সারারাত ঘুম হলোনা আমার।যদি আমি ঘুমোলে উনার কিছু হয় তাহলে কি করবো। একদম বুকের সাথে মনের কাছাকাছি মিশে রইলাম উনার সাথে।উনি আমাকে এমন ভাবে ধরে রেখেছেন যেনো আমি কোথাও হারিয়ে যাবো।ফজর এর আজান শেষে আমি উঠে পড়লাম।নামাজ পড়ে উনার সুস্হতার জন্য প্রার্থনা করে কিচেনে গিয়ে গরম ভাত রান্না করলাম,ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে ঝোল করলাম।কাল সারাদিন কিছুই খান নি উনি।আমার রান্না শেষ হলে তখন ও কেউ ওঠে নি।ঘরে খাবার নিয়ে রেখে দেখলাম ফ্লোরে উনার প্যান্ট পড়ে আছে,সিঁড়ি ঘরে তো কাল রাতে শার্ট আর এপ্রোণ খুলে রেখে এসছিলাম,দ্রুত পায়ে গিয়ে এপ্রোণ আর শার্ট নিয়ে এসে প্যান্ট সহ সব ধুয়ে ছাদে শুকাতে দিয়ে এলাম।রুমে এসে উনার কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর একটু কম হয়েছে।আস্তে করে ডাকলাম উনাকে।কয়েকবার ডাকতেই উনি চোখ খুললেন।
"আমাকে দেখে বললেন,তুমি এত সকালে উঠেছো কেনো?কাল তো সারারাত ঘুমোও নি।"
"আপনি না আমি বেশী ঘুমোয় বলে বকেন।আজ এত ঘুমোতে বলছেন কেনো?"
"কারণ ঘুমোও নি একটুও তাই।"
"পরে ঘুমোবো আগে উঠুন।আপনার জ্বর মাপতে হবে।"
"বিহান নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।কি ভাবছে সেটা তো বুঝতে পারছি না।"
আস্তে করে উঠিয়ে বালিস হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলাম।একটা শার্ট নিয়ে উনার গায়ে পরিয়ে দিলাম।শার্টের বোতাম লাগানোর সময় উনি বললেন,
"তুমি এত্ত কেয়ারিং একটা মেয়ে আগে তো জানতাম না।এইটুকু পুচকু মেয়ে স্বামির সেবাযত্ন করছে।আমি তো আগে জানতাম এই পুচকু মেয়েকে সারাজীবন ই আমার দেখেশুনে বেড়াতে হবে।কিন্তু নাহ মেয়েটা আমাকে সামলাতে শিখে গিয়েছে।"
"আমি শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললাম,যার স্বামি এতট কেয়ারিং তাকেও তো কেয়ারিং হতে হবে তাইনা।আর বলছি একটা বেবি নিলে কেমন হয়।"
উনি খুব জোরে কেশে উঠলেন।যেনো গলায় কিছু বেঁধেছে।চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললেন,
"কিছু বললে দিয়া।আর আমি কি ঠিক শুনলাম,নাকি কানে সমস্যা হলো আমার।জ্বর হওয়াতে কান ই নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার।"
"আপনার কানের কিছুই হয় নি। আমি বেবির কথা ই বলেছি।"
"বেবি।তুমি বেবির কিছু বুঝো।বেবি পালন করতে পারবে।"
"যখন মেয়েরা মা হয়না,তখন সব পারে।দায়িত্ব আপনা আপনি চলে আসে।"
"তুমি কি সিরিয়াস বেবি নিতে চাইছো?ভ্রু উঁচিয়ে বললেন।"
"হ্যাঁ। সত্যি চাইছি।"
উনি এক গাল হেসে বললেন,
"হঠাত এই বুদ্ধি কে দিলো।"
"শার্টের বোতাম লাগানো শেষ হলে পানির পট এগিয়ে বললাম,পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন।খাবার খেতে হবে ওষুধ খেতে হবে।"
"ব্রাশ ছাড়া আমি খাবার খাবো।"
এমন ভাবে বললেন যেনো আমি কোনো অখাদ্য খেতে বলেছি।
"জ্বর হলে কি ব্রাশ করা লাগে।"
"ব্রাশ ছাড়া চুমু খাওয়া যায় বালিকা কিন্তু ভাত খাওয়া যায় না।ব্রাশ এগিয়ে দাও, বাড়িতে তো ব্রাশ রেখে গেছিলাম।"
আমি ব্রাশে পেষ্ট মাখিয়ে এনি দিলাম।উনি আস্তে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে ব্রাশ শেষ করে বেরিয়ে এলেন।আবার এসে বালিশ হেলান দিয়ে বসলেন।
আমি ভাত মেখে উনার গালে তুলে দিতে দিতে বললাম,
"বেবি নেওয়ার ব্যাপার টার কি হলো। কিছু তো বললেন না।"
"হঠাত এই বুদ্ধি উদয় হলো যে। "
"কাল ইউটিউবে সার্চ করে দেখেছি স্বামি স্ত্রীর ঝগড়ার সমাধান নিয়ে।সেখানে ভিডিও তে বলেছে একটা বাচ্চার অভাবে দাম্পত্য জীবনে সৃষ্টি হয় অশান্তি।আমিও ভেবে দেখলাম আমাদের একটা বাচ্চা প্রয়োজন।তাহলে আমাদের আর ঝগড়া হবে না।"
"আমি তো ঝগড়া করিনা,তুমি মানুষের কথা শুনে ঝগড়া করো।"
"বললাম তো সরি আর হবেনা।কিন্তু আমার বেবি চাই।"
"তোমার বেবি ক্যারি করার বয়স হয়নি এখনো।আরো পাঁচ বছর পরে বেবি নিবো আমরা।তোমার লেখাপড়া শেষ হোক আগে।"
"দেখুন শুনেছি,বিয়ের অনেক দিন হয়ে গেলে নাকি আর বেবি হয় না।পাশের বাসার আন্টিরা রোজ বলে এতদিন বিয়ে হয়েছে এখনো বেবি নিলে না।বাচ্চা কাচ্চা হয়না, কোনো সমস্যা থাকলে ডাক্তার দেখিয়ে নাও।"
"তুমিও বলবা জাস্ট বিয়েই হয়েছে চাচীআম্মারা ইয়ে হয়নি।"
"ইয়ে টা কী।"
"ইয়ে ইয়ে ইয়ে আসলেই ইয়ে মানে কিয়ে।"
"ইয়ে ফিয়ে বুঝিনা।আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।আসলেই যদি আর বেবি না হয় আমার।"
"আউচ!এইসব মাথায় ঢুকালো কে তোমার।আল্লাহ যখন দিবে তখন হবে।আর তুমি কি দুনিয়ার যাবতীয় সমস্যার সমাধানের হেল্প গুগল আর ইউটিউব থেকে নাও।"
আমি হেসে দিলাম।উনার খাওয়া শেষে ওষুধ খাইয়ে বললাম এবার সুয়ে পড়ুন।আমি বাইরে যাচ্ছি।
চলে আসতেই শাড়ির আঁচল টেনে ধরলেন।
"পেছনে তাকিয়ে বললাম,কি হলো আবার।"
"কি ভেবেছো আমি খেয়াল করবো না।শাড়ি পরলে কখন।"
"সকালেই"
"কেনো?আমার মাথা খারাপ করতে।"
আমার বেশ লজ্জা লাগছে উনার কথা শুনে।নিচের ঠোঁট কামড়ে দুই হাত কচলাচ্ছি।
উনি বললেন,
"বলেছি না আমার সামনে এসে এইভাবে ঠোঁট কামড়ে ধরবে না,আর ঠোঁট ও ভেজাবে না বার বার।আমার মাথা ঠিক থাকে না এইভাবে দেখলে।"
"জ্বরে কি মাথা পুরাই গেছে আপনার।ভুলভাল কথা বলছেন।"
"বালিকা তুমি শাড়ি পরিয়া মসৃণ পেট বের করিয়া ঘুরঘুর করিতেছো।মাথা তো পুরাই যাবে।উনার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।"
আমি তাকিয়ে দেখি পেট বের হয়ে আছে, এইজন্য শাড়ি পরতে ইচ্ছা করেনা।ম্যানেজ ই করতে পারিনা।দ্রুত শাড়ি টেনে ঠিক করে নিলাম।উনি আমার আঁচল সহ আমায় কাছে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললেন,যাও এবার।
আমি চলে আসতেই বললেন,
"আরে সত্যি চলে যাচ্ছো মেডিসিন দিয়ে যাবে না।"
"দিলাম না।"
"উহু!অন্য মেডিসিন।ভালবাসার মেডিসিন।"
কপালে একটা চুমু দিয়েই দৌড় দিলাম।দিন দিন কি হয়ে যাচ্ছে এই মানুষ টা।
মারুফা খালা উঠান,ঘর বারান্দা সব ঝাড়ু দিচ্ছে।কাল বৃষ্টিতে ধুলাবালিতে ভরে গিয়েছে।মামি রান্নাঘরে গিয়ে বেশ অবাক এত সকালে রান্না করলো কে এটা ভেবে।আমাকে দেখে বললো,
"দিয়া এত সকালে কে রান্না করলো তুই।"
"হ্যাঁ মামি।তোমার ছেলেকে খেতে দিলাম।"
"আমাকে ডাকলি না কেনো?"
"তুমি আর কত করবে যাও তোমার ছেলের কাছে।দেখে এসো যাও।"
দিয়া কত বড় হয়ে গিয়েছিস তুই।সত্যি আমার খুব ভাল লাগছে দেখে।তুই আর বিহান ভাল থাকলেই আমার শান্তি লাগে মনে।
"তুমি তো আমার বেষ্ট শ্বাশুড়ি মা।"
"পাগলি মেয়ে।বিহান কে দেখে আসি আমি দিয়া।"
"আচ্ছা যাও।"
--------------------------------------------------------
আমার বাবা যে এতটা অসুস্থ আর আমি জানতেই পারলাম না।আমার জীবনের প্রথম পুরুষ মানুষ ই হলো বাবা।যে না চাইতেই অনেক বেশী ভালবাসা দিয়েছে।বাবাকে ফোন দিলাম দুইবার কিন্তু ফোন তুললো না।ফোন রেখে ভেবে যাচ্ছি কি করবো।কিছুক্ষণের মাঝেই বাবা কল ব্যাক করলো।
--আসসালামু আলাইকুম বাবা।
--ওয়ালাইকুম আসসালাম মা।
কেমন আছো বাবা তুমি?
--ভাল আছি বাবা শুনেছি তুমি অসুস্থ আমাকে তো বলোনি।
--তুমি কাঁদছো কেনো মা?আমার কিছুই হবেনা।বয়স হচ্ছে শরীর তো দিন যাবে আর খারাপ ই হবে।
--আমি কাঁদবো না কেনো?আমার বাবা অসুস্থ আর আমি জানিইনা।তোমার কি অনেক খারাপ লাগে বাবা।
--আরে মা না।বিহান তো দেখছে আমাকে।সুস্থ হয়ে যাবো।আমার জামাই এত বড় একজন ডাক্তার আমি কি সুস্থ না হয়ে যাবো।
--তোমার জামাই ও অসুস্থ তার অনেক জ্বর।
জ্বর নিয়ে কাল বাড়িতে এসছে।
--একটু পরে গিয়ে দেখে আসবো।
কেটে গেলো চারদিন, চারদিন পরে বিহান সুস্থ হলো।দুইদিন পরে আমার আর রিয়ার এডমিশন।ভাইয়া, আমি, রিয়া,বিহান আর বিভোর ভাই মিলে ঢাকায় রওনা হলাম।বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে চিন্তায়।জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা মনে হয় এডমিশন।মুখ শুকিয়ে গিয়েছে রিয়া আর আমার।আম্মু বার বার বলে দিয়েছে ঠান্ডা মাথায় লিখতে,কেননা পারা জিনিস ঘাবড়ে গিয়ে ভুল করি আমি।সবার দোয়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।পথে একজন মহিলা রিয়াকে বললো,দিয়ার কত আগে বিয়ে হয়ে গিয়েছে তোমার তো বেশ বয়স হলো বিয়ে হবে না।কিছু মহিলা আছে মেয়েদের ষোলো পেরোনোর সাথে মনে করে যেনো আহামরী বয়স হয়েছে।মা বাবার সাথে যেনো তাদের চিন্তা বেশী।এমনিতে রিয়া চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে তার উপর এমন বিশ্রি কথা শুনে বিহান এর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো রাগে।কিছু বলতে যাবে বিভোর ভাই আটকে দিলেন।বিভোর ভাই বললেন,
--আন্টি আপনার বয়সী,এমনকি আপনার থেকে কম বয়সী অনেকেই মারা গিয়েছে।আপনি এখনো বেঁচে আছেন কিভাবে?কবে ম*রবেন।
মহিলাটি যেনো বেকুব বনে গেলো।আমি আর ভাইয়া ফিক করে হেসে দিলাম।
মামাদের প্রাইভেট কারে চড়ে রওনা হলাম আমরা।