43★
৭৭
আরহাম যখন রুমে এলেন তখন ঘড়িতে ঠিক এগারোটা বাজে।উনার গলা ভিজে ঘামে একাকার।চোখমুখ লাল।পিঠ বেয়ে ঘাম ঝরছে।
উনি দরজা খুলে এসে হাফসাকে সামনাসামনি সোফায় বসে থাকতে দেখে হাতের বাটিটা টেবিলে রাখলেন।তারপর এসির পাওয়ার বাড়াতে বাড়াতে বললেন, ‘আম রিয়েলি সরি।ট্রাস্ট মি আমার মনেই ছিলো না যে আপনাকে দরজা বন্ধ করে রেখেছি।’
হাফসা উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ এত ক্লান্তির কারন কি উনার!
কিছুক্ষণের মধ্যে আরহাম ওয়াশরুম থেকে মাথাসহ শরীর ভিজিয়ে এসে বললেন, ‘এত কষ্ট রান্না?আপনি এতো কষ্ট করেন?’
হাফসার চোখ কপালে উঠার উপক্রম।তার মানে উনি এতক্ষণ কিচেনে ছিলেন।
আরহাম গায়ে কোনোভাবে শার্ট জড়িয়ে ভেজাচুলে হাফসার পাশে বসে বললেন, ‘কথা বলছেন না কেন?রাগ আমার ওপর?আই এম সরী।ভেরী সরি।আপনাকে বিকেলে বেশী ফোন করেছিলাম,খুব প্রয়োজন ছিলো আমার এই চান্সটা।কিন্তু আম্মু অসুস্থ আমি জানতাম না।শুধু শুধু আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য যে পানিশমেন্ট দিবেন, আমি মাথা পেতে নিবো।’
হাফসা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,’আ্ আপনি কিচেনে কি করছিলেন?’
আরহাম হাফসার হাতের ব্যান্ডেজ টা নিজের হাতে নেড়ে নেড়ে দেখে বললেন, ‘আম্মুর খাবার টা আমি তৈরী করেছি।’
‘আপনি??’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি রান্না জানেন?’
‘জ্বী না।’
‘তাহলে কিভাবে বানালেন?’
‘ইউটিউব দেখে।জানি খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু আম্মু কিছু মনে করবেন না।আপনি আসার আগে,আম্মুর এসব খেয়ে অভ্যেস আছে।’
হাফসা নিচে যাওয়ার জন্য উঠতে আরহাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন? ‘
‘আম্মুকে খাইয়ে ওষুধ দিব।’
‘আমি খাইয়ে আসছি।’
‘সাহারির রান্না বাকি।’
‘সার্ভেন্ট রাঁধছে।’
‘উনাদের রান্না…
‘আমার কোনো সমস্যা নেই।’
‘আ্ আব্বু, মেহমান?’
‘তাদেরও সমস্যা থাকার কথা না।’
উনি হাফসাকে আবার পাশে বসালেন।ওর ব্যান্ডেজের ওপর চুমু খেয়ে বললেন, ‘চাঁদের গায়ে বারবার দাগ কেন লাগে?’
হাফসা পুলকিত হয়।আরহামের সম্বোধন গুলো ওর মনে অদ্ভুত এক ভালোলাগার সৃষ্টি করে।আরহাম বাটি থেকে এক চামচ খাবার ওর মুখে তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘ইফতারে তো খাননি কাঁদতে কাঁদতে।এখন কোনো ‘না’ যেনো না শুনি।
হাফসার অভিমানের সব সুর কেঁটে গেল আরহামের মিনতি এবং ভালোবাসার কাছে।নিজের সর্বস্ব সঁপে দেওয়া যায় যে পুরুষ মানুষের কাছে সেই পুরুষের প্রতি নারীর অভিমান কেবল লোক দেখানো।উনার হাত থেকে খাবার মুখে তুলে নিয়ে সে বলল,
‘আমার নিজের খুব খারাপ লাগছে।ইফতারে খাবার পুড়িয়ে ফেলেছি।মেহমানদের…
‘আমি তো আপনার দোষ দিচ্ছি না।তবে তখন সাহরির রান্না করতে গেলে খবর ছিলো।’
হাফসা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে।এতো ভালোবাসা, স্নেহ কোথায় জমিয়ে রাখেন আরহাম?
খাওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ান।হাত বাড়িয়ে হাফসার হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন,’পুষ্পের পাপড়ি যেনো মুচড়ে না যায় আবার।’
হাফসা হাসে।
আরহামও বিনিময়ে মুচকি হেসে বললেন,
‘ঘুমান আপনি।সাহরিতে উঠতে কষ্ট হবে পরে।’
_____
হাফসার ঘুমজড়ালো চোখজোড়া যখন চোখ বুজার অপেক্ষায়, তখনি কারো বাহুডোরে যত্নের সহিত আবদ্ধ হয় সে।আরহাম ওর গালের নিচে চুমু দিয়ে বললেন, ‘একটা সত্যি কথা জানেন?আপনি আমার মন খারাপের মেডিসিন।’
হাফসা হাসল।সে ভুলো গেলো,সন্ধ্যার সব অভিমান।তাঁর ছোট হাতজোড়া জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তমের প্রশস্ত বুক।সে বুকের মালিক,প্রেয়সীর ছোট্ট একটুকরো ভালোবাসায় প্রশান্তির হাসি হাসলো!
______
চারিদিকে ঘন আঁধারে আচ্ছন্ন।ঘড়িতে বোধহয় তিনটার গণনা শুরু হয়েছে।একটু পর সাহরির এলার্ম বাজবে।মাইমুনার রুমের পর্দাটা হালকা বাতাসে দূলছে।আরহামের লাল চোখজোড়া থেকে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ে মাইমুনার গালে।যে হাত দিয়ে মাইমুনা কে আঘাত করেছিলেন, সেই হাত দিয়ে তার আঘাতের জায়গায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আরহামের হৃদয়ে অসহনীয় কষ্ট লেগেছিলো মাইমুনা কে আঘাত করতে।পরিণয়ের তিন বছরেও তাদের মধ্যে কখনো ঝগড়া হয় নি,কথা কাটাকাটি হয়নি,খুনসুটি হয়েছে তবে সেটা ভালোবাসার।
একসাথে পথচলার পুরো সময়টুকু দূজনের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিলো।
‘কেন বদলে গেলেন My moon!আমি আপনাকে আঘাত করতে চাইনি সত্যি!এত জেলাসি কেন করতে হয় উমায়ের কে নিয়ে।আপনিই তো সবসময় বলতেন, ‘আমার জীবনে অন্য একটা Moon আসুক।যে আপনার বোন হবে।’
‘হিংসা’ জিনিসটা আপনাকে কত নীচ বানিয়ে দিলে আপনি উমায়ের কে নিয়ে এমন ওয়ার্ড ইউজ করলেন। কত খারাপ লেগেছে আমার!’
____
ফযরের নামাজ পড়ে এসে আরহাম যখন ড্রয়িং রুম পেরিয়ে উপরে উঠতে যাবেন তখন পথ আটকে এসে দাঁড়ান মিসেস আতিয়া।
‘বাবা একটু কথা ছিল তোমার সাথে।তুমি ফ্রী আছো?’
‘জ্বী।’
মিসেস আতিয়া আরহাম কে সরাসরি মাইমুনার রুমে নিয়ে গেলেন।আরহাম কে দেখেই চোখ নামিয়ে নেয় সে।তাঁর চোখে যত আকুতি,অপরাধবোধ,অনুতাপ।
আরহাম কে বসতে বলে মিসেস আতিয়া বলতে লাগলেন, ‘মা হয়ে ছেলের কাছে ক্ষমা চাইছি।হাফসা খুব ভালো মেয়ে।তাকে নিয়ে কিছু কটুক্তি করেছি।আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।ক্ষমা করে দিয়ো।’
আরহাম চুপ থাকলেন।তাঁর দৃষ্টি মাইমুনার দিকে নিবদ্ধ।
তিনি আবারো বলতে লাগলেন, ‘মাইমুনাও ক্ষমা চাইছে তোমার কাছে।’
বলে মিসেস আতিয়া রুম থেকে চলে গেলে মাইমুনা জড়তা ভেঙে বলতে লাগলো, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিন।আমি ওকথা বলার প্রস্তুত ছিলাম না,কিন্তু কিভাবে যেন বলে ফেলেছি।এই শাসন টা আমার প্রয়োজন ছিলো।প্লিজ ক্ষমা করে দিন।আর কখনো হাফসাকে আঘাত করে কোনো কথা বলবো না।’
আরহাম শান্তসুরে বললেন, ‘উনার কাছে গিয়ে ক্ষমা চান।আমাকে বলে কি হবে।’
‘ওকে বলতে পারবো না।ও হার্ট হবে।ও তো জানে না।আমি আর বলবো না কখনো প্রমিস।’
‘আচ্ছা।’
‘আ্ আ আপনি ক্ষমা করেছেন আমাকে?’
আরহাম উঠতে উঠতে বললেন, ‘এখন করেছি।তবে আগের হিসাব তো বাকি।’
মাইমুনা অসহায় চোখজোড়া নিবদ্ধ করে রাখলো তার যাওয়ার প্রতি।এ মান-অভিমানের কবে সমাপ্তি ঘটবে!
আরহাম রুমে এসে দেখলেন হাফসা মাএ জায়নামাজ তুলছে।তিনি চুপচাপ গিয়ে বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে পড়লেন।
আরহাম স্বভাববত চুপ থাকেন না।একটু হলেও কথা বলেন।
হাফসা জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার মন খারাপ? ‘
44★
৭৮
মসজিদের জায়গা দেখতে আজ কোলানগর আসছেন আরহাম।সামনে ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চারা খেলছে।কদিন পর এখানে সবাই নামাজের পায়তারা করবে ভেবেই আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, পুরো কাজটা যেনো সুন্দর মতো সম্পন্ন হয়।
দূপুরের তেজী রোদে তাঁর গায়ের জুব্বা ভিজে একাকার।যোহরের নামাজ পড়েছেন গ্রামের একটা মসজিদে।
রোদের উষ্ণতা থাকলেও এই গ্রাম্য পরিবেশ টা বেশ লাগছে আরহামের।
আহিরকে নিয়ে গ্রামের একটা পথে হাঁটছিলেন আরহাম।উদ্দেশ্য চেয়ারম্যান বাড়ি।আরহাম আসছেন জানলে চেয়ারম্যান নিজেই নিজের দলবল নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন।উনাকে না জানিয়ে আসার কারন এটাই যাতে তাদেরকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না হোন।
উঠান থেকেই সাদা জুব্বায় ঘামে জবুথবু হওয়া আরহামকে দেখেই ফায়েজ খান দৌড়ে আসলেন।সালাম দিয়ে হুলস্থূল হয়ে তাকে ঘরে নিয়ে বসালেন।
জরুরি কথাবার্তা শেষে আরহামকে নিয়ে বাইরে বের হলে উনার নজরে পড়লো গ্রামের মহিলারা তাকে কিছুটা লুকিয়ে চুরিয়ে দেখছেন।এ বিষয়টা অস্বস্তি লাগলো আরহামের।অস্বস্তির মধ্যে আরো অস্বস্তি এসে ভীড় করলো যখন পেছন থেকে আচমকা কেউ একজন উচ্ছাসিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ও মাই আল্লাহ।আপনি এখানে?’
মেয়েলি কন্ঠটা কেমন পরিচিত লাগলো উনার।আদওয়া কে সামনে দেখেই উনার কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পরে।ইনি এখানে কেমনে!
আরহামকে নিয়ে আদওয়ার এত এক্সাইটমেন্ট দেখে ফায়েজ খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি উনাকে চিনো?’
‘হ্যাঁ মামা।বাবার ফ্রেন্ডের ছেলে উনি।কিন্তু এখানে কেন?’
‘ওইযে মসজিদের কাজটা উনিই করাবেন।’
আদওয়া আরো কিছু বলতে গেলে আরহামের ফোন বেজে উঠে।
পাশ থেকে সরে গিয়ে ফোনটা কানে তুললেন। হাফসা ভালোমন্দ কথা বলে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কখন আসবেন?’
আরহাম নিচু স্বরে বললেন, ‘মিস করছেন বুঝি?’
‘জ্ জ্বী না,ইফতারের আগেই চলে আসবেন যেখানেই থাকুন।’
আরহাম হেসে ফোন রেখে দেন।
তাঁর ঝিলিক হাসি গিয়ে কাটার মতো লাগলো আদওয়ার কাছে।লোকটা কার সাথে কথা বলে এত হাসেন?আমাকে দেখামাত্রই তো মুখ শুকিয়ে গিয়েছিলো।
আরহাম ফোন রেখে বললেন, ‘আমাকে ফিরতে হবে।আজকে আসি।’
‘জ্বী না,কোনোমতেই না।আজকে আমাদের এখানে ইফতার সাহরি করে কাল যাবেন।’
আরহাম হেসে ফেললেন,সেই হাসিতে আরেকদফা মুগ্ধ হলো আদওয়া।
‘জ্বী না, ইন শা আল্লাহ অন্য একদিন।আজ যেতে হবে।’
‘খুবই কি জরুরি যাওয়া?’
‘জ্বী,বাসায় আম্মু উমা..মানে সবাই একা।আব্বুও একটু অসুস্থ যেতে হবে।’
আদওয়া আরহামকে কথা বলাতে চাইছিলো।জিজ্ঞেস করলো, ‘আঙ্কেলের কি হয়েছে?’
‘অসুখ।’
আহির এসে জানালো লেট হচ্ছে।আরহাম যখন ফায়েজ খানের থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন,আদওয়ার করুন চাহনী উনার দৃষ্টি এড়ালো না।রোডে ওঠে দেখলেন,বেশ কিছু লোক দল বেঁধে তাদের দেখছে।বিশেষ করে মহিলারা।একজন নামকরা আলেমকে দেখে গ্রামের সহজ সরল মানুষ তো চমকিত হবেই!
কাঁচা রাস্তার রোডে উঠে গাড়িতে উঠলেন আরহাম।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন, ‘ইতিমধ্যে লেট।প্রিয়তমার আবদার রাখতে পারবেন তো!’
_____
সন্ধ্যার পর ইফতার করে এসে নামাজ পড়ে উঠতেই কিরান হাজির।
সে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে।হাফসার বাড়ি কোথায়,তাঁর বাড়ি থাকতে সে এখানে কেন থাকে।সে কেন মসজিদে নামাজ না পড়ে ঘরে পড়ে।সে আস্তে আস্তে কেন তিলাওয়াত করে।সে স্কুলে যায় না কেন।
হাফসা কিরানের সব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছে।তখনই রুমে প্রবেশ করলেন আরহাম। ইফতারের কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসে পৌঁছেছিলেন।
কিরানকে কাছে নিয়ে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সে কয়টা রোজা রেখেছে?
কিরান তাঁর ছোট ছোট হাতের আঙ্গুল গুলো গুনতে গুনতে বলে,আমি আটাশ টা রোজা রেখেছি।
হাফসাসহ আরহাম হেসে বললেন, ‘রোজাই তো পঁচিশটা। তুমি তিনটা বেশী রাখলে কীভাবে?’
সে গুণে গুণে হিসাব দিল,সে সকালে ইফতার খেয়েছে। তারপর ঘুমিয়েছে,বিকেলে আবার ইফতার করেছে এ হিসেবে দূটো হয় তাঁর।
কথা বলার একপর্যায়ে সে হাফসাকে দেখিয়ে বলল, ‘মামা তুমার বউ আমাকে দিবে?আমি তাকে আমার সব টয়ে’স দিব।আমার পাশে ঘুমাবে সে।’
কিরানোর কথায় আরহাম অবাক হওয়ার ভান ধরে বললেন, ‘বলে কী!আমার এত মায়ার বউ দিয়ে দিব তোমাকে?’
‘হ্যাঁ।তুমার তো আরেকটা বউ আছে মামা।আমার তো নেই।’
হাফসা মিটিমিটি হাসছে।আরহামের মুখে প্রথম ‘বউ’ ডাক শোনা ওর।কেমন জানি লাগছে!
আরহাম কিরানকে কোলে নিয়ে বললেন, ‘না মামা।আমার দূজনের মধ্যে কাউকে দিব না।তুমি বড় হও।ভালো করে পড়াশোনা করো তারপর তোমাকে চারটা বিয়ে করাব।চারজন বউ থাকবে।’
‘সত্যি?’
আরহাম কিরানের এক্সপেকটেশন দেখে হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ সত্যি।’
সে মেনে নিলো।বলল সে ভালো করে পড়াশোনা করবে।কিন্তু তাঁর শর্ত ঠিক হাফসার মতো সুন্দর বউ দিতে হবে তাকে।নানুমণির সাথে জেদ ধরে থেকেছে সে,মায়ের সাথে কোনোমতেই যেতে রাজি হয়নি।আরো অনেক কথাবার্তারপর সে বলল, ‘আজ সে হাফসার সাথে ঘুমাবে।’
আরহাম তাকে ভুতের ভয় দেখিয়ে সোজা নিচে দিয়ে আসলেন।রুমে এসে বললেন, ‘একটুর জন্য আপনাকে হারায়া ফেলতাম।’
‘এত জেলাস আপনি?তাও এই বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে?’
‘বিষয়টা যদি আপনার হয়,তাহলে তো জেলাস হতেই হয়।’
45★
৭৯
বিকালে আদওয়া বাসায় ফিরতেই দেখে ড্রয়িংরুমে ইমান আর তাঁর আম্মু আব্বু।নিরস চোখে একবার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে সে রুমে চলে গেলো।অথচ আদওয়া মোটেই চুপচাপ থাকার মেয়ে না!
ইমান আদওয়ার ফিয়ন্সে।দূ বছরের প্রণয়ের সম্পর্ক,ফ্যামিলিতে যখন জেনে যায় বিষয়টা ইমান নিজেই তাঁর মা-বাবার মাধ্যমে আদওয়ার ফ্যামিলিতে প্রস্তাব পাঠায়।উনারা আগামী মাসে অস্ট্রেলিয়া যাবেন,দেশে ফিরে এসেই অনুষ্ঠান হবে।তাই এখন আংটি পরিয়ে যেতে চাইছেন।একসপ্তাহ আগেও আদওয়া ওর আব্বুকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিলো, সে এখনি কারো অধিকারে যেতে চায় না।সে ফ্রীডম থাকতে চায়।ইনডিরেক্টলি সে ইমানের সাথে এনগেজমেন্ট টা ক্যানসেল করার কথাই বুঝিয়েছিলো।
রুমে এসেই ব্যাগ ফ্লোরে ছুড়ে বালিশে মাথা লাগিয়ে কেঁদে দিলো।তাঁর ছোট্ট মনে কঠিন এক আঘাত লেগেছে আজ।ছোটবেলা থেকেই উচ্চবিলাসী সে।চাওয়ার আগেই সব জিনিস পেয়েছে সে।এমনকি ইমানকেও তাঁর নিজের পছন্দ করা।
ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে আরহামের ছবিটা দেখে সে অঝরে কেঁদে দিলো।এই লোকটা বিবাহিত।এই বিষয়টা কোনোভাবেই মানতে পারছে না তাঁর মন।বারবার মনে হচ্ছে, সব ভুল,সব মিথ্যা!
ফ্ল্যশব্যাক….
আজকে ক্লাস শেষে আরহামের বাসায় গিয়েছিলো আদওয়া।আংকেলকে দেখে,আন্টির রুমে কিছুক্ষণ গল্প শেষে সে আন্টির মেয়েদের সাথে কথা বলতে দোতলায় গিয়েছিলো।দোতলায় না পেয়ে যখন সে ছাদে গিয়েছিলো,সেই দৃশ্য দেখে বাচ্চাদের মতো ওখানেই কেঁদে দিয়েছিলো সে।আরহাম হাফসাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ছিলেন।নানা খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা।কখনো বা তাঁর কানে ফুল গুজে দিচ্ছিলেন,কখনো বা খোলা বাতাসে তাঁর লম্বা চুলে এলোমেলো বেণী করে দিচ্ছেলেন।মেয়েটা আলবাত সুন্দরী।কত ভাগ্যবতী সে!
আদওয়া প্রথমে ভেবেছিলো,মেয়েটা নিশ্চয়ই লোকটার প্রেয়সী হবে।কারণ লোকটা তো অবিবাহিত।
নিচে এসে যখন মাকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘বাসায় কে কে আছে?’
তখন উনি বলছিলেন,’তাঁর মেয়ের মতোই দূই বউমা।মাইমুনা যখন কোনো কারণে ড্রয়িং রুমে আসছিলেন,তখন তাকেও দেখা হয়েছে তার।দূজনই হুরপরী।আজ আন্টির সাথে একপ্রকার জোর করেই কোনোমতে কান্না আটকে চলে এসেছিলো।
বর্তমান….
চোখমুখ মুছে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো সে।তখনি রুমে পারমিশন নিয়েই আসলো ইমান।
তাঁর চোখেমুখে অসহায়ত্ব।আদওয়া মা বাবাকে দেখেও অন্তত একটা সালাম দিয়ে না আসায় তাঁর মা-বাবা কিছুটা লজ্জিত।তবুও সে বিষয় টা সামলে নিয়ে বলে,
‘আদওয়া কিছু হয়েছে?তুমি ঠিক আছো?’
আদওয়া তাঁর লাল চোখ জোড়া তুলে তাকাতেই ইমান আশ্চর্যান্বিত হয়।গাড়িতে আসতে আসতেও তুমুল কেঁদেছে মেয়েটা।ইমান অস্থির হয়ে ওর পাশে বসে বলে,’তুমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?কিছু কি হয়েছে।বলো আমাকে।তুমি কি কেঁদেছো?’
আদওয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘বিয়ে তো আমাকে করবে।অথচ আমাকে একটাবার জানালে না পর্যন্ত আজ আসবে….
ইমান ওর কথাটা পুরোপুরি এড়িয়ে বলে, ‘তুমি খুব কেঁদেছো।কেন?’
‘মন ভেঙেছে তাই।’
‘একটু ক্লিয়ারলি বলো।’
‘ইউ ডিজার্ভ বেটার দ্যান মি।’
‘এটা কথা ছিলো না।’
****
আরহাম মাইমুনার রুমে এসে বসে আছেন কিছুক্ষণ।সে ওয়াশরুম থেকে বের হলেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা, কিরান চলে গেলেন।আমি তো জানি না।’
‘বিকালে গিয়েছেন।’
‘আমি তো বাসায় ছিলাম।’
‘মা গিলটিফিল করছিলেন, আপনার সামনে যেতে।’
‘কেন?’
‘গতদিনের জন্য।’
‘এসব কি আবার।’
মাইমুনা মলিনস্বরে বলল, এবারের ঈদ টা আমার বাবার বাড়ি করি?’
‘কেন?’
‘এমনিই’
‘না,আমি তো আপনার হাতে পায়েস না খেয়ে ঈদের জামাআতে যাইনি।’
মাইমুনা ক্ষণকাল চেয়ে রইলো আরহামের দিকে।এই লোকটা ইগনোরও করে,আবার ভালোওবাসে।আরহাম মাইমুনাকে ধরে নিয়ে বিছানায় বসালেন।তারপর কিছু না বলে চুপচাপ মাইমুনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলেন।বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘আই অলওয়েজ মিস ইউ মাই হানি।ইন এভরি সেকেন্ড।’
রাতে বাবার জ্বর বাড়লো।বেশ কিছুদিন থেকেই বাবা অসুস্থ।একদিন গরমের মধ্য থেকে এসে ঠান্ডা পানিতে গোসল করার পর থেকে জ্বর।
রাত তখন দশটা।হাফসা বাবার জন্য আলাদা করে খাবার বানিয়ে এসে দেখলো,আরহাম বাবার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন।হাফসা খাইয়ে দিতে চাইলে মানা করলেন উনি।ওর হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিজেই খাওয়ানোর চেষ্টা করলেন।
হাফসা আম্মুকে খাইয়ে মাইমুনার খাবারও রেডি করে রুমে দিয়ে আসলো,উনার আবার টাইমলি খেয়ে ওষুধ খেতে হয়।
সবশেষে রইলো হাফসা।
আরহাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি খেয়েছেন কী না?’
সে উত্তরে বলল,’আপনি কখন খাবেন?’
****
‘তুমি আদওয়ার সাথে ক্লিয়ারলি কথা বলো।কোনো কারনে,সে আপসেট।বিয়ে বিষয় টা সহজ না ইমান।মেয়েদের মনের কথা আরেক মেয়ে হয়ে আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারি।’