কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের জাঁকজমক আয়োজন করা হয়েছে। বড় বড় বক্সে বিয়ের গান-বাজনা বাজছে। গেট ধরার পর্ব শেষ হলে সবাই গিয়ে ভেতরে বসে। তুর্য সেই পরীদের বাড়ি থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত পরীর সাথে সাথেই আছে। পরীর সাথে দু’দণ্ড মন খুলে কথা বলবে সেই সুযোগটাও পাচ্ছে না। এইদিকে পরী লজ্জায় তুর্যর দিকে তাকাতে পারছে না। ভেতরে গিয়েও দুজনে পাশাপাশি বসেছে। তিথি পরীর কাছে এসে বলে,
“একটা কথা বলব তোমায়।”
পরী হেসে বলে,
“হ্যাঁ, বলো।”
তিথি তুর্যকে বলে,
“ভাইয়া তুমি একটু উঠো তো।”
তুর্য কপালে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলে,
“কেন?”
“আমার পরীর সাথে একটু কথা আছে।”
তুর্য উঠে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসে। তিথি তুর্যর চেয়ারে লজ্জায় নতজানু হয়ে বসে। মুখে লাজুক হাসি। পরীও হেসে বলে,
“কী ব্যাপার বলো তো? এমন লজ্জা পাচ্ছ কেন?”
লজ্জামাখা স্বরে তিথি বলে,
“প্রান্ত আজ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল বাসায়। সবাই রাজি।”
পরী খুশি হয়ে বলে,
“সত্যি?”
তিথি মাথা উপরনিচ করে বলে,
“হুম।”
আদরে বুকে আলিঙ্গন করে নেয় তিথিকে পরী। বলে,
“অনেক খুশি হয়েছি আমি তিথি। আমি চাই সবসময়ই তোমরা এমন হাসিখুশি থাকো।”
তিথিকে ছেড়ে দিয়ে গাল টেনে বলে,
“কংরাচুলেশন ডিয়ার।”
“পরী!”
“বলো।”
“আমার সেই খারাপ ব্যব…”
পুরো কথা বলার আগে পরী থামিয়ে দিয়ে বলে,
“চুপ। আজকের খুশির দিনে আগের কোনো কথা নয়।”
দুজনের কথার মাঝে রেহান এসে বলে,
“আরে বেয়াইনসাব তুমি এখানে। আর আমি তোমাকে খুঁজছি।”
পরী একবার তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“কেন?”
“কথা আছে। আসো একটু।”
তুর্য রাগান্বিত দৃষ্টিতে পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। পরী একবার তুর্যর দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার রেহানের দিকে।তুর্য, সাগর, মেহনুবা, প্রান্ত, তিথি ওরা সবাই তাকিয়ে আছে পরীর দিকে। কারণ ওরা সবাই জানে কাল রাতের কথা।পরী পড়েছে এখন দোটানায়। না পারছে মুখের ওপর বারণ করতে আর না পারছে রেহানের সাথে যেতে। এইদিকে তিনি আত্মীয় মানুষ। মুখের ওপর না’ও বলা যাচ্ছে না। অগত্যা পরী উঠে রেহানের সাথে যায়। এদিকে তুর্য রাগে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রেখেছে। প্রান্ত তুর্যর কাঁধে হাত রেখে বলে,
“রিল্যাক্স! এত রাগ করার কী আছে?”
তুর্য পরী আর রেহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“দেখিস না দুজনে কী সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে। আবার নাকি কী কথাও আছে! কেন ভাই? এমন কী কথা যে আমাদের সামনে বলা যাবে না?”
“তুই এমন হিংসুটে তুর্য?”
“হ্যাঁ, তাই।”
“আচ্ছা আমার কথা শোন। হাজার হোক ওরা তো এখন রিলেটিভ। মুখের ওপর না করবে কীভাবে? তাছাড়া আত্মীয়ের সাথে হেসে কথা বলবে না তো কি রাগ দেখিয়ে কথা বলবে?”
“ওকে। তোর সব কথা মানলাম। কিন্তু আলাদা কী কথা থাকতে পারে? নিশ্চয়ই প্রপোজ করার মতলব আছে।”
“বি পজিটিভ ইয়ার! এখানে এত মানুষ। আমরা ছাড়াও আরো অনেকেই আছে। তাই হয়তো আলাদা কথা বলতে চেয়েছে।”
“আমার রাগ কমছে না প্রান্ত।”
“কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ।”
.
রেহান পরীকে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে আরো কয়েকজন ছেলে-মেয়ে বসে আছে। রেহান সবার সাথে পরীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
“এইযে আমার একমাত্র বেয়াইনসাব পরী। সুন্দর না? নামের মতো দেখতেও পরী।”
তারপর পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আর ওরা আমার বন্ধু। তোমাকে এখানে এনেছি একজন বিশেষ মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে।”
রেহানের বন্ধুর মধ্যে একজন বলে,
“আচ্ছা তোরা কথা বল। আমরা ঐদিকটায় যাই।”
“ওকে।”
একটা মেয়ে বাদে সবাই অন্যদিকে চলে যায়। রেহান ঐ মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
“এই হচ্ছে আমার গার্লফ্রেন্ড শ্রাবণী। যার কথা কাল তোমায় বলেছিলাম।”
পরী হেসে বলে,
“ভাবি বলে ডাকব?”
উত্তরে শ্রাবণীও হেসে বলে,
“না। নাম ধরেই ডাকো।”
“তুমি মেবি আমার চেয়ে বড় হবে।”
“আমি অনার্স ১ম বর্ষে পড়ি। তুমি?”
“আমি এইচএসসি পরীক্ষার্থী।”
“তাহলে খুব বড় তো নই। নাম ধরেই ডেকো প্লিজ।”
পরী হেসে বলে,
“আচ্ছা ঠিকাছে। তো এই পুলিশকে প্রেমে ফেললে কী করে?”
“আর কী করে? দেখো না কী রসিক মানুষ।”
কথা বলতে বলতে তিনজনের আড্ডা জমে ওঠে। কথাবার্তা শেষ করে যায় প্রিয়ম আর রোজের কাছে। সেখানে সবাইকে দেখলেও তুর্যকে দেখতে পায় না। কাকে যে জিজ্ঞেস করবে সেটাও বুঝতে পারছে না। নাচ-গানের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই এখন ব্যস্ত। পরীর চোখ যায় দিশানের দিকে। গায়ে হলুদ থেকে মিলির সাথে দিশানের বেশ ভাব জমেছে। এখন আর অন্য কারো কাছে তেমন থাকে না। সারাক্ষণ মিলির কাছেই থাকে। পরী দিশানকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
“আজকাল দেখি মিলি আপুর পিছুই ছাড়ছ না হু?”
দিশান ভাব নিয়ে বলে,
“তুমি কি জেলাস ফিল করছ?”
পরী ভ্রু কু্ঁচকে বলে,
“কেন?”
“কেন আবার? এইযে এখন আমি তোমায় ছেড়ে মিলি আপুর কাছে থাকি। কী আর করব বলো? তুমি তো তুর্য ভাইয়াকে পেয়ে আমায় পাত্তাই দাওনি।”
পরী দিশানের গাল টেনে দিয়ে বলে,
“ফাজিল! আচ্ছা শোনো, তোমার তুর্য ভাইয়া কোথায়?”
“জানি না তো। তুমি ভাবির ভাইয়ের সাথে যাওয়ার পর তুর্য ভাইয়াও কোথায় যেন চলে গেছে।”
“বলে যায়নি?”
“না।”
“আচ্ছা তুমি যাও।”
দিশান আবার একছুটে মিলির কাছে চলে যায়। পরীর মনটাই খারাপ হয়ে যায়। এভাবে না বলে তুর্য চলে গেল কেন? ইচ্ছে ছিল, আজ সকল মান-অভিমান ভুলে তুর্যর কাছে নিজেকে ধরা দেবে। অথচ তা আর হলো না। খাওয়ার সময়ও আর তুর্যর দেখা পাওয়া গেল না। মানুষটা কি তাহলে সত্যি সত্যিই চলে গেল। পরী কয়েকবার ফোনও দিয়েছে। কিন্তু ফোন বন্ধ।
রাত প্রায় আটটা হবে। রোজের বান্ধবী, কাজিনরা নাচছে। সাথে অন্যরাও যোগ দিচ্ছে। কিন্তু পরীর মন কিছুতেই এখানে বসছে না। কোথা থেকে যেন মেহু ছুটে এসে বলে,
“ঐ পুলিশরে তুই কী যাদু করছিস বল তো?”
“মানে?”
“মানে এটাই উনি তোকে চোখে হারাচ্ছে।”
“ধুর! ভুল ভাবছিস তুই। উনার গার্লফ্রেন্ড আছে।”
“তাই নাকি? জানতাম না তো। আচ্ছা যাই হোক,সে তোকে ছাদে যেতে বলেছে।”
“কেন?”
“আমি কী জানি!”
“আচ্ছা।”
পরী দোনোমনা হয়ে ছাদে যায়। অদ্ভুত ছাদে তো কেউ নেই। মেহনুবা কী তাহলে মজা করল? তবে মন খারাপের জন্য শূন্য ছাদটা একদম পার্ফেক্ট। পরী আরেকবার তুর্যর নাম্বারে ডায়াল করতে যাবে তখন পরীকে টেনে ছাদের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে তুর্য। পরী চিৎকার করতে যাবে তখন তুর্য পরীর মুখ চেপে ধরে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“কাল এতবার করে বারণ করার পরও কেন তুমি ওর সাথে এত সময় কাটাচ্ছ? কীসের আলাদা কথা তোমাদের?”
পরী অস্ফুট শব্দ করছে। কথাও বলতে পারছে না। তুর্যর থেকে নিজেকে ছাড়াতেও পারছে না। তুর্য ধমক দিয়ে বলে,
“চুপ করে আছো কেন? উত্তর দাও।”
পরী মনে মনে বলে,
“আরে আহম্মক! মুখ ধরে রাখলে উত্তর দেবো কীভাবে?”
মুখে কিছু বলতে না পেরে পরী আবারও তুর্যর হাতের আঙুলে কামড় বসিয়ে দেয়। তুর্য ব্যথা পেয়ে হাত সরিয়ে নেয়। পরী ছাড়া পেয়ে বড় শ্বাস নেয়। তুর্যর মুখের রিয়াকশন দেখে ফিক করে হাসে। এমনিতেই প্রচুর রেগে ছিল তুর্য। পরীর এহেন কাণ্ডে ও হাসিতে রাগটা যেন আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। পরীর হাত ধরে দেয়ালের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে। পরী ব্যথা পেয়েও কিছু বলে না। তুর্য রক্তরাঙা চোখে পরীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“খুব মজা লাগে না তোমার? লাগবেই তো। এখন তো সুযোগ পেয়েছ তুমি। তাই যেভাবে খুশি সেভাবেই নাচাচ্ছ আমায়। সুযোগটা ভালোমতোই কাজে লাগাচ্ছ। আমার ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে বারবার আমায় আঘাত করছ আমি না করা সত্ত্বেও। প্রতিশোধ নিচ্ছ না তুমি প্রতিশোধ?”
পরী তুর্যর দৃষ্টিতে নিজের শীতল দৃষ্টি রেখে বলে,
“আমি ব্যথা পাচ্ছি।”
পরীর দূর্বল কণ্ঠে এইটুকু শুনেই তুর্য হাত ছেড়ে দেয়। পরী কয়েক কদম এগিয়ে সামনে দাঁড়ায়। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট না হলেও অস্পষ্টভাবে পরীর হাতে তুর্যর চেপে ধরার দাগ দেখা যাচ্ছে। পরী সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে শান্তভাবে বলে,
“আমি আগেও বলেছিলাম, প্রতিশোধ আমার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না। এখন শত হোক, রেহান আমার ভাবির ভাই। তার মুখের ওপর সামান্য কিছুতে ‘না’ বলতে পারি না আমি। এমন তো নয় যে, সে আমায় কোনো খারাপ প্রস্তাব করেছে। তাছাড়া তার গার্লফ্রেন্ড আছে। এবং সে যথেষ্ট ভালো মানুষ। বাকি রইল ভালোবাসার কথা। এই এইটুকুতেই আপনি আমায় আজ এতগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন। অথচ আপনি দেখলেন না একবারও আমার ভালোবাসাটা। বোঝেনওনি কখনো। তাই হয়তো আজ এতগুলো কথা বলতে পারলেন।”
আচমকা তুর্য পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“স্যরি পরী। প্লিজ স্যরি। ক্ষমা করে দাও। আমি তো জানতাম না তার গার্লফ্রেন্ড আছে। আর রাগটাও কন্ট্রোল করতে পারিনি।”
পরী তুর্যর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অভিমানিসুরে বলে,
“কথায় কথায় জড়িয়ে ধরবেন না।”
তুর্য হেসে বলে,
“আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না।”
পরীর হাসি পেলেও সেটা জোর করে আটকিয়ে রাখে। অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে। তুর্য বলে,
“ওহ আচ্ছা! পরী তো আমার সাথে রাগ করেছে। পরী তো এখন আমার সাথে কথা বলবে না। একি! পরী কি হাসছে আমার কথা শুনে?”
তুর্যর কথা বলার ভঙ্গিতে হাসি আটকে রাখা জুলুম হয়ে যাচ্ছে পরীর। তবুও যথাসম্ভব চেষ্টা করছে হাসি আটকে রাগী ভাবটা ধরে রাখার। কিন্তু একের পর এক তুর্যর মজা করা কথা শুনে হাসি আটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। তুর্য বলে,
“এখনই যত রাগ করার করে নাও। বিয়ের পর কিন্তু রাগ করার আর সুযোগ পাবে না।”
পরী নিশ্চুপ। তুর্য আবার বলে,
“জিজ্ঞেস করো ‘কেন’।”
পরী তবুও চুপ। তুর্য নিজেই বলে,
“ও জিজ্ঞেস করবে না? আচ্ছা আমিই বলি। সুযোগ পাবে না এজন্যই যে তখন তো আমার টাইগার বাসায় থাকবে। তুমি রাগ করলেই টাইগারকে বলব, ‘যা তো আমার বউয়ের আঁচল ধরে আমার কাছে নিয়ে আয়।’ তুমি তো আবার ওকে ভয় পাও। টাইগারের কথা মনে আছে তোমার? আরে ঐযে, তুমি যে বলতে বিদেশী কুত্তা।”
কীসের আর কী রাগ দেখাবে। পরী দম ফাঁটিয়ে হেসে ফেলে এবার। সাথে তুর্যও যোগ দেয়। পরী হেসেই চলেছে। তুর্য হাসতে হাসতে বলে,
“কী হুম? আমার সাথে নাকি রাগ করে থাকবে? কতক্ষণ পারলে রাগ করে থাকতে?”
পরী তুর্যর হাতে একটা কিল বসিয়ে দেয়। তুর্য পরীকে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয়। পরীর হাসি বন্ধ হয়ে যায়। এখন মনোযোগ দিয়ে শুনছে তুর্যর বুকের হৃদস্পন্দন। পরী নিচুস্বরে বলে,
“শুনতে পাচ্ছি।”
“কী?”
“আপনার হৃদস্পন্দন। কী বলছে জানো?”
“হুম জানি।”
“বলেন তো কী বলছে?”
“উঁহু। তুমি বলো। দেখি মিলে নাকি।”
“ভালোবাসি পরী। এটাই বলছে।”
তুর্য মুচকি হাসে। পরী মাথা তুলে তুর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মিলেছে?”
পরীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে তুর্য বলে,
“হ্যাঁ।”
এরপর শক্ত করে জড়িয়ে নেয় বুকের মাঝে। পরীও শান্ত হয়ে থাকে তুর্যর বুকে। চারপাশ থেকে শীতের ঠান্ডা শীতল বাতাস কখনো কখনো দুজনকে শিউরে দিচ্ছে। পরী লজ্জায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। কুহেলিকারা চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। হয়তো পরীকে লজ্জা থেকে বাঁচাতেই।
পরী মৃদুস্বরে বলে,
“একটা আবদার করি?”
“হু।”
“একটা গান শোনান।”
তুর্য মুচকি হেসে পরীর উদ্দেশ্যে গান শুরু করে,
“ঠিক এমন এভাবে
তুই থেকে যা স্বভাবে।
আমি বুঝেছি ক্ষতি নেই,
আর তুই ছাড়া গতি নেই।
ছুঁয়ে দে আঙুল
ফুঁটে যাবে ফুল, ভিজে যাবে গা।
কথা দেয়া থাক, গেলে যাবি
চোখের বাইরে না।”