দিশান আর তুর্যর হাসি দেখে রাগে পরীর শরীর রিরি করছে। এইদিকে কুকুরটার ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। আর কুকুরটাও! একদম ফাজিলের হাড্ডি। পরীর ওড়না মুখে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে ওদের ওপর রাগ অন্যদিকে কুকুরটার ভয় সব মিলিয়ে জমে গেছে পরী। মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। চোখ বন্ধ করে বার কয়েক দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয়। এরপর ওড়না রেখেই দেয় এক দৌড়। এক দৌঁড়ে ফ্ল্যাটে চলে যায়। দরজা লাগিয়ে দৌঁড় দিতে গিয়েই ধাক্কা খায় মায়ের সাথে। রেহেনা বেগমও খেয়াল না করায় ধাক্কা খেয়ে সোফায় বসে পড়ে। পরী জিহ্বা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। রেহেনা বেগম কোমরে হাত দিয়ে বলেন,
“কুত্তার বাচ্চা চোখে দেখস না?”
পরী ভয়ে ভয়ে বলে,
“তুমি সবসময় তোমায়সহ আমায় বকো কেন বলো তো? শুধু কুত্তা বলতে পারো না?”
“চুপ কর তুই। ধাক্কা দিলি ক্যান?”
“আমি কি ইচ্ছে করে দিছি নাকি!”
“তাহলে কি পাগলা কুত্তায় দৌঁড়ানি দিছে?”
“খবরদার মা কুত্তা বলো না। টাইগার বলবা টাইগার।“
“মাথা গেছে নাকি তোর? আমরা কি সুন্দরবনে থাকি?”
“দাঁড়াও বলছি।“, বলে পরী রান্নাঘরে যায়। ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি বের করে মুখ লাগিয়ে খেয়ে বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“মা গো মা আর বইল না। ঐ যে তুর্য আছে না? ওদের একটা কুত্তা আছে বুঝছ। কুত্তার নাম রাখছে টাইগার। আমি কুত্তা বলছি বলে ঐ কুত্তায় আমার ওড়না কামড় দিয়ে ধরছে। তাই তো আমি ওড়না রেখেই দৌঁড় দিছি দেখো।“
“ভারী সাংঘাতিক তো!”
“খুব।“
“আমার মেয়ের ওড়না রেখে দেয় তাও আবার কুত্তায়? চল তো তুই আমার সাথে।“
“কোথায়?”
“ঐ কুত্তার কাছে।“
“না মা। আমি নাই। আমি যাব না। অসম্ভব।“
“কী ডরপোক মাইয়া পেটে ধরছি গো আল্লাহ্! অবশ্য যে মুরগির বাচ্চা ধরতেই ভয় পায় তার কাছে কুকুর তো অনেক বেশিই ভয়ংকর।“
পরী কোমরে হাত রেখে বলে,
“তুমি কিন্তু আমায় অপমান করছ মা।“
“তোর আবার মান আছে নাকি যে অপমান করব?”
পরী নাকমুখ কুঁচকে চিৎকার করে বলে,
“মা!!”
“আহ্! চিল্লাবি না। কানে লাগে। তুর্য কোথায়?”
“ছাদে।“
“চল আমার সাথে।“
“না।“
“আমি আছি তো। চল। ঘর থেকে একটা ওড়না পরে আয়।“
পরী এক প্রকার বাধ্য হয়েই একটা ওড়না পরে মায়ের সাথে ছাদে যায়। তুর্য তখন টাইগারকে খাওয়াচ্ছিল। তুর্য রেহেনা বেগমকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছেন?”
ব্যাস! আম্মা গদগদ হয়ে গেছে আবার ওর কথা শুনে। হেসে বলেন,
“তোমার টাইগারকে দেখতে আসলাম।“
পরী অবাক না হয়ে আর পারে না। কানের কাছে মুখ নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা? ভাব তো নিয়ে আসছিলে সিংহের মতো। এখন বিড়ালের মতো হয়ে গেল কেন?”
রেহেনা বেগম পরীর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলেন,
“তুই চুপ করে থাক।“
“থাকলাম আমি চুপ। তুমি শুধু একবার ঘরে আসো।“
বলেই রাগে হনহন করে রুমে চলে যায়। রুমের মধ্যে পায়চারী করতে করতে বলে,
“ভাইয়া যে বলে ঠিকই বলে। নিশ্চয়ই এই মহিলা আমার সৎ মা। নয়তো আমায় সাপোর্ট না করে কি ঐ বজ্জাত ছেলেটার পক্ষে থাকে?”
একা একাই কথা বলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে পরী। বেশ কিছুক্ষণ পর রেহেনা বেগম রুমে আসেন। পরী একবার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মেয়ের রাগ যে কীভাবে ভাঙাতে হয় এটা তার ভালো করেই জানা আছে। তিনি সোজা রান্নাঘরে চলে যায়। মেয়ের জন্য গরম গরম আলুরচপ বানিয়ে সস দিয়ে পরীর রুমে নিয়ে যায়। পরীর মুখের সামনে ধরে বলে,
“এই নে ধর।“
পরী ফোন থেকে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কী?”
“আলুর চপ।“
“ঐ কুত্তা আর কুত্তার মালিকরে গিয়ে খাওয়াও।“
“তুইও তো কুত্তা।“
পরী অবাক হয়ে বলে,
“মানে কী?”
“মানে আমিও তো তোরে কুত্তা ডাকি তাই বললাম আর কী!”
পরী বিছানা থেকে সটান উঠে দাঁড়ায়। দু’হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে,
“অসম্ভব। তোমার মতো মায়ের সাথে এক বাসায় থাকা অসম্ভব।“
“আরে এটা তো আমার ডায়লগ। যখন তোর আব্বুর সাথে আমার ঝগড়া হয়, তখন আমিও বলি ‘তোমার সাথে সংসার করা অসম্ভব।‘ তুই দেখি আমার ডায়লগ মুখস্থ করে ফেলছিস।“
পরী কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। এনাকে কিছু বলাই বেকার। রাগে, দুঃখে মুখটা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। বিছানার ওপর থেকে ফোন নিয়ে বলে,
“আমি গেলাম মেহেনুবার বাসায়। খবরদার বলছি ঐ বাসায় পা রাখবে না। আব্বু আসলে আমায় ফোন দিতে বলবা।“
পরী আর কোনো কথা না শুনেই নিচে নামে। তখনই দেখা হয় তিথির সাথে। তিথি একগাল হেসে বলে,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“মেহুর বাসায়।“
“মেহু কে?”
“বেষ্টু। পাশের বাসাতেই থাকে।“
“ওহ ঠিকাছে। চলো আমাদের ফ্ল্যাটে যাই।“
পরী মনে মনে বলে,
“এই মেয়ে বলে কী? তোমার ভাইর জন্য মায়ের সাথে ঝগড়া করে আসলাম। আর এখন কীনা যাব তোমাদের বাসাতেই!”
কিন্তু মনে মনে বলে,
“না গো। খুব ইমার্জেন্সি দরকার।“
“আচ্ছা। আমিও না হয় সাথে যাবনি। চলো তো এখন।“
তিথি টেনেই পরীকে নিয়ে যায়। তিথির মা দরজা খুলে দিতেই তিথি বলে,
“ও পরী। নতুন ভাড়াটিয়া। আমাদের পাশের কলেজেই পড়ে।“
পরী সালাম দিয়ে বলে,
“ভালো আছেন আন্টি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?”
“জি আলহামদুলিল্লাহ্।“
“আসো ভেতরে আসো।“
পরী তিথির সাথে তিথির রুমে যায়। তুর্যর মা তাহমিনা বেগম নাস্তা বানিয়ে সবাইকে ড্রয়িংরুমে ডাকে। পরী আর তিথি আসার পর তিনি বলেন,
“তিথি, তুর্য আর দিশানকেও ডেকে আন। একসাথেই খেয়ে নে সবাই।“
“উফ মা! তুমি যাও ছাদে। আমি পরীর সাথে কথা বলি।“
“আচ্ছা যাচ্ছি।“
পরীর হার্টবিট বেড়ে যায়। তুর্য নাম শুনলেই আতঙ্ক লাগে। মুখোমুখি হলে আবারও কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া লাগবেই। তিথি নাস্তা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“খাওয়া শুরু করো।“
তিথির ফোন আসায় রিসিভ করে একটু দূরে চলে যায়।
পরী মনে মনে ভাবে,
“নাস্তা না খেলে ওরা খারাপ ভাববে। আবার ঐ আপদের সামনে পড়লেই ঝগড়া হবে। তারচেয়ে ভালো আপদ আসার আগেই নাস্তা খেয়ে ফেলি।“
পরী বড় চায়ের মগটা নিয়ে চা খাওয়া শুরু করে। অর্ধেক শেষ হতেই বাহির থেকে দিশানের গলা শোনা যাচ্ছে। চায়ের মগটা রেখেই পরী দৌঁড়ে তিথির রুমে চলে যায়। নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছে এখন। তিথির ফোনে কথা বলা শেষ হলে ড্রয়িংরুমে আসে। পরীকে না পেয়ে রুমে যায়। অনেকবার বলার পরও পরী ড্রয়িংরুমে আসেনি। রুমে বসে বসেই দুজনে গল্প করছে। এক সময় ড্রয়িংরুম থেকে তুর্যর চিৎকার শোনা যায়।চেঁচিয়ে বলে,
“আমার চায়ের মগে লিপস্টিক ভরিয়েছে কোন ফাজিলরে?”
পরীর মুখটা পাংশু হয়ে যায়। হেঁচকি উঠে যায় সাথে সাথে। ভয়টা তো আর তুর্যকে নিয়ে নয়। ভয়টা ঐ টাইগারকে নিয়ে। আবার যদি পিছে লাগে! ও আল্লাহ্! ভাবতেই আত্মার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তাহলে ঐ মগের চা তুর্যর ছিল। ধুর! মনে হচ্ছে যেন চা নয় বিষ খেয়েছে বিষ!
পরী ড্রয়িংরুমে যাওয়ার পর কলিংবেল বাজে। দরজা খুলে দেন তাহমিনা বেগম।
“আপনাকে তো চিনলাম না।“
“আমি আপনাদের নতুন ভাড়াটিয়া। আপনার ভাগ্নে বলল পরী নাকি এখানে?”
“আপনি পরীর বাবা?”
“জি।“
“ভেতরে আসেন ভাই।ও এখানেই আছে।“
“না আপা। ওরে ডেকে দেন।“
তাহমিনা বেগমের আর ডাকতে হয়নি। পরী নিজেই যায়। পরীর বাবা হেমায়েত ইসলাম পরীর হাত ধরে নিয়ে যান। দেখে খুব গম্ভীর মনে হলো। বাসায় নিয়েই পরী ও রেহেনা বেগমকে অবাক করে দিয়ে তিনি চড় বসান পরীর গালে। পরী গালে হাত দিয়ে টলমল করা চোখে তাকিয়ে আছে। রেহেনা বেগমকে পরীকে ধরে বলেন,
“এসব কী? মারলে কেন ওকে?”
“তোমার মেয়ের সাহস খুব বেড়ে গেছে জানো সেটা?”
“কী করেছে?”
“এলাকার গুন্ডা ছেলেদের সাথে তর্ক কে করতে বলছে ওরে? বেশি প্রতিবাদী হয়ে গেছে? আজকাল ছেলেরা কেমন জানে না ও?”
রাগে তার শরীর কাঁপছে। পরী জিদ্দে দাঁতে দাঁত চেপে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মনে মনে অপেক্ষায় আছে সকাল হওয়ার। বিচার কারা দিয়েছে বুঝতে কষ্ট হয় না একটুও। কাউকে কিছু না বলেই নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
প্রান্ত সমস্ত রাগ নিয়ে থাপ্পড় বসায় সেলিমের গালে। মারতে মারতে নিচে ফেলে দেয়। এলোপাথাড়ি লাত্থি দেয় কিছুক্ষণ। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“তোকে বারণ করেছিলাম না বিচার না দিতে? এরপরও তুই বিচার কেন দিলি ওর বাবার কাছে? সেটা আবার আমায় বলতে আসছিস?”
সেলিম ব্যথায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলে,
“ভাই আমি ভুইলা গেছিলাম।মাফ কইরা দেন।“
প্রান্ত রাগে আর কথা না বাড়িয়ে বাসায় চলে যায়।
.
পূব আকাশে সূর্যের তেজ রোদের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। ক্যারাম বোর্ডের দোকানে বসে আছে সেলিমসহ আরও চ্যালাপ্যালারা। পরী সেদিকে তেড়ে গিয়ে ক্যারাম বোর্ডটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। পরী দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমার সাথে ঝামেলা, আমার ওপর রাগ আমার সাথে লড়। আমার সাথে কথা বল। আমার আব্বুর কাছে বিচার দিছিস ক্যান?”
সেলিম আস্তেধীরে বলে,
“আপনে তুইতোকারি করেন ক্যান?”
“তুইতোকারি করি ক্যান?”বলে তেড়ে যায় সেলিমের দিকে মারতে। তখন কেউ একজন পেছন থেকে আলতো করে ধরে পরীর হাত। পরী অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় পেছনে। ছেলেটা ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুঁটিয়ে বাম হাত দিয়ে একবার চশমার ফ্রেমটা ঠিক করে।
“রিল্যাক্স!”
“আমার হাত ধরেছেন কেন? কে আপনি?”
“ওহ্ স্যরি! আমি প্রান্ত।“
“তো? নাচব এখন আমি? হাত ছাড়েন মিয়া!”
প্রান্ত ভ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে পরীর কথা শুনে।