পরিজান

নূরনগরের পার্শ্ববর্তী এলাকার বেশ স্বনামধন্য ব্যক্তি সম্রাট মির্জার একমাত্র পুত্র শশীল। একমাত্র সন্তান
হওয়ায় বাবা মায়ের একমাত্র আদরের সে। যখন যা চায় তাই পায়। ছেলের আবদার পুরন করতে করতে কখন যে ছেলেকে বিপথে পাঠিয়ে দিয়েছেন তারা নিজেরাও বুজতে পারেননি। বুঝতে পেরেছে শেষ সময়ে। এখন সম্রাট তার ছেলেকে ঠিক করতেই পারছেন না। বেশ কয়েকবার জেল থেকে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছেন। তবুও ছেলের অন্যায় কমাতে পারছে না। নিষিদ্ধ জায়গায় গিয়ে নিষিদ্ধ মেয়েদের সাথে মেলামেশা আর নেশা করতে করতে চরিত্র টাই বখে গেছে।
ওই খারাপ চোখের ললুপ দৃষ্টি পড়ে রুপালির উপর।
রুপালি তখন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। ওর সাথে সবসময় একজন রক্ষি থাকতো বিধায় শশীল শুধু লালসার দৃষ্টি দিতো। বারবার চেষ্টা করেও রুপালির ধারে কাছে সে ঘেষতেও পারে না। এতে দিন দিন আরো ক্ষিপ্ত হয় শশীল। সবসময় হিংস্র বাঘের মত ওত পেতে থাকতো। কিন্ত সে তার শিকার কে ঘায়েল করতে পারতো না।
তবে একদিন সে সুযোগ এসেই গেলো। সেদিন ছিল জমিদার বাড়িতে অনুষ্ঠান। অনেক মানুষের আনাগোনা। সন্ধ্যার পর জলসার আয়োজন করা হয়েছিল প্রাঙ্গনে। এরই মধ্যে রুপালির কাছে একটা ছোট বাচ্চা এসে চিঠি ধরিয়ে দিলো। চিঠিতে লেখা ছিলো,”তোমার জন্য বাড়ির পিছনে অপেক্ষা করছি।
সিরাজ,,,”
তখন ওদের দুজনের ভালোবাসা আরো গভীরে চলে গিয়েছিল। খুব বিশ্বাস করতো সিরাজকে। তাই হারিকেনের আবছা আলোয় ওতটুকু পড়েই রুপালি সেখানে চলে গেল। বাড়িতে অনেক মেহমান। ওকে কেউ খুজবে না। সেই সুযোগে রুপালি চলে গেল। কিন্ত সেখানে সিরাজের পরিবর্তে ছিলো শশীল। জমিদার বাড়ির পেছনে খানিকটা জঙ্গল ছিল তখন। তবে এখন তা পরিষ্কার করা হয়েছে।
রুপালির চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে আরেকটু ভেতরে নিয়ে গেল শশীল। চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। কেননা দেওয়ালের ওপারে শব্দ খুব কমই যায়। তাছাড়া গান বাজনা চলছে এতে আরো শুনতে পাবে না কেউ। তবুও রুপালি চিৎকার করছে। শশীল সম্পর্কে গ্রামের সবাই অবগত। ওর কর্মকান্ড সবাই জানে। রুপালির ভয়ে জ্ঞান হারানোর অবস্থা।
শশীল রুপালিকে মাটিতে ফেলে হাতটা পা দিয়ে চেপে ধরে। ব্যথায় গোঙ্গাতে লাগলো রুপালি। শশীল তার হাতের থাবা রুপালির শরীরে দেওয়ার আগেই সে স্থির হয়ে গেলো। রুপালি খেয়াল করল তরল জাতীয় কিছু শশীলের থেকে নির্গত হয়ে রুপালির গলায় পড়ছে। হাত ভেজালো রুপালি সে তরলে। চন্দ্রের একটুখানি আলো গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছে। রুপালি সেই আলোতে হাতটা এগিয়ে ধরতেই শিউরে ওঠে। ততক্ষণে শশীলের দেহ মাটিতে পড়ে গেছে। রুপালি স্থির দেহের দিকে তাকালো। একটু ও নড়ছে না। তারমানে মারা গেছে শশীল। রুপালি মুখ ঘুরিয়ে তাকালো এবং পরীকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। দা হাতে দাঁড়িয়ে পরী। চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে দা থেকে। শশীলের চোখদুটো এখনো খোলা। পরী দায়ের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে বলে,’রুপালির দিকে নজর দিয়েছিস কিন্ত এই পরীর দিকে তোর মৃত চোখ দুটোও নজর দিতে পারবে না।’
ওড়নার বাঁধন খুলে পরী নিজের মুখটা বের করে। এই মুহূর্তে ভয় পেলো না পরী। নিজের করা প্রথম হত্যা তবুও পরী ভয় পেলো না। দ্রুত রুপালিকে ধরে ওঠায়। রুপালি তখনও কাঁপছে। পরী জিজ্ঞেস করে,’তুমি ঠিক আছো আপা??’

-‘পরী তুই খুন করলি!!’
-‘মরে গেছে!!সত্যি সত্যি!’
একটু অবাক হলো পরী। কারণ সে বাজে ভাবে জখম করতে চেয়েছিল। কিন্ত পরীর ধারণার চাইতে কোপ টা একটু জোরে হয়ে গেছে। রুপালি পরীর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,’কি করলি পরী!!এখন কি হবে?’

-‘তো কি করবো?নাহলে ওই শয়তান টা তোমার সর্বনাশ করতো যে।’
রুপালির ভয় আরো বাড়লো। সে বলল,’সবাই জানলে কি হবে পরী? তোকে পুলিশ ধরবে যে। এটা তুই কি করলি পরী?’
রুপালি কাঁদতে লাগল। শশীলের শরীর দেখে ভয় পেতেও লাগল। এতো জোরেই আঘাত করেছে পরী যে মাথার অর্ধেক কেটে গেছে। রাতের বেলা ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না। দিন হলে রুপালি নির্ঘাত জ্ঞান হারাতো। পরী রুপালির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আর বলতে লাগল,’এতো বোকা তুমি কি করে হও? ওই কাগজের লেখাটা সিরাজ ভাই লেখেনি। হাতের লেখা বোঝনি তুমি? আর সিরাজ ভাই এমন লোক না যে তোমাকে ওই জঙ্গলের মধ্যে ডাকবে।’

রুপালি দাঁড়াল, সত্যি তো। সিরাজ তো কখনোই এখানে আসতে বলতো না। হারিকেনের আলোয় হাতের লেখা ঠিক খেয়াল করেনি রুপালি। তাহলে কি শশীল নিজেই চিঠি পাঠিয়েছিল! রুপালি আবার চমকালো বলল,’পরী,শশীল কিভাবে জানলো আমার আর সিরাজের সম্পর্কের কথা? আমি তো সব লুকিয়ে গেছি।’
-‘এখন কথা বলার সময় নয়। আগে ঘরে যাই তারপর সব কথা হবে।’

মেহমান থাকার কারণে ওরা গাছ বেয়ে ছাদে উঠলো। তার পর দুজনেই পরীর ঘরে গেল। আলোতে নিজের শরীরে রক্ত দেখে গা গুলিয়ে এলো রুপালির। পরীর শরীরেও কিছু রক্ত লেগেছে। দুজনে গোসল সেরে জামা কাপড় ধুয়ে দিলো।
কিন্ত আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো পরের দিন সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। শশীল যে মারা গেছে তা গ্রামের কেউ জানতে পারলো না। শশীলের লাশ কেউ কি দেখেনি? লাশটা তো ওখানেই ফেলে এসেছে ওরা। তাহলে!!!শশীলের পরিবার ও তার খোঁজ করেনি। কারণ কদিন আগে সে একটা মেয়েকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। সেজন্য পুলিশ তাকে খুঁজছে। শশীলের বাবা ওকে ভারত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলেও শশীল গ্রামেই পলায়িত ছিল। শশীলের নজর রুপালির দিকে তখনো অটুট। তাই ভারতে যাওয়ার আগে রুপালির উপর শেষ থাবা দিতে চেয়েছিল কিন্ত ও নিজেই শেষ হয়ে গিয়েছে। সম্রাট ভেবেছে হয়তো তার ছেলে ভারতে চলে গেছে।

পরী কিছুতেই বুঝতে পারছে না শশীলের লাশ কোথায়? সেজন্য ওই জঙ্গলে পরী যেতে চাইলে রুপালি আটকে দেয়। বলে,’তুই যাবি না পরী। ভালোই হয়েছে কেউ জানেনা। পুলিশ জানাজানি হলে তোকে ধরে নিয়ে যাবে। একটু চুপ থাক পরী। তুই একজন গ্রামের মেয়ে সেভাবেই পড়ে থাক। এতো গোয়েন্দা গিরি করবি না। দেখ আম্মা কিন্ত তার বড় মেয়েকে হারিয়েছে। এখন আমাদের হারালেন আম্মার কি অবস্থা হবে ভেবেছিস কখনো? এতো সাহসী হওয়া ভালো না পরী।’
বোনের কথায় মনক্ষুণ্য হলো পরীর। মালাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। মালাকে সে আর কষ্ট দিতে চায়না। তাই কিছু ঘেটে দেখতে পারলো না সে। ওই ঘটনা চাপা পড়ে গেল পরী রুপালির মাঝে। আরও কেউ আছে যে লাশ সরিয়েছে। সে কে তাও চাপা পড়ে গেল। পরী এরপর থেকে নিজেকে বদলে ফেললো। একজন গ্রামের মেয়ে তৈরি করলো নিজের মধ্যে।

আজ পরী নিজের পুরোনো সত্ত্বায় ফিরে এসেছে। সেদিন খুন ইচ্ছা করে করেনি পরী। চেয়েছিল সামান্য আঘাত করতে কিন্ত সেটা খুন হয়ে গেল। আজ পরীর সত্যিই খুন করতে ইচ্ছা করছে। বিন্দুকে যারা মেরেছে তাদের আরও নির্মম ভাবে খুন করতে চাইছে পরী।
সিরাজের কথা বাদ দিয়ে পরী শশীল কে খুন করার কাহিনী সবই বলে দিলো। আফতাব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। আর মালা মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগল। এ কেমন মেয়ে জন্ম দিয়েছেন তারা যে মানুষ মারতেও দ্বিধা বোধ করে না। আর পাঁচকান হলে তো বিপদ। রুপালি নিজ কক্ষের দরজায় বসে সব শুনেছে। সেও কাঁদছে। পরীকে বারণ করা সত্ত্বেও সে বলে দিয়েছে। শুধু কুসুম ই ছিল সেখানে উপস্থিত। পরী খুন করেছে শুনে সেও ঘাবড়ে গেছে। এতো সুন্দর কোমল মেয়েটা যে মানুষ খুন করতে পারে তা জানা ছিল না কুসুমের। সে ভয়ে চুপ করে আছে।
আফতাব বলে উঠল,’এই কথা যেন আর কেউ না জানতে পারে। আর পরী তোমার এখন থেকে ঘর থেকে বের হওয়াও বন্ধ। তোমার সবকিছুই ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মালা নিজের মেয়েকে তুমি সামলাও নাহলে খারাপ হয়ে যাবে কিন্ত।’

পরী চেঁচিয়ে উঠলো,’নাহ আমি ঘরে থাকবো না। আমার বিন্দুকে কে মেরেছে তা আমাকে জানতে হবে।’
-‘জেনে কি করবে তুমি? আবার খুন করবে? তারপর কি হবে জানো? বাইরের জগত ঘরে বসে দেখা যায় না। আমার সম্মান নষ্ট করবে না। মালা মেয়েকে কাছে রাখতে চাইলে আটকে রাখো।’

আফতাব অন্দর থেকে বেরিয়ে গেল। পরী আরো চেঁচিয়ে বলতে লাগল সে ঘরবন্দি হবে না। বিন্দুর খুনিকে সে নিজে খুজবে। মালা পরীর হাত ধরে দোতলার ঘরে নিয়ে যেতে লাগল। পরী বলল,’আম্মা হাত ছাড়েন আমার। আমার বিন্দুকে ওরা মেরে ফেলছে আমি ওদের শাস্তি দেবো।’

-‘তার লাইগা পুলিশ আছে। তারা খুজবো। তুই ঘরেই থাকবি।’
পরীকে আর বলতে না দিয়ে ওকে ঘরে আটকে রাখেন মালা। পরী মেঝেতে বসেই কাঁদতে লাগল। সাথে বিন্দুর সাথে কাটানোর মুহূর্ত মনে করলো। কতই না আনন্দের ছিল সময়টা আর আজ! সেই বিন্দুটাই নেই। এই ক্ষতটা পরীর সারাজীবন থাকবে।

এরই মধ্যে পরীর জন্য অনেক গুলো সম্বন্ধ এসে পড়েছে। কোথায় শোক কোথায় কি? পরীর বিয়ের আলোচনা চলছে এখন। আফতাব এখন নিজেও চায় এই মেয়ে বিদায় হোক। এই মেয়ে ঘরে থাকলে ওনাকে নির্ঘাত থানা পুলিশ দৌড়াতে হবে। সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। এর চেয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই হবে উত্তম কাজ।
এসব ঘটনা দেখে নাঈম নিজেই চমকে গেছে। একটু আগে কত কিছু ঘটে গেল। ঘরের বাইরে শোক পালন করে এসে ঘরের ভেতরে বিয়ের আলাপ করছে। সত্যিই এই জমিদার বাড়ি আর লোকজন অদ্ভুত। তবে গ্রামের মানুষ এরকমই হয়ে থাকে।
নাঈমের সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে পরীকে দেখতে না পারার কারণে। রাতে সে যা ভেবেছিল তার উল্টো হয়েছে। রুপালির প্রসব বেদনার কারণেই নাঈম ভেতরে ঢুকতে পারেনি। তখন অনেক মানুষ ছিল। নাঈম ধরা পড়ে যেতো। তবুও হাল সে ছাড়েনি। জেগেছিলো সারারাত যদি একটু সুযোগ সে পায়। তাও পায়নি নাঈম। তাই গাঢ় ঘুমে বিভর ছিল সকালে। যখন ঘুম ভাঙলো সব শুনে দৌড়ে গেল। কিন্ত ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। পরীকে সে দেখতে পারলো না।

নিজের ঘরে নাঈম মনমরা হয়ে বসে আছে। নিজের প্রতি নিজেই সে বিরক্ত। তখনই আসিফ এসে ঘরে ঢুকলো। নাঈম কে উদ্দেশ্য করে বলল,’নাঈম তুইও কি পরীকে দেখেছিস আজকে??’
নাঈম নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। আসিফের কন্ঠস্বর শুনে চমকে তাকালো বলল,’নাহ,কেন বলতো?তোরা কি দেখেছিস?’
আসিফ ভীত কন্ঠে বলল,’আমি দেখিনি তবে শেখর দেখেছে।’
নাঈম চট করে দাঁড়িয়ে গেল বলল,’তুই আর শেখর তো একসাথে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলি।’
-‘হ্যা গিয়েছিলাম। কিন্ত শেষ প্রহরে শেখর শায়েরের সাথে চলে এসেছিল আমি আসিনি। যাত্রা দেখতে দেখতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

নাঈম কিছু বলল না। আসিফ একটু চুপ থেকে বলে উঠল,’পরীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাঈম।

-‘জানি,সেতো আরো আগে ঠিক হয়েছে।’
-‘নাহ নাঈম এই মাত্র ঠিক হলো। জানতে চাইবি না কার সাথে পরীর বিয়ে?’
-‘কার সাথে?’
-‘শেখরের সাথে। সব ঠিকঠাক করে ফেলেছে শেখর। সামনের মাসে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।’
নাঈমের মনে হলো কেউ তাকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলো। ক্ষত না হলেও ব্যথা অনুভব করছে নাঈম। সব জেনে শেখর এটা কিভাবে করতে পারলো? নাঈম ঘর থেকে বের হতে নিলে আসিফ বলে,’গিয়ে লাভ নেই। শেখর শহরে চলে গিয়েছে। সে আমাদের সাথে আর সম্পর্ক রাখবে না।’

নাঈম এবার বেশ রেগে গেল। সে বাইরে বের হতে হতে বলল,’ওর সাথে শেষ কথা তো আমাকে বলতেই হবে।’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.