উপস্থিত সকলেই এখন একদম মিইয়ে আছে। তুর্য ভেতরে এসে বলে,
“এসব কী হচ্ছে?”
অনেকটা সাহস জুগিয়ে তাহমিনা বেগম বলেন,
“তোর বউ আমার মুখে মুখে তর্ক করে। এতগুলো মানুষের সামনে আমায় অপমান করছে। বিশ্বাস না হলে ভাবিদের জিজ্ঞেস করে দেখ।”
তুর্য পরীর দিকে তাকায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে পরী। চোখগুলো টলমল করছে। যেকোনো সময়ে পানিটুকু গাল বেয়ে পড়বে। তুর্য দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে,
“আমি পরীকে চিনি মা।”
“কী বলতে চাইছিস তুই? আমি মিথ্যে বলছি? এতগুলো মানুষ তো এখানে আছে। ওদেরকেই জিজ্ঞেস করে দেখ।”
“আমার কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। এখানে উপস্থিত প্রত্যেককেই আমি চিনি। আর তোমাকেও!”
“কী বলতে চাস পরিষ্কার করে বল। আমি কি পরীকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছি?”
“দিচ্ছ না। বরং বিয়ের পর থেকে দিয়ে আসতেছ। খুব বেশিই বাড়াবাড়ি করছ তুমি। আমার কাছে ও’কে খারাপ বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে আছো। কী লাভ মা? বলো কী লাভ? নিজের এই অহেতুক রাগ জেতাতে গিয়ে কেন আমায় মেরে ফেলতে চাইছ? তুমি জানো না আমার জীবনে পরী কী? পরীকে ছাড়া যে আমি বাঁচব না এটা তুমি জানো না? তুমি সব জানো। সব বোঝো। তবুও তুমি চাইছ আমার থেকে পরীকে আলাদা করতে।”
তাহমিনা বেগমসহ উপস্থিত সকলেই চুপ করে থাকে। তুর্য আবার বলে,
“সকালের রান্নার সময় তুমি যে অহেতুক পরীর ওপর রাগ দেখিয়ে চেঁচামেচি করো সেগুলো কিন্তু আমার কানে আসে। খাবার ভালো হলেও সেটাকে তুমি নুন বেশি হয়েছে, মরিচ বেশি হয়েছে বলে চেঁচাও। অথচ এসব বিষয় নিয়ে পরী কখনোই আমায় কিছু বলিনি। আমি যতবার চেয়েছি তোমায় বিষয়টা নিয়ে কিছু বলতে ততবার পরী আমায় আটকিয়েছে। বলেছে, ‘এটা আমাদের বউ-শ্বাশুরীর বিষয়। তুমি আসবে না একদম।’ আমি বুঝতাম পরী কষ্ট পায় তবুও নিজেকে তোমার সাথে মানিয়ে নিতে চেয়েছে। পরীর সাপোর্ট নিচ্ছি বলে হয়তো ভাববে ছেলে এখন বউ পাগল হয়ে গেছে। না মা, আমি একদম ঠিক আছি। তোমাদের দুজনের জায়গা আমার মনে আলাদা। আমি দেখেশুনে সঠিকটাই বলি। দিনকে দিন তোমার নাটক, অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ মা। পরী আমায় কিছু না বললেও অফিস থেকে ফিরে ওর মলিন মুখটা দেখলে আমি সব বুঝি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। পরীকে নিয়ে তোমার যখন এতই সমস্যা তখন আমরা আলাদা থাকব।”
“তুই আলাদা থাকবি?” বলেন তাহমিনা বেগম।
“হ্যাঁ, থাকব। আমি শান্তি চাই। অন্যের মেয়ের ওপর অত্যাচার করার আগে তিথির কথাও একটু মাথায় এনো। আজকে তিথির শ্বাশুরী যদি তিথির সাথে এমন করত তাহলে তুমি সহ্য করতে পারতে তো? নিজের মেয়ের জন্য তোমার যেমন পুড়ে তেমনি ওর বাবা-মায়েরও পুড়ে। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি বিয়ের আগে পরীর বাবার ভয় পাওয়ার কারণ। যাই হোক, আমার শেষ কথা আমি জানিয়ে দিচ্ছি আমি আর এখানে থাকব না। আজই আমি পরীকে নিয়ে চলে যাব।”
“তুর্য আমার কথা শোন!”
তুর্য আর না দাঁড়িয়ে পরীর হাত ধরে রুমে নিয়ে যায়। ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়। পরীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়। বলে,
“আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও পরী। আমার উচিত ছিল আরো আগেই এখান থেকে চলে যাওয়া। কিন্তু কী করব বলো? মা হয় তো! ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়। ভেবেছিলাম মা একদিন শুধরে যাবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। শোধরানোর মতো মানুষ নয় মা। অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমায়। আর না। আমরা আলাদা থাকব। ভালো থাকব।”
পরী নিরবে চোখের পানি ফেলে তুর্যর শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে। তুর্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“প্লিজ আর কেঁদো না। আর প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নাও।”
“আলাদা হওয়াটা কী খুব জরুরী?” ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে পরী।
“হ্যাঁ, জরুরী। একটু একা থেকে দেখুক কেমন লাগে। যেদিন নিজে থেকে নিজের ভুল বুঝতে পারবে সেদিন আমরা ফিরে আসব। তোমার কোনো দ্বিমত আমি শুনব না। আমি এই বাসায় থাকব না। আর আমি যেখানে থাকব তোমাকেও আমার সাথেই থাকতে হবে।”
.
.
রাত আটটার দিকে তুর্যর বাবা বাসায় আসেন। তিনি বাড়িতে আসার পর তুর্য সব খুলে বলে। তুর্যর বাবা বিচক্ষণ মানুষ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন,
“তুই যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিত তখন আমি আর বাঁধা দেবো না। আর যাই হোক, আমার ছেলে কোনোদিন ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না। তাতে আমার বিশ্বাস আছে।”
তুর্য রুমে চলে যাওয়ার পর তাহমিনা বেগম বলেন,
“তুমি তুর্যকে না আটকিয়ে যেতে বলতেছ?”
“তোমার হাত থেকে বৌমাকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই।”
বিছানায় টান হয়ে শুয়ে বলেন তিনি। তাহমিনা বেগম ক্ষেপে বলেন,
“কী বলতে চাইছ তুমি?”
“এটাই বলতে চাচ্ছি যে, তুমি একটা বাজে শ্বাশুরী। এখন আর বিরক্ত করিও না। একটু বিশ্রাম নিতে দাও।”
রাগে সাপের মতো ফুসতে থাকেন তাহমিনা বেগম। তিনি যা চেয়েছিলেন তার উল্টো হচ্ছে এখন। ছেলে এবার সত্যিই হাত ছাড়া হয়ে গেল!
—————————
বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় দিশান খুব কেঁদেছে। পরী নিজেও কেঁদে ফেলেছে। তুর্য বলেছে থাকার ব্যবস্থা করে তারপর দিশানকেও আমাদের সাথে রাখবে। টাইগারকেও দেখে এসেছে। এখন যাচ্ছে পরীদের বাসায়। আজ রাতটা ঐ বাড়িতেই থাকবে। কাল নতুন বাসা খুঁজে নেবে। পরী বাড়িতে ফোন দিয়ে মাকে সব জানিয়েছে। বাবা যেন উত্তেজিত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে বলেছে। পরী ভেবেছিল যাওয়ার সময় একবার হলেও তাহমিনা বেগম আটকাবেন। অন্তত তুর্যর দিকে তাকিয়ে হলেও। কিন্তু না তিনি থামাননি। সামনেও আসেনি আর। প্রান্তকে ফোন দিয়ে তুর্য বাড়ির কথা বলেছে। একটা বাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে। কারণ জানতে চাইলে বলেছে পরে বলবে। তিথি পরে বাড়িতে বাবার কাছে ফোন দিয়ে সব শুনেছে।
পরীদের বাসায় আসার পর কেউ কোনো অস্বাভাবিক ব্যবহার করেনি। আগে ওরা বাড়িতে আসলে সবাই যেমন ব্যবহার করত এখনো তাই করছে। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর সময় তুর্যর মলিন মুখটা দেখে কষ্ট হয় পরীর। কেঁদে কেঁদে বলে,
“আমার জন্য আজ আম্মুর থেকে তোমায় আলাদা হতে হলো। আমি সত্যিই খুব বাজে।”
তুর্য পরীকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
“আরে বাচ্চাদের মতো কাঁদছ কেন? এখানে তোমার তো কোনো দোষ নেই। তুমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছ মানিয়ে নেওয়ার। তাছাড়া তুমি তো চাওনি আলাদা হতে। এটা আমার সিদ্ধান্ত।”
“তবুও!”
“কোনো তবুও নেই। তুমি কোনো অন্যায় করোনি। দোষ যদি তোমার হতো তাহলে আমি কখনোই আলাদা হতাম না। মায়ের একটু বোঝা প্রয়োজন। উল্টো আমার নিজের খারাপ লাগে। আমার জন্য তোমায় কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।”
“উহ্! তোমার কোনো দোষ নেই।”
তুর্য হাসে। পরীকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“তুমি চিন্তা কোরো না। আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে। সুখের সংসার।”
.
পরেরদিন তুর্য বা প্রান্ত কেউই অফিসে যায়নি। মেহনুবা, তিথি আর প্রান্ত এসেছে পরীদের বাসায়। প্রান্ত আর তুর্য গেছে বাড়ি খুঁজতে। তিথি পরীর সাথে কথা বলছে। মায়ের এমন ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত তিথি। তবে এত মন খারাপের মধ্যেও মেহনুবা ভালো একটা খবর নিয়ে এসেছে। বাড়ি থেকে সাগর আর মেহনুবার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। সারাদিন তিনজনে একসাথে আড্ডা দেয়। তিথি আর মেহনুবার সাথে আড্ডা দিয়ে মন অনেকটা হালকা হয়ে যায়। দরজার আড়াল থেকে মেয়ের হাসি দেখেন রেহেনা বেগম।
সেই সকালে বের হয়েছে প্রান্ত আর তুর্য। এরমধ্যে দুপুরে শুধু ফোন দিয়ে পরী খেয়েছে নাকি জিজ্ঞেস করেছিল। আর এখন বিকেল চারটা বাজে। ফোন দিয়ে বলল তুর্যর অফিসের সামনের রোডে আসতে। কথা আর না বাড়িয়ে ফোনও কেটে দেয়। বোঝা যায় কিছু নিয়ে ব্যস্ত খুব। পরী মেহনুবা আর তিথিকে নিয়ে যায়। রাস্তায় আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল সেলিম। ওদেরকে দেখতে পেয়ে বলে,
“আমার লগে আহেন।”
সেলিম আট তলা একটা ফ্ল্যাটের তিন তলায় নিয়ে যায়। কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় প্রান্ত। ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা। ভেতরে আরো কয়েকজন ছেলে। সবাই ফ্লোরে এদিক সেদিক হয়ে বসে আছে। সোফায় এক কোণায় কপালে হাত রেখে তুর্য হেলান দিয়ে বসে আছে। পরীকে দেখে তৃপ্তির হাসি হাসে। সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই উবে গেল। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে পরীকে। পরী গিয়ে তুর্যর পাশে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে সব দেখে। ফ্লোরে বসে থাকা ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলে,
“ভাবি গো ঘর গুছাইতে যাইয়া জীবন শেষ। শুক্রবারে আমাদের একটু রান্না করে খাওয়াইয়েন। খুশি হব।”
পরী হেসে বলে,
“আচ্ছা। শুক্রবারে তাহলে সবার দাওয়াত রইল।”
তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“সারাদিন তাহলে এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলে?”
“হুম।” মাথা ঝাঁকিয়ে বলে তুর্য। পরীর হাত ধরে বলে,
“চলো রুম দেখবে। ঠিকঠাক আছে কী না।”
রুমে গিয়ে পরী হতবাক। ঘরের সব আসবাবপত্র এনেছে।
“এত টাকা কোথায় পেলে?”
“একাউন্টে টাকা ছিল তো। সংসার করব সুখের সংসার। সব তো থাকা লাগবে তাই না? আসো বারান্দায় যাই।”
পরীকে নিয়ে বারান্দায় যায় তুর্য। বলে,
“দেখো বারান্দা পছন্দ হয়েছে? তোমার জন্য বড় বারান্দা দেখে ফ্ল্যাটটা নিয়েছি। ফুলগাছের টব এনে দেবো বারান্দায় রাখবে।”
পরী তুর্যর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি এত ভালো হাজবেন্ড কেন?”
“তুমি ভালোবাসো তাই।”
রাতে সবার জন্য রান্না করে নিয়ে আসে রোজ আর রেহেনা বেগম। পরীর দরকারি সব জিনিসপত্র নিয়ে আসেন বাবা আর প্রিয়ম। রুম গোছানো যতটুকু বাকি ছিল সেটুকু তিথি, মেহনুবা আর পরী মিলে গুছিয়ে ফেলে। রাতে সবাই একসঙ্গে খায়। সবাই চলে যাওয়ার ওর তুর্য বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। খুব খাটনি গেছে আজ। শরীর ম্যাড়ম্যাড় করছে। পরীকে কাপড় গোছাতে দেখে বলে,
“এখন আবার কাপড় ভাঁজ করছ কেন?”
“গুছিয়ে রাখছি।”
“দরকার নেই এখন। রাখো এসব। কালকে করবে এগুলো।”
“আরে! বেশিক্ষণ লাগবে না তো।”
“না লাগুক। এখন করবে না মানে করবে না।”
পরীকে আর কাজ করতে না দিয়ে হাত টেনে বিছানায় বসায়। কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
“মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।” বলে তুর্য।
পরী হাসে। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মনে মনে হাজার ধন্যবাদ দেয় আল্লাহ্কে।
.
পরেরদিন ঘুম ভাঙে সকাল নয়টার দিকে। তুর্যর অফিস আটটায়। তুর্য এখনো ঘুমাচ্ছে। পরী তড়িঘড়ি করে ওঠে। তুর্যকে ধাক্কিয়ে বলে,
“উঠো তাড়াতাড়ি। লেট হয়ে গেছে তোমার। অফিসে যাবে না?”
“উহু! দু’দিন ছুটি নিয়েছি।” ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে তুর্য।
“আচ্ছা তাহলে ঘুমাও। আমি নাস্তা বানাই।”
“দাঁড়াও।”
চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বলে,
“কী?”
“আজকে দুজনে একসাথে নাস্তা বানাব।”
“বাহ্! কী ভাগ্য আমার।”
দুজনে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে যায়। তুর্য আটা গুলিয়ে দিয়েছে। পরী মোটামুটি সব রান্নাই পারে। কিন্তু রুটিটাই বানাতে পারে না। মানে রুটি গোল না হয়ে মানচিত্র হয়ে যায়। তুর্য বলে,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? বানাও।”
“আমি রুটি বানাতে পারি না কচু।”
“কেন?”
“গোল হয় না রুটি।”
“আচ্ছা আমি শিখিয়ে দেবো। আমার সামনে বানাও।”
মানচিত্র বানিয়ে হাসির পাত্রী হতে চাইছে না পরী। কিন্তু তুর্যও নাছোড়বান্দা। তুর্যর সাথে তর্কে না পেরে রুটি বানাতে রাজি হয়।পরীর রুটি বানানো দেখে তুর্য হেসে কুটিকুটি অবস্থা। পরীর হাত থেকে বেলন নিয়ে বলে,
“তোমাকে রুটি বেলতে বলেছি। বাটতে বলেনি। যেভাবে বানাচ্ছ মনে হচ্ছে পাটায় বাটছ আটা।”
পরী নাকমুখ ফুলিয়ে বলে,
“এত পারো নিজে বানাও। তবুও বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হি হি, হা হা করে মজা নিবা না।”
পরীর কথা শুনে আর রাগ দেখে আরো জোরে শব্দ করে হাসে তুর্য।