এক সমুদ্র প্রেম

ধূসরের অপেক্ষা ফুরোচ্ছেনা। আর কতক্ষন বসে থাকবে এভাবে? সে বেজায় বির*ক্ত। ফোন টি*পতে টি*পতে অসহ্য লাগছে এখন। তবুও উঠে রুমে গেল না। আগে ছেলেটাকে দেখবে তারপর যাবে। এমন কোন রাজপুত্র, যাকে পিউয়ের এত্ত পছন্দ! সে আরেকবার চকচকে সাদাটে হাতঘড়িটা দেখে নেয়। কমসে কম বিশ মিনিট ধরে বসে আছে এখানে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটাতে রাশিদ মজুমদার ঢুকলেন। সাথে আনিসের বয়সী এক ভদ্রলোক। কথা বলতে বলতে আসছিলেন দুজন। পেছনে রয়েছে আরো কজন। ধূসর গলার আওয়াজ শুনে বিদ্যুৎ বেগে তাকাল। ভাবল এই বুঝি অনাকাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত মানুষটি এলো। ওকে বসা দেখেই রাশিদ মজুমদার থেমে গেলেন। বললেন,
” কী ব্যাপার বাবা,তুমি রুমে যাওনি?”
ধূসর উঠে দাঁড়াল।
” কিছু দরকার?”
” না,আসলে পরে যাব ভেবেছিলাম। ”
পেছন থেকে নারীটি শুধালেন,
” ছেলেটি কে দুলাভাই?”
” হু? মিনা আপার মেজো জায়ের ছেলে। ”
ধূসর ওনাকে সালাম দিলো। রাশিদ পরিচিত করালেন,
” উনি হলেন পিউয়ের মামীর ছোট বোন,রূম্পা। আর ও ওর স্বামী মুস্তাফিজ রহমান। ”
ধূসর হেসে লোকটির সাথে করমোর্দন সাড়ল। অথচ তার মন, চোখ দুটোই রইল সদর দরজায়। সে রোহানকে খুঁজছে। ছেলেটা কী আসেনি? রাশেদ ওনাদের কাছে ধূসরের প্রসংশা স্বরুপ নানান কথা বললেন। তাদের হয়েও কিছু কথা ওকেও শোনালেন। বিধিবাম! একটাও ধূসরের মস্তিষ্কে গেল না। সে উদগ্রীব হয়ে বাইরে দেখছে। অনেকক্ষন গেলেও দরজা দিয়ে কেউ ঢুকছেনা,আসছেনা। শেষমেষ অধৈর্য হয়ে পরল ধূসর।
অস্থি*রতায় ভেতরটা টইটম্বুর হলো। কৌতুহল চে*পে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসল,
” রোহান আসেনি আঙ্কেল?”
রাশেদ মজুমদার ভ্রুঁ গুঁটিয়ে বললেন,
” তুমি রোহান কে চেনো?”
ধূসর চটপট উত্তর দেয়,
” পিউয়ের কাছে শুনেছিলাম। আসেনি?”
” আমিইত রোহান। এই যে আমি, আমি।”
ছোট্ট বাচ্চা কণ্ঠ শুনে ধূসর চোখ নামায়। রূম্পা বেগমের আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে সরল চেহারার স্বাস্থ্যবান ছেলেটা হাত উঁচিয়ে বলল ‘ হাই।’
সাথে ফোঁকলা চারটে দাঁত বের করে হাসল। মাথা দুলিয়ে বলল,
” তুমি আমাকে খুঁজছো, কেন? ক্রিকেট খেলবে?”

ধূসর আকাশ ভে*ঙে ধপ করে মাটিতে পড়ল। হতবাক হয়ে বলল,
” ওর নাম রোহান?”
প্রশ্নটাও বেজে বেজে এলো গলায়। রাশিদ বললেন,
” হ্যাঁ। কেন, তুমি কি ভেবেছো?”
ধূসরের ভাবনাচিন্তা হযবরল হয়ে আসে।
” আপনাদের পরিবারে আর কোনও রোহান নেই? বর্ষার খালাতো ভাই?”
রূম্পা বেগম বললেন,
” আমিইত বর্ষার একমাত্র খালা বাবা। আমার এই একটাই ছেলে। তুমি কি অন্য কাউকে খুঁজছিলে?”
ধূসর আহাম্মক বনে থাকল কিছুক্ষন। রাশিদ ওর কাধে হাত রেখে চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
” কিছু হয়েছে?”
তৎক্ষনাৎ ওপর থেকে খিলখিল হাসি ভেসে আসে। ধূসর চোখ তুলে তাকায়। পিউ হাসিতে নুইয়ে পরছে। পাশে অবোধের মতো দাঁড়িয়ে সুপ্তি। ধূসরের বুঝতে বাকী নেই,পিউ তাকে কী মারাত্মক লেভেলের বোঁকা বানিয়েছে। রাশিদ সহ উপস্থত বাকীদের পিউয়ের হাসিটা মাথার ওপর দিয়ে গেল। তিনি শুধালেন,
” হাসছো কেন মা?”
পিউ চটজলদি স্বাভাবিক হলো। হাসিটা ঠোঁট দিয়ে চে*পে দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল ‘কিছুনা’। তারপর দ্রুত চলে গেল ভেতরে। ধূসর দাঁত চে*পে চোখ বোজে। মনে মনে কষে একটা থা*প্পড় মারে নিজেকে। তার মত ছেলে কী না একটা হাঁটুর বয়সী মেয়ের থেকে ধোঁ*কা খেল? ছি!

***
পিউ হাসতে হাসতে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পরল। হাঁটু দুটো ভাঁজ হয়ে পেট অবধি উঠে এসেছে। একবার ডান কাত হচ্ছে একবার বামে। সুপ্তি নির্বোধের মত দেখল কিছুক্ষন। কৌতুহলে চোখ পিটপিট করে বলল,
” ও পিউপু,হাসছো কেন তুমি?”
পিউ হাসির চোটে কথা বলতে পারছেনা। পেট -পিঠ ব্যা*থায় আঁটশাঁট। চোখ চিকচিক করছে। সুপ্তি শেষ মেষ বিদ্বিষ্ট হলো। ছোট মানুষ হলেও মেজা*জ উঠল তুঙ্গে। পিউ আপুর এই এক রো*গ,হাসি উঠলে আর থামেনা।
ধ্যাত! বলে সে পা ছু*ড়ে ছু*ড়ে বেরিয়ে যায় বাইরে। পিউ তখনও গড়াগড়ি খেয়ে হাসছে। চেষ্টা করছে,চাইছে, স্বভাবিক হতে। অথচ ধূসরের চেহারাটা মনে পড়লেই পেট চি*রেখু*ড়ে হাসি বের হয়। এখানে তার কী দোষ?

****

গায়ে হলুদের প্যান্ডেল বড় করে সাজানো হয়েছে উঠোনে। গ্রামের বাড়ি যখন, আশেপাশে জায়গা জমির অভাব নেই। কাকভোর থেকেই তার তোরজোড় শুরু। মশলা বাটাবাটির আওয়াজে পিউয়ের ঘুম সুবিধের হলোনা। সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে রাত করে ঘুমোলেও, উঠে পরেছে এখন। বর্ষার রুমে ঘুমিয়েছিল ওরা। পিউ,পুষ্প,বর্ষা এক ঘরে,এক বিছানায় । পিউ শোয়া থেকে উঠে বসে। দুহাত মেলা আড়মোড়া ভাঙে। হাই তুলতে তুলতে সামনে তাকাতেই দেখল বর্ষা পায়চারি করছে। হাতে ফোন। ব্যস্তভাবে মেসেজ করছে কাউকে। সে দুষ্টু হেসে বলল,
” সকাল অকাল প্রেমলীলা শুরু হু হু,? ”
বর্ষা কপাল কুঁচকে তাকায়। ভুল শুধরে দেয়ার ভঙিতে বলে,
” মোটেওনা। আমি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি।”
” আরে থাক বর্ষাপু,এসব বলে লাভ নেই। আমি কি ছোট আছি এখনো? আর তোমারই তো জামাই,নিয়ে যাব না আমরা। আমার চয়েস আবার অত বাজে না বুঝলে।”
” চ*ড় খাবি। আমি সত্যিই আমার বন্ধুর সাথে কথা বলছি।”
পিউ সন্দেহী কণ্ঠে বলল ” আসলেই? ছেলে না মেয়ে?
” মেয়ে।”
” এত সিরিয়াস মুড নিয়ে মেয়েরা, মেয়েদের সাথে কথা বলে?”
বর্ষা আনন কয়েক ধাপ কালো করে বলল,
” কী করব বল! ওর সাথে কথা হয়েছিল ও আমার বিয়ে, গায়ে হলুদ সবেতে থাকবে। অথচ এখন বলছে আসবে কাল। রা*গ হবেনা আমার?”

পিউ বিজ্ঞের ন্যায় মাথা দুলিয়ে বলল,
” অবশ্যই! কেন হবেনা? এইটুকু পথ, কাল আসবে কেন,আজ আসলে কী হয়?’
” এইটুকু পথ? ও ঢাকা থেকে আসবে পিউ।”
পিউ ভ্রঁরু উঁচিয়ে বলল,
” ওরে বাবাহ!তাহলে তো অনেক পথ।”

পুষ্প ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল ‘ সকাল সকাল তোদের ছেলে-মেয়ে বিয়ে দেয়া বন্ধ কর৷ ঘুমোতে দে আমাকে। এমনিতেই রাতে ঘুমোইনি। ”
বর্ষা বলল,
” সারা রাত চ্যাটিং করবি,আর রাতে ম*রার মত ঘুমাবি।”
ওমনি পিউ সচেতন কণ্ঠে শুধাল,
” সারা রাত কার সাথে চ্যাটিং করেছে আপু?”
পুষ্পর ঘুম ছুটে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকাল। দুদিকে মাথা নেড়ে বর্ষাকে ইশারা করল মুখ না খুলতে। পিউ পেছনে চাওয়া মাত্রই স্বাভাবিক করে ফেলল নিজেকে। বেচারী কিছুই বুঝল না। আহ্লাদী স্বরে বলল,
” ও বর্ষাপু বলোনা।”
বর্ষা কী বলবে বুঝল না। জোর করে হাসার চেষ্টা করল। এর মধ্যেই পুষ্প ধম*ক দেয়,
” তোর জেনে কাজ কী?যা নিচে যা।”
পিউর চেহারায় মেঘ জমে। সচরাচর পুষ্প তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনা বলে অভিমান হলো। আস্তেধীরে ঘর ছাড়ল। ধম*ক দিয়ে পুষ্পর নিজেরই খা*রাপ লাগল। অনুতাপ করে বলল,
” আহারে! সকাল বেলাই বকলাম। থাক,পরে আদর করে দেব।”
পুষ্প আবার চোখ বন্ধ করে। ঘুমোবে সে। বর্ষা সব শেষে ফোনে মন দেয়। ওপাশের ব্যাক্তিটিকে মেসেজ পাঠায়।
” আমি অতশত জানিনা,বিকেলের মধ্যে তোকে বাড়িতে দেখতে চাই ব্যাস।”

***
পিউ ভাবছে। এক্কেবারে হাবুডু*বু খাচ্ছে ভাবনায়। পুষ্প ধ*মক দিয়ে ঘর থেকে বার করতে পারলেও মাথা থেকে প্রসঙ্গটা বার করতে পারল না। তার জানামতে পুষ্প সদা সিঙ্গেল। কখনও দেখেওনি কারো সাথে কথা বলতে৷ সাদিফ ভাইয়ের সাথে না ওর বিয়ে হবে? তাহলে কী ওনার সাথেই রাত জেগে কথা বলেছে? ওরা কী তাহলে জানে এ ব্যাপারে? তার জানামতে এটাতো কারো জানার কথা নয়। সে নিজেওত জানতোনা,যদি না ওইদিন সেজো মায়ের ওয়াশরুমে থাকতো। তবে কার সাথে কথা বলছিল আপু?

পিউ ঠোঁট কা*মড়ে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল। অন্যমনস্কতায় সামনে যে পিলার পরেছে খেয়াল অবধি করেনি। যেই মাত্র মাথাটা ঠু*কে যেতে ধরবে ওমনি মাঝপথে হাত রাখল কেউ। পিউয়ের কপাল শুদ্ধ গিয়ে ঠেকল একটা ঠান্ডা হস্ত তালুতে। চমকাল সে। চকিতে তাকাল। ধূসরকে দেখতেই নুইয়ে যায়, দৃষ্টি নামায়। ধূসর হাত নামাল, রে*গে বলল,
” চোখ কই থাকে তোর? দেখে হাঁটতে পারিস না? মানুষ রাতকানা হয় শুনেছি, তুই কী দিনকানা?”

পিউ নীচু কণ্ঠে বলল,
” সবে ঘুম থেকে উঠেছি তো,তাই দেখতে পাইনি।”
বলতে বলতে চোখ তুলল । গলায় মাফলার পেঁ*চানো,গায়ে কালো জ্যাকেট পড়ুয়া ধূসরকে দেখে আটকে গেল দৃষ্টি। কয়েক পল চেয়েই রইল ওভাবে। ধূসর এদিক ওদিক তাকায়। কিছুতেই পিউয়ের সাথে দৃষ্টি মেলানো যাবেনা এমন। পিউ ধূসরের আপাদমস্তক দেখল। বরাবরের মতই ঘোষণা করল,
” ধূসর ভাই তার দেখা শ্রেষ্ঠ সুদর্শন পুরুষ! ”
কালো জ্যাকেটে কাউকে এত মারাত্মক লাগতে পারে? পারেইতো, এই যে ধূসর ভাইকে লাগছে।
পিউ অভিভূতের মতোন তাকিয়ে রয়। জ্বিভ খসে বেরিয়ে আসে,
” আপনি এত সুন্দর কেন ধূসর ভাই?”
ধূসর চট করে তাকাল। চোখ ছোট করে বলল ” কী?”
পিউ হুশে আসতেই ভ্যাবাচেকা খেল। পলক ঝাপ্টে বলল,
” না মানে হয়েছে কী….”
কথা খুঁজতে মাথা চুল্কাল। ক গোছা চুল এসে পরল চোখের পাশে। সবে ঘুম ভা*ঙা, এলোমেলো কেশ,ফোলা মুখচোখের পিউকে মনোযোগ দিয়ে দেখল ধূসর। শুকনো ঢোক গিল*ল। পরপর পিউয়ের চোখ ঢেকে দেয়া চুল সরিয়ে গুঁজে দিলো কানে। পিউ স্তব্ধ হয়ে তাকালো। চাউনিতে ধূসর অপ্রস্তুত হয়ে পরে। গলা ঝেড়ে বেরিয়ে যায় সদর দরজা থেকে।
**
” এই পিউ,তোকেই তো খুঁজছিলাম। কোথায় থাকিস?’
পিউ বিস্ময়াকুল হয়ে দেখছিল তার ধূসর ভাইয়ের প্রস্থান। সাদিফের হঠাৎ কথায় ধ্যান ভা*ঙে। সম্বিৎ ফেরে। সাদিফ কাছে এসে দাঁড়ায়।
” ফ্রেশ হয়েছিস তুই?”
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ল।
” এই বাড়িতে সুন্দর একটা বাগান আছে শুনলাম। চল দেখে আসি।”
সাদিফের উদ্বোলিত ভঙি। চেহারাতেও হাসি লেপ্টে। গ্রামে এসে প্রচন্ড এঞ্জয় করছে। শীত শীত ব্যাপারটাও দারুন এখানে। যতই শীত হোক, ঢাকায় অতটা বোঝা যায়না।
পিউ বলতে গেল,
” কিন্তু আমিতো… ”
সাদিফ পথিমধ্যে বলল ” আরে কিন্তু টিন্তু বাদ। চলতো…”
পিউয়ের কথা পাত্তা পায়না। রীতিমতো হাত টে*নেটুনে নিয়ে চলল সাদিফ।

***
আমজাদ আর আফতাব সিকদার রাশিদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন। আনিস আর তিনি গতকাল রাতেই পৌঁছেছেন এখানে। রাশিদ বয়সে অনেক ছোট তার। দুলাভাইকে একদম নিজের বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করেন রাশেদ। যে কোনও ভালো মন্দ কাজের পরামর্শ নেন। এখনও নিচ্ছেন। কী মেন্যু করলে ভালো হবে,কোন দিকে গেট করবেন, সব বুঝে নিচ্ছেন ভালো করে। ধূসর এসে তাদের কাছে দাঁড়ালো। প্যান্ডেলের বাইরে বাবুর্চিখানা বসবে। বিশাল বিশাল হাড়ি পাতিল জমা হচ্ছে সেখানে। মুত্তালিব ওকে দেখতেই বললেন
‘ কী ব্যাপার ধূসর,এত সকালে উঠলে যে? বুঝেছি, আওয়াজে ঘুম ভে*ঙেছে তাইতো?”
ধূসর শুভ্র হেসে বলল ‘ না আঙ্কেল, আমি সকালেই উঠি।”
” বাহ! বেশ ভালো গুন। ”
এরপর ধূসরের কাঁধ আগলে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
” আমার তোমাকে দারুন লেগেছে বুঝলে। একটা ব্যাপার পেয়েছি তোমার মাঝে। ”
ধূসর এবারেও হাসল। তিনি বললেন,
” তা বাবা ফিউচার প্ল্যান কী তোমার? রাজনীতি করছো শুনলাম।”
” জি। ”
” আমার রাজনীতির প্রতি তরুন বয়স থেকেই আলাদা ঝোঁক ছিল বুঝেছ। করেছিলাম কিছুদিন।”
” তাই? তাহলে কন্টিনিউ করলেন না কেন?”
মুত্তালিব শ্বাস ফেলে বললেন,
” কী করে করব বলো দেখি,বিয়েত নিজেরা পছন্দ করে করেছিলাম। আমার শ্বশুর মশাই মেয়ে দেয়ার আগেই শর্ত ছু*ড়েছেন,কিছুতেই ওসবের কাছে ঘেঁষা যাবেনা। অগত্যা আমিও আর এগোইনি। ভালোবাসাটাকেই বেছে নিয়েছি। তবে তোমার ব্যাপারটা ম*ন্দ লাগছেনা। ব্যাবসা,রাজনীতি সব এই কাঁধে। হা হা হা।”
মুত্তালিব হাসলেন। অথচ ধূসরের মুখে পরতে পরতে অন্ধকার ছেঁয়ে এলো। ভবিষ্যতের কোনও এক ভাবনায় আকুল হয়ে ওঠে মস্তিষ্ক। তার রাজনীতি, শেষমেষ তারই প্রতিকূলে যাবে না তো?

‘ আচ্ছা ধূসর,বলোতো বাবা, কোন দিকে স্টেজটা করলে ভালো হবে? বামে করব,না কী ডানে? ডানে আবার সদর গেটটা সামনে পরে। কী করা যায়,একটু বুদ্ধি দাওতো।”
ধূসর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে ধাতস্থ করে। নিচের ঠোঁট কা*মড়ে আশপাশ দেখে। হুট করে নজর আটকায় সাদিফ আর পিউয়ের দিকে। হাত ধরাধরি করে হাঁটছে তারা। ধূসরের কপালে ভাঁজ পরল। আগ্রহভরে চেয়ে রইল।

পিউ সাদিফের দীর্ঘ কদমের সঙ্গে কূলোতে না পারলেও তাল মেলাচ্ছে। মূলত সাদিফটাই টেনে নিচ্ছে ওকে। তার মাথায় তখনও ঘুরছে ধূসরের কথা। ইদানীং ধূসর যা যা করছে তিন বছরে করতে দেখেনি। মানুষটা বিদেশ থেকে ফিরে মধু মিশিয়ে কথা বলতো। হুটহাট বদলে গেল। ধম*কাত,চোখ রাঙা*ত। তারপর এতদিন ধরে ভালো করে কথাও বলেনি, তাকানো তো দূর। অথচ এখন প্রায়ই চোখাচোখি হচ্ছে। বেখেয়ালে তাকালেও দেখছে ধূসর তার দিকে তাকিয়ে। যেন সব সময় ওকেই দেখছে। কী মানে এসবের?

বিভ্রান্ত পিউয়ের ভাবনার সুতোতে টান লাগে সাদিফের উচু কণ্ঠে। তড়িৎ বেগে ঘুরে তাকায় সে। সাদিফ হাত ছেড়ে দূরে গিয়েছে অথচ সে খেয়ালও করেনি। পিউ আহত শ্বাস নেয়। বিড়বিড় করে বলে,
” হায়রে ধূসর ভাই! আপনার জন্যে আমার ধ্যান জ্ঞান ডিভোর্স দিলো আমাকে। ”

উঠোনের পাচিল জুড়ে অসংখ্য মর্নিং গ্লোরিস ফুটেছে। শ্যাওলা পরা দেয়ালে নীল রঙ বেশ লাগছে দেখতে। এছাড়াও আশেপাশে গাঁদা,গোলাপ,ডালিয়া গাছের চারা লাগানো। কিছুতে ফুল ফুটলেও কিছুতে কলি এসেছে সবে। সাদিফ মর্নিং গ্লোরির কাছে এগিয়ে যায়। পকেট থেকে ফোন বের করে ফটাফট কিছু ছবি তোলে। মুগ্ধ হয়ে আওড়ায়,
” সুন্দর না ? ”

পিউ ছোট করে বলল ‘ হু।’
সাদিফ একটা ফুল ছিড়ে হাতে নেয়। এগিয়ে আসে। হুট করে পিউয়ের কানে গুঁজে দেয়। আচমকা ঘটনায় পিউ বিহ্বল হয়ে তাকায়। তৎক্ষনাৎ দূরে দাঁড়ানো ধূসরের হাত মুঠো হয়। সাদিফ বিমোহিত হেসে বলল,
” ফুল গাছে সুন্দর জানি, অথচ আমার মনে হচ্ছে ওকে তোর চুলে বেশি মানিয়েছে। ”
পিউ হেসে বলল,
” থ্যাংক ইউ।”
সাদিফ দোলনা দেখিয়ে বলল ‘ চল ওদিকে যাই।”
আবারও তার হাত ধরে সাদিফ। পিউ আনন্দ সমেত এগোয়। সাদিফ ওকে বসালো। সামনে এসে ফোন উঁচিয়ে বলল,
” তুই বোস,আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।”

পিউ তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। আপত্তি করে বলে,
” না না আমি চুলটাও আচড়াই নি। এভাবে ছবি তুলবেন না,ভাইয়া। বি*শ্রি আসবে।”
” কে বলল? সুন্দর লাগছে তো।”
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ে,
” না। এক কাজ করি,আপনি অপেক্ষা করুন,আমি যাব আর আসব। ”
” কোথায় যাবি?”
” সেজেগুজে আসি?”
সাদিফ তব্দা খেয়ে বলল,
” এ্যা?”
” হ্যাঁ। আসছি দাঁড়ান।”
পিউ উঠতে নিলেই সাদিফ বাঁ*ধা দিলো,
” না। এভাবেই ভালো লাগছে। চুপচাপ বোস। ”
পিউ করুন কণ্ঠে বলল,
” অন্তত একটু লিপস্টিক দিয়ে আসি ভাইয়া?”
সাদিফ হাটুমুড়ে বসে ক্যামেরা অন করল। কথাটায় চোখ রা*ঙিয়ে বলল,
” তুই চুপ করে বোসবি?”
পিউ ঠোঁট উলটে বসে থাকে। সাদিফ ফোন চিৎ- কাত করতে করতে বলে,
” পোজ দে।”
পিউ দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে বসে পোজ দেয়। মুত্তালিব নিষ্পৃহ ধূসরকে বললেন,
” কী ধূসর, বলো কিছু। ”
জবাব এলোনা। শুনেছে কী না সন্দেহ। তিনি এবার উঁচু স্বরে ডাকলেন,
” এই যে ধূসর বাবা! ”
ধূসর নড়ে ওঠে। ডাকটা পিউ অবধি পৌঁছে যায়। ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সেদিকে তাকায়। ধূসর এদিকেই চেয়ে। শ*ক্ত চিবুক,হাড় হিম চাউনী।
‘ তুমি তো কিছু বলছোনা,কোন দিকে করতে বলব।”
ধূসর জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। হাসার চেষ্টা করে বলে,
” বামদিকে ভালো হবে। ”
মুত্তালিবের পছন্দ হলো।
” তাহলে এটাই পাঁকা কী বলো!”
” জি।”
মুত্তালিবের কাঁধে প্যান্ডেলের দায়িত্ব বর্তেছে। দ্বিধায় ভুগছিলেন কী করবেন সে নিয়ে। একটু আইডিয়া পেয়ে ধূসরকে রেখেই দ্রুত এগোলেন ভাইকে জানাতে। এরপর আরেকবার পিউয়ের দিক তাকাল ধূসর। দৃষ্টি অদ্ভূত,দূর্বোধ্য। লম্বা পায়ে ফের ঢুকে গেল বাড়িতে। পিউয়ের মাথা ভেদ করে গেলেও সে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায়। কাজে ব্যা*ঘাত ঘটল সাদিফের। শুধাল,
‘ কী হলো?”
” আর তুলতে হবেনা ভাইয়া। থাক এখন।”
কোনও মতে বলেই সেও ঘরের দিক ছোটে। সাদিফ কিছুই বোঝেনি। ওদিকটায় কতক্ষন চেয়ে থেকে ফোনের স্ক্রিন সামনে ধরল। এতক্ষন ধরে তোলা পিউয়ের ছবিগুলো দেখতে দেখতে চশমাটা ঠেলে মুচকি হাসল।

***

পিউ প্রত্যেকটা ঘরে গিয়ে গিয়ে উঁকি মারছে৷ রাতে ধূসরকে কোন ঘরে থাকতে দিয়েছে সে জানেনা। গ্রামের বাড়ির হাড়কাঁপানো ঠানায় সেই যে খেয়ে রুমে গেল,লেপের তলায় ঢুকল, আর বেরই হয়নি। তাই এখন তিন তলার প্রত্যেকটি ঘর খুঁজে ম*রতে হচ্ছে। ধূসর ভাই তখন ওভাবে তাকালেন কেন? কেন ওরকম করলেন? তিনি কি রা*গ করেছেন?
জানতেই হবে। নাহলে আজ দুপুরে ভাত খেলেও হজম হবেনা। পিউ ক্লান্ত হলো। হার মানল। তবুও ধূসরকে পাওয়া গেল না। লোকটা তো বাড়ির ভেতরেই এসেছে দেখল,গেলটা কোথায় তাহলে?
ছাদে? হ্যাঁ, ওখানে থাকতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে পিউ ধুপধাপ পা ফেলে ছাদের দিকে ছুটল।

ধূসর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। কুয়াশা কে*টে অল্প স্বল্প রোদের দেখা মিলেছে। সরাসরি পিঠে এসে লাগছে তার। হাত ভর্তি কাপড়ে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠল শান্তা৷ সব গুলো আধা-শুকনো। এখন রোদে দিলে বাকীটাও শুকিয়ে যাবে। ছাদে আসতেই ধূসরকে দেখে থমকাল সে। ধূসর পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শান্তা গুঁটিয়ে আসে। মাথায় ঘোমটা টানে। সুধীর পা ফেলে আস্তে আস্তে দড়িতে কাপড় মেলে দেয়। মাঝে মাঝে, আড়চোখে দেখে নেয় তাকে। ধূসর হঠাৎই ঘুরে তাকাল। ওমনি চোখাচোখি হলো দুজনের। চটপট আঁখি ফেরাল শান্তা। অপ্রতিভ হয়ে পরল। কী করবে, কোথায় তাকাবে! নার্ভাসনেসে মাথা নুইয়ে মেলে দেয়া কাপড়টা গোঁটাল,পরপর আবার মেলল। ধূসর দেখেও দেখলোনা ওসব। পকেট থেকে ফোন বের করে নিউজফিড অন করল। শান্তার কাজ শেষ অথচ যাচ্ছেনা। ক্ষনে ক্ষনে চোরা চোখে তাকাচ্ছে তার দিক। ধূসরের বুঝতে বাকী নেই। ফোন থেকে চোখ তুলল এবার। মেয়েটার খুশখুশ করা দেখে প্রশ্ন করল,
” কিছু বলবে?”
হঠাৎ প্রশ্নে শান্তা ভড়কে যায়। নিরব পরিবেশে ধূসরের গভীর স্বর তার লোম কাঁ*পায়। ঘনঘন দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝায় ‘ না। ‘

ধূসর সোজাসাপটা শুধাল,
” তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”

শান্তার মুখস্রী থমথমে হলো। আস্তে করে বলল “যাচ্ছি। ”
নিচে নামতেই পথে বাঁধল পিউ। সে দুরন্ত পায়ে আসছিল৷ ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায় সে। একবার ওপর দিক চেয়ে বলে,
” ছাদে যাচ্ছো পিউপু?”
পিউ ব্যস্ত কণ্ঠে বলল” হ্যাঁ, সর সর।”
শান্তা হাত দিয়ে রাস্তা আটকে বলল ” যেওনা। উনি নিষেধ করেছেন।”

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.