তুর্য আর পুলিশ অফিসার দুজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। পরী আল্লাহ্’র নাম নিয়ে জোরে দৌঁড় দেয়। এতে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দুজনই। কয়েক সেকেন্ড পার হতে দুজনই একসাথে দৌঁড় শুরু করে। এই যাত্রায় পুলিশ অফিসার বলে,
“আপনি দৌঁড়াচ্ছেন কেন?”
“আমি তো ওকে ধরতে যাচ্ছি। কিন্তু আপনি কেন দৌঁড়াচ্ছেন স্যার?”
“আরে আমিও তো ওর পিছেই যাচ্ছি। দিনদুপুরে একজন পুলিশকে ইভটিজিং করা!”
তুর্য এবার থেমে যায়। সাথে পুলিশও। তুর্য একটু দম নিয়ে বলে,
“আপনার ভুল হচ্ছে। ও আমায় লাভ ইউ বলেছে।”
“আপনি চেনেন ওকে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আর কী! যান।”
তুর্য পরীর পেছন পেছন দৌঁড়াতে থাকে। পরীর বাকি বান্ধবীরাও দৌঁড়াচ্ছে। ওরা আলাদা আর পরী আলাদা। পুলিশ অফিসার বাকিদের ধরে ফেলে। সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমরা কেন দৌঁড়াচ্ছো হুম?”
সোনালী আমতা আমতা করে বলে,
“বাড়ি যেতে লেট হয়ে যাচ্ছে তো তাই আরকি!”
“তাই নাকি? যেই মেয়েটা লাভ ইউ বলল তার সাথে আমি তোমাদের কথা বলতে দেখেছি। কী কথা বলছিলে তোমরা? তারপর ওকে রেখেই তোমরা হাঁটা শুরু করলে। কাহিনী কী বলো।”
সকলেরই শীতের মধ্যে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। তবে সেটা ঠান্ডায় নয়। ভয়ে। পুলিশ এবার ধমক দিয়ে বলে,
“কী হলো? বলো?”
মেহু এবার কাঁপান্বিত স্বরে বলে,
“আসলে স্যার আমরা ডেয়ার গেম খেলছিলাম।”
সে অবাক হয়ে বলে,
“ডেয়ার গেম? বাবারে বাবারে! এত সাহস তোমাদের? তার মানে কি ঐ মেয়ে আমাকেই লাভ ইউ বলেছিল? আর ফ্লাইং কিসটা আমায়ই দিয়েছিল?”
সবাই মাথা নিচু করে বলে,
“জি।”
পুলিশ অফিসার একটু ভাবান্বিত হয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“তাহলে ছেলেটা মিথ্যা বলল কেন!”
লিমা এবার বলে,
“এইযে আমরা কান ধরছি। আর কখনো এমন হবে না সত্যি।”
পুলিশ এবার হেসে বলে,
“ডেয়ার খেলো ঠিকাছে। কিন্তু এত ভয়ংকর ডেয়ার দিও না কাউকে। যাও বাসায় যাও।”
সবাই খুশি হয়ে বলে,
“ধন্যবাদ স্যার।”
এরপর সকলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচে লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকে।
.
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অচেনা গলি দিয়ে ঢুকে কোথায় যে এসেছে পরী নিজেও জানে না। হাঁপিয়ে উঠেছে অনেক। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। গলির শেষ মাথায় দেয়াল ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে পড়ে পরী। লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে চোখ বন্ধ করে। হঠাৎ অনুভব করল মুখে বাতাস লাগছে। চকিতে চোখ মেলে তাকায় পরী। পাশেই তুর্য দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পরীর মুখে ফুঁ দিচ্ছে। পরী ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। তুর্য ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,
“আরে আরে! গঙ্গা ফড়িং এর মতো লাফাচ্ছো কেন?”
পরীর মেজাজ বিগড়ে যায়। রাগ দেখিয়ে বলে,
“আপনি তখন কোথা থেকে উদয় হলেন? আর আমার পিছু পিছুই বা কেন এসেছেন?”
“আগে দম নাও। হাঁপিয়ে গেছ প্রচুর।”
“আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”
“কী আজব! এইযে শীতের মধ্যেও তোমার কপাল ঘেমে টপটপ করে ঘাম পড়ছে দেখেছ? আমি না আসলে ফুঁ দিয়ে বাতাস করত কে?”
পরী দু হাত জরো করে কপালে ঠেকিয়ে মাথা নত করে বলে,
“উদ্ধার করেছেন আপনি আমায়।”
“ব্যাঙ্গ করে বলছ কেন হু? আসলেই আমি তোমাকে উদ্ধার করেছি।”
পরী চোখ পিটপিট করে বলে,
“ওহ আচ্ছা! তাই নাকি? তো কীভাবে উদ্ধার করেছেন শুনি।”
“পুলিশকে বলেছি তুমি আমায় লাভ ইউ বলেছ।”
“কিহ্! আপনাকে বলেছি এটা বলেছেন? আমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?”
“সে যাই হোক। বাঁচিয়েছি তো।”
“ঘেঁচু করেছেন।”
“আর তুমি? তুমি কী করেছ? রাস্তাঘাটে পুলিশকে বলে বেড়াচ্ছ ‘আই লাভ ইউ’। আবার ফ্লাইং কিসও দিচ্ছ।”
“তাতে আপনার কী? এরপর থেকে মাইক নিয়ে বলব। সরাসরি গিয়ে চুমু খাব।”
“আর এইগুলো ইনফরমেশন যখন আমি আন্টিকে দেবো তখন বুঝবা মনু কত ধানে কত চাল।”
পরী কপাল কুঁচকে নাক ফুলিয়ে বলে,
“আপনার আন্টিকে আমি ভয় পাই নাকি?”
“পাও না?”
“না। পাই না।”
“আচ্ছা। সেটা পরে দেখা যাবে। এখন বাড়ি যাবে তো?”
“হু।”
“তাহলে চলো।”
“আপনার সাথে কে যাবে? আমি একাই যাব।”
“তুমি চেনো এই এলাকা?”
“চিনি না। তবে চিনে নেব।”
“তাই? তাহলে যাও একা একা। যখন বখাটেদের পাল্লায় পড়বে তখন মনে মনে বলবে, ‘কেন যে তুর্যর সাথে গেলাম না।’ তোমার যা খুশি করো গিয়ে। আমি এতদূর থেকে এসেছি। খুবই টায়ার্ড লাগছে।”
তারপর হাই তুলতে তুলতে বলে,
“বাড়িতে গিয়ে একটা ঘুম দেবো।”
এরপর কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করতে করতেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পরী চেয়ে আছে যাওয়ার পথে। একবার এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে দেখেছে। শুধু চিপাগলি। এখানে তো কেউ মেরে ফেললেও টের পাবে না। তারপর বিকেলও পার হয়ে যাচ্ছে। চারপাশ কুয়াশায় ঢাকতে শুরু করেছে। রাস্তা খুঁজতে গিয়ে যদি সত্যিই কোনো বখাটের পাল্লায় পড়ে যায়। এরপর আর কোনো কিছু না ভেবেই দৌঁড়াতে শুরু করে তুর্যর পেছনে। তুর্যর কাছে গিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে হাঁটছে। তুর্য মনে মনে হাসছে। হাসিটা বুঝতে না দিয়ে বলে,
“সেই পানি তো খাবেই। ঘোলা করে খাবে।”
“শাট আপ!”
তুর্য ভ্রু দুটো নাচিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
“ওকে, ওকে।”
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরী বাড়িতে ফিরতেই রেহেনা বেগম অস্থির হয়ে বলেন,
“কখন থেকে তোকে ফোন করছি। ফোন ধরিস না কেন?”
“ওহহো! ফোন তো সাইলেন্ট ছিল মা।”
“দেরি হলো কেন আজ?”
পরী নিজের রুমে এগোতে এগোতে বলে,
“গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল তাই।”
“ওহ্। আচ্ছা সন্ধ্যার পর রেডি হয়ে নিস।”
“কেন?”
“মেয়ে দেখতে যাব।”
“ভাইয়ার জন্য?”
“হুম।”
“আব্বু রাজি?”
“রাজি হবে না কেন? কোনোদিক তো খারাপ শুনলাম না। এখন মেয়ে দেখে আসি। কথাবার্তা বলে আসি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে আসব।”
“ইশ! মা কী যে খুশি লাগছে।”
রেহেনা বেগম ভ্রু কুঁচকে বলেন,
“তুই এত খুশি হচ্ছিস কেন? তোর তো আর বিয়ে না।”
পরী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। রেহেনা বেগম মুখ টিপে হেসে বলেন,
“এত যে খুশি কেন আজ তুই। সেটাও জানি।”
পরী অবাক হয়ে বলে,
“কেন?”
“কেন আবার! আজ তুর্য এসেছে তাই।”
“তুমি জানলে কী করে?”
“ছাদে কাপড় আনতে গেছিলাম। তখন দেখলাম তোকে আর তুর্যকে। তুই যতক্ষণ না বাড়িতে ঢুকছিলি তুর্য দাঁড়িয়ে ছিল।”
পরী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। তিনি বলেন,
“হয়েছে। আর লজ্জা পেতে হবে না। আমার মেয়ের মনে যে এখনো তুর্যরই বসবাস সেটা আমি জানি।”
“তুমি এতকিছু কী করে জানো বলো তো?”
“মেয়ের মনই যদি না বুঝি তবে কেমন মা হলাম?”
“কে বলবে তুমি আমার মা? আমাদের কথাবার্তা শুনলে মানুষ বলবে আমরা বেষ্টফ্রেন্ড।”
“কেন রে, মেহু একাই তোর বেষ্টফ্রেন্ড?”
পরী ফিক করে হেসে বলে,
“তুমি কি এখন মেহুকে হিংসে করছ নাকি?”
“না রে পাগলী।”
পরী রেহেনা বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“জানো আম্মু ক্লাসের অনেকেই যখন ওদের বোনের গল্প করত, তখন আমি মনে মনে ভাবতাম, ইশ যদি আমারও একটা বোন থাকত। তাহলে আমিও এমন দুষ্টুমি করতাম। কিন্তু বোঝার পর থেকে এটাই বুঝেছি আমার সবকিছুর কমতি পূরণ করেছ তুমি। আমার জীবনের প্রথম বেষ্টফ্রেন্ড তুমি। আমার বান্ধবীরা ওদের বোনের সাথে খুনসুটি করে। আমি তোমার সাথে করি। তুমি একমাত্র ব্যক্তি যে আমার মন পড়তে পারো। তুমি যে আমার জীবনে কী তা আমি কখনোই বলে শেষ করতে পারব না।”
আবেগে রেহেনা বেগমের চোখ ছলছল করে ওঠে। পরীর গালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার লক্ষী মেয়ে। তুই যেমন আমার গর্ভে হয়ে গর্ব করিস। ঠিক তেমন আমিও গর্ব করি আল্লাহ্ তোকে আমার গর্ভে দিয়েছেন তাই।”
পরী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাকে। এই অনুভূতীর অনুভব সীমাহীন। যেখানে শান্তির কোনো অভাব নেই।
.
.
তুর্য বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই দিশান তুর্যর সাথে লেগে আছে। প্রথমে তো কান্নাই করে ফেলেছে। খাওয়ার টেবিলে বসেও তুর্যর গা ঘেঁষেই বসেছে। তুর্য বলে,
“কী হয়েছে তোর?”
“তুমি খুব পঁচা ভাইয়া। আমাদের একটুও ভালোবাসো না।”
“কে বলেছে ভালোবাসি না? অনেক ভালোবাসি তোদের।”
“তাহলে আমাদের রেখে এতদূরে থাকো কেন?”
“তুমি বুঝবি না এতকিছু।”
দিশানের মুখে রাতের অন্ধকার নেমে আসে। তাহমিনা বেগম তুর্যর প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলেন,
“কয়দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিস?”
“সাতদিন।”
“ছয়টা মাস পর তুই বাড়িতে আসলি। তাও সাতদিনের ছুটি নিয়ে?”
“তো আমি কি বিয়ে করতে এসেছি?”
“তোকে এবার বিয়েই করিয়ে দেবো। তখন দেখব বউ রেখে কীভাবে যাস।”
তিথি পিঞ্চ মেরে বলে,
“আম্মু তখন দেখবা বউ নিয়েই চলে যাবে।”
“হু বললেই হলো না? বউ দেবো না। ওকেও যেতে দেবো না।”
তিথি তুর্যর উদ্দেশ্যে বলে,
“কী ভাইয়া? বিয়ের জন্য প্রস্তুত তুমি?”
তুর্য ভাত মাখতে মাখতে বলে,
“ধুর! পাগল হলি নাকি তুই?”
তাহমিনা বেগম বলেন,
“আর কত বসে থাকবি? মেয়ে দেখি বাবা?”
“মা! তুমি যেভাবে বলছ মনে হচ্ছে আমি বুড়ো হয়ে গেছি।”
“তা বলিনি পাগল ছেলে। আমি শুধু চাই তুই এবার বিয়েটা কর।”
দিশান এবার হেসে হেসে বলে,
“ভাইয়া তুমি পরী আপুকে বিয়ে করে ফেলো। দারুণ মানাবে তোমাদের। সাথে দুজনের টম এন্ড জেরির মতো ঝগড়া তো ফ্রি আমাদের জন্য।”
তাহমিনা বেগম কপট রাগ দেখিয়ে বলেন,
“বড়দের মাঝে কথা বলা ঠিক নয় দিশান। তাছাড়া ঐ মেয়ে কখনো এই বাড়ির বউ হতে পারবে না।”
দিশানের মনটা ছোট হয়ে যায়। তিথির মুখটাও মলিন হয়ে যায়। এতক্ষণ গোগ্রাসে ভাত গিললেও এবার আর গলা দিয়ে খাবার নামছে না তুর্যর। অজানা কারণে মনে হচ্ছে খাবারগুলো গলাতেই আটকে যাচ্ছে।
তাহমিনা বেগম আরো ভাত দিতে গেলে তুর্য না করে। প্লেটে মাখা ভাতগুলো খেতেই এখন জুলুম মনে হচ্ছে। তিথি বোধ হয় ভাইয়ের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই মুখটা হাসি হাসি করে তুর্যর প্লেটটা সামনে নিয়ে বলে,
“কতদিন হয়েছে তোমার মাখা ভাত খাই না ভাইয়া।”
তাহমিনা বেগম ধমক দিয়ে বলেন,
“মুখের সামনে থেকে ভাতের প্লেট কেড়ে নেওয়া কেমন স্বভাব? ভাতের কি অভাব পড়েছে?”
তুর্য মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিচ্ছে তিথিকে। নয়তো এই খাবার গলা দিয়ে সত্যিই আর নামত না। ঐদিকে খাবার ছেড়ে উঠতেও পারত না মায়ের মন খারাপ হবে বলে।
তুর্য তাহমিনা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“আহা! বকছ কেন? খাক ও। আমার সাথে কাড়াকাড়ি না করলে আর কার সাথে করবে?”
“তোদের লাই পেয়েই এমন হয়েছে। আমি তোকে আবার ভাত দিচ্ছি।”
তুর্য এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“না মা। এখন আর খাব না। রাতে খাব।”
বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে তুর্য নিজের রুমে চলে যায়। দীর্ঘদিন পর নিজের রুমে, নিজের বিছানায়। চোখ দুটো ঘুমে টানছে। চোখ বুজতেই পরীর আতঙ্কিত মুখটা ভেসে ওঠে। সেই প্রথমদিন আর আজ একই রিয়াকশন ছিল মুখের। তুর্য চোখ বন্ধ করেই হাসে। ঘুমকে সরিয়ে আলসেমি বাদ দিয়ে ছাদে যায়। শরীরের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। গায়ে শুধু একটা জ্যাকেট আর ভেতরে পাতলা একটা টি-শার্ট। পকেটে দু’হাত পুরে তুর্য সেই ফুল গাছটার দিকে এগিয়ে যায়। গাছে শুধু একটাই ফুল ফুঁটে আছে। বাকিগুলো এখনো কলি অবস্থায়। তুর্যর অবাধ্য মন বারবার চাইছে ফুলটা পরীকে দিতে। যাবে কি একবার ফুলটা নিয়ে পরীর বাসার সামনে?
পেছন থেকে তিথি এসে ডাকে।
“ভাইয়া।”
তুর্য পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। বলে,
“কিছু বলবি?”
“কী করছ?”
“ফুলগাছগুলো দেখছিলাম।”
“হঠাৎ?”
“না। এমনি। তোর কী খবর বল? পড়াশোনা কেমন চলে?”
“হুম ভালো।”
“পরীক্ষার তো আর বেশি সময় নেই। মন দিয়ে পড়াশোনা করিস।”
“আসছে! পণ্ডিতি কম করো হু। আর শোনো।”
“বল।”
“পরীর সাথে দেখা করবে না?”
“কেন?”
“কেন আবার কী? এতদিন পর আসলে আর দেখা করবে না ওর সাথে?”
“কেন দেখা করব? ও কি আমার বউ?”
“এখনো নয়। তবে হতে কতক্ষণ।”
তুর্য চুপ করে থাকে। তিথি আবার বলে,
“আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী?”
“তুমি পরীকে ভালোবাসো।”
“এমন মনে হলো কেন?”
“সত্যি বলেছি নাকি সেটা আগে বলো।”
“জানি না রে। তবে ইদানীং ওকে খুব মিস করছিলাম। আজকে বাড়িতে আসার সময় দেখা হয়েছিল।”
“ওয়াও! সত্যিই?”
“হ্যাঁ। এতদিন পর ওকে দেখে কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছিল। বেশ ভালোই আছে ও।”
“চোখের দেখাই সব নয়। মানুষের যদি মনের ভেতরটা পড়ার ক্ষমতা থাকত তাহলে অনেকেরই ভুল ধারণা ভেঙে যেত। পরীকে ভালোবাসলে ওকে বলে দাও।”
“পরিবার মানবে না।”
“কার?”
“দুজনেরই।”
“পরিবার মানবে না বলে নিজের ভালোবাসার কথাও জানাবে না? তাছাড়া পরিবার পরে। আগে নিজেদের ভালোবাসার কথা তো জানাও।”
“আগে এটা তো শিওর হতে হবে পরীর মনে আমার জন্য এখনো ভালোবাসা আছে নাকি।”
“তাহলে সময় নাও।”
“তাই নেব।”
—————————
ফ্রেশ হয়ে এসে সেই যে ঘুমিয়েছে পরী এখনো পর্যন্ত ওঠার নাম নেই। রেহেনা বেগম কতবার করে ডেকে গেছেন। শেষমেশ প্রিয়ম বলে,
“আর ডেকো না ওকে। আজই তো আর শেষ দেখা নয়।”
“আমরা সেই কখন না কখন আসব। একা বাসায় রেখে যাব?”
“আমি মেহনুবাকে গিয়ে নিয়ে আসছি। ও থাকবে পরীর সাথে।”
“আচ্ছা তাই কর তাহলে।”
প্রিয়ম গিয়ে মেহনুবাকে নিয়ে এসেছে বাসায়। যাওয়ার আগে বারবার করে বলেছে দরজা আনলক যেন না করে। পরিচিত কেউ আসলেও যেন দরজা না খোলে। খুব বেশি প্রয়োজন হলে যেন প্রিয়মকে কল করে। মেহেনুবাও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে। রেহেনা বেগম বলেন,
“ফ্রিজে আইসক্রিম, ফল, চকোলেট আছে। টেবিলে খাবার আছে। দুজনে খেয়ে নিও।”
“আচ্ছা আন্টি।”
সবাই চলে যাওয়ার পর মেহেনুবা দরজা লক করে পরীর রুমে আসে। আজ পরীর সাথে থাকবে মানে রাত জেগে সাগরের সাথে কথা বলতে পারবে। বাসায় তো ছোট বোন সাথে ঘুমায়। তাই কথা বলার উপায় নেই। পরী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহেনুবা ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভি অন করে। সোফায় আরাম করে বসে সাগরকে কল দেয়।
.
তিথির সাথে কথা শেষ করেই তুর্য ফুলটা ছিঁড়ে নিয়ে আসে। এই মুহূর্তে পরীর বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ব্যালকোনিতে আলো এসে পড়েছে। তার মানে পরী এখন ওর রুমেই আছে। মেয়েটা কি আসবে একবারও বারান্দায়? তুর্য পায়চারি করতে থাকে একা একা। কিছুক্ষণ পর ফোনে কথা বলতে বলতে মেহনুবা ব্যালকোনিতে আসে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে তুর্যকে চিনতে কষ্ট হয় না। রুমের আলোতে তুর্যও মেহনুবাকে চিনতে পারে।
তুর্য হাত নাড়িয়ে ইশারায় বলে,
“পরীকে একটু আসতে বলো।”
মেহনুবা ইশারায় বলে,
“বাড়িতে কেউ নেই।পরী ঘুমায়।”
তুর্য সামনে একটু এগিয়ে গিয়ে বলে,
“মেইন দরজার সামনে একটু আসো।”
মেহনুবা সাগরকে পরে কল করবে বলে কেটে দেয়।
দুজন দরজার দুপাশে। তুর্য বলে,
“আপু পরীর সাথে একটু কথা বলিয়ে দাও।”
মেহু দরজার ওপাশ থেকে বলে,
“ভাইয়া ও তো এখন ঘুমাচ্ছে।”
“আচ্ছা দরজা খুলে দাও। আমি ডাকছি।”
“প্রিয়ম ভাইয়া দরজা খুলতে বারণ করেছে।”
“আমায় বিশ্বাস করতে পারো আপু। আমি কারো কোনো ক্ষতি করব না।”
মেহুর মন দোনোমনা করছে। আর যাই হোক তুর্য যে কোনো ক্ষতি করবে না এটা সত্যিই। কারণ অনেকবার সুযোগ পেয়েও তুর্য পরীর কোনো ক্ষতি করেনি। বরং সব বিপদ-আপদ থেকে পরীকে বাঁচিয়েছে। তাই মনের সাথে যুদ্ধ করেই মেহু দরজা খুলে দেয়। তুর্য ভেতরে গিয়ে দরজা লক করে বলে,
“ঘাবড়ে যেও না। কিচ্ছু করব না আমি। তুমিও আমার সাথে পরীর রুমে চলো।”
তুর্যর হাতে ফুল দেখে মেহু বলে,
“হাতে ফুল কেন ভাইয়া? আপনি কি ওকে প্রপোজ করতে এসেছেন?”
তুর্য মুচকি হেসে বলে,
“সেটা না হয় সিক্রেট থাকুক। বেশি সময় নেব না আমি। এখন চলো।”
রুমের সামনে গিয়ে তুর্য বলে,
“তুমি দেখো আগে ঠিকভাবে আছে নাকি।”
“মানে?”
“মানে ঘুমানোর সময় তো সবার হুশ থাকে না।”
মেহু বুঝতে পেরে দরজা থেকে উঁকি দিয়ে বলে,
“ঠিক আছে। চলুন।”
তুর্য ভেতরে গিয়ে দেখে লেপের নিচে পুরো শরীর এঁটে শুধু মাথাটুকু বের করে কাৎ হয়ে শুয়ে আছে। তুর্য ফ্লোরে বসে পরীর মুখোমুখি। বিছানার ওপর এক হাতে গাল ভর দিয়ে পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তুর্য মনে মনে বলে,
“আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছ।”
মেহুর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপু ফ্রিজে দেখো তো আইসকিউব আছে নাকি।”
মেহু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
“কেন?”
“দরকার আছে। দেখো তুমি।”
মেহু গিয়ে দেখে ডিপে আইসকিউব আছে। নিয়ে আসার সময় সাগর কল দেয়। মেহু ফোনটা রিসিভ করে আইসকিউব তুর্যর কাছে দিয়ে ব্যালকোনিতে চলে যায়। তুর্য একটা কিউব নিয়ে পরীর মুখের ভেতর পুরে দেয়। বরফের ঠান্ডায় পরী সাথে সাথে লাফিয়ে বসে পড়ে। দ্বিতীয় শক খায় তুর্যকে দেখে। তুর্য খিলখিল করে হাসছে। পরীর ঘুমের রেশ এখনো কাঁটেনি। পরী আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। ঢুলুঢুলু চোখে চারপাশে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,
“আরে এটা তো আমারই রুম।”
তুর্য বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরীকে টেনে খাট থেকে নামায়। নিজের মুখোমুখি সামনে দাঁড় করায়। তুর্যর ঠান্ডা হাত দিয়ে পরীর উষ্ণ হাতে স্পর্শ লাগায় দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নেয় পরী। ঘুমের ঘোরে পড়ে যাওয়া ধরলে তুর্য ধরে ফেলে।
“আরে! সাবধানে।”
পরী নিভু নিভু চোখে তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি এইখানে কেন? আমি কোথায়?”
তুর্য অবস্থা বেগতিক বুঝতে পারে। এই মেয়ে ঘুম থেকে নয় যেন নেশা করে উঠেছে। পরীকে ধরে বেসিনের সামনে নিয়ে যায়। তারপর পরীর মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে দেয়। পরী হকচকিয়ে উঠে। তার মানে সামনে সত্যিই তুর্য দাঁড়িয়ে আছে। তুর্য বলে,
“ঘুমের নেশা ছেড়েছে?”
“আপনি এখানে কী করছেন? কে আসতে দিল আপনাকে? বাড়ির সবাই কোথায়?”
“আস্তে। একসাথে এত প্রশ্নের উত্তর দেবো কীভাবে?”
“আমার কোনো উত্তর লাগবে না। আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।”
“বাড়ি থেকে বের করতে পারলেও মন থেকে বের করতে পারবে না।”
পরী অবাক হয়ে যায় তুর্যর কথা শুনে। তুর্যর কপালে, গলায় হাত দিয়ে বলে,
“ঠিক আছেন আপনি?”
তুর্য খপ করে পরীর হাত ধরে ফেলে। হাতটা নিয়ে বাম হাত দিয়ে জ্যাকেটর এক সাইড সরিয়ে হাতটা বুকের বামপাশে রাখে। বলে,
“ঠিক-বেঠিক কপালে, গলায় হাত দিলে বুঝবে না। এখানে হাত রাখো সব বুঝতে পারবে। হার্টবিটের শব্দ বুঝতে পারছ?’
পরী এবার ভ্রমহেতু হয়ে তাকিয়ে আছে। তারপর দ্রুত হাতটা সরিয়ে নেয়।
“আপনি চলে যান।”, বলে পরী যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। তুর্য পরীর হাত টেনে ধরে দেয়ালের সাথে হাতটা চেপে ধরে। দুজনের দূরত্ব খুব কম। পরী হাত ছাড়ানোর জন্য জোড়াজোড়ি করছে। তুর্য অবাক নয়নে পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত ছাড়াতে না পেরে বিরক্ত হয়ে যখন তুর্যকে কিছু বলতে যাবে তখন তুর্যর চোখের দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হাত ছাড়ানোর চেষ্টাটাও থামিয়ে পায়। ভ্রমে পেয়েছে যেন। খুব বেশি সময় ধরে পরী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনি। লজ্জারা যেন জেঁকে ধরেছে। দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলে পরী। হার্টবিট এত জোরে কম্পিত হচ্ছে যে মনে হচ্ছে তুর্যও সেটা শুনতে পাচ্ছে। তুর্য মুখটা আরো এগিয়ে নেয় পরীর মুখের দিকে। পরীর এখন জীবন যায় যায় অবস্থা। তুর্য মুখটা পরীর কানের কাছে নিয়ে বলে,
“লজ্জা পেলে তো তোমায় দারুণ লাগে!”
তুর্যর ফিসফিস করে বলা প্রতিটা শব্দ পরীর কর্ণকুহরে নতুন অনুভূতির সূচনা করেছে। তুর্যর শীতল অধরের স্পর্শ পরীর কানের লতিতে স্পর্শ করেছে খুব সামান্য। তবুও এই ছোঁয়া যেন অন্তহীন অনুভূতির নাম। পরী নিজেকে ঠিক রাখতে চেয়েও রাখতে পারছে না। চোখ দুটো ছলছল করছে। সারা শরীর কাঁপছে। হাত-পা, ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। তুর্য সেটা বুঝতে পেরে পরীর গালের সাথে নিজের গাল ঘষে। পরী মনে মনে ভাবে এবার তুই শেষ রে পরী! তুর্যর খোঁচা খোঁচা দাড়ি পরীর গালে ছুঁয়ে শিহরিত করে তুলছে।
তুর্য এবার পরীকে ছেড়ে দিয়ে রুমে যায়। পরী তখনও বরফের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। পা দুটো জমে যেন বরফ হয়ে গেছে। টেবিলের ওপর রাখা ফুলটা নিয়ে এসে পরীর অর্ধখোলা খোঁপায় গুঁজে দিয়ে আবারও কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“এটা সেই গাছের ফুল। যেই গাছের ফুল থেকেই তোমার সাথে আমার প্রথম ঝগড়ার শুরু হয়েছিল। আজও সেই একই গাছের ফুল তোমার খোঁপায় গেঁথে দিয়ে আমার ভালোবাসার সূচনা করে গেলাম।”, বলে পরীর ঘাড়ে আলতো করে একটা চুমু এঁকে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।