--হেলে যাওয়া সূর্য, ক্লান্ত আমি, চেহারায় মলিনতা, চোখের পানিতে লেপ্টে যাওয়া কাজলের কালি চোখের নিচে নিয়ে সাদা একটা শাড়ির লাল পাড় পরে,এলোমেলো চুল নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে বাসায় প্রবেশ করলাম আমি।কয়েকঘন্টা বাস জার্নি বেশ কয়েকবার বমি ও হয়েছে শরীর যেনো কেমন নুইয়ে পড়ছে।এত ক্লান্ত তো আগে কখনো লাগে না আমার।বাড়িতে প্রবেশ করেই বাড়ির পরিবেশ কেমন যেনো অন্যরকম মনে হলো।আম্মু বাড়ির গেটেই দাঁড়িয়ে আছে এক পলকে।যেনো আমার জন্যই পথ পাহারা দিচ্ছে।আম্মুর থেকে পাঁচ দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি।কেমন যেনো থমকে গেলাম।আর যেনো পা চলছে না আমার।আম্মু এক নজরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।খানিক টা দূর থেকেই ক্লান্ত কন্ঠে ডাকলাম।
"আম্মু"
আম্মু যেনো কিছু বলবে কিন্তু বলতে পারছে না আমাকে এ অবস্থায় দেখে।আম্মুর চোখে পানি চলে এসছে,আম্মুর ঠোঁট কাঁপছে।আমিও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না।আম্মুর দিকে তাকিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম আম্মু শব্দটা উচ্চারণ করতে করতে।আমি কাঁন্না ভেজা কন্ঠে উচ্চস্বরে কেঁদে ডাকলাম "আম্মু।"
আম্মু শাড়ির আঁচল মুখে গুজে কাঁন্না আটকানোর চেষ্টা করে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।আমি কিছুই বলতে পারছি না আম্মুকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি আর আম্মু আম্মু করছি শুধু।আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে।আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার জন্যই ছুটে এসেছি ঢাকা থেকে।আম্মু কয়েকটা কষ্টের নিঃশ্বাস নিয়ে আধভেজা কন্ঠে বললো,
"শান্ত হও মা।এভাবে কাঁন্নাকাটি তোমার শরীরের জন্য ভালো নয়।মাথায় যন্ত্রণা বাড়বে।"
কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
"তাহলে আমি কি করবো আম্মু।কাঁন্না ছাড়া আমার জীবনে কি অবশিষ্ট আছে।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আম্মু।"
"যার পাশে বিহানের মতো ছেলে আছে তার চোখে কি কাঁন্না মানায়।"
"প্লিজ আম্মু বিহানের কথা আর বলোনা।আমার এই কাঁন্নার একমাত্র কারণ বিহান আম্মু।বিহান আমাকে ঠকিয়েছে,ভীষণ কষ্ট দিয়েছে।"
"এসব তোমার ভুল ভাবনা দিয়া।তুমি হয়তো জানোনা বিহান তোমাকে কত ভালবাসে।শান্ত হও মা।ভেতরে চলো সব ঠিক হয়ে যাবে।"
"বিহান আমাকে ভালবাসে না আম্মু,কোনদিন ভালবাসে নি।বিহান আমাকে এত কষ্ট দিয়েছে আমি কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারবো না।কিন্ত কেনো আম্মু আমার অপরাধ কী?সেই ছোট বেলা থেকে বিহান কে ভালবাসি আমি আর আজ বিহান আমাকে ও চায় না এমন কি আমার সন্তান কেও চায় না।পৃথিবীতে এমন ও খারাপ বাবা আছে আম্মু,যে নিজের সন্তান কে খু*ন করতে চায়।আমার কপাল এত খারাপ কেনো বলতে পারবে আম্মু।আমি কি এতই খারাপ কারো সত্যিকারের ভালবাসা পেলাম নাহ।আমার কপালে সুখ টায় সইলো না।"
"তোমার কি সত্যি মনে হয় বিহান তার সন্তান চাইছে না। এটা যদি বিহান চেয়েও থাকে তাহলে বিহান কতটা কষ্ট পাচ্ছে তুমি ভেবেছো।"
"কি ভাববো আমি।এখানেও আমাকে ভাবতে হবে।প্লিজ আম্মু আর নিজের ভাতিজার পক্ষে কথা বলোনা।এত কিছুর পরেও অন্তত বলো না।আমার আম্মু হবার সুবাদে অন্তত অন্য কারো পক্ষ নিও না।যে তোমার মেয়েকে ঠকিয়ে অন্য মেয়ের কাছে যেতে পারে তুমি তার পক্ষ নিবে।"
"দুনিয়াতে কি এমন মা আছে দিয়া নিজের মেয়ের থেকে অন্য কাউকে বেশী ভালবাসে।তবে আমার মেয়েকে যে সব থেকে বেশী ভালবাসে আমি তাকে ভালবাসি দিয়া। তার সাপোর্ট আমাকে নিতেই হবে।আমার মেয়ের ভালোর জন্য হলেও।"
--আম্মুর কাছ থেকে ছুটে দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমের দিকে গেলাম।দরজার সামনে গিয়ে ভীষণ ভাবে চমকে গেলাম আমি।বিহান এখানে কিভাবে এলো।আমার আগে আমার ই বাড়িতে বিহান।চোখের পানি হঠাত থমকে গেলো আমার।বিহান মামির কোলে মাথা গুজে উচ্চস্বরে কাঁদছে আর বলছে,,
" আমি আর পারছি না আম্মু।আমাকে একটু তোমার কোলে মাথা রেখে কাঁদতে দাও।আমি তোমার সন্তান আমাকে তুমি এতটা ভালবাসো,ফুপ্পি দিয়াকে এতটা ভালবাসে, একজন বাবা হওয়ার সুবাদে আমিও আমার সন্তান কে ঠিক এতটায় ভালবাসি আম্মু।আমার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসার আগের আমি মে*রে ফেলতে চাইছি আমি কতটা নির্দয় আর নিষ্টুর বাবা।কিন্তু আম্মু বিশ্বাস করো এই পৃথিবীতে আমি ভীষণ অসহায় এই মুহুর্তে। আমার হাসি খুশি জীবন টা এলোমেলো হয়ে গেলো আম্মু।দিয়ার কিছু হলে আমার কি হবে। দিয়াকে ছাড়া এক সেকেন্ড ও বাঁচতে পারবো না আমি।দিয়ার শারিরীক কন্ডিশন দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আমি ওর হাজবেন্ড একজন ডাক্তার চোখের সামনে দেখছি দিয়ার এই অবস্থা তোমাকে বোঝাতে পারবো না আমার ভেতরে কি যন্ত্রণা হয়।কত গুলো রাত আমি ঘুমোয় নি,আমার ঘুম আসে না ঠিকভাবে,খাবার খেতে পারিনা সারাক্ষণ দিয়ার হাসিখুশি মুখটা ভেষে ওঠে।সেদিন দিয়াকে র*ক্তাক্ত অবস্হায় সেন্সলেস দেখে আমার কি হচ্ছিলো।দিয়ার মুখে অক্সিজেন চলছিলো পৃথিবীর সব কিছু অন্ধকার লাগছিলো আমার।দিয়ার প্রথম রিপোর্ট দেখলাম দিয়া প্রেগন্যান্ট বিশ্বাস করো আম্মু খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।নিমিষেই এক পশলা হাসি কোথা থেকে জড় হয়েছিলো আমার চোখে মুখে।কিন্তু দিয়ার পরবর্তী রিপোর্ট দেখে চুরমার হয়ে গেলো আমার সব হাসি আনন্দ।আমার সিনিয়র ডাক্তার আমাকে যখন স্পষ্ট জানিয়ে দিলো দিয়ার পক্ষে এখন কোনভাবেই বেবি ক্যারি করা সম্ভব নয়। দিয়ার হার্ট এ বড় প্রব্লেম হয়েছে চার'মাসের মাঝে সার্জারী করাতে হবে।কিন্তু তার আগে দিয়াকে মেডিসিন খাইয়ে সুস্থ করতে হবে।ওর শরীরের কন্ডিশন ভালো নয়।সার্ভাইভ এর চান্স এমনিতেই কম।দিয়া বাঁচবে কিনা তার ই নাকি কোনো গ্যারান্টি নেই আর বেবি থাকলে মোটেও চান্স নেই।তার উপর বেবি থাকলে মা বেবি কেউ বাঁচবে না।দিয়া সুস্থ হলে ফিউচারে আমাদের আবার বেবি হবে কিন্তু দিয়ার কিছু হলে আমার কি হবে।বেবি না হলেও আমি বাঁচতে পারবো কিন্তু দিয়া ছাড়া পারবো না।দিয়া আমাকে আবার ও ভুল বুঝে চলে এসছে।আম্মু সারারাত ডাক্তারদের বোর্ড বসেছিলো দিয়ার সার্জারী নিয়ে।সেই বোর্ডে প্রেয়সী ও ছিলো।প্রেয়সী আমার রুমে এসেছিলো আমাকে সান্তনা দিতে।আমার সেন্স ছিলো না চিন্তায় পাগল ছিলাম। ঠিক সেই মুহুর্তে ফোন আসে প্রেয়সীর বাবা মারা গিয়েছে আমি প্রেয়সী কে বুঝাচ্ছিলাম।ঠিক তখন ই দিয়া গিয়ে দেখে ভুল বুঝলো।আমি জানি এতে দিয়ার কোনো দোষ নেই।কিন্তু আমি কি করবো আম্মু।আমি আর পারছি না আম্মু।সত্যি আর পারছিনা।পৃথিবীর যে কোনো কিছুর বিনিময়ে যদি আমার স্ত্রী সন্তান আমি রক্ষা করতে পারতাম তাহলে আমি সেটাই করতাম আম্মু।আমার জীবন দিয়ে হলেও করতাম।আমি এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না।আমার দিয়াকে চাই আমার পাশে।"
বিহান আমাকে না দেখলেও মামি আমাকে দেখেছে।মামি চোখের পানি মুছে বললো,
"শান্ত হও বাবা।আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হবে।দিয়া এসছে।"
বিহান আমার দিকে ঝড়ের গতিতে তাকালো।আমি কেঁদেই যাচ্ছি।এত কিছু বিহান টা সহ্য করছে অথচ আমি জানি না।আমাকে কিছু বললোই না।আবার ও ভুল বোঝার অপরাধে কষ্ট পাচ্ছি আমি।আমার মরে যাওয়ায় ভালো বিহানের মতো হাজবেন্ড পেয়েও ভুল বুঝি বারবার।
মামি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
"আমার পাগলি টা।কি অবস্থা তোর।নিজের চেহারার কি অবস্থা করেছিস।"
বাবা পাশেই ছিলো।বাবার ও হার্টে প্রব্লেম।বাবার চোখে ও পানি।পরিবারে যেনো অন্ধকার নেমে এলো আমার অসুস্থতায়।আম্মু বাবা কাকু কাকিদের কারো মনে শান্তি নেই।সন্ধ্যায় সুয়ে আছি বিছানায়।ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, কিচ্ছু হবে না তোর দিয়া।আমার বোন স্ট্রং মেয়ে, সব ঠিক হয়ে যাবে।ভাইয়া চোখের পানি মুছে বেরিয়ে গেলো।মেহু আপু আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলছে জানিস দিয়া তোর মেসেজ পেয়ে বিহান ভাই এয়ার টিকিট করে এক ঘন্টার মাঝে যশোর এসে নেমেছিলো।তোর ভাইয়া বাইকে করে এগিয়ে নিয়ে এসছে।বিহান ভাই কে জীবনে এতটা অসহায় কখনো দেখি নি।বিহান ভাই কে না দেখলে জীবনে বুঝতাম না হয়তো একটা ছেলের ভালবাসা কত গভীর হতে পারে।বিহান ভাই তার অনাগত সন্তানের জন্য ভীষন কষ্ট পাচ্ছে।বিহান ভাই কে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রে।
আপুকে বললাম," উনি কোথায় আপু।"
"উঠানে আছে সবার সাথে কথা বলছে।"
"একটু পাঠিয়ে দিবে প্লিজ।"
"আচ্ছা যাচ্ছি।"
দু'মিনিটের মাঝে বিহান রুমে প্রবেশ করলো।বিহান এসে বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছে।আমাকে দেখেই বললো,
"কি ব্যাপার দিয়ার কি রাগ কমেছে।"
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি বিহানের দিকে।একটা মানুষ কিভাবে নিজের কষ্ট হাইড করতে পারে।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললো,
"ওভাবে যে চলে এলে, কি সিদ্ধান্ত নিলে আমার সাথে আর থাকবে না।"
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে কেঁদে দিয়ে বিহান কে জড়িয়ে ধরে বললাম,
"আমি মরতে চাই না।আপনার সাথে আরো কয়েকযুগ বেঁচে থাকতে চাই।আপনার মতো মানুষের সাথে আরো কয়েক টা যুগ বেঁচে থাকতে চাই আমি।"
"হোয়াট ননসেন্স,তুমি মরে যাবে মানে।"
"আপনি প্লিজ আর অভিনয় করবেন না।আমি সব জানি।কেনো লুকালেন এত কিছু।আপনাকে ভুল বোঝার অপরাধে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।"
বিহান আমাকে একদম বুকের সাথে মিশিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
"আই লাভ ইউ দিয়া।তোমার কিছুই হবেনা।আমি তোমার কিছুই হতে দিবো না।দিয়া আমাদের সন্তান আমি ভীষণ ভালবাসি,আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি।আমার কিছুই করার নেই।"
"আমি মরে গেলে যাবো তবুও আমাদের সন্তান কে বাঁচাবো।আমার কিছু হলে আপনি একা হয়ে যাবেন।আমাদের বেবি থাকলে আমাকে ভুলে থাকতে পারবেন।"
"স্টপ দিয়া প্লিজ!তুমি না বাঁচলে তো আমিও বাঁচবো না।আমাদের সন্তান কি মা বাবা ছাড়া বাঁচবে।"
বিহানের এই কথায় আমি বুঝতে পারলাম পাগল টা আমায় ছাড়া থাকতেই পারবে না।
দিন যাচ্ছে,সময় এগোচ্ছে আমার অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছে।আমার জিদের জন্য বাচ্চা কিছুই করলাম না।আমি জানি এক মা পারে তার সন্তান এর জন্য সব যুদ্ধ করতে।আর জন্ম,মৃত্যু উপরওয়ালার হাতেই।
কেটে গেলো সাত মাস,হাত পা ফুলে গিয়েছে আমার।প্রেগ্ন্যাসির সাড়ে আটমাস চলে আমার।প্রায় এক সপ্তাহ আমি অসুস্থ। হঠাত পেটে ভীষণ পেইন শুরু হওয়ায় বিহান আর বিভোর ভাই আমাকে হসপিটাল নিয়ে গেলো।নড়াইল থেকে আম্মু-বাবা,আয়রা,কাকিমনি,মামা -মামি,ভাইয়া-ভাবি চলে এসছে আমার অসুস্থতার খবর শুনে।আজ দীর্ঘদিন পরে কাকুর সাথে রিয়ার দেখা।কাকু বারবার রিয়ার দিকে তাকাচ্ছে ছল ছল চোখে।আমাকে ঘিরে যেখানে সবাই চিন্তা করছে আমি সেখানে রিল্যাক্স এ সুয়ে আছি হসপিটালের বেডে।আমার চারদিকে এত ভালবাসার মানুষ সেখানে আনন্দের শেষ নেই আমার।সবাই চিন্তিত তবে বিহান বেশী চিন্তিত।আমার সার্জারী আজ বিহান ই করবে।বিহান এই প্রথম কোনো সার্জারী করতে ভয় পাচ্ছে।কিন্তু আমি জানি বিহান সাকসেসফুল হবেই।