কেউ জানে না। সেই সত্যিটা খালুজানকে জানানো উচিৎ।জন্মদাতা হিসেবে তার অধিকার রয়েছে!’
[১১৫]
অদৃষ্টলিপি কেউ খণ্ডাতে পারে না। বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েও নিজের ভবিতব্যকে বদলাতে পারেনি জমিদার অলিওর চৌধুরী। ভালোবাসার লোভে জর্জরিত প্রাণ ছিল তার। কাঙ্ক্ষিত মানুষটি ভালোবাসেনি তাকে। শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মানুষটির হাতেই তার মৃত্যু হলো। তবুও কত তৃপ্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল সে। যে মানুষটাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার ভাগ্য হয়নি, সেই মানুষটাকে মৃত্যুসঙ্গী হিসেবে পেয়ে যেন তার জীবনের সর্বোচ্চ সার্থকতা নেমে এসেছিল। অলিওর এবং শারমিনের মৃত্যু, ওদের দু’টো প্রাণ হারিয়ে যাওয়ার পর শাহিনুরের জীবনে নেমেছিল ঘোর অমাবস্যা। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় প্রণয়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় সে অমাবস্যা কেটে গেল। জীবনের উত্থানপতনে আচমকাই বড়ো হয়ে গেল মেয়েটা। কঠিন লড়াইয়ের সম্মুখীন হয়ে চারপাশের অশুভ ছায়াকে পরাজিত করল। চিনতে পারলো এক শুদ্ধ পুরুষ’কে। তাকে ভালোবাসার বিনিময়ে যে পুরুষটা অনায়াসে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে দিলো। বিতৃষ্ণায় ভরা জীবনটার সমাপ্তি দিতে গিয়ে নতুন করে জীবনের সূচনা করল। সেই পুরুষটাকে আকস্মাৎ খুব আপন মনে হলো। আকস্মাৎ এক শুদ্ধ পুরুষ’কে ভালোবাসতে ইচ্ছে করল। যে ভালোবাসায় অনায়াসে কোন পুরুষের কাছে নিজের জীবন সঁপে দেওয়া যায়, সেই ভালোবাসায় আক্রান্ত হলো সে। অন্ধের মতো যে পুরুষটির কাছে দীর্ঘ কিছু সময় শুধু দেহ সঁপেছিল তার হৃদয়ের প্রেম, ভালোবাসার ভয়াবহতাও অনুভব করতে পারলো। সেই অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়েই নতুন করে নতুন পথে পা বাড়িয়েছিল। চারদিকে অথৈজল মাঝখানে একটি পর্বত আঁকড়ে বেঁচেছিল দু’জনে। ছোট্ট একটা সংসার পেতেছিল। কত প্রেম, কত সুখ সেসব কি ভুলা যায়? যায় না। গোটা জীবনের দুঃখগুলো স্মরণ হলে বুকচিরে শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ আর যখন মনে পড়ে সেই ভয়ানক, বীভৎস বাক্যটুকু ‘নির্জন রাস্তার মাঝখানে ফেলে দু’টো গাড়ি দিয়ে একদম পিষে দিয়েছিলাম!’ বুক ফেটে আর্তনাদ বেরোতে চায়। পৃথিবীর প্রতি সমস্ত মায়া ত্যাগ করে, নিজ বুকের মধ্যেখানে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিতে ইচ্ছে করে৷ বাঁচতে ইচ্ছে করে না, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আত্মায় হাহাকার করে, ‘মানুষটা কেমন আছেন? কেমন আছেন তিনি? আমাকে কি মনে পড়ে না? কীভাবে আছেন আমাকে ছাড়া! ‘ সুখ এখন সত্যি ‘বু বু’ ডাকে। না জানি কবে বাবাহ বলে ফেলে সেই ভেবে বড়ো আতঙ্কে থাকে সে। আকাশপানে উদাস চেয়ে কত কল্পনাজল্পনা, কী অসহ্য অপেক্ষা!

সহসা আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো শাহিনুর। কেটে গেল উদাসীনতা, দেখতে পেলো দু’জন অপরিচিত নারী লোক’কে নিয়ে জেবা আসছে বাইজি গৃহের দিকে। গৃহের প্রধান দরজায় এসে উঁচু কণ্ঠে ডাকতে শুরু করল সে,
-‘কই গো শাহিনুর নিচে আসো৷ দেখে যাও কাদের নিয়ে এসেছি।’
শাহিনুরের আগে শবনম বের হলো। শাহিনুর তার পেছন পেছন মৃদু পায়ে এগুতে লাগলো। দরজার কাছে এসে হঠাৎ হেসে ফেলল শবনম। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে অপরিচিত নারী দ্বয়ের একজনের কাছে গিয়ে থুতনিতে চার আঙুলের পেট ছুঁইয়ে বলল,
-‘ও মা বোষ্টমীদি যে! তা এতদিন পর মনে পড়ল?’
বোষ্টমীদি মুগ্ধ করা এক হাসি দিলো। বলল,
-‘কতদিন পর বড়ো গিন্নির দেখা। এসেছি তোমার খবর নিতেই তোমার সতীন ধরে বেঁধে এখানে নিয়ে এলো। আজকাল শরীরটা ভালো যায় না গো।’
বলতে বলতেই সিঁড়িতে বসে পড়ল দুই বৈরাগী মহিলা। মাঝে মাঝেই এরা পাঁচফোড়ন গৃহে আসে। জেবা গান শুনতে ভীষণ ভালোবাসে। পাঁচফোড়ন গৃহে জেবা আসার পরেই বৈরাগীদের সঙ্গে শবনমের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুখ,দুঃখের আলাপ শেষে গান শুনিয়ে চাল নিয়ে বিদায় হয় এরা।

শবনম জেবা দু’জনই তাদের দুপাশে বসল। জেবা শাহিনুরের একহাত টেনে তার পাশে বসালো। বলল,
-‘তোমাকে বোষ্টমীদির গান শোনাতে নিয়ে এলাম। বোষ্টমীদির গান শুনলে প্রাণ একদম শীতল হয়ে যায়। বসো ও বোষ্টমীদি আমাদের নতুন বউকে একটা গান শোনাও দেখি।’
শাহিনুর নিঃশব্দে বসলো। বৈরাগী নারীদ্বয়ের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইল । তাদের মুখদুটোয় কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা, চোখ যেন শীতল হয়ে ওঠল। শবনম বৈরাগীদের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘আমাদের বাড়ির নতুন বউ। আমার সেজো দেওরের বউ।’
শাহিনুরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘নুর, এনারা হচ্ছেন বৈরাগী। সংসার ধর্ম ত্যাগ করে গান গেয়ে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে এরা।’
শাহিনুর অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইল। বৈরাগীদের একজনের হাতে একতারা। আরেকজনের কাঁধে মাঝারি আকৃতির থলে। দু’জনের গা’য়েই কমলা রঙের শাড়ি। তাদের শাড়ি পরার ভঙ্গিটাও ভীষণ পছন্দ হলো তার৷ একতারা হাতে বৈরাগী বলল,
-‘আহা রূপ যেন ক্ষইয়ে পড়ছে। আহা অমন সুন্দর চোখদুটিতে কীসের অতো আকুলতা গো?’
শাহিনুর মাথা নিচু করে ফেলল। জেবা গড়গড় করে শাহিনুরের জীবনের দুঃখগুলো বলতে লাগলো। শেষে হাঁপিয়ে গিয়ে বলল,
-‘ও বোষ্টমীদি তুমি গান গেয়ে নুরের মন ভালো করে দাওতো। যাওয়ার সময় আশীর্বাদও করে যাবে কিন্তু। আমার দেওর যেন তাড়াতাড়ি তার কাছে ফিরে আসে।’
শাহিনুরের দুঃখ অনুভব করে বোষ্টমী সৃষ্টিকর্তাকে ইঙ্গিত করে বলল,
-‘সবই তার লীলা।’
থলে কাঁধে বৈরাগী বলল,
-‘সংসার ধর্ম পালন করতে গেলে জটিলতা আসবেই বোন৷ ভেঙে পড়লে চলবে না। দুনিয়াতে আমরা নারী’রা যে ভালোবাসার কাঙালিনী। এই কাঙালিনী হয়েই সংসার ত্যাগ করে পথে পথে ঘুরে বেড়াই!’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অপর বৈরাগীকে বলল,
-‘দেখি ধরো দেখি একটা গান ধরো।’
একতারা হাতে বৈরাগী শাহিনুর’কে আপাদমস্তক দেখলো। মাথা দুলিয়ে রহস্যময় হেসে বলল,
-‘এত তোলপাড় কেন বাছা? বুকটাকে শান্ত করো। সে আসবে তোমার ভালোবাসার টানেই আসবে। এই দু’টি চোখে যত নোনাপানি জমে আছে সব তার সোহাগেই বাঁধনহারা হবে।’
শাহিনুরের বুক ভারী হয়ে ওঠল। শবনম তাগাদা দিয়ে বোষ্টমীকে গান ধরতে বলল। কয়েক পল সময় যেতেই সকলের মধ্যে নীরবতা স্থান করে নিলো। শুধু একতারা হাতে বোষ্টমী আকাশপানে তাকিয়ে একতারার সুর তুলে গান ধরল,
সোনার ও পালঙ্কের ঘরে,
লিখে রেখে ছিলেম দ্বারে
যাও পাখি বলো তারে,
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেকো ভালো থেকো,
মনে রেখো এ আমারে।

বুকের ভেতর নোনা ব্যাথা,
চোখে আমার ঝরে কথা,
এপার ওপার তোলপার একা
যাও পাখি বলো তারে,
সে যেন ভোলে না মোরে,
সুখে থেকো ভালো থেকো,
মনে রেখো এ আমারে।

মেঘের ওপর আকাশ ওড়ে,
নদীর ওপার পাখির বাসা,
মনে বন্ধু বড় আশা

যাও পাখি যারে উড়ে,
তারে কইও আমার হয়ে
চোখ জ্বলে যায় দেখবো তারে,
মন চলে যায় অদূর দূরে।
যাও পাখি বলো তারে,
সে যেন ভোলে না মোরে,
সুখে থেকো ভালো থেকো,
মনে রেখো এ আমারে।

সোনার ও পালঙ্কের ঘরে,
লিখে রেখে ছিলেম দ্বারে
যাও পাখি বলো তারে,
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেকো ভালো থেকো,
মনে রেখো এ আমারে।

গান শেষে বোষ্টমী শাহিনুরের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করল,
-‘স্বামী, সন্তান নিয়ে তোমার সংসার সুখের হোক। তোমার স্বামী দীর্ঘজীবী হোক।’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.