তুর্য ব্যথায় কুঁকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“দুইটা হাতি আমার ওপর পড়ে একদম আরাম করে শুয়ে আছে।“
এরপরই ঝাড়ি দিয়ে বলে,
“উঠো তাড়াতাড়ি!”
পরী আর দিশান ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। ওরা দুজনও বেশখানিকটা ব্যথা পেয়েছে। তবে তুর্যর ব্যথার তুলনায় সেগুলো কিছুই না। তুর্য হাত ধরে ব্যথায় আহ্ শব্দ করে ওঠে দাঁড়ায়। পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এত গায়ে পড়া স্বভাব কেন তোমার?”
পরী দাঁতমুখ খিঁচে বলে,
“আমার গায়ে পড়ার কোনো স্বভাব নেই ওকে?”
“তো একটু আগে কোথায় পড়লে? আমার মাথায়?”
“না, আপনার গলায়। গলা তো নয় যে জিরাফের গলা।“
“আর তুমি? তুমি কী? তুমি যে ছোটখাট একটা হাতির বাচ্চা।“
“কী? আমি হাতির বাচ্চা? আপনি জানেন, আমি খাই না বলে মা আমায় কত বকে?”
“তা খাবে কেন? কারণ তুমি তো খুব ভালো করেই জানো তুমি একটা হাতি। ছোট হাতি।“
পরী মুখটা একটু তুর্যর মুখের দিকে এগিয়ে নিয়ে বলে,
“একদম হাতি বলবেন না বলে দিচ্ছি।“
“একশো বার বলব। কী করবে শুনি?”
“আপনার মতো অসুরের সাথে কিছু করার জো আছে নাকি যে করব!”
“আমি অসুর?”
“আপনি শুধু অসুরই নন। আপনি একটা বেক্কলও।“
“আমি বেক্কল?”
“হ্যাঁ, আপনি বেক্কল। বেক্কল না হলে কি পড়ে যাওয়ার সময় সাপোর্ট হিসেবে ঐটুকু একটা ছেলের হাত ধরেন?”
“আর তুমি খুব জ্ঞানী তাই না? তুমি কেন দিশানের সাথে আমার ওপর পড়লে?”
“তো আমি কী করতাম? দিশান আমার স্কার্ট টেনে ধরেছিল।“
“তো? স্কার্ট না হয় খুলেই যেত এজন্য কী আমার ওপর পড়তে হবে?”
পরী তুর্যর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“ইউ…”
পুরো কথা সম্পূর্ণ করার আগেই পরীর মা রুমে প্রবেশ করেন। আবারও সবকিছু চুপচাপ হয়ে যায়। দিশান এতক্ষণ নিরব দর্শক হয়ে দুজনের ঝগড়া দেখছিল। পরীর মা রেহেনা বেগম একবার তুর্যর দিকে, একবার পরীর দিকে আবার আরেকবার দিশানের দিকে তাকান।
তিনি ভাবান্তর হয়ে বলেন,
“কী হচ্ছেটা কী বলতো? আমি আসলেই চারপাশ এমন চুপচাপ হয়ে যায় কেন? তার আগে তো মনে হয় ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো কিছু চলছিল।“
পরী হেসে বলে,
“ধুর মা। তুমিও যে কী বলো না। আসলে কী বলো তো? তুমি তো মা। আর মা মানেই হলো শান্তি। তাই তোমার আগমনে চারপাশ শান্তিতে চুপচাপ হয়ে যায়।“
পরী একবার তুর্যর দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“ঠিক বলেছি না বলুন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ সব ঠিক। আমার মা-ও যখন আসে তখন মনে হয় আমি কানে কিছু শুনিই না। আমি যেন শান্তশিষ্ট জগতে ঢুকে যাই।“
রেহেনা বেগম একটু সলজ্জিত হয়ে বলেন,
“ঠিকাছে, ঠিকাছে। আমি চা নিয়ে আসছি।“
তিনি চলে যাওয়ার পরই পরী ধমক দিয়ে বলে,
“ঢং করার আর জায়গা পান না তাই না? আপনার মা আসলে আপনি আর কানেই শোনেন না? আগ বাড়িয়ে কথা বলার আর জায়গা পান না! নেহাৎ আমার মা একজন সাধাসিধে মানুষ। তাই আপনার এসব ভক্করচক্কর ধরতে পারেনি।“
“হ্যাঁ, সেটাই। উনি যদি চালাকচতুর হতেন তাহলে উঠতে বসতে তোমাকে উত্তম মধ্যম দিত।আর সেটাই ভালো হতো বুঝেছ?
আর এখন সামনে থেকে সরো। যেটা করতে এসেছি সেটা করতে দাও। আমাকে যেতে হবে।“
“যান, যান। আমি মনে হয় আপনাকে জামাই আদর খাওয়ার জন্য থাকতে বলেছি?”
“তোমার আর কোনো বোন আছে?”
পরী হাত ঘাড়ে রেখে ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে বলে,
“না। কেন?”
“তাহলে তোমার স্বামী হয়ে জামাই আদর খাওয়ার থেকে কচু গাছের সাথে গলায় দড়ি দেওয়াও ভালো।“
পরী হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে,
“যান, যান। আপনার মতো ঝগড়ুটে ছেলের পাত্তা এই পরীর কাছে নেই বুঝেছেন।“
হাতে নাস্তাসমেত ট্রে নিয়ে রেহেনা বেগম রুমে প্রবেশ করায় ঝগড়া আর বেশিদূর এগোলো না। পরী আর সেখানে না থেকে নিজের রুমে চলে যায়। তুর্য ফ্যান ঠিক করে দিয়ে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও চায়ের কাপে চুমুক দেয়। রেহেনা বেগম তুর্যর কাজ করার আন্তরিকতায় খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন,
“তুমি অনেক ভালো একটা ছেলে। অবশ্য তোমাকে দেখেই বোঝা যায় খুব ভদ্র তুমি। তা তুমি কী করো বাবা?”
“জি, আমি জব করি আন্টি।“
“ভালো, ভালো। খুব ভালো। তোমরা কয় ভাই-বোন?”
“আমরা এক ভাই, এক বোন। আমার বোন ছোট। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।“
“আমার মেয়েও তো ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। তাহলে দিশান তোমার কী হয়?”
“আমার খালাতো ভাই। ছোট খালা মারা যাওয়ার পর খালু আবার বিয়ে করেন। তখন থেকে দিশান আমাদের সাথেই থাকে।“
“আচ্ছা। বুঝেছি।“
চায়ের কাপটা রেখে তুর্য হেসে বলে,
“আজ তাহলে উঠি আন্টি।“
“আবার এসো বাবা।“
“আচ্ছা আসব। চল দিশান।“
তুর্য যাওয়ার সময় মনে মনে বলে,
“আপনার যেই দজ্জাল মেয়ে! এটা জানার পরও স্বেচ্ছায় এখানে আসা মানে কিং কোবরা সাপের সামনে দাঁড়িয়ে বলা, ‘আয়, আয় আমার কামড় দেয়।‘ কী সাংঘাতিক মেয়েরা বাবা!”
বিকেলবেলায় পরী আর ওর বান্ধবী মেহেনুবা প্রাইভেট থেকে ফিরছিল। গল্পগুজবের এক পর্যায়ে মেহেনুবা মন খারাপ করে বলে,
“বুঝলি পরী, প্রেম ভালোবাসা মানেই একটা প্যারা।“
পরী খোলা চুলে আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলে,
“এই কথা বলছিস কেন?”
“আমার বয়ফ্রেন্ডের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। আগে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন দিত। জান খেয়েছ, জান কী করো ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এখন নাকি তার ফোন দেওয়ারই সময় নেই।“
“এজন্যই তো বলি এসব প্রেম, ভালোবাসায় জড়ানোর দরকার নেই। তখন তো কথা শুনিস না।“
“তুই তো এখন বলবিই। এখনো তো কাউকে ভালোবাসিস না তাই ভালো লাগার অনুভূতিটাও বুঝিস না।“
“ভালোলাগা আর ভালোবাসা কি এক জিনিস?”
“না। তবে ভালোলাগা থেকেই তো ভালোবাসার সৃষ্টি।“
“কী জানি বাবা! প্রেম বিশেষজ্ঞ নই তো তাই জানিও না।“
“আচ্ছা বাদ দে এসব। কাল কলেজে আসবি তো?”
“সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাশ তো এখনো শুরু হয়নি।“
“হ্যাঁ, জানি। কাল ফার্স্ট ইয়ারদের নবীণবরণ অনুষ্ঠানের আয়েজন করা হয়েছে। আমাদের পাশের যে কলেজটা আছে না? ঐ কলেজ আর আমাদের কলেজ মিলে অনুষ্ঠানটা করবে। খুব বড় করে আয়োজন করা হয়েছে।“
“তাহলে তো যেতেই হয়। সকালে বাসায় আসিস।“
“পারব না রে। কাল আমার বয়ফ্রেন্ড সাগর আমায় নিয়ে যাবে।“
“হু, যা। তোদেরই তো সময়।“
“তুইও একটা প্রেম করে নে।“
“পাগল? তোদের প্রেম-পিরিতির কথা শুনেই প্রেমের ভূত আমার মাথা থেকে নেমে গেছে। এমনিতেই ভালো আছি। কোনো প্যারা নেই, চিন্তা নেই।“
“এই পরী।“
“কী?”
মেহেনুবা সামনের রাস্তার দিকে হাত তাক করে বলে,
“ওখানে এত মানুষ জড়ো হয়ে আছে কেন?”
“জানি না তো। চল গিয়ে দেখি।“
পরী আর মেহেনুবা সেদিকেই এগিয়ে যায়। কিছুটা কাছে যেতেই দেখতে পায় দুজন লোকের বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে। একজন বাবার বয়সী লোক আরেকজন কম বয়সী একটা ছেলে। এক পর্যায়ে ছেলেটা বাবার বয়সী লোকটার গালে থাপ্পড় দিয়ে বাইকে ওঠে কী বলে যেন শাসিয়ে চলে যায়। লোকটা রাস্তায় বসে কাঁদতে থাকে। এতগুলো মানুষের সামনে একটা ছেলের বয়সী তরুণ এভাবে থাপ্পড় মেরে গেল এটা তো কম অপমানজনক নয়। পরী আর মেহেনুবা যেতে যেতেই ছেলেটা চলে যায়। পরী লোকটার দিকে এগিয়ে যাওয়া ধরলে মেহেনুবা পরীর হাত ধরে বলে,
“যাস না পরী। কোন না কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যাবি আবার।“
“এটা তুই কী বলছিস মেহু? উনার জায়গায় যদি তোর বা আমার বাবা থাকত তাহলে কি আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতাম?”
পরীর এই কথায় মেহেনুবা আর আটকিয়ে রাখার সাহস পেল না। পরীর হাত ছেড়ে দিল।
পরী লোকটার কাছে এগিয়ে তাকে ধরে ওঠায়।
“আঙ্কেল প্লিজ এভাবে কাঁদবেন না। কী হয়েছিল বলেন তো?”
লোকটা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয়,
“আমার কোনো দোষ নাই মা।আমি ভ্যান নিয়া যাইতেছিলাম। তখন ঐ পোলায় বাইক নিয়া পিছন দিয়া আইছিল। ওর বাইকের সাথে আমার ভ্যান ধাক্কা লাগে। উল্টা আমারে গালাগালি করে। আমি প্রতিবাদ করায় আমারে সবার সামনে মারল।“
কথাগুলো বলে উনি বাম হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছেন। পরী বলে,
“বুঝতে পেরেছি আঙ্কেল। জোর যার, মুল্লুক তার। এতগুলো মানুষ এখানে অথচ কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না।“
পাশের চায়ের দোকান থেকে তখন একটা ছেলে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে এগিয়ে এসে বলে,
“আপনিও কোনো প্রতিবাদ করতে আইসেন না আপা। ঐ ব্যাটার মতো মনে হয় আপনিও এই এলাকায় নতুন। তাই আমগো বসরে চিনেন না। “
পরী চোখ রাঙিয়ে বলে,
“চিনি না। আর চিনতেও চাই না। এতক্ষণে পরিষ্কার বুঝতে পারছি কেন কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। করবে কীভাবে? টাকা দিয়ে যে আপনার বস আপনাদের মতো কতগুলো পোষা মানুষ পুষে। প্রতিবাদ করতে গেলে তো তখন জীবন নিয়ে টানাটানি।“
“আপনি মাইয়া মানুষ আপা। তাই সম্মান দিয়া কথা বলতাছি। প্রতিবাদ করতে আইসা নিজের ক্ষতি নিজে কইরেন না।“
“রাখেন আপনার ক্ষতি। আপনাদের হুমকি-ধামকিতে আমি ভয় পাই? আমার চাচ্চু পুলিশ অফিসার। একবার যদি বলি না তাহলে জেলের ঘানি টানতে হবে।“
পরীর কথায় ছেলেটা শব্দ করে হেসে বলে,
“আপা ঐসব পুলিশ আমার বস পকেটে রাখে। সবই টাকার গোলাম।“
“সব পুলিশকে আপনাদের মতো চামচা ভাববেন না।“
“আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করতেছেন।“
মেহেনুবা এগিয়ে এসে পরীর হাত ধরে বলে,
“এখান থেকে চল পরী।“
পরী মেহেনুবার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে লোকটাকে বলে,
“আঙ্কেল আপনি এখান থেকে চলে যান। মানুষ শুধু মজাই নিতে পারবে। কোনো প্রতিবাদ করতে পারবে না।“
লোকটা ভ্যান নিয়ে চলে যাওয়ার পর মানুষের ভিড়ও কমতে থাকে। কয়েকজন আবার কৌতুহলবশত পরীর প্রতিবাদ করা দেখছে। মেহেনুবা এবার পরীর হাত ধরে টানতে টানতে বলে,
“হয়েছে তো। এবার চল।“
ছেলেটা মেহেনুবাকে বলে,
“হ আপা লইয়া যান এই প্রতিবাদী আপারে। আর বুঝাইয়েন একটু, এমনে প্রতিবাদ করতে গিয়া যেন নিজের ক্ষতি নিজে না করে।“
পরী রাগে হাত উঁচু করে ডান হাতের তর্জনী তুলে বলে,
“আমি প্রতিবাদ করবই। আপনার বস কী করতে পারে তা আমি দেখে নেব।“
মেহেনুবাদের বাড়ি পরীর বাড়ির পাশেই। মেহেনুবা পরীকে নিয়ে আগে পরীর বাসায় যায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠতে ওঠতে বলে,
“তোকে বারবার বলি যে, কোনো ঝামেলায় জড়াবি না। তবুও ঝামেলায় জড়িয়ে গেলি। কেন তোর ওকে ওর বস নিয়ে হুমকি দিতে হবে?”
পরী রাগে চুপ করে আছে। মেহেনুবা আবারও বলে,
“আমরা মেয়ে পরী। আমাদের সম্মানের ভয় আছে। আল্লাহ্ না করুক, যদি ওরা তোর ক্ষতি করে বসে তখন? ওদের দ্বারা সব সম্ভব।“
“এজন্য ভয়ে চুপ করে থাকব?”
“নিজের ভালোটা দেখে তারপর পরের জন্য ভাববি। যেই প্রতিবাদে নিজের ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে সেই প্রতিবাদ কেন করতে হবে?”
“মেহু তুই মাঝে মাঝে স্বার্থপরের মতো কথা বলিস।“
“তোর ভালোর জন্যই বলছি।“
“দেখ মেহু, তোকে যদি কেউ ইফটিজিং করে আমার সামনে তখনও কিন্তু আমি চুপ থাকতে পারব না। প্রতিবাদ করব। এখন তোর এসব কথা রাখতে গেলে আমায় চুপচাপ তোকে ছেড়ে চলে যেতে হবে তখন।“
“সব কথায় যুক্তি দাঁড় করাবি না।“
“ভুল কিছু বলেছি?”
“দেখ আমরা ফ্রেন্ড। তোকে কেউ কিছু বললে যেমন আমি সহ্য করতে পারব না। ঠিক তেমনি এটাও জানি, আমায় কেউ কিছু বললে তুইও সহ্য করতে পারবি না। কিন্তু তাই বলে যাকে চিনিস না, জানিস না তার জন্য কেন প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি করবি?”
“না হোক আমার পরিচিত। সে তো একজন মানুষ। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াব না?”
“উফ! তোর সাথে কথায় আমি পারব না। তবে একটা কথা সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, কোনো ঝামেলায় জড়াবি না।“
“আচ্ছা বাদ দে। এসব মাকে বলিস না আবার। টেনশন করবে।“
“আচ্ছা। আমি তাহলে এখন বাড়ি চলে যাই?”
“এসেই তো পড়লি। রুমে চল।“
“কাল আসব। এখন যাই। টাটা।“
“শোন, শোন।“
মেহেনুবা আর কোনো কথা না শুনেই দৌঁড়ে চলে যায়। পরী সিঁড়ির রেলিং ধরে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
“এই চোর।“
পরী পিছনে ঘুরে দেখে তুর্য। ভ্রু বাঁকা করে বলে,
“কে চোর?”
“তুমি চোর। তখন তো ছাদে ফু্ল চুরি করেছিলে। এখন এখানে দাঁড়িয়ে কি রেলিং চুরি করার ধান্দা করছ?”
পরী ঝাঁঝালো গলায় বলে,
“যদি এই রেলিং আমি ছুটাতে পারতাম তাহলে সত্যি বলছি, এটা দিয়েই আপনার মাথাটা আমি ফাঁটিয়ে ফেলতাম।“
“তোমার সাহস তো মন্দ নয়।“
“মন্দ সাহস আমার কোনো কালেই ছিল না। একটা ফুল আমার জীবনটা তছনছ করে দিচ্ছে।“
পরী রাগ দেখিয়ে ওপরে চলে যায়। তুর্য সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর নিচে চলে যায়।
পরী নিজেদের ফ্ল্যাটে গিয়ে ব্যাগটা সোফার ওপর রেখে পাশের সোফায় শুয়ে পড়ে। রেহেনা বেগম পরীর কাছে এসে বলেন,
“তোর গরম লাগছে না?”
পরী মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“লাগছে। কেন?”
“তাহলে আমার রুমে আয়। তুর্য ফ্যান ঠিক করে দেওয়ার বাতাস তো তিনগুণ বেড়ে গেছে রে পরী। এখন তো রুম এসির মতো ঠান্ডা লাগে। আয়, চল।“
পরী শোয়া থেকে বসে বলে,
“একদিনেই একদম তার গুণগান শুরু করে দিয়েছ?”
“গুণ আছে বলেই তো বলছি। তুই ওকে হিংসে করছিস কেন?”
“ওমন বদ লোককে আমি হিংসা করি না। বাদ দাও। কাল কলেজে অনুষ্ঠান আছে। সকাল সকাল ডেকে দিও। আমি এখন একটু ঘুমাব।“
“এক ঘুমে কি সকালে উঠবি?”
“বোকার মতো কথা বলো কেন মা? এখন মাত্র পাঁচটা বাজে। এক ঘুমে কীভাবে সকালে উঠা যায়? যাচ্ছি আমি রুমে।“
পরী যাওয়ার পর রেহেনা বেগম বিড়বিড় করে বলেন,
“মেয়েটা হয়েছে একদম ওর বাপের মতো। কিছু বললেই ছ্যাত করে ওঠে।“
.
এরমধ্যে সন্ধ্যায় ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা খেয়ে মেহেনুবার সাথে বেশকিছুক্ষণ কথা বলে পরী। কখন যাবে, কী পোশাক পড়বে এসব। এরপর রাতের খাবার খেয়ে আবারও শুয়ে পড়ে। একবার ঘুমানোর ফলে রাতে আর ঘুম আসতে চাইছিল না। একবার এপাশ, আরেকবার ওপাশ করতে করতে অবশেষে ঘুম চোখে ধরা দেয়।
বাসস্টপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে পরী। সব বাসগুলোই প্রায় যাত্রীতে ভরপুর। একা একা দাঁড়িয়ে যেতেও আনইজি লাগে। এভাবে দাঁড়িয়ে আরো দেরি হয়ে যাচ্ছে। মেহেনুবা বারবার ফোন দিচ্ছে। তাই আর কোনো উপায় না পেয়ে যাত্রীভর্তি বাসেই ওঠে। ভাগ্য ভালো থাকায় একটা সীটও পেয়ে যায়। কিন্তু কে জানত সেই ঝগড়ুটে ছেলের পাশের সীটটাই ফাঁকা থাকবে? এটা ভালো ভাগ্য নাকি মন্দ ভাগ্য সেটা নিয়েই কনফিউশনে আছে পরী। তুর্য পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এভাবে সেজেগুজে পটের বিবি হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছো কেন?”
পরী চাপাস্বরে রেগে বলে,
“আমার টাকার জিনিস দিয়ে আমি সেজেছি। তাতে আপনার কী?”
“তা ঠিক। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে বোসো। তোমার তো আবার পোশাকের ঠিক নেই। কোথা থেকে কী দেখিয়ে বসবে আল্লাহ্ মালুম। আমাকে না হয় দেখিয়েছ তাই বলে কি পাবলিককেও দেখাবে?”
পরী ধিরিম করে তুর্যর পাশে বসে পড়ে। দাঁত কিড়মিড় করে শাসিয়ে শাসিয়ে বলে,
“মুখের ভেতর একদম স্কচটেপ লাগিয়ে দেবো ফাউল কথা বললে।“
“সত্যি কথাকে ফাউল কথা বানিয়ে দিলে?”
পরী উত্তর দেওয়ার আগেই দুজন হিজড়া হাত তালি দিতে দিতে বাসে ওঠে। হিজড়া দেখলে অজানা ভয়ে পরীর আত্মার পানি শুকিয়ে যায়। দুজনের মধ্যে একজন তুর্যর গাল টেনে দিয়ে বলে,
“এই হ্যান্ডসাম, সেক্সি টাকা বের করো।“
পরীর ভয় সব উবে গিয়ে এবার দম ফাঁটিয়ে হাসি শুরু করে।