অপেক্ষা | পর্ব – ৪৪

পর্ব – ৪৪

(১০৯)
ফযরের আলো ফুটেছে সবে।নামাজ তিলাওয়াত শেষে শুয়েছেন আরহাম।কপালে কনুই রেখে সোজা হয়ে ঘুমিয়ে আছেন।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে!গত তিন চারদিনের গরমের উত্তাপের পিঠে অসময়ের এ বৃষ্টি যেনো আশীর্বাদস্বরুপ।ঠান্ডায় গা যেন শিউরে উঠছে।কমল নিয়ে আরহামের একটু কাছে আসলো আদওয়া।

কিছু একটা ভাবে,তো মুখ উঁচু করে আরহামকে দেখে।ক্রমাগত কয়েকবার এমন করে সিওর হয়,লোকটা ঘুমিয়ে গেছেন।কিন্তু ওর তো ঘুম কোনোমতেই আসছে না।উঠে উনার প্রতি ঝুঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল উনাকে।

আরহামের লম্বা ঘন দাঁড়িতে আলতো হাত রেখে বেণী পাকানোর চেষ্টা করে।বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়ি নিয়ে একপ্রকার উঠে পড়ে লেগেছে। একসময় আরহামের দিকে হঠাৎ চোখ যেতে দেখে,উনি চোখ বুজেই মুচকি হাসছেন।

আদওয়া লজ্জা পেয়ে একটু দূরে সরেই কমল দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লো।আরহাম হেসে ওকে কাছে টেনে বুকের মধ্যে এনে শোয়ালেন।আদওয়া তো অবাক!আদওয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন, ‘আপনিও ঘুমোচ্ছেন না আমাকেও ঘুমোতে দিচ্ছেন না।চুপচাপ ঘুমান তো।’

বিস্ময়ে,লজ্জায় পড়ে চুপচাপ আরহামের বুকে পড়ে রইলো সে।আরহামের এত কাছে ওর প্রথম আসা।হৃদপিণ্ড ধুকপুক ধুকপুক করে বেজেই চলছে।উনি কি শুনতে পাচ্ছেন!’

******
দূপুরের খাবারের পর সবাই যখন যে যার রুমে তখন আদওয়ার অলস সময় কাটছে।ইচ্ছে করছে কারো সাথে কথা বলতে,গল্প করতে।রুম থেকে বেরিয়ে চুপি চুপি মাইমুনার রুমে উঁকি মারতেই ধরা পড়ে সে।মাইমুনা মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘আদওয়া?’
দরজা থেকেই উত্তর দিল ‘জ্বি আপু।’

‘আসতে পারো।’

আদওয়া আসলো।

মাইমুনা পাঁচ মিনিট ওকে পরখ করে হেসে ফেললেন।সে স্ট্যাচু হয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেনো কেউ তাকে ধমক দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার শাস্তি দিচ্ছে।

মাইমুনা ঠোঁট কামড়ে হেসে তাকে বসতে বলল।আদওয়া ঝটপট বসে পড়লো মাইমুনার পাশেই।অল্প কিছুক্ষণ কথা বলতেই সে রাজ্যের গল্প জুড়ে বসলো।তোতাপাখির মতো কথা বলছে আর ঠোঁট নাড়িয়ে হাসছে।

আদওয়ার সাথে কথা বলার মাঝেই আরহামের ফোন এসে ঢুকলো।আদওয়া ফিরে গেলো নিজের রুমে।

সালাম বিনিময় হতে বললেন, ‘বাসায় কি কেউ এসেছে?’

‘উহু,কেনো?’

‘আপনার বাসার কেউ?’

‘জ্বি না কেনো?’

‘কিছু না।’

‘কিছু তো হয়েছে প্লিজ বলুন।’

‘কিছু না’ বলে তিনি ফোন কেটে দিলেন।

ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আরহাম।মাইমুনার মা যেনো উঠে পড়ে লেগেছেন আদওয়াকে নিয়ে।মেয়ে জামাই দিয়ে ফোন করিয়ে কথা শোনাতেও ছাড়লেন না!আঘাত পেয়েও চুপ থাকলেন আরহাম।সঠিক সময় এসে সবাইকে বুঝিয়ে দিবে,কে ভুল আর কে সঠিক।

******
বিকেলে বাবা-ছেলে একসাথেই বেরোলেন।আরহামকে সাথে নিয়েই বাজার করবেন আজ।নির্ষ্কমা ছেলেকে বাজার করা শিখাতে চান।তিন-তিনটে সংসার একসাথে সামলাচ্ছে অথচ বাইরের দূনিয়ার হুষ নেই।

গলি পথের বড় সুপারমার্কেটটায় সবসময় ভিড় লেগেই তাকে।তাই গাড়ির বদলে বাইক নিয়ে বেরোলেন আরহাম।

কাঁচাবাজারে গিয়ে চারিদিকের ঘোলাটে গন্ধে নাক চেপে ধরলেন আরহাম।মাস্ক কিনতে গিয়ে এসে দেখলেন আব্বু কোথায়ও নেই।ভীড় পেরিয়ে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে মাংসের দোকানে গিয়ে পেলেন উনাকে।

চারিদিকে চোখ বুলিয়ে খোঁপে ভরা ঝাকে ঝাকে মুরগী দেখে বললেন, ‘এরা কি রাতে এখানেই থাকে?’

আব্বু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,’না বাড়ি যায়।সকাল হলে আবার এসে খোঁপে উঠে বসে থাকে।’

আরহাম আব্বুর দিকে ভীরু চোখে তাকালেন।বুঝলেন না আব্বু রেগে গেলেন কেন!অবান্তর কোনো প্রশ্ন তো করেন নি।

মাছের দোকানে গিয়ে মাছবিক্রেতার সাথে আব্বুর আলাপচারিতা দেখে বুঝলেন তারা উভয়ই পূর্ব-পরিচিত।মাছের দাম জিজ্ঞেস করে বাড়তি কুশল বিনিময়ও হলো তাদের।অতপর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরহামের বাহু ধরে দোকানদারের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এ হচ্ছে আমার ছেলে।আমি চলে গেলে মাঝেমধ্যে সে-ই আসবে।চোজ করার সময় তিন চারদিন আগের ফ্রিজড করা আইসমিক্সড মাছগুলোই চোখে লাগবে তার।ভাই আপনি কাইন্ডলি ভালো মাছগুলো বেছে দিয়েন তাকে।’

এমন মধুর অপমানে আরহাম লজ্জিত হলেন।হারে হারে টের পেলেন আব্বুর সাথে বাজারে আসার পরিণতি।দোকানদার কাকাটা উনার দিকে চেয়ে হেসে মজা নিতেও ছাড়লেন না।

ফল-সবজির দোকানে গিয়ে বললেন, ‘তুমি বলো কোনটা নিবে?’

আরহাম সবগুলোয় চোখ বুলিয়ে দোকানির উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, ‘ম্যাংগোষ্টীন,ক্যারামবেলা,কাস্টার্ড অ্যাপল,ব্লাক বেরী,আর কলিফ্লাওয়ার।’

বলা নামগুলো পুনরায় পুনরাবৃত্তি করলেন।কিন্তু দোকানি তখনো বোকার মতো তাকিয়ে আছে দেখে বুঝলেন না উনার বলায় কোথায় ভুল হলো।

পাশ থেকে আব্বু সবিনয়ে দোকানির উদ্দেশ্যে বললেন,
গাব,কামরাঙ্গা, আতাফল,কালো জাম, ফুলকপি, এগুলো প্যাকেট করে দিন।’

আরহাম এতক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ জিভ কেটে আব্বুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললেন, ‘সরি আব্বু।সরি সরি।মাই মিস্টেক।’

সর্বশেষ যাওয়া হলো প্রয়োজনীয় প্যাকেটজাত জিনিসের দোকানে।লিস্টমতো সবকিছু নেওয়া শেষে পেমেন্ট করার সময় আব্বুর কাছে ভাংতি পাওয়া গেলো না।তাই আরহাম কার্ড এগিয়ে দিতে ওয়ার্ডবয় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।আব্বু তখন অন্য দোকান থেকে ভাংতি নিয়ে ফিরে এসে উপস্থিত দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে একটু রেগেই বললেন, ‘সুপারমার্কেটকে কি তুমার সপিংমল মনে হচ্ছে? ‘
আরহাম কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন।দোকানটা তো বেশ উন্নত।কৌতূহল দমাতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের এখানে কার্ড দিয়ে পেমেন্ট হয় না?’

‘না স্যার।সুপারমার্কেটের কোনো সপেই কার্ড দিয়ে পে করা এভেইলএবল নয়।’

আরহাম আব্বুর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন।

‘বাসায় আসো।আর বাজার করার ইচ্ছে নেই।’

*******
ছাদ থেকে কাপড় নিয়ে ফিরছিলো আদওয়া।গ্লাস দিয়ে গেট বরাবর চোখ যেতেই থমকে যায় সে।আরহামকে বাইকে পুরো হিরোদের মতো লাগছে।ব্রেক কষে হেলমেট টা যখন মাথা থেকে তুললেন তখন চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আরহামের কপালে আঁচড়ে পড়তেই আদওয়া চমকালো।উথাল-পাতাল সুন্দর লাগছিল উনাকে।এগিয়ে এসে আরেকটু দেখতে চাইলে ততক্ষণে তিনি ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েন।

লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ক্রস করে দ্রুত নিচে নামতে চাইলে একেবারে শেষের সিঁড়িতে গিয়ে পা পিছলে কাপড় নিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে যায় সে।

শব্দ শুনে আরহাম রুম থেকে বেরোতে এসে দেখলেন সে ফ্লোরে বসে আছে।আরহাম তড়িৎ এসে হাত বাড়িয়ে ওকে তুলে সোফায় বসালেন।পেঁচিয়ে যাওয়া কাপড়গুলো হাত থেকে নিয়ে অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাথা পেয়েছেন?পড়ে গেলেন কীভাবে?’

কনুইতে ব্যাথা পেয়েছে।ছিলে গিয়েছে বেশকিছু জায়গা।আরহাম কামিজের হাতা একটু তুলে কাটা অংশ দেখে যেনো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কোথায়ও লেগেছে?’

‘পায়ে আঙুলে।’

আরহাম তাকে কোলে করে রুমে নিয়ে গেলেন।ফার্স্ট এইড বক্স এনে কনুইতে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।

পায়ে স্পর্শ করতেই আদওয়া অপ্রস্তুত হয়ে পা গুটিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ।

উনি জিজ্ঞেস করলেন,’কি হলো?’

‘পায়ে আমি লাগিয়ে নিতে পারবো।’

‘আমি দিলে কি সমস্যা?’

‘আপনি আমার পা ছুবেন।ক্ কেমন দেখায় না?’

আরহাম প্রত্যুত্তর না করে পা খানা হাতে নিয়ে মেডিসিন লাগিয়ে দিলেন।
পাশে বসে জিজ্ঞেস করছেন, ‘কীভাবে পড়ে গেলেন?তাড়াহুড়ো করছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেনো?’

‘আপনাকে দেখ…’

আদওয়া মুখে হাত চেপে ধরে।মুখ ফসকে কি বলে ফেললো!অন্যসব কথা বলে এ প্রসঙ্গ ঘুরাতে চাইলেও আরহাম স্থির এই কথায়ই অটল থেকে বললেন,

‘আমাকে দেখে?’

আদওয়া মুখ কাচুমাচু করে বলে,’আপনাকে দেখবো বলে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে…

এ পর্যায়ে আরহাম হেসেও চুপ হয়ে গেলেন।হাসি আটকাতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আদওয়া লজ্জা পেয়ে আটসাট হয়ে বসে রইলো চুপচাপ…

71★

১১০
গত হয়েছে বেশ কয়েকদিন।বিয়ের নিমন্ত্রণে এটেন্ড হতে না পারার দরুন আরহামের অস্ট্রেলিয়া ফেরত দূই আন্টিসহ তাদের পরিবার এসে আজকে হাজির।আরহাম জুমআর নামাজ পড়ে সবে বাসায় ফিরেছেন।নিচুমুখে তাদের সালাম দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে না চাইতেও কিছু কথা কানে আপোসে ভেসে আসে।আরহামের ঠান্ডা মস্তিষ্কে তড়িৎ বিজলি খেলে যায়।পুনরায় ফেরত এসে আদওয়ার রুমে যেতে দেখলেন সোফার কোণায় চুপচাপ বসে আছে সে।আরহাম গিয়েই প্রশ্ন করলেন, ‘আন্টি আপনাকে কি বলেছেন?তারা কি বলেছে আপনাকে?’

আদওয়া কিছুক্ষন চুপচাপ থাকে।অতপর মাথা নাড়িয়ে বলে, ক্ কি বলবেন?কিছু না তো।’

‘আমি আস্ক করেছি তারা কি বলেছে আপনাকে, সেটা আমাকে বলতে…নো মোউর এক্সট্রা ওয়ার্ডস’

আরহামের শক্তকন্ঠে আদওয়া ভয়ে চমকে যায়।বুঝানোর ভঙ্গিতে বলতে চেষ্টা করে, ‘ ত ত্ তারা কিচ্ছু বলেন ন ন নি আম্’

আরহাম হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অন্যদিকে ফিরে নিজের রাগ কোনোমতে কন্ট্রোল করে নিলেও আম্মুর রুমে গিয়ে সে রাগের হালকা দকল পড়লো দরজার ওপর।আরহাম রাগ নিয়েও আম্মুর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন।রুক্ষস্বরে বললেন, ‘মেহমান রা কখন এসছেন?’

‘তুমার আন্টি হয় তারা, আন্টি বলো।এইতো সকালে আসছেন।’

‘আদওয়াকে আঘাত দিয়ে কি কথা বলেছেন তারা?উনি কেন কাঁদতে হলো?হুয়াই?অ্যান্সার মি আম্মু?’

আরহামের রাগে লাল হয়ে যাওয়া রণমূর্তি চেহারা দেখে আম্মু দমে গেলেন।ধীরেসুস্থে বললেন,
”তেমন কিছু বলেনি।বাকি দূজনের থেকে যাস্ট একটু শ্যামলা…

‘তো আমার ওয়াইফ শ্যামলা হোন বা কালো হোন তাদের কী?’

‘আরহাম তুমি এমনভাবে কথা বলছো কেন?তারা আমার বোন হয়।’

‘আমাকে ভুল বুঝবেন না আম্মু।কিন্তু বাইরের মানুষ এসে কেনো তাদের আঘাত দিয়ে কথা বলবে।সংসার তো আমি করছি তাই না?আপনার পর আমার তিনস্ত্রী আমার কাছে পৃথিবীর সেরা সুন্দর তিন নারী।সো,কোনোদিন যেনো তাদের সৌন্দর্য নিয়ে কেউ কথা না বলে।’

কিছুসময় অতিবাহিত হলো।মাথা ঠান্ডা হলো,রাগ নামলো।কিছুপূর্বের কথাগুলো বলার জন্য আম্মুর কাছে ক্ষমা চেয়ে রুমে এসে দেখলেন, সায়হানের ছবিটা জুম করে দেখছে ফুলটুসি।আরহাম আর এগোলেন না।ফিরে গেলেন নিজের রুমে।

*****
হাফসা তখন রুম গুছিয়ে রাখছিলো।আরহাম গিয়ে তাকে বাঁধা দিয়ে সোফায় বসান।হাত থেকে চাদর নিয়ে বিছানা ঠিক করলেন, কাপরগুলো গুছিয়ে রাখলেন,আসবাব সঠিক জায়গামতো রেখে ঘর ঝাড়ু দিলেন, বারান্দার ফুলগাছে পানি স্প্রে করলেন, ওয়াশিং মেশিনের ভিজিয়ে রাখা কাপড়গুলো ধুয়ে রোদে দিয়ে আসলেন।পুরো সময়টুকু হাফসা চুপচাপ ছিলো।অথচ অন্যসময় হলে এতকিছু তো দূর,বিছানা অবধি নিজ হাতে গুছিয়ে নিতো।তাকে কিছু করতে দিতো না।আরহাম ক্লান্ত শরীরে এসে পাশে বসলেন।হাফসার দিকে নিঁখুত দৃষ্টিতে তাকালেন।তার সৌন্দর্য যেনো আরো তিনগুণ বেড়ে গেছে।গালগুলো ফুলিয়ে স্ট্যাচুর মতো তাকিয়ে আছে আরহামের দিকে।অন্যসময় হলে চোখে চোখ রাখলে লজ্জায় নেতিয়ে পড়তেন!এখন দৃষ্টি সরাচ্ছেন না কেন!

আরহাম ওর গোল গালগুলো টেনে আদূরে ভঙ্গিতে বললেন, ‘সেইমিকুইন!এত দীর্ঘ দৃষ্টি কেন?আমি ঘুমিয়ে থাকা বাদে অন্যসময় হলে তো এভাবে তাকান না!’

‘ঘুমিয়ে যখন থাকেন,তখন বুঝেন কীভাবে যে আমি আপনার দিকে তাকাই?’

আরহাম উনার শাহাদাত আঙ্গুলটা উনার বুকের বা পাশে তাক করে দেখিয়ে বললেন, ‘এখানের দৃষ্টি দিয়ে।’

‘বুকের ভেতর চোখ থাকে কিভাবে?’

আরহাম অদ্ভুত সুন্দর হাসি হেসে বললেন, ‘অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে।এখানটায় যাদের জন্য ভালোবাসা থাকে,তাদের জন্য আরেকটা ভিন্ন রকম জগৎ থাকে।বুঝলেন? ‘

‘বাস্তবে তিনটে আর বুকের ভেতরে কয়টা সংসার পেতেছেন?’

আরহাম হাত দিয়ে আঙ্গুল কষে কিছু গুণার চেষ্টা করতে বললেন, ‘ভিতর-বাহির সহ মোট ছয়টা।’

হাফসা ভেংচি কেটে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

‘হলোটা কি সোনামণির আম্মুর?’

‘আরও পাঁচ পাঁচটা বউ আমি সহ্য করবো কীভাবে?’

‘আচ্ছা বাদ,৪ টা ডিলিট।মাএ দূইটা আছে আর।’

‘কোন দূইটা?’

‘আপনি ভেতরে একটা,আর বাইরে একটা।’

‘উহু,সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকি?’

‘জেলাস হবেন না?’

‘উহু।’

‘কেন?খারাপ লাগবে না আমি যখন তাদের সাথে থাকবো?’

‘উহু,সয়ে গেছে।’

আরহাম আক্ষেপের সুরে বললেন,’সবাই যদি আপনার মতো ভাবতো,বুঝতো!’

সাথে সাথেই এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললেম, ‘আজই আপনার জায়গা চেন্জ হয়ে যাচ্ছে।নিচে আম্মুর পাশের রুমে থাকবেন এখন থেকে।আমি চাই না,আপনি বারবার নামা-উঠার কষ্ট ভোগ করুন।

‘আপনার রুম কে গুছিয়ে দিবে?’

আরহাম তার গ্রীবায় আলতো স্পর্শ করে বললেন, ‘আপনার সাথে বিশ হাত দূরত্ব নিয়ে আমি উপরে থাকতে পারবো না।আপনার সাথে আমিও শিফট হয়ে যাচ্ছি এক ঘরে।’

******
মাগরিবের আযানের তখনো ঢের দেরি।অথচ আরহামকে রেডি হয়ে কোথাও বেরোতে দেখে মাইমুনা জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’

‘নতুন একজন মেহমান আনতে।’

মাইমুনা আশ্চর্য্য হয়ে বলে,’চার নাম্বার কেউ বাকি ছিলো বুঝি?’

সে প্রশ্নাত্বক চোখে চেয়ে রইলো আরহামের উত্তরের আশায়।অথচ সামনের ব্যক্তির ভেতরে হৃদয় ফেঁড়ে যাওয়া যন্ত্রণা বয়ে গেলো সেটা বুঝার অনুভূতি টুকুই তার নেই।তার কৌতূহল দমাতে আরহাম হাসলেন।কাছের মানুষ এত যত্ন করে আঘাত দেয় কীভাবে!

কিছু লাগবে?বাইরে যাবো।’

মাইমুনা তখনোও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।একই সময় নামলো হাফসাও।নতুন মেহমানের কথা বলার সময় সেও শুনলো কিন্তু প্রশ্ন করলো না।

আরহাম হাফসার দিকে প্রশ্নাত্বক চোখে তাকালে, সে বলল,’উহু লাগবে না কিছু।ফিরবেন তাড়াতাড়ি।’

আরহাম পুনরায় হাসলেন।কিছু হাসি কষ্ট ঢাকতে,আর কিছু হাসি আনন্দ উড়াতে।একই হাসি,কিন্তু ভেতরের কারণ দূই ধরনের।

বিদায় নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন দুইজনের দূই এক্সপেকটেশন চোখে গেঁথে।

******
ইশার নামাজ পড়েই জায়নামাজেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সে।হুট করে কারো ছোট্ট হাতের আদূরে স্পর্শ পেয়ে ঘুমের মধ্যেই খানিক চমকে উঠলো।আধো বুলিতে ‘আদু আদু’ ডাকটা স্পষ্ট হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সে।সায়হানকে দেখেও বিশ্বাস হলো না ওর।পুনরায় চোখ মুখ কুঁচকে সত্যি সত্যি তাকে দেখতেই আরহামের হাসির শব্দ পায়।ভাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে একের পর এক চুমু দিতে থাকে গালে,চোখে মুখে।

খুশিতে চোখে পানি চিকচিক করছে আদওয়ার।সায়হানও চকলেট মাখানো ছোট্ট হাতজোড়া দিয়ে তাকে ধরে আছে।আদওয়া সায়হানের কপালে পুনরায় আদূরে স্পর্শ একে বলে,’ও কবে আসলো?মা বাবা এসেছেন?’

‘আসেননি।’

আদওয়া চরম অবাকত্ব নিয়ে বলে,’তাহলে তাকে কীভাবে…

‘আমি নিয়ে আসছি।আমার সাথে এসেছে।’

আদওয়ার খানিক মন খারাপ হলো হয়তো মা বাবা না আসায়।তবুও ভীষণ আশ্চর্য নিয়ে বলল, ‘ভাই আসলো আপনার সাথে?দুইদিনই তো মাএ দেখেছে।অপরিচিত কারো সাথে মিশে না।’

‘আসতে চায় নি।পরে যখন বললাম, ‘আদুপাখি যেখানে আছে সেখানে নিয়ে যাবো তখন রাজি হয়ে গেল।’

আদওয়া হাসলো।আরহাম সন্তুষ্টি খুঁজে পেলেন তার হাসিতে।যাই হোক,এত কষ্ট একটু তো স্বার্থক।

১১১
পকেটে হাত গুজে পাশাপাশি হাটছেন আরহাম।সকালের সুরভিত রৌদ্রের ঝলকানিতে আদওয়া আড়চোখে দেখছে ওর স্বপ্নের পুরুষকে।আগে স্বপের ছিলেন,এখন বাস্তবের।দাঁড়িতে যে কাউকে এত্ত মায়া লাগতে পারে, আরহামকে দেখার আগে তা জানাই ছিলো না আদওয়ার!

উনি উনার কথা চলতি রেখে বললেন, একটা কথা ইনফর্ম করে রাখি।আপনার আগের লাইফ কেমন ছিলো আমি জানি না,জানতে চাইও না।আগের সব ভুলের জন্য মন থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবেন।কিন্তু এখনকার লাইফ পুরোপুরি সুন্নাহে ভরপুর হতে হবে,ইসলামিক হতে হবে।প্রতি ছোট বিষয়গুলোও মেনে নিতে হবে,মানিয়ে নিতে হবে।আপনি ভুল করলে আমি বুঝিয়ে দিব,শিখিয়ে দিব।কিন্তু তারপরও ইচ্ছানুযায়ী কোনো হারামে থাকা যাবে না।আমি বলছি না যে,পুরোপুরি আল্লাহর প্রতিটা বিধান,হারাম-হালাল মানা সম্ভব।মানুষ মাএই ভুল,ভুল সবারই হয়।কিন্তু ভুল যেনো ভুল করেই হয়,ইচ্ছে করে এমন কিছু করবেন না যাতে গুনাহ লিখা হয়।ভুলের মাএা কমিয়ে আনতে হবে।কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্টিভ থাকা যাবে না,ভার্চুয়ালি শপিং করবেন।খুব বেশী প্রয়োজন হলে বাইরে নিয়ে যাব।আমার সাথে যাবেন,আমার সামনেই প্রয়োজন সারবেন,আমার সাথেই ফিরবেন।তবুও আমি চাই না এই ফিতনার যুগে আমার ব্যক্তিগত ফুলগুলোকে কেউ দেখুক।এই বিষয়ে আমি খুব জেলাস।

দ্বীন পাল করতে আপনি আমার পরিবারের সবাইকে বন্ধুর মতো পাবেন।কারো কোনো দোষ-এুটিতে লুকিয়ে গিবত না করে,সুন্দর করে তাকে বুঝিয়ে বলবেন।অগোচরে কখনো যেনো কোনো মন্তব্য করতে না শুনি।গিবত আমি সবচাইতে বেশী ঘৃণা করি,আর মিথ্যা।ফোনে কোনো হারাম মেটারিয়াল থাকা যাবে না।আপনার আত্নীয়,আমার পরিবারের নাম্বার ছাড়া কারো নাম্বার রাখার দরকার নেই।সময় কাটাতে হলে,পরিবারের সাথে কাটাবেন।আপনার বাসায় বেড়াত যাবেন,দ্বীনি শিক্ষা নিবেন,ইসলামিক বই পড়বেন।কিন্তু ইসলামিক বিষয় জানতে হলেও ফোন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।কারণ এর দ্বারা যেকোনো ভাবে গুনাহ হয়ই।কোনো ছবি,কারোর ছবি ফোনে রাখা যাবে না।কোনো প্রাণী, মানুষের ছবি তুলা যাবে না।কারো প্রতি কোনো অভিযোগ থাকলে মোটেই কষ্ট দিয়ে কথা বলবেন না।নিজেদের মধ্যে সুন্দরমতো মিটিয়ে নিবেন।আর লাস্ট একটা কথা,আমি সবাইকে সমান রকমের পছন্দ করি।তিনজনেরই প্রশংসা করা,তিনজনকেই সময় দেয়া আমার জন্য বৈধ।সো,এই বিষয়গুলো নিয়ে কখনো জেলাস ফিল করবেন না।বোনের মতো থাকবেন।ওকে?’

‘আচ্ছা।’

আরহাম লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে থামলেন।বললেন, ‘আমারও যদি ভুল হয়,ধরিয়ে দিবেন।দায়িত্বে যদি হেরফের হয়,শাস্তি দিবেন।’

এ প্রস্তাব যেনো আদওয়ার ভীষণ পছন্দ হলো।উৎফুল্ল হয়ে বলল,’ওকে শাস্তি দিব।’

আরহাম সরু চোখে তাকালে আদওয়া ভাবুক হয়ে বলে,’স্ত্রীকে ভালোবাসাও তো দায়িত্ব।তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘ভালোবাসা কম হলে দায়িত্বে এুটি হয়।আর দায়িত্বে এুটি হলে শাস্তি পেতে হয়!তাই না?’

আরহাম চুপ রইলেন।নিজের চালে নিজেই যেনো ফেঁসে গেলেন।এখন সে প্রতি সেকেন্ডর ভালোবাসার পরিমাণ গুণে গুণে রাখবে!