পৌষের সপ্তম দিন আজ। গত তিনদিন ধরে সূর্যালোকের দেখা নেই৷ ফলে পুব আকাশ থেকে আসা এক ফালি রোদ্দুর’কে আজ সোনার চেয়েও দামী মনে হচ্ছে। পাঁচফোড়ন গৃহের পুরো বাগান বকুল ফুল, শিউলি ফুলের মিশ্র ঘ্রাণে মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছে। প্রকৃতিতে আজ অন্যরকম সুর। প্রেরণার আগমণে সেই সুরে হঠাৎ ভাঁটা পড়ল। রোজকার মতোই নামাজ, কোরআন পড়ে বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছিল সে৷ হঠাৎ শিউলি গাছের নিচে দুই চাকাওয়ালা চেয়ারে (হুইলচেয়ার) ছাইরঙা চাদর গায়ে অজ্ঞাত পুরুষ মানুষ দেখতে পেয়ে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। সচেতন দৃষ্টিতে তাকিয়ে পা’য়ের গতিতে দৃঢ়তা বজায় রেখে হুইলচেয়ারের সামনে এসে দাঁড়াল। মুহূর্তেই চোখের পাতায় তার রাশভারী পুত্রধনের অবয়ব ভেসে ওঠল। স্তব্ধ হয়ে সে অবয়বের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। নিমিষেই নোনাপানিতে ভরে গেল দু’চোখের পাতায়। সহসা মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে ওঠল, অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া বড়ো বড়ো করে আপাদমস্তক প্রণয়’কে দেখল। আতঙ্কগ্রস্থ কণ্ঠে একবার উচ্চারণ করল,
-‘আমার প্রণয় , আমার বুকের ধন। এ কী হয়েছে তোর বাপ!’
বলতে বলতেই দু হাত বাড়িয়ে প্রণয়ের কপোলদ্বয় স্পর্শ করল। স্নেহভরা কম্পমান হাতদুটোর স্পর্শ পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল প্রণয়। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই মূর্ছা ধরে তার বুকে ঢলে পড়ল প্রেরণা। শ্রদ্ধেয় আম্মা’কে দু’হাতে আগলে ধরল সে। অসহায় কণ্ঠে কয়েকবার ডাকল,
-‘আম্মা, আম্মা, আম্মা।’
__
ভোররাতে প্রণয় স্বপ্ন দেখেছে তার মেয়ে গুটিগুটি পায়ে হাঁটছে। দু’হাত তালি দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। আধো-আধো কণ্ঠে বারবার ডাকছে বাবা, বাবা। সে মেয়ের কাছে যেতে চাইছে। ছুটে গিয়ে কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু পারছে না, অদৃশ্য এক বাঁধায় সে কিছুতেই নিজের সন্তানের কাছে যেতে পারছে না। যদিও বা কাছে যেতে পারছে একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারছে না৷ বাবা হয়েও অনুভব করতে পারছে না, সে একজন বাবা৷ কী দুর্বিষহ যন্ত্রণা!
মেয়ের জন্ম আষাড় মাসে। হিসেব অনুযায়ী এখন পৌষ মাস। মেয়ের তাহলে ছ’মাস পড়েছে। মনে পড়তেই বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠল। ধৈর্যচ্যুত হলো৷ অনেক হয়েছে বোঝাপড়া, অনেক হয়েছে হিসাবনিকাশ। এবার তাকে ফিরতে হবে। প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর বিষাক্ত অপেক্ষার অবসান ঘটাতে হবে। তীব্র উত্তেজনায় ছটফট করতে করতেই আপন গৃহে প্রবেশ করেছে আজ৷ অঙ্গন তাকে বাইজি গৃহের পথেই নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে বাঁধা দেয়। তার অবচেতন মন শুধু শাহিনুরের অপেক্ষা নয়, অভিযোগ নয়, অভিমানও টের পায়। সে জানে তাদের বাগানের ঐ শিউলি ফুল, বকুল ফুল শাহিনুরের খুব প্রিয়। দীর্ঘ দূরত্বের পর তাদের মিলন হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ বিরহ যন্ত্রণার ইতি টেনে অবিনশ্বর মিলনকালে তার প্রেমিক মন অভিমানেদের জায়গা দিতে চায় না। তাই বুকের ভিতর নতুন প্রেমের সঞ্চার ঘটে। অল্প বয়সী প্রেমিক পুরুষটির মতো প্রেমিকার মান ভাঙাতে বাগান থেকে ফুল কুড়াতে উদ্যত হয়। ঠিক সে সময়ই আগমন ঘটে প্রেরণার! দুই পুত্রের মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠতে পারেনি, এরই মধ্যে আরেক পুত্রের অঙ্গহীন দেহ যেন প্রেরণার কলিজা শক্ত দাঁতে কেউ চিবিয়ে দিলো। আর কত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে তারা? তাদের করা পাপের ফল তার এই সুশীল, নিরপরাধ পুত্রটি কেন ভোগ করবে? পাঁচফোড়ন গৃহের পরিবেশ হঠাৎ করেই বদলে গেল। মৃত্যু শোকের চেয়েও ভয়াবহ শোক নেমে এলো পুরো গৃহে। কারো মুখে রা নেই। সকলেই নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ, হতবাক! এ কী পরিণতি! হায় হায় এ সেই প্রণয়? বিশাল দেহের শক্তপোক্ত মানুষ’টাকে কোন নরপিশাচ ভেঙে চুরমার করে দিলো? কে হে পাষণ্ড? আজ যেন আবারও প্রকৃতি হুহু করে কেঁদে ওঠল। এক অসহায় মা’য়ের আর্তনাদ অশ্রু ঝড়িয়ে দিলো উপস্থিত সকল মানব চক্ষে। এ গৃহের খবর ও গৃহে পৌঁছাতে সময় লাগবে না। তাই মা’কে শয্যায় রেখে প্রণয় রুদ্ধ শ্বাসে হুইলচেয়ারের সাহায্যে ছুটে গেল বাইজি গৃহে। তার পেছন পেছন অঙ্গন, জেবা, আর কিছু ভৃত্যরাও গেল। প্রণয়, শাহিনুরের মিলনকাল আজ।
[১১৭]
বাইজি গৃহের প্রবেশদ্বার পর্যন্ত এসে থেমে গেল প্রণয়৷ পেছন ঘুরে অঙ্গন’কে বলল,
-‘ভাই, ওদের নিয়ে ফিরে যা। তোদের এভাবে দেখে নুর আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। পঙ্গু মানুষ বলে আমাকে দেখার জন্য এতজন প্রয়োজন নেই। ও যেন সাহস পায়, শক্তি পায়, আমার পাশে শুধু ওকেই প্রয়োজন এটুকু বুঝতে পারে। আম্মার মতো করে ও যেন ভেঙে না পড়ে। তোদের এভাবে দেখলে ও ভেঙে পড়বে। চলে যা তোরা, আমি ওদেরকে নিয়ে আসছি…’
দোতলার জানালা খুলে প্রবেশদ্বারের দিকে দৃষ্টি যেতেই আঁতকে ওঠল শাহিনুর। চিৎকার করে শবনম’কে বলল,
-‘বড়ো ভাবি উনি ফিরেছেন! বড়ো ভাবি আমার ডাক্তারসাহেব ফিরে এসেছেন! আমার সুখের আব্বু..’
বাকিটুকু আর শোনা গেল না। কারণ ছুটন্ত পায়ে ঘর ছেড়েছে শাহিনুর। সিঁড়িতে ধপাধপ্ ধপাধপ্ শব্দ হচ্ছে। যা বুঝিয়ে দিচ্ছে শাহিনুর শায়লার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। তার প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গ ফিরে এসেছে। গৃহদ্বার খুলে বড়ো বড়ো পা ফেলল। সে চাইছিল তারই মতো করে প্রণয়ও ছুটে আসুক। দু-চোখ ভরে তার শাহিনুর’কে দেখুক। তার দীর্ঘ প্রতীক্ষার ব্যথায় ব্যথিত হৃদয়ের কথা শুনুক, তৃষ্ণার্ত আঁখিযুগলের তৃষ্ণা মেটাক। কিন্তু তার চাওয়াকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে প্রণয়ের হুইলচেয়ার থেমে গেল৷ দীর্ঘ ছ’মাস পর শাহিনুর’কে দেখে হৃৎস্পন্দন কিছু সময় থেমে রইল। পরোক্ষণেই তার সমস্ত ইন্দ্রিয় চঞ্চল হয়ে ওঠল। অধরকোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠল। চোখের তারায় অশ্রুকণারা ভীড় জমালো। শাহিনুরের পা’য়ের গতি কমে এসেছে। বিস্ময় চোখে প্রিয়তম স্বামীর মুখপানে তাকিয়ে আছে। শ্বাসরুদ্ধ করে ধীরপায়ে এগুচ্ছে। হঠাৎই শরীরটা অবশ লাগলো। সহসা দুই কর্ণে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করল মুনতাহার বলা শেষ বাক্যটির,
-‘নির্জন রাস্তার মাঝখানে ফেলে দু’টো গাড়ি দিয়ে একদম পিষে দিয়েছিলাম।’
শিউরে ওঠল সর্বাঙ্গ। তাড়াক করে বেড়ে গেল হৃৎস্পন্দন। কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। একহাত দিয়ে বুকের বা’পাশটা চেপে ধরল৷ ভীষণ ব্যথা হচ্ছে সেখানটায়। অথচ আজ তার এখানে ব্যথা হওয়ার দিন নয়। আজ এখানে সুখ পাওয়ার দিন। তবুও কেন ব্যথা হচ্ছে? ডাক্তারসাহেব যখন ফিরেছে এ ব্যথা সে ঠিক সারিয়ে তুলবেন৷ এক ঢোক গিলল শাহিনুর। শুঁকিয়ে ওঠা গণ্ডস্থল একটু ভিজিয়ে নিয়ে পা’য়ের গতি বাড়িয়ে দিলো৷ শাহিনুর যত এগুলো প্রণয়ের অধরকোণের হাসিটুকু তত বিস্তৃত হলো। তার একটি হাতও আপনাআপনি বুকের বা’পাশে চলে গেল। প্রিয়তমার দর্শন পেয়ে আনমনে বিরবির করল,
-‘প্রিয়দর্শিনী।’
দীর্ঘ দূরত্বের সমাপ্তি ঘোষণা করে এক নিমিষেই একে অপরের কাছাকাছি চলে এলো। শাহিনুরের চঞ্চল চিত্ত, ছুটন্ত চরণদ্বয় থেমে গেল। স্বচ্ছ, চাতকী আঁখিযুগল প্রগাঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল। হাত বাড়ালো প্রণয়। মাতাল করা ঘ্রাণেও ধ্যান ভাঙলো না শাহিনুরের। সে একই ভাবে তাকিয়ে সহসা ধপ করে বসে পড়ল। চমকে ওঠে দু’হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করল। বহুদিন পর কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির স্পর্শ পেয়ে দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেলো শাহিনুর। অভিযোগ, অভিমানে আড়ষ্ট হয়ে কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘এই আপনার এই যাব এই আসব ডাক্তারসাহেব?’
প্রণয়ের চোয়ালজোড়া তীব্র কষ্টে ভারী হয়ে ওঠল। ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে প্রণয়কে আপাদমস্তক দেখে পুনরায় শাহিনুর প্রশ্ন করল,
-‘ওরা আমার এতবড়ো সর্বনাশ কেন করল ডাক্তারসাহেব?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রণয়। শাহিনুরের সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। বুঝতে পেরে শক্ত করে ওর কাঁধ চেপে ধরল। শাহিনুর কম্পমান একহাত বাড়িয়ে প্রণয়ের চাদর সরানোর চেষ্টা করল৷ প্রণয় অবাক চোখে তাকাল। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে রুদ্ধশ্বাসে নিজহাতেই চাদর সরিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে যে দৃশ্য শাহিনুর দেখল। সে দৃশ্য তাকে বাঁধ্য করল প্রণয়ের থেকে ছিটকে সরে যেতে৷ দু’কদম ছিটকে গিয়ে দু’হাতে নিজের মুখমণ্ডল ঢেকে আর্তচিৎকার করে ওঠল সে। হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত সম্পূর্ণ অংশ নেই! একেবারেই নেই! শ্যামবর্ণীয় দীর্ঘদেহী পুরুষটা দু’খণ্ডে ভাগ হয়ে গেছে! বদ্ধ চোখে বারকয়েক ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ল প্রণয়। ভেঙে গুড়িয়ে পড়া এক অসহায় পুরুষ কণ্ঠে বলে ওঠল,
-‘দূরে যেও না নুর। সব ব্যথা সহ্য করেছি, এই ব্যথা সহ্য করতে পারব না। কাছে এসো। একটিবার জড়িয়ে ধরো আমায়। আমায় তুমি ভালোবাসো, ভালোবাসো আমায় তুমি। পঙ্গু বলে দূরে সরে যেও না!’
আরো একবার চিৎকার করে ওঠল শাহিনুর৷ ঠিক যেভাবে ছিটকে সরে গিয়েছিল সেভাবেই আবার কাছে চলে এলো। হাত বাড়িয়ে প্রণয়ের ঠোঁটজোড়া চেপে ধরল। কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-‘না, না, চুপ, চুপ।’
বলেই দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বহুদিনের জমানো কান্নাগুলো একসঙ্গে উপচে পড়ল। প্রণয়ও শক্ত হাতে শাহিনুরের পিঠ চেপে ধরল। তার বুকে মুখ লুকিয়ে বিধ্বংসী কান্নায় ভেঙে পড়ল শাহিনুর। কাঁদতে কাঁদতেই পৃথিবীর প্রতি অভিযোগ তুলল।
-‘নিষ্ঠুর পৃথিবী, পাষাণ মানুষ।’
নিঃশব্দে প্রণয়ের চোয়ালবেয়েও অশ্রু গড়াতে লাগলো। শান্ত করার চেষ্টা করল শাহিনুরকে। সে শান্ত হলো না। তার বুকের আরো গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে আর্তনাদ করে ওঠল,
-‘আমার সুখের আব্বু, আমার ডাক্তারসাহেব।’
পরোক্ষণেই উন্মাদের মতো মাথা তুলে প্রণয়ের মুখের দিকে তাকাল৷ দু’হাতে স্বামীর চোয়ালদ্বয় স্পর্শ করে থুতনিতে বিধ্বস্ত ঠোঁটে শক্ত একটি চুমু খেলো। চোখজোড়া বদ্ধ করে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল প্রণয়। পুনরায় আবারও ডুঁকরে ওঠল শাহিনুর। আবারও শক্ত হাতে জড়িয়ে বুকে মাথা রাখলো। কাঁদতে থাকলো অবিশ্রান্ত ভাবে। প্রণয় তার পিঠে, মাথায় হাত বুলালো। কখনো দু’হাতে কপোলদ্বয় ছুঁয়ে সারামুখে চুমু খেলো। তবুও মেয়েটার কান্না থামলো না। বহুদিন পর তার কান্নার বাঁধ ভেঙেছে। আজ যে এ কান্না থামবার নয়। মানুষটার নিষেধ তো এটাই ছিল, ফেরার আগপর্যন্ত সে যেন না কাঁদে, শক্ত থাকে। এবার সে শক্ত খোলস থেকে মুক্তি পেয়েছে। তার মানুষ’টা ফিরে এসেছে। যেভাবেই ফিরুক সে ফিরেছে। এই কান্নায় যতই দুঃখ মিশে থাকুক সমাপ্তিতে এক চিলতে সুখ ধরা দেবেই দেবে।
___
প্রণয়, শাহিনুর একে অপরেতে মগ্ন। সুখ’কে কোলে নিয়ে শবনম এসেছে শাহিনুরের পরে পরেই। অথচ তারা দু’জন একে অপরের প্রতি এতটাই বিভোর ছিল যে একটুও টের পায়নি। তাদেরকে টের পাইয়ে দেওয়ার জন্যই বোধহয় সহসা শিশুকন্যা সুখ কেঁদে ওঠল। কন্যার পিতামাতা একে অপরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় চমকে ওঠল৷ দু’জনই মাথা তুলে দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল অদ্ভুতভাবে। শাহিনুরের চোখে প্রগাঢ় দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে মোহনীয় স্বরে প্রণয় বলল,
-‘আমাদের মেয়ে সুখ, কাঁদছে।’
অধর উল্টে কেঁদে ফেলল শাহিনুর। ঘাড় ফিরিয়ে সুখের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসলো। শবনমের কোলে ছোট্ট দেহটিকে অপলকভাবে দেখলো প্রণয়৷ চট করে শাহিনুর’কে ছেড়ে দু-হাত বাড়িয়ে দিলো। বলল,
-‘আয় বাবা, বুকে আয়।’
অশ্রুসিক্ত নয়নে শবনম সুখকে প্রণয়ের কোলে দিলো। বাবা, মেয়ের সামনে থেকে কিঞ্চিৎ সরে গিয়ে পাশেই হাঁটু গেড়ে বসলো শাহিনুর। সুখকে দু’হাতে উঁচু করে সম্মুখে ধরে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল প্রণয়। মেয়ে প্রথমবার বাবাকে দেখায় চিনতে না পেরে কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিলো। প্রণয়, শাহিনুর দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। অথচ তাদের চার চোখে অবিরত নোনাপানি ঝড়ছে। মেয়েকে কতক্ষণ দেখে চোখ শীতল করে বুকে চেপে ধরল। বাবা বাবা গন্ধের আদুরে বুক পেয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হলো সুখ। প্রণয় আদুরে স্বরে বার বার ডাকতে শুরু করল,
-‘বাবা, এইতো তোমার বাবা ফিরে এসেছে। বাবা বলে ডাকবে না। স্বপ্নে এসে খুব তো ডাকলে, উতলা করে তুললে বাবাকে।’
সুখ অস্ফুট আওয়াজ করল। শাহিনুর অবাক হলো। শবনম খুশিতে কেঁদে দিয়ে বলল,
-‘ডাকবে ডাকবে ধৈর্য ধরতে বলছে।’
মেয়েকে আদর করতে করতেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেল৷ খিদে পেয়েছিল বলে যে মেয়ে কাঁদছিল। সে মেয়ে বাবাকে পেয়ে, বাবার আদর খেয়ে, বাবার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ল। শবনম প্রণয়কে বলল,
-‘দাও আমার কোলে দাও ঘুমিয়ে গেছে।’
প্রণয় দিলো না। আরো গভীর করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল৷ বলল,
-‘বাবা বাবা ফিল পাচ্ছি ভাবি। আপনি আম্মার কাছে যান৷ আমরা আসছি।’
শবনম চলে গেল। বড়ো ভাবি বিদায় হতেই একহাতে সন্তপর্ণে মেয়েকে আগলে রাখল। অপরহাতে
শাহিনুরের হাত টেনে উল্টে পিঠে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো। প্রগাঢ় চাহনিতে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘আমার অনুপস্থিততে আমার তুমি’কে, আমার সুখ’কে আগলে রাখার জন্য তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ শাহিনুর শায়লা।’
শাহিনুর মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রণয়ের দিকে তাকাল। হুইলচেয়ারের হাতলে একহাত ভর দিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে প্রণয়ের কপালে গাঢ়ভাবে ঠোঁট ছোঁয়াল। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘আমাদের কাছে ফিরে আসার জন্য আমরাও আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ডাক্তারসাহেব।’
আলতো হেসে হাত বাড়িয়ে শাহিনুরের মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে বলল,
-‘দু-হাত ভর্তি শূন্যতা নিয়ে ফিরেছি চন্দ্রকান্তা। তোমাদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হতে চাই।’
দু’হাতে প্রণয়ের চোয়াল স্পর্শ করে ভাঙা কণ্ঠে শাহিনুর বলল,
-‘গভীর রাতে আপনার ভালোবাসাময় বুকটায় একটুখানি ঠাঁই চাই, আর তো কিছু চাই না সুখের আব্বু।’