ঢাকা শহরে এর আগে খুব একটা আসা হয় নি আমার।রিয়ার খালামনির বাসায় এসেছিলাম একবার আর একবার একটা পারিবারিক অনুষ্টানে এসেছিলাম।তবে খুব একটা ঘুরে দেখা হয় নি।এই শহরের সব কিছুই অচেনা অজানা আমার।আমাদের গাড়িটা গ্রাম পেরিয়ে প্রবেশ করলো ঢাকা শহরে।প্রাইভেট কারে জার্নি করতে খুব একটা ভাল পারিনা আমি।সারা রাস্তা বমি করে ভীষণ ক্লান্ত আমি।বিহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে এসেছি সারা রাস্তা।বিহান আমাকে যত্নের সাথে আগলে নিয়ে এসছে সারা রাস্তা।কখনো পানি ছিটিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করেছে, কখনো পানি খাইয়েছে,কখনো ওষুধ।অবশেষে আমরা পৌছালাম ঢাকায় বিহানের বাসায়।গাড়ি থেকে ক্লান্ত চোখে আস্তে করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল বিলাসবহুল একটা বাড়ি দশ তলা বিশিষ্ট। এ বিল্ডিং এর আট তলার একটা ফ্ল্যাটে বিহান আর বিভোর ভাই থাকেন।বিভোর ভাই ড্রাইভার কে গাড়ি পার্কিং এ রাখতে বললেন।ড্রাইভার কে সাথে নিয়ে লিফটে উঠলাম আমরা।চোখের পলক পড়তেই উঠে গেলাম আট তলায়।এটা ছিলো জীবনের প্রথম লিফটে ওঠা আমার।
--লিফট থেকে নামতেই শ্যামবর্ণের একটা ছেলে বিহান কে বললো আসসালামু আলাইকুম স্যার।
--বিহান সালামের উত্তর দিলো।
--ছেলেটি বললো,স্যার ছুটি কাটিয়ে এলেন।আপনাদের দুই ভাই কে খুব মিস করছিলাম।ব্যাড মিন্টন খেলা খুব মিস করছিলাম।
--বিহান বিনয়ের সাথে উত্তর দিয়ে বললো হ্যাঁ ভাই গ্রাম থেকে এলাম।
--স্যার সাথে কারা, উনি কি অসুস্থ আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
--অসুস্থ মহিলা বাদে বাকি সবাই ভাই আর বোন।
--আমাকে দেখিয়ে বললো উনি তাহলে কে?
--আমার বাড়িওয়ালা।
--ওহ আচ্ছা আমাদের ভাবি।ভাবি তো অনেক পিচ্চি দেখতে।মনে হচ্ছে সেভেন এইটে পড়ে।
--উনি আবার ও বিনয়ের সাথে হাসলেন।
--ছেলেটি বললো,আমি রিমা কে পাঠাচ্ছি ভাবির জন্য লেবুর পানি দিতে।
--না থাক ভাই সমস্যা নেই।ভাবিকে কষ্ট দিতে হবে না।করে নিতে পারবো।
মনে হচ্ছে বিহান এত বড় ডাক্তার বলে একটু বেশী ই কেয়ার করছে।
বিভোর ভাই চাবি দিয়ে দরজা খুললেন।এই ফ্ল্যাটে এসে চোখ মেলে দেখেই যেনো আমার অসুস্থতা সব হাওয়ায় উড়ে গেলো।দুটো ব্যাচেলর ছেলে থাকে এখানে।একজন বিবাহিত আরেকজন অবিবাহিত কেউ কি দেখে বলবে এটা কোনো ছেলেদের ফ্ল্যাট।এত সুন্দর পরিপাটিভাবে সাজানো ঘর আমার জীবনে আগে দেখিনি।ঠিক যেনো সিনেমার কোনো ঘর দেখছি আমি।বিহান যে পরিপাটি ছেলে আগেই জানতাম বাট এতবেশী সেটা জানতাম না।বিশাল বড় ডায়নিং এ ঢুকতেই চোখে পড়লো আমার আর বিহানের বড় একটা ছবি টাঙানো।এটা তো সেই দিনের ছবি যেদিন আমি লাল শাড়ি আর ও লাল পাঞ্জাবী পরেছিলো।আমার সামনে হাঁটু গেড়ে অবুঝ একটা বালকের মতো বসে ছিলো।আমার কাধে বিহানের হাত খুব ই সুন্দর এই ছবিটা দেখতে।ইয়া বড় একটা অ্যাকুরিয়াম রাখা যার মধ্য লাল,নীল,হলুদ বিভিন্ন রকমের মাছ খেলা করছে,তার পাশে বিশাল একটা সাদা গোলাপের গাছে।যদিও গাছ টা কৃত্তিম কিন্তু বোঝার উপায় নেই।
পাশেই মনে হচ্ছে ড্রয়িং রুম সোফা, টিভি দেখা যাচ্ছে।বিভোর ভাই রিয়া আর ভাইয়াকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলো।ভাইয়া গা এলিয়ে দিয়ে সোফায় বসলো।রিয়া ও বেশ ক্লান্ত।এর ই মাঝে পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি সরবত আর পানি নিয়ে এলো।ভাইয়া আর রিয়া সরবত খেয়ে রেস্ট নিচ্ছে।বিভোর ভাই বললেন ধন্যবাদ ভাবি। মহিলাটি কে আমরা অবশ্য কেউ ই চিনলাম না তবে এই বোধহয় রিমা যার কথা একটু আগে বললো।বিভোর ভাই রিয়াকে বললেন,রিয়া উনি রিমা ভাবি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন।রিয়া বিনয়ের সাথে হেসে বললো, ভাবির সাথে পরিচিত হয়ে নিবো সমস্যা নেই।মাত্রই এসেছি বলে বেশী কথা বলছি না।রিমা ভাবি রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,আপনাকে দেখতে হিন্দি সিরিয়াল এর নায়কাদের মতো আপু।রিয়া মনে হয় বেশ লজ্জা পেলো তবে বিভোর ভাই এর মুখে সাথে সাথেই হাসি ফুটলো।প্রেমিকার রুপের বর্ণণা শুনতে কার না ভাল লাগে।রিয়া ওয়াশ রুমে গিয়ে গোসল করে নিলো।রিয়ার পরে ভাইয়া ও গিয়ে গোসল করে নিলো।বিহান আমাকে ওর রুমে নিয়ে গেলো।বিহানের রুমে এসে চোখ জুড়িয়ে গেলো আমার।বিহানের মতোই মুগ্ধতায় ভরপুর বিহানের রুম।বিছানায় রাখা কতগুলো ছোট কুশণ।বিছানার পাশেই রাখা আর্টিফিশিয়াল গেন্দা ফুলের ঝাড়।রুম ময় বিভিন্ন শৌখিন জিনিসে ভরপুর।আমি বিছানায় গিয়েই সুয়ে পড়লাম।এক নজরে এটুকুই চোখে পড়েছে আমার।এ রুমের টেবিলে আমার আর বিহানের আরেক টা ছবি।আমার মুখে সাবানের ফেনা বিহানের মুখেও।দেখতে কি সুন্দর লাগছে।বিহান এসি অন করে দিয়ে বললো আমি গোসল করে আসি।বিহান ওয়াশ রুমে গিয়ে গোসল শেষ করে বেরিয়ে এলো।
ওর পরণে টাওয়াল,খালি গায়ে সমস্ত শরীরে পানির ফোয়ারা।ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আরেক টা টাওয়াল দিয়ে গায়ের পানি মুছছে।কোট স্ট্যান্ড থেকে একটা গ্রে কালারের গেঞ্জি নিয়ে আয়রণ করে নিয়ে গায়ে দিলো সাথে একটা ব্লু জিন্স পরলেন।গেঞ্জি তো আয়রণ ছিলোই একটু কম ছিলো এই আরকি।তবে তো বোঝা যাচ্ছিলো না আয়রণ নেই।মেয়ে মানুষ হলে কি করতেন উনি তাই ভাবছি।ছেলে মানুষ হয়ে এত পরিপাটি থাকেন।গায়ে পারফিউম লাগিয়ে আমার কাছে এসে বললেন,
"দিয়া ওঠো,গোসল করলে সুস্থ লাগবে।"
"মাথা ঘুরাচ্ছে খুব।"
"গোসল করলে ঠিক হয়ে যাবে এসো।"
আমি ওঠার চেষ্টা করতেই, উনি নিজেই ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন ওয়াশ রুমে।ওয়াশ রুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি।আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, কি হলো গোসল করে নাও, আমি এখানেই আছি।কোথাও যাচ্ছি না।কোথায় পড়ে যাবে তার ঠিক নেই দুই দিন পরে এক্সাম তোমার।
উনার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলাম।
ওনার সামনেই গোসল করলাম,যদি পড়ে যায় তাই উনি আর বাইরে যান নি।গোসল শেষে আমাকে চেঞ্জ করতে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
চেঞ্জ করে একটা কালো গাউন পরলাম।
বিভোর ভাই বাড়ি থেকে আম্মুর পাঠানো খাবার গুলো সবাইকে খেতে দিলেন।খাবার খেয়ে নিলাম সবাই।খাওয়া শেষে রিয়া আমি বসে সবাই গল্প করছি।এ বাসায় বেড দুইটা রিয়ার খুব ঘুম পাচ্ছে।বিহান বললো আমার রুমে যাও ঘুমিয়ে থাকো।রিয়ার সাথে আমিও গেলাম।দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম।ভাইয়ারা বসে গল্প করছে সবাই।
ঘুমোনোর আধাঘন্টা পরেই ঘুম ভেঙে গেলো আমার।তাকিয়ে দেখি বিহানের হাতে বালতি।জিজ্ঞেস করলাম বালতিতে কি?
--বিহান উত্তর দিলো গোসল করে যে কাপড় রেখেছিলে সেটাই ধুয়ে দিলাম।বেলকনিতে নেড়ে দিয়ে আসি।
--ওহ গড বলেই কপালে হাত দিলাম আমি।তখন আর কাপর ধোয়ার কথা খেয়াল ই ছিলো না।উনাকে বললাম,
--তাই বলে আপনি আমার কাপড় ধুবেন।আমি একটু পরেই ধুয়ে দিতাম।
--ইস রে!এইটুকু কাজ করে দিলাম তোমার।খুব বেশী তো কিছুনা।সারাজীবন এর দায়িত্ব নিয়েছি তোমার এই কাপড় ধোয়া তো সিম্পল একটা কাজ।
আমি ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন,
"ঘুম ভাঙলো।"
"হ্যাঁ। "
"মাথা পেইন কি কম লাগছে এখন।"
"হুম কম হয়েছে।"
"তাহলে পড়তে বসো।আমি বাজারে যাচ্ছি।"
"আমিও যাবো বাজারে।"
"মাছের বাজারে বিশ্রি অবস্থা। তুমি গেলে বমি করবে।যেতে হবে না।"
"আমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকবো।"
"ছোট মানুষ কোথায় হারিয়ে যাবে।"
"আমি অতটাও ছোট না যে হারিয়ে যাবো।"
"তুমি অতটাও বড় না বুঝেছো।এটা নড়াইল না পিচ্চি,ঢাকা শহর।"
"আপনি নিবেন কিনা বলুন।"
"সব জায়গা ঘুরাবো তোমাকে।আগে পরীক্ষা টা হয়ে যাক। এখন তুমি দেখো পছন্দ হয়েছে তোমার সংসার।"
"আমার সংসার।"
"তোমার ই তো।ইন্টার পাশ করলে এমনিতেই তোমাকে ঢাকা চলে আসতে তাইনা?তোমার আসার আগেই আমি সাজিয়ে রেখেছি।"
"খুব খুব খুব সুন্দর হয়েছে। একদম আপনার মতোই।"
সন্ধ্যার পরেই রিয়া আর আমি দুজনে পড়তে বসলাম।বিহান বাজারে গিয়েছে।বিহান ফিরে এলে ভাইয়া আর বিভোর ভাই ঘুরতে যাবে বাইরে।বিভোর ভাই আমাদের দুজনকে কফি বানিয়ে দিয়ে আমাদের পাশে বসে বললেন,
"রিয়া ডাক্তার হওয়ার পর কি আমাকে স্যাঁকা দিবে তুমি।"
"রিয়া রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললো শুনো না বিভোর বেবি।"
"বিভোর ভাই যেনো বেশ অবাক।বুকে হাত দিয়ে বললেন,আউচ বুকে লাগলো।জীবনে প্রথম এমন মিষ্টি ডাক।বুকে ব্যাথা করছে।"
এরই মাঝে বিভোর ভাই চিৎকার দিয়ে উঠলো।
"রিয়া বললো স্যাঁকা খেয়ে ফিলিং কেমন বিভোর বেবিটা।"
"তাই বলে গরম কফিতে আঙুল ডুবাবে।যেভাবে আঙুল টা ধরেছিলে ভাবলাম কিসমিস কিছু দিবা।তা না রিয়েল স্যাঁকা দিলে।"
"কিসমিস জীবনে খান নি তাইনা?আমি তো শুনেছি সেমাই তে দেওয়ার আগে আপনি সব খেয়ে ফেলতেন।"
"আরে এই কিসমিস সেই কিসমিস না।আই মিন চুমুর কথা বলেছি।"
"দিয়া তোর ভাই আমাকে বিশ্বাস করে না।আমি নাকি ডাক্তারি তে চান্স পেয়ে স্যাকা দিবো।আমাকে রিতীমতো অপমান করলো।প্লে গার্ল ভাবে সে আমাকে।"
"সরি আপু।আর এসব বলবো না। দিয়া কান বন্ধ কর।"
"আমি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে বললাম কেনো?"
"ভাই ভাবির প্রেমালাপ শুনতে নেই।"
"আমি কানে কাগজ টুকে দিয়ে বসে হাসছি।'
"বিভোর ভাই বললেন,আই লাভ ইউ রিয়াপাখি।"
অথচ আমি তাদের প্রেমালাপ সব ই শুনছি।কি ফাজিল আমি।রাতে আমার উনাকে সুয়ে সুয়ে এসব ই বলে দিবো।