পরিজান

কোলাহল পূর্ণ শহরের রাস্তায় যানবাহনের আনাগোনা। গাড়ির হর্ণে কান তব্দা দেয়। ফুটপাত জুড়ে রয়েছে ছোটখাট দোকান। মানুষের ভিড়ে চলাফেরা করা মুশকিল। গ্রামে শীতকাল চললেও শহরে শীতের ছিটেফোটাও নেই। এ যেন চৈত্র মাস। লোকজনের মাঝে শীত নিজেই ঢুকতে পারছে না। কথাটা বেশ হাস্যকর মনে হলেও এটাই বাস্তব।
নাঈম রিকশায় বসে আছে। জ্যামে আটকে গেছে সে। আটকেছে গিয়ে একেবারে সূর্যের নিচে। গাছের ছায়া ও নেই সেখানে। তপ্ত গরমে ঘেমে একাকার সে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। লাল বর্ণ ধারণ করেছে ফর্সা মুখখানা। পকেট থেকে রুমালটা বের করে ঘাম মুছে নিলো সে। জ্যাম ছাড়তেই রিকশা চলতে লাগল। শেখরের বাসার সামনে নামলো নাঈম। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেল সে। চারতলা বিল্ডিং এর দোতলায় থাকে শেখর। কলিং বেল চাপতেই শেখরের ছোট বোন এসে দরজা খোলে। নাঈম কে দেখে সে খুব খুশির হলো। ভাইয়ের বন্ধু হিসেবেই অত্যন্ত ভালো জানে সে নাঈম কে। নাঈম সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তারপর সোজা শেখরের ঘরে চলে গেল। শেখর কে কিছু বলতে না দিয়েই বলল,’কি রে আমাকে না জানিয়ে চলে এলি?আমাকে বললে আমিও তো আসতাম।’

শেখর সোজা হয়ে দাঁড়াল বলল,’কাজ ছিলো।’
-‘কাজ তো থাকবেই বিয়ে বলে কথা। আমাকে একবার জানালি না। আর তুই নাকি আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখবি না।’
-‘আরে আসিফ আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলো তাই ওসব বলেছি।’
-‘আসিফ তোর মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল না। সত্যি কথা বলতেছিল। এমনটা করার কারণ কি শেখর? তুই সব জেনেও এমন সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলি?’

-‘শোন,তুই কিন্ত পরীকে দেখিসনি। আমি দেখেছি। আমি বললে ভুল হবে আরো অনেকেই দেখেছে।’

-‘এক দেখাতে মোহ সৃষ্টি হয় শেখর। তুই তোর পরীকে ভালোবাসিস না। আর জানিসই তো আমি পরীকে,,’

নাঈম কে থামিয়ে শেখর বলল,’তুই তোর দেখিসনি তাহলে তুই কিভাবে ভালোবাসিস বল? আমি দেখে ভালোবাসতে না পারলে তুইও পারিসনি নাঈম। হ্যা মানছি আমি পরীর সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছি তাহলে তো তুইও হয়েছিস। দেখিসনি পরীকে কিন্ত মুখের কথা শুনেই তোর এই অবস্থা আর আমার দেখে কি অবস্থা হয়েছে ভাবতে পারছিস?’

ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নিলো নাঈম। ছিঃ!!এতোটা জঘন্য মনের মানুষ শেখর তা আজ জানলো নাঈম। শেখরের দৃষ্টিভঙ্গি এতোটা কুৎসিত!!ওর মতো ছেলে পরীকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
-‘তোর দৃষ্টি যে এতো নোংরা তা আমার জানা ছিল না
শেখর। ওই মেয়েটার দিকে ভালোবেসে তাকানোর বদলে ললুপ দৃষ্টি দিচ্ছিস?’
-‘আমি খারাপ নজরে দেখিনি পরীকে। তুই যদি তখন একবার পরীর স্নিগ্ধ মুখশ্রি দেখতে তাহলে তুইও এক দেখায় আবার নতুন করে মেয়েটির প্রেমে পড়তি। বিশ্বাস কর আমি খারাপ চোখে দেখিনি। আমি কেন কোন পুরুষ ই বিকৃত নজরে দেখার কথা ভাবতেও পারবে না। মোহে আটকে গেলেও একদিন ঠিকই ভালোবেসে আগলে রাখব।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নাঈম বলে,’আমি মানতে পারছি না শেখর। বন্ধু হয়ে এইভাবে বেঈমানি করে ঠিক করলি না।’
-‘নিজের পছন্দ কে পাওয়াটা বেঈমানি নয়।’
নাঈম আর কথা বলল না। চলে যেতে উদ্যত হয়েও ফিরে তাকালো। শেখর কে উদ্দেশ্য করে বলল,’যদি কোনদিন শুনি পরী তোর কাছে ভালো নেই সেদিন তোকে খুন করতেও আমি পিছপা হবো না।’

——-

শশ্মানে কাঠ পোড়ার ধোঁয়া উঠছে এখনো। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে বিন্দুর চিতায়। দূরে মাটিতে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্পান। নাহ আজ তার চোখে এক ফোটা জল নেই। সব শুকিয়ে গেছে। বিন্দুর কথাগুলো মনে পড়ছে খুব। বিন্দু তো বলেছিল সে সম্পান কে ভুলবে না। তাহলে আজ কেন ওকে ভুলে রেখে গেল? সম্পান কেও তো সাথে নিয়ে যেতে পারতো? হঠাৎই সম্পান শুনলো বিন্দু আগুনের ভেতর থেকেই যেন বলছে,’তোমার নামের সিঁদুর ছাড়া অন্য নামের সিঁদুর আমার মাথায় পড়ার আগেই যেন আমার মরণ হয়। আমি তোমার বউ হমু মাঝি।’
সম্পান তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল। ‘বিন্দু’ বলে দৌড়ে এগিয়ে গেলো আগুনের দিকে। কিন্ত তার আগেই কয়েকজন লোকেরা টেনে ধরে সম্পান কে। চেতনা হারিয়ে সম্পান ঝাপ দিতেও পারে ওই আগুনে। সম্পান চিৎকার করে বলতে লাগল,’আমি তোরে সিঁদুর পরাইছি বিন্দু। তাও আমারে রাইখা যাইস না। তোরে ছাড়া আমি ভালো থাকমু না বিন্দু।’

মহেশ সম্পানের পাগলামো দেখতেছে আর চোখের পানি ফেলছে। এখন মহেশের মনে হচ্ছে সম্পানের সাথেই বিন্দু ভালো থাকতো। ছেলেটা সত্যিই বড্ড বেশি ভালোবাসে তার মেয়েকে। কিন্ত এখন এসব বলে কি লাভ?? সেই বিন্দুটাই তো নেই। মহেশের এখন মনে হচ্ছে এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র দায়ী চন্দনা। চন্দনা যদি রাজি হতো সম্পানের সাথে বিন্দুকে বিয়ে দিতে তাহলে এসব হতো না। আদরের মেয়ে বিন্দুর এমন পরিণতি হতো না।
বিন্দুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হতেই সবাই চলে গেল। সম্পান হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে কিছুটা ছাই হাতে নিলো। পানি দিয়ে আগুনের আভা কমানো হলেও এখনও ছাই বেশ গরম। তবে প্রেমিক পুরুষ সম্পানের হাত তা সয়ে নিলো। ছাই নিয়ে সে ছুটলো। গন্তব্য কোথায় তা সে নিজেও জানে না।

——

জমিদার বাড়িতে আজ যেনো ছোটখাটো অনুষ্ঠান। অন্দরের উঠোনের খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বসে আছে তিনজন মধ্যেবয়স্ক নারী। তারা তাদের ব্যাগ থেকে নানা ধরনের শাড়ি বের করছে। আবেরজান আর শেফালি একটা একটা করে পরীর গায়ে ধরে দেখছে। কোনটাতে পরীকে বেশি মানাচ্ছে। সবগুলো রঙেই পরীকে সুন্দর লাগছে। পরী নির্জীব হয়ে বসে আছে। রঙহীন হয়ে আছে মুখখানা। বিন্দু চলে গেছে আজ সাতদিন পার হয়ে গেছে অথচ কোন খবর পরী পায়নি। কে মারলো বিন্দুকে তাও জানেনি কেউ। পরী রোজ কুসুম কে দিয়ে খবর নেয়। সেদিনের পর থেকেই পরী ঘরবন্দি। আজকেই তাকে বাইরে আনা হয়েছে। আর আজকেই পরী জানতে পারলো যে শেখরের সাথে তার সামনের মাসে বিয়ে। অন্য কোন সময় হলে পরী হয়তো কিছু বলতো কিন্ত আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। প্রাণহীন মনে হচ্ছে নিজেকে। পরীকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে আবেরজান বলল,’এই,এমনে চুপ থাকলে হইবো?চোখ ঘুরাইয়া দেখ কোনডা পছন্দ হয়?’
বিরক্ত হলো পরী বলল,’তুমিই দেখো দাদি।’

-‘কাপড় পইরা তো আমি জামাইর কাছে খারামু না তুই?দেখ।’
পরী এবার বেশ চটে গেল। মোড়া থেকে দাঁড়িয়ে বলল,’তুমিই দেখো বুড়ি। একটা কাপড় পরে দাঁড়াও আমি তোমাকে আকাশে ছুড়ে মারি। নিজের জামাইকে তখন দেখাইও।’
-‘তোর আর কইতে হইবো না। তোর মতো বয়সে কতো দেখাইছি।’
-‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে আমাকে এর মধ্যে টানবে না বুড়ি।’

পরী নিজের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রুপালি কুসুম কে দিয়ে কয়েকটা শাড়ি পাঠালো পরীর ঘরে। পরী তখন পড়ার টেবিলে বসে সোনালীর খাতাটা নেড়ে দেখছিল। কুসুম আস্তে করে পরীর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,’আমার অনেক কষ্ট হইতাছে বিন্দুর লাইগা আপা। আপনেও কষ্ট পাইতাছেন জানি। কিন্ত এখন আপনার বিয়া না দিলেও পারতো। আপনার মনডা তো ভালা নাই। আপনে চইলা গেলে আমি আর জুম্মান থাকমু কেমনে আপা?’
পরী কুসুমের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ জোড়া জলে ভরা। তবুও পরী ঠোঁটে হাসির রেশ ধরে বলে,’আমার রুপা আপা আর তার ছেলেকে দেখে রাখিস কুসুম। ওদের দায়িত্ব আমি তোকে দিয়ে গেলাম। যেকোন বিপদে তুই ওদের পাশে থাকবি।’

-‘কথা দিলাম আপনেরে আমি হ্যাগো পাশে থাকমু।’

পরী হাসলো। কুসুম ওকে অনেক বিশ্বাস করে। পরী জানে কুসুম তার কথার খেলাপ করবে না। এতে ওর প্রাণ সংকটে হলেও না।

আজ রাতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল শায়েরের। সামনের মাসে পরীর বিয়ে। জমিদার বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা। এখন থেকেই টুকটাক কাজ সারতে হবে। সেজন্য শায়ের শহরে গিয়েছিল। আসতে আসতে তাই অনেক রাত হয়ে গেছে। বৈঠকে গিয়ে আগে কলপাড় থেকে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। তারপর নিজের ঘরে গেল। হারিকেনের আচ কমানো ছিল। সেটা বাড়িয়ে দিয়ে পেছন ফিরতেই দুকদম পিছিয়ে গেল শায়ের। সামনের জলচৌকিতে কেউ বসে আছে। সেটা যে পরী তা শায়েরের বুঝতে বেগ পেতে হলো না। নেকাবের আড়ালে থেকেই পরী বলল,’ভয় পেলেন নাকি?’
-‘এতো রাতে আপনি আমার ঘরে কেন এসেছেন?’

পরী শান্ত গলায় জবাব দিলো,’বিন্দুকে কারা মেরেছে?’
-‘আমি এখনো জানতে পারিনি। তবে পুলিশ তদন্ত,,,’

বাকিটুকু শায়ের বলতে পারলো না। পরী মৃদু চিৎকার করে বলে,’কথা ঘোরাবেন না। আমি জানি আপনি সব জানেন।’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.