৫. বিকেলের দিকে রুমাইশা আর শাফিন বেরোলো জঙ্গলের ভেতর ঘুরতে। দুপুরের একটু আগে এসে শামসুল কাদের রুমাইশার বই খাতা, কিছু জামা কাপড়, আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস এনে দিয়ে গেছে৷ সেগুলো গোছ গাছ করে গোসল সেরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ওরা ভাবলো জঙ্গল টা একটু ঘুরে আসা যাক৷
রুমাইশার মনে পড়ল ছোট বেলায় রুমাইশারা যখন আসতো ওরা তিনজন মিলে জঙ্গলে ঘুরতে যেত, রুমাইশা, রাফসান আর সাফওয়ান। শাফিন তখন অনেক ছোট। তাই ওকে আর নেওয়া হতো না৷
তিনজনে মিলে জঙ্গলের কিছুটা গভীরে যেত, সেখানে একটা ডোবা আছে, তার পানি অনেক স্বচ্ছ। ওই ডোবায় লাল শাপলা ফুটতো। রুমাইশা শুধু ফুল নিতে চাইতো। শাপলার গোড়ায় অনেক সময় সাপ পেচিয়ে থাকে তাই রাফসানের খুব ভয় লাগতো ফুল তুলতে। কিন্তু সাফওয়ান ছিলো অনেক সাহসী। আর সবথেকে বয়সে বড় হওয়ায় ওর ওপরেই ছিলো আবদার পুরনের ভার।
শাফিন আর রুমাইশা হাটতে হাটতে সেই ডোবার কাছে এসে পৌছালো, জঙ্গল টা যেন আগের থেকে আর ও বেশি ঘন হয়েছে, চারদিক লতাপাতা আর ছোট ছোট গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ দিয়ে পরিপূর্ণ। ডোবার চারপাশে না না রকম জংলী ফুল ফুটে আছে।
শাফিন জিজ্ঞেস করলো আর সামনে এগোবে কিনা, রুমাইশা এগোতে চাইলো আর একটু, বলল,
—চল আর একটু যাই, কতদিন পর এই জঙ্গলে এসেছি, আবার কতদিন পর আসবো তার ঠিক নেই।”
শাফিন ও সম্মতি জানালো। কিছুদুর এগোনোর পর ওরা কিছুটা ফাকা জায়গা দেখতে পেলো। এই খানে লতাপাতার পরিমাণ অন্য জায়গার তুলনায় অনেক কম। ঘাস ও উঠে উঠে গেছে অনেক জায়গা থেকে, মনে হচ্ছে এইখানে নিয়মিত কেউ আসে বা থাকে। ব্যাপার টা ওদের দুজনের কাছেই খুব অদ্ভুত ঠেকলো, তাছাড়া আশ পাশ টাও কেমন যেন গা ছমছমে, খুব নির্জন।
হটাৎ করেই এক ঝটকা শীতল বাতাস বয়ে গেলো ওদের ওপর দিয়ে, শাফিনের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো যেন। শাফিন রুমাইশার দিকে ফিরে বলল,
—বাসায় ফিরে চলো আপু, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, আর এই জায়গাটা তেমন সুবিধার ঠেকছে না।”
রুমাইশা ও সম্মতি জানয়ে বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালো, তখনি রুমাইশার চোখ গেলো তাদের ডান দিকে প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ হাত দূরে।
রুমাইশার চোখ দুটা বড় বড় হয়ে গেলো, যেন হাটতে ভুলে গেছে ও। রুমাইশাকে এভাবে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে শাফিন ও রুমাইশার দৃষ্টি অনুসরণ করে ডান দিকে তাকালো, তাকিয়েই শাফিনের পিলে চমকে উঠলো! শাফিন তাড়াতাড়ি করে রুমাইশার হাত ধরলো, তারপর কাপাকাপা গলায় বলল,
—আপু, আমরা হয়তো অনেক বড় বিপদে পড়ে গেছি৷ এখনি এখান থেকে চলো, নইলে আজ হয়তো আর বেচে ফিরবো না।”
তখনি ঝোপের মধ্যে কিসের একটা আওয়াজ হলো, সাথে সাথে উল্টো দিক ফিরে হাতধরা অবস্থায় বাড়ির দিকে উর্ধশ্বাসে, প্রাণপণে ছুট লাগালো দুজন। ভুলেও পেছনে তাকানোর সাহস করলো না। ডোবা পার হয়েও ছোটা থামালোনা ওরা।
ছুটতে ছুটতে সামনে যেতে যেতে যখন ওরা বাড়ির নাগালে এসে গেলো তখনি ছোটা থামালো দুজনে। রুমাইশা হাপাতে হাপাতে বসে পড়লো ঘাসের ওপর। শাফিন ও বসলো পাশে, দুজনেই হাপাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, ভয়ে নীল হয়ে গেছে রুমাইশা। ভয়ে ভয়ে আবার একবার তাকালো তাদের ফিরে আসার রাস্তার দিকে, ছোটার সময় মনে হচ্ছিল কে যেন ওদের পিছু নিয়েছে, একদমই যেন পেছনে, হাত বাড়ালেই ছুতে পারবে! কিছুক্ষন বসে থেকে নিজেদের স্বাভাবিক করে নিয়ে দুজনে বাড়ির দিকে এগুলো, কিন্তু দুজনের কেউ ই টের পেলো না, যে ছাদের চিলেকোঠার রুম থেকে কেউ একজন ঈগলের মত তীক্ষ্ণ চোখে তাদেরকে দেখছে।
৬. রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর শাফিনের ডাক পড়লো ছাদে৷ রুনিয়া সাফওয়ান কে খাবার দিতে যাওয়ার সময়ে সাফওয়ান বলে দিয়েছে শাফিন যেন এক্ষুনি ওর সাথে দেখা করে৷
রুনিয়া নিচে এসে শাফিন কে এই কথা বলতেই শাফিনের মুখ খানা ফ্যাকাসে হয়ে যায়৷ আমতা আমতা করে রুনিয়া কে জিজ্ঞেস করে,
—আমাকে কেন ডেকেছে মা, আমাকে তো ভাইয়া ডাকে না! আমি কি কিছু করেছি?”
রুনিয়া বললেন,
—আমি কিভাবে বলব ও তোকে কেন ডেকেছে? তোকে যেতে বলেছে দ্রুত যা।”
শাফিন আর বাক্য ব্যয় না করে ছাদের দিকে এগোলো। চিলেকোঠার ঘর অব্দি যাওয়া লাগলো না। ছাদে উঠে কয়েক পা ফেলার পরই সামনে কাঙ্ক্ষিত অবয়ব দেখতে পেলো সে। শাফিনের দিকে পেছন ফিরে দাড়িয়ে আছে এক জন লম্বা চওড়া পুরুষ। আবছা আলোয় তাকে বিশালাকারের দেখাচ্ছে।
পরনে সাদা রঙের আন্ডারশার্ট আর কালো ট্রাউজার। পিঠের আর বাহুর উচু উচু হয়ে থাকা পেশির দিকে তাকালেই বোঝা যায় ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ এর পেছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করা হয়৷ এই প্রথম সাফওয়ান কে স্যুট বুট ছাড়া দেখলো শাফিন।
শাফিন মনে মনে ভাবলো, ‘সাফওয়ান ভাইয়া এত লম্বা কেন? আমাদের গোষ্ঠী তে এমন লম্বা কেউ আছে বলে মনে হয় না, আমি 5.10, আব্বু 5.8, দাদু ও ছিলো 5.10 এর কাছাকাছি, আর সাফওয়ান ভাইয়া! সে এক ধাক্কায় 6.4।
কার মতো যে হয়েছে আল্লাহ মালুম!
শাফিনের ভাবনায় ছেদ পড়লো এক গম্ভীর ভরাট পুরুষালি কণ্ঠে। সাফওয়ান পেছন ফেরা অবস্থাতেই ভারিক্কি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—জঙ্গলে কেন গিয়েছিলি?”
শাফিন নমনীয় কন্ঠে ধীরে ধীরে বলল,
—একটু ঘুরতে গেছিলাম, রুমি আপু বলছিলো যে জঙ্গলের দিকে একটু ঘুরতে যাবে, অনেক দিন যায়নি তাই।”
— ফেরার সময়ে ছুটছিলি কেন?”
ছোটার কথা মনে পড়তেই শাফিনের ভয়েস চেঞ্জ হয়ে গেলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,
—ভাইয়া, আর বলো না! জঙ্গলের ভেতরের যে ডোবা আছে ওর থেকে কিছুটা সামনে গেছিলাম আমরা, কিন্তু ওখানে গিয়ে জঙ্গল কেমন যেন খুব হালকা মনে হচ্ছিল, যেন সেখানে কেউ বা কিছু যাওয়া আসা করে অনেক, বা থাকে। আমরা যখন ওখান থেকে ফিরে আসবো তখনই দেখি আমাদের থেকে খানিক টা দূরে কিছু একটার খোলস। সাপের খোলসের মতো। কিন্তু সেটা সাপের খোলসের থেকেও সাইজে অনেক বড়। আর পুরু। নিশ্চিত ওইখানে কোনো বড় সাইজের অজগর থাকে, নয়তো অন্য কিছু।”
শাফিন আর ও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই সাফওয়ান ওকে থামিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বলল,
—আমি যেন আর কখনো তোদের কাউকে জঙ্গলে যেতে না দেখি, আর খুব প্রয়োজনে গেলেও, ডোবার ওইপাশে যাবিনা৷ মনে থাকে যেন কথা টা৷ আর রিমু কখন এসেছে?”
বাকিরা রুমাইশা কে রুমি বললেও সাফওয়ান ওকে রিমু বলে ডাকে, ছোটবেলায় এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতো,
—সবাই ওকে যা ডাকে আমিও তাই ডাকবো কেন? তাহলে অন্য সবার আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি থাকলো?”
তখন বাকিরা মজা করে বলতো,
—কেন, তুই কি স্পেশাল?”
সাফওয়ান দ্বিগুণ জোর দিয়ে বলত,
—হ্যা আমি স্পেশাল৷”
— গত পরশু এসেছে রুমি আপু, বিকেল বেলা।
বলল শাফিন
প্রতিউত্তরে সাফওয়ান কিছু বলল না, চুপ করে থাকলো। তারপর কিছুক্ষণ পর শাফিন কে চলে যেতে বলল, শাফিন সাথে সাথেই নিচে চলে আসলো।
রুমাইশা এতক্ষন নিচেই ছিলো, সাফওয়ান কি বলে সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলো ও। শাফিন নিচে এলেই ও গিয়ে জিজ্ঞেস করলো সাফওয়ান কি বলছিলো।
শাফিন সব খুলে বলল। সাফওয়ান ওর কথা জিজ্ঞেস করেছে শুনেই ওর বুকের ভেতর অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করলো। কেমন যেন একটা সুখ সুখ অনুভূতি। ও তো ভেবেছিলো সাফওয়ান হয়তো ভুলেই গেছে যে রুমাইশা নামে কেউ একজন আছে৷
তারপর দুজনে কথা শেষ করে যে যার মতো রুমে চলে গেলো।
৭. রাতে পড়া শেষ করতে করতে দুইটা বেজে গেলো। শাফিন আজ দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছে, ওর শরীর টা সন্ধ্যা থেকে একটু মেজমেজে লাগছে৷ রুমাইশা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলো, আজ আর বাইরের লাইট টা কেউ অফ করেনি।
রুমাইশা শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো, সাফওয়ান ভাইয়া এরকম হয়ে গেল কেন? ভাইয়া তো আগে কত মজা করতো ওদের সাথে, খুব প্রাণোচ্ছল ছিলো ভাইয়া। ওদের তিন জনের লিডার ছিলো সাফওয়ান। তানিয়া ফুপ্পিরা দেশের বাইরে থাকে বলে আয়ান আর জায়ানের সাথে ওদের খুব বেশি মেলামেশা হয় না৷ তাই তিনজনের দেখা হলেই সারাক্ষন একসাথে থাকতো।
সাফওয়ান ছিলো বদমেজাজি আর একরোখা। ছোটবেলায় প্রচুর মারদাঙ্গা করার স্বভাব ছিলো ওর, যাকে তাকে মেরে বসত। একবার ওরা তিনজন পৌর পার্কে খেলা করার সময়ে একটা মেয়ে রুমাইশার চুল টেনে ধরেছিলো, রুমাইশার সে কি কান্না! বছর চারেকের রুমাইশা তখন ছিলো সাফওয়ান এর কলিজার টুকরা। সাফওয়ান তখন বারো বছরে পড়েছে৷ আর রাফসান নয়ে।
রাফসান রুমাইশার কান্না থামাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো, আর সাফওয়ান গিয়ে মেয়েটারে কষে দিলো একটা থাপ্পড়৷ মেয়েটা হয়তো বছর ছয়েকের হবে৷ গালে পুরো চার আঙুলের দাগ বসে গেলো মেয়েটার।
এদিকে মেয়েকে চড় দিয়েছে দেখে সেই মেয়ের বাবা মা এসে সাফওয়ান এর সাথে ঝামেলা বাধিয়ে দিলো। রুনিয়া রহমান ছিলেন ওদের সাথে। মেয়ের মা বলে গেলো,
—ছেলেকে এখনো শাসন করুন, নইলে ছেলের বিগড়ে যেতে সময় লাগবে না৷”
রুমাইশা নিজের মনে মনেই হাসলো, সাফওয়ান ভাইয়া কত্ত কেয়ারিং ছিলো ওর প্রতি। এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে গেলো ও।
হঠাৎ করেই ভারী কিছু পড়ার শব্দে আজ ও জেগে উঠলো রুমাইশা…..